রাসূল (সা)-এর সামাজিক ও মানবীয় চরিত্র

অধ্যাপক মফিজুর রহমান

عَنْ عاَئِشة قالتْ قالَ رَسوْلُ الله (ص) لِخَديْجَةََ واَخْبَرَهاَ الْخَبَرَ لقََدْ خَسِيتُ على نَفسِىْ فَقالَتْ خَديجةَ كلاَّ واللهِ ما يُخزِِيْكَ الله اَبَدََ ১ اِنَّكَ لتَصِلُ الرَّحِمَ ২. و تُحْمِلُ الكَلَّ ৩. و تَكسِبُ المعْدومَ ৪. و تقْرِى الضَّيْفَ ৫. و تُعينُ على نَوَائبِ الحَقّ.ِ
অনুবাদ
হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুহাম্মদ (সা) তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রাহ) কে হেরা পাহাড়ে ঘটে যাওয়া অহি ও জিবরাইল-সংক্রান্ত সব কথা বলেন ও ভয়ার্ত চিত্তে বললেন, “আমি আমার জীবন সম্পর্কে আশঙ্কা করছি।” খাদিজা সান্তনা দিয়ে বলেন, “আল্লাহর শপথ! তা কখনও হতে পারে না, তিনি আপনাকে অপদস্থ করবেন না। ১. আপনি আত্মীয়াতার বন্ধন সংরক্ষণ করেন, ২. আপনি দুস্থ মানুষের বোঝা হালকা করেন, ৩. নিঃস্বদের আহার করান, ৪. অতিথিদের সেবা করেন, ৫. সত্যের পথে নির্যাতিতদের সাহায্য করেন।” (বুখারি)

হাদিসের শানেনজুল
আমরা জানি যে, নবীদেরকে আল্লাহতায়ালা জন্ম থেকে নবী করে পয়দা করেছেন। তবে নবুওয়ত ঘোষণা করার সময়টি আল্লাহ তাদেরকে অহির মাধ্যমে জানিয়ে দেন। এর পূর্বে তাদের নবুওয়তপ্রাপ্ত অবস্থায় থাকে। খোদ নবীরও কিছুই জানা থাকে না। তবে হ্যাঁ নবুওয়তের আগে সকল নবীর জীবন থাকে পবিত্র ও মাহফুজ। আল্লাহ তায়ালা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। মুহাম্মদ (সা) ছিলেন জন্ম থেকে সকল বিষয়ে ব্যতিক্রম। তার বাল্যকাল, কৈশোর ও যৌবনকাল কেটেছে আরব জাহেলিয়াতের মধ্যে। শরাব, নারী ধর্ষণ ও খুন-খারাবি এবং অসংখ্য মূর্তির পরিবেশে জন্ম নিলেন, পালিত হলেন কিন্তু আশ্চর্য! পাপাচার ও বর্বতার সামান্যতম কণাও তার পূত-পবিত্র চরিত্রকে স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারেনি। সমস্ত আরব জগতে শিশুকাল থেকে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘আল-আমিন’ ও আস্সাদেক হিসেবে। তিনি পরম সত্যবাদী ও আমানতদার। মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ। তিনি ছিলেন সর্বদা মানবতার মুক্তির চিন্তায় ধ্যানস্থ ও চিন্তিত ও নিঃসঙ্গপ্রিয়।

قال علِىُّ كانَ رسول لله (ص) مُتَوَاصِلَ الاَحْزانِ – دائمَ الفِكْر- لسْتُ لهُ راحةُُ (ترمذى)
হযরত আলী (রা) বলেন, নবীজি (সা) যেন সর্বদা নিমজ্জিত ছিলেন ব্যথার সমুদ্রে, ছিলেন চিন্তার মহাজগতে এবং সদা অস্থির অবস্থায়।” (তিরমিজি)
৪০ বছর বয়সে তার এ নিঃসঙ্গতা অস্থিরতা অসহ্য অবস্থায় পৌঁছে। তিনি অহি নাজিলের সময় থেকে তিন বছর পূর্ব হতে প্রতি রমজান মাস ব্যক্তিগত ইবাদাত ও ধ্যানে কাটাতেন মক্কার অদূরে জাবালে নুরের চূড়ায় এবং গুহায়। সেখান থেকে সোজা কাবা দেখা যেতো, তিনি থাকতেন কাবামুখী হয়ে। সে সময়ের আমল সম্পর্কে যতটুকু সিরাতকারেরা বলেছেন, নির্বাক হয়ে দেখতেন অপলক নয়নে-মহাকাশের নীলাকাশ, রাতের তারার মিতালি, পূর্ণিমায় উদ্ভাসিত চাঁদের হাসি। মৌনভাবে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের পাহাড়, মরুর বালুসমুদ্রে খাঁ খাঁ ঊর্মিমালা, দেখতেন মরু পাহাড়ের পাখ পাখালি ও বিচিত্র প্রাণিকুল।

اِنَّ فىْ خَلْقِ الثمواتِ و الارضِ واخْتلافِ اللَّيلِ والنَّهارِ لايَتِ لِّاولى الْبابِ
“আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের পরিবর্তনে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন লুক্কায়িত এ মহাকাশ, বিশ্ব চরাচর, পাহাড় মরু ও জীববৈচিত্র্য ছিল তাঁর অধ্যায়ের এক এক মহাকাব্য, আর এর মধ্যে ছড়িয়ে থাকা রহস্য যেন বিচিত্র অধ্যায়ের সূচিপত্র।”

প্রকৃতি যেন তাঁর পাঠশালা, বিশাল Universe Zvi Varsitz, তিনি তাঁর পাঠক ও গবেষক, তাঁর চিন্তার অন্যতম বিষয় মানবসমাজ ও বিপর্যস্ত মানবতা, তার চারদিকে নেশায় বুদ হয়ে থাকা নর-নারী, বিবস্ত্র নারী-পুরুষের কাবা প্রদক্ষিণ-তাওয়াফ করা, শত শত বিচিত্র রঙের ও আকার আকৃতির দেবদেবী যাদের সামনে সিজদায় লুটিয়ে থাকা সৃষ্টির সেরা মানুষ, অপ্রয়োজনে ও বিনা কারণে বছরের পর বছর রক্তের প্রতিশোধ ও যুদ্ধের হুঙ্কার, মানুষের জানমালের ওপর শক্তিশালীদের জুলুমের তান্ডব, নারীদের ওপর চলছিল নেশাখোরদের বলাৎকার ও মেয়েশিশুদেরকে জীবন্ত কবরে মাটিচাপা দেয়ার ভয়াল দৃশ্য দেখা মুহাম্মদের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেও এ জাহেলিয়াতের প্লাবন থামাতে না পেরে মুহাম্মদ (সা) চিন্তায় নিমগ্ন হলেন হেরাগুহায়, চেয়ে থাকতেন কাবার রহস্যময় কালো ঘরটির দিকে যা সভ্যতার প্রথম সূতিকাগার। তিনি যেন অপেক্ষায় আছেন কাবার মালিকের হেদায়াতের প্রত্যাশায়। কুরআন বলছে,
َ أَلَمْ نَشْرَحْ لَكَ صَدْرَكَ – وَوَضَعْنَا عَنكَ وِزْرَكَ – الَّذِي أَنقَضَ ظَهْرَك
“আমি তোমার বক্ষকে কি নবুওয়তের জন্য প্রশস্ত করিনি? আমি তোমার থেকে সে চিন্তার বোঝা অপসারণই করেছি যা তোমার পাঁজর ভেঙে দিচ্ছিল।” (সূরা ইনশিরাহ : ১-৩)

এমনি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ৪০ বছর পূর্ণ হলে ২৭ রমজান রাতে আল্লাহর অহি নিয়ে আবির্ভূত হলেন জিবরাইল (আ), আকাশ পৃথিবীজুড়ে তার বিশাল অবয়ব, যে দৃশ্য মুহাম্মদকে ভয়ে ও বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দিল। তিনি এত নিকটে এলেন, যা কুরআনের ভাষায়;
ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى – فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى – فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى
“অতঃপর জিবরাইল তার নিকটে অতি নিকটে এলো। তাদের মধ্যে দুই ধনুকবাতারও কম দূরত্ব এলো, তখন সে মুহাম্মদের ওপর অহি পৌঁছালো যা পৌঁছার কথা ছিল।” (সূরা নজম : ৮-১০)

নবীজির ওপর সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাজিল হলো। রাসূল (সা) অহি নাজিলের ভয়াল বিস্ময়ে কম্পিত দেহে অস্থির মনে হেরাগুহা ত্যাগ করে ঘরে গিয়ে খাদিজাকে বলেন,لَقَدْ خَشِيْتُ عَلئ نِفْسِي زَمِّلُونِي زَمِّلُونِي فَزَمِّلُوهُ
“আমাকে কম্বল জড়িয়ে দাও, কম্বল জড়িয়ে দাও, আমার জীবনের বিষয়ে আমি ভয় করছি।” (বুখারি)
তাকে কম্বল জড়িয়ে দিয়ে হযরত খাদিজা (রা) ১৫ বছরের জীবনে রাসূলের একান্ত সান্নিধ্যে থেকে তাকে কিরূপ দেখেছেন, সান্তনা দিতে গিয়ে সে প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন যা এরপর আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

হাদিসের উৎস
সমগ্র দুনিয়ার হাদিসবেত্তাদের উসতাদ মুহাম্মদ বিন ইসমাইলের অমর গ্রন্থ, সহিহুল বুখারিতে এ হাদিস উক্ত হয়েছে। হাদিস মরফু, মুত্তাসিল সনদ সকল বর্ণনাকারী সেকাহ্ ১৬ বছর পরিশ্রম করে ছয় লাখ হাদিস হতে বাছাই করে ৭২৭৫টি হাদিস বুখারিতে গ্রহণ করেছেন (বুদরুদ্দিন আইনি) সমস্ত দুনিয়ার মুহাদ্দিসদের ইজমা হলো, আল্লাহর কিতাবের পর আকাশের নিচে সর্বাধিক সহিহ্ গ্রন্থ ‘সহিহুল বুখারি।’ (ফাতেহুল বারি ও উমদাতুল কারি) ইমাম নাসাঈ, বলেন, ‘হাদিসের সমস্ত কিতাবের মধ্যে বুখারি শরিফের চেয়ে উত্তম আর কোন কিতাব নেই।’ (মুকাদ্দমা মুসলিম)

তিনি হাদিস বাছাইয়ের কঠিন কাজটি করেছেন বায়তুল্লাহ শরিফে বসে আর বাছাইকৃত হাদিস দিয়ে অধ্যায় রচনা করেছেন মসজিদে নববীর রিয়াজুল জান্নাতে বসে। ইমাম বুখারির শিরোনাম রচনার মধ্যে রয়েছে তার অসাধারণ জ্ঞান প্রজ্ঞা, চাতুর্য ও গভির পান্ডিত্য, যা এখনও পর্যন্ত মুহাদ্দিসদের হতবাক করে দেয়। তাই বলা হয় ‘ফিকহুল বুখারি ফি তারা জিমিহি’ বুখারির অসাধারণ পান্ডিত্য তার কিতাবের শিরোনামের মধ্যে লুকিয়ে আছে।

সাহিবুল হাদিস
প্রথম বর্ণনাকারী হিসেবে রয়েছেন উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা (রা), যিনি হযরত আবু বকর (রা)-এর কন্যা। তিনি বেশি সুন্দরী ছিলেন বলে তাকে হোমায়রা বলতেন নবীজি (সা)। খাদিজার ইন্তেকালের পর নবীজি (সা) এর সাথে আয়েশার বিয়ে নিষ্পন্ন হয়। তখন আয়েশা মাত্র ছয় বছরের বয়স্কা, ৫০০ দিরহাম মহর নির্ধারিত হয়। হযরত আবু বকর বিয়ের খুতবা ও আকদ্ দেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে হযরত আবু বকর খুতবায় বলেন, আপনারা জানেন রাসূলুল্লাহ আমাদের নবী। তিনি আমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ প্রদর্শন করেছেন। এক সময় ছোট মেয়েদের নিয়ে আমরা অনেক কুসংস্কার গড়ে তুলেছি। মেয়েদের আমরা জীবিত পুঁতে ফেলেছি হাত-পা বেঁধে দেবীর পায়ে বলি দিয়েছি। আজ আমার প্রিয় কন্যাকে রাসূলের হাতে তুলে দিয়ে যাবতীয় কুসংস্কার মুছে ফেলতে চাই। রাসূলের সাথে আমার বন্ধুত্বকে অটুট রাখতে চাই। আমার প্রিয় কন্যা রাসূলের সাথে সাথে তাঁর আদর্শ ও বাণী প্রচার করবে।” সবাই মারহাবা বলে স্বাগত জানালো। হিযরতের সাত মাস পরে মদিনায় রাসূলের গৃহে আসেন। নবীজি ইন্তেকালের সময় আয়েশার বয়স হয়েছিল ১৮ বছর এবং ওফাতের পর ৪৮ বছর জীবিত ছিলেন। হাদিস বর্ণনাকারীদের মধ্যে আয়েশার স্থান উচ্চে। তিনি রাসূল থেকে ২২১০টি হাদিস বর্ণনা করেন। ৫৮ হিজরি ১৭ রমজান ৬৭ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর অসিয়ত অনুসারে জান্নাতুল বাকির কবরস্থানে রাতে তাঁকে দাফন করা হয়। তাফসির, হাদিস সাহিত্য ও নসবনামায় তার পা-িত্য অসাধারণ। তিনি ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী। তাঁর চরিত্রের ওপর আল্লাহর আয়াত নাজিল হয়েছে। ইমাম যুহরী বলেন, ‘উম্মতের জ্ঞানসমুদ্র যত বড় আয়েশার জ্ঞানসাগর তার চেয়ে বড়।”

হাদিসের ব্যাখ্যা
কথাগুলো মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে হযরত খাদিজার উক্তি। তিনি নবীজি (সা) এর সবচেয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী। সকল উম্মতের মধ্যে প্রথম ঈমান আনয়নকারী, জগতের শ্রেষ্ঠতম চারজন রমণীর অন্যতম। যিনি তার সকল ধনসম্পদের পাহাড় রাসূলের কদমে হাজির করে দেন। রাসূলের সব ছেলেমেয়ে তাঁর গর্ভে জন্মলাভ করেন। তিনি ২৫ বছর উম্মুল মোমেনিন হিসেবে নবীজির সান্নিধ্য লাভে ধন্যা হন। অহি লাভের পর রাসূল (সা) এর অস্থিরতায় তিনি সান্তনা দেন ও বলেন, كلاّ واللهِ ما يُخزِيك الله اَبَدََ (ও)َ
“আল্লাহর শপথ তিনি আপনাকে কখন অপমান ও অপদস্থ করবেন না”।

একজন স্ত্রীর মন্তব্য স্বামীর ব্যাপারে খুবই প্রণিধানযোগ্য। কারণ সুখে-দুঃখে, দিনে-রাতে সকালে-বিকেলে, রাগ-বিরাগ সর্বাবস্থায় নিবিড়ভাবে স্বামীকে দেখার সুযোগ তিনিই লাভ করেন। আর যদি স্ত্রীও হন অতীব বিচক্ষণ, সচেতন ও জ্ঞান ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন তবে তো কথাই নেই। যে মুহাম্মদকে গোটা আরব জনপদ পূর্বেই আল আমিন বলে ঘোষণা দিয়েছে। নবুওয়ত-পূর্ব জীবনে বর্বতার মধ্যে সভ্য, অশ্লীতার মধ্যে পরিচ্ছন্ন, পুঁতিগন্ধময়ের মধ্যে সৌরভ, অন্ধকারের মধ্যে আলো হিসেবে দেখছেন। তারপরও সবার প্রশংসার চেয়ে খাদিজার উক্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নবীজি (সা) বলেন, “তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর বিবেচনায় উত্তম।” তিনি আরও বলেছেন, আমার স্ত্রীদের বিবেচনায় আমি উত্তম। নবীজি (সা) এর সাথে খাদিজার দাম্পত্য জীবনের ১৫টি বছর তখন চলছিল। জীবনীকারেরা আরও দেখেছেন এ দীর্ঘ সময়ের কোনদিন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন বিষয়ে উচ্চবাচ্য হয়নি, মান অভিমান পর্যন্ত হয়নি। সম্ভ্রান্ত, ধনবতী ও গুণবতী এই রমণী নবীজির জীবনে কিভাবে ছায়া হয়েছিলেন, খাদ্যসামগ্রী নিয়ে হেরার চূড়ায়ও উঠেছেন যা আজও যেন বিস্ময়! পৃথিবীর জীবনে আমরা এমন প্রায়ই দেখি একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক, সেনাপতি, দার্শনিক ও জ্ঞানী কিন্তু পারিবারিক জীবনে সফল নহেন। সেখানে দ্বন্দ্ব, কলহ অবিশ্বাস, খোনাখুনি পর্যন্ত হচ্ছে আর বিচ্ছেদ তো চলছে অগণনভাবে। সেখানে মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে আল্লাহর শপথ করে তার জীবনের পবিত্রতা ও সৌন্দর্যের ওপর আল্লাহর অনিবার্য সাহায্যের ব্যাপারে খাদিজার কথাগুলো কুরআনের বাণীরই প্রতিধ্বনি করছে। কিছুদিন অহি বন্ধ থাকায় নবীজি (সা) হৃদয়ে যে অস্থিরতা ও আশঙ্কা দেখা দিল, আল্লাহ সান্তনা দিয়ে বলেন,
وَالضُّحَى – وَاللَّيْلِ إِذَا سَجَى- مَا وَدَّعَكَ رَبُّكَ وَمَا قَلَى- وَلَلآخِرَةُ خَيْرٌ لَكَ مِنْ الأُولَى .
“শপথ মধ্যাহ্নের আর নিশিথ রাতের। হে মুহাম্মদ (সা) তোমার প্রভু তোমাকে ত্যাগ করেননি, তোমার প্রতি বিরাগ ভাজনও হননি। নিশ্চয়ই বর্তমানের চেয়ে ভবিষ্যৎ তোমার অনেক উত্তম।” (সূরা দোহা : ১-১৪)
انك لتَصِلُ الرَّحِمَ
“নিশ্চয়ই আপনি আত্মীয়দের সাথে মধুর সম্পর্ক ও সম্প্রীতি বজায় রাখেন।”

নবুওয়তের ঘোষণা দেয়ার পর যে বিষয় তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং কুরআন পরবর্তীতে যে আত্মীয়তার বিষয়ে আয়াত নাজিল করেছে রাসূলের জীবনে সে সকল চারিত্রিক মাধুর্য পূর্বেই বিকশিত হওয়ার ব্যবস্থা আল্লাহতায়ালা করেছেন। নবীজি (সা) রক্তের আত্মীয়দের ব্যাপারে সর্বদা যত্নশীল ছিলেন। এক আবু লাহাব ছাড়া অন্য চাচারা ঈমান না আনলেও নবীজির সাথে অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক রাখতেন। আবু তালেব যদিও ঈমান আনেননি কিন্তু নবীজির জন্য সর্বস্ব দিয়ে সাহায্য করেছেন। যেখানে ইবরাহিম (আ)-এর পিতা আজর ইবরাহিমকে ঘরছাড়া করেছেন নমরুদের সাথে সহযোগিতায় আগুনের কু-লীতে নিক্ষেপ করার ব্যবস্থায় নিয়োজিত সেখানে রাসূলের চাচা আবু তালেব কাবাঘরের দায়িত্ব ত্যাগ করেছেন মুহাম্মদকে ত্যাগ করেননি। তিন বছর শে’বে আবু তালিবকে বন্দী অবস্থায় গাছের পাতা খেয়ে অনাহারে ছিলেন। বিনিদ্র রজনী মুহাম্মদকে পাহারাদারি করেছেন এর দৃষ্টান্ত দ্বিতীয়টি পাওয়া কঠিন। নিশিথ রাতে মিনার উপত্যকায় মদিনাবাসীর সাথে আকাবার বায়াত অনুষ্ঠিত হচ্ছিল সে সময় খঞ্জর হাতে রাসূলের পাহারাদারিতে দ-ায়মান। সে ব্যক্তিটি রাসূলের চাচা হামজার ছোটভাই আব্বাস তখনও ছিলেন মুশরিকদের মধ্যে। আবার চাচা আবু তালিবের আর্থিক কষ্ট লাঘব করতে চাচাতো ভাই আলীর দায়িত্বে ছোট থেকেই রাসূল গ্রহণ করেছেন। নবুওয়তের দায়িত্ব পালনের পরও আত্মীয়তার বিষয়ে অনেক হাদিস উল্লেখ করেছেন আর নির্দেশ অবতীর্ণ হয়েছে কুরআনুল কারিমে,
وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَتَسَاءَلُونَ بِهِ وَالأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيباً.
“তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যার নামে তোমরা অধিকার দাবি কর আর সতর্ক থাক আত্মীয়তার অধিকার ও সম্পর্কের বিষয়ে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখেন।” (সূরা নিসা : ০১)
رَّحِمْ قاطِعُ الجنَّةَ يدْخُلُ لا قال رسول لله (ص)
“সাবধান রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়তা ছিন্নকারীরা জান্নাতে যাবে না।” (বুখারি)
اللَّهَ قطعهُ قَطعنىْ وَمَنْ اللَّهَ وصلهُ وصلنِىْ مَنْ فقولُ بالْعرسِ مُعلَّقةُ الرَّحِمُ عَنْ عاَئشة قالتْ فَقال رسول لله
“আত্মীয়তার সম্পর্ক তথা ‘রেহেমকে’ আল্লাহ আরশের সাথে লটকিয়ে রেখেছেন যে তা ঠিক রাখবে সে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখবে, যে বিচ্ছিন্ন করবে সে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন বিনষ্ট করবে।” (বুখারি)

আজকের সমাজে ভাইয়ে ভাইয়ে, পিতা-পুত্রে, চাচা-জেঠাদের সাথে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক নেই বরং নিকট-আত্মীয়রা যেন অন্যদের চেয়েও বেশি শত্রু। সামান্য কারণে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই রয়েছে। তা চলছে বছরের পর বছর ধরে। আজ রক্তের সে অবহেলিত দাবি পূরণ করা সুস্থ সমাজের জন্য জরুরি।
و تَحْمِلُ الْكَلَّ
“নিশ্চয় আপনি দুর্বলদের বোঝা বহন করেন।”
হযরত খাদিজা (রা) বলেন, ‘আপনাকে দেখেছি সারাজীবন দুর্বল ও বঞ্চিতদের বোঝা বহন করতে। সমাজের বেশির ভাগ মানুষ দুর্বল ও অবহেলিতদের মধ্যে এরা ন্যূনতম মৌলিক অধিকার ভোগ করতে পারে না। এরাই সমাজের মূল স্রোত। এরা সবসময় স্বল্পসংখ্যক সুবিধাভোগীর হাতে নিপীড়িত। মুহাম্মদ (সা) এদের অন্তর্ভুক্ত। সোনার চামচ মুখে নিয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেননি। তিনি তো স্বল্প অর্থের বিনিময়ে দীর্ঘদিন পর্যন্ত মক্কাবাসীর বকরি চরিয়েছেন। ইমাম বুখারী এমন একটি হাদিসও গ্রহণ করেছেন। আল্লাহতায়ালা এমন কোন নবী পাঠাননি যিনি রাখাল ছিলেন না। আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি বেশির ভাগ নবী শ্রমজিবী। রাসূল (সা) সমগ্র জীবন ইয়াতিম ও বেওয়ারিশ ও মিসকিনদের জন্য জীবনপাত করেছেন। তিনি এতটুকু বলেছেন আমার উম্মতের বেশির ভাগ মানুষ গোলাম, শ্রমজীবী ও ইয়াতিম হবেন। তাদের বোঝা হালকা করার জন্য নিয়োজিতরা জান্নাতি।

قال قال رسول اللهِ (ص) لا يدخل الجنَّةِ سيعئ الملكةِ قالو يا رسول اللهِ اليس اخبَرْتنا هذهِ الاُمَّة اكْثرُ الامَمِ ممْلوْكينَ و يتامى؟ قال نعمْ- فاكرمُوْا هُمْ لَكَرمَةِ اَوْلاَدُكُم وَ اطْعِمُهُمْ مِمَّا تأكُلون
নবীজি (সা) বলেন, জালেম মালিকেরা জাহান্নামি, লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাদেরকে বলেননি, এ উম্মতের বেশির ভাগ মানুষ হবে গোলাম ও ইয়াতিম? তিনি বলেন, হ্যাঁ, তোমরা সন্তানের মতো তাদেরকে স্নেহ করবে আর তোমরা যা খাবে তাদেরকে তাই খেতে দেবে।” (ইবনে মাজাহ)

আজকের সমাজে কী দেখি? মানুষ কিভাবে জালেমদের অত্যাচারে নির্বাক ও নিথর, মজলুমেরা আদালতের কাঠগড়ায় ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়ে অশ্রুবিসর্জন করছেন।
(রা) و تَكسِبُ المعْدوم
হযরত খাদিজা বলেন, ‘আপনি তো নিঃস্বদের আহারের ব্যবস্থা করেন, আপনি নিরন্ন মানুষের মুখে খাবার তুলে দেন, আপনি বিবস্ত্রদের কাপড় দেন, আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই আপনার কল্যাণ করবেন।

এ দরিদ্র, নিঃস্ব বুভুক্ষুরা আল্লাহর পরিবারের সদস্য। একটি হাদিসে এমন রয়েছে। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলবেন কিয়ামতে “হে বনি আদম! আমি ক্ষুধার্ত হয়ে তোমার নিকট গিয়েছিলাম তোমরা আমাকে খাবার দাওনি, লোকেরা বলবে তুমিতো আহার কর না, কিভাবে তোমায় করাবে? আল্লাহ বলবেন সে ক্ষুধার্তকে খাবার দান করা হলে আমাকে খাদ্য দেয়া হতো।” সোবহানাল্লাহ্। (মুসলিম)
عنْ بْنِ عبَّاسِ قال سمِعْتُ رسولُ اللهِ يقول ليسَ المومنُ الَّذى يَشْبَعُ و جاَرُهُ جاععُ اِلى جنْبِه
ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, আমি রাসূলের জবানে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “তারা মুমিন নয় যারা প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্ত রেখে আহার করে।” (মিশকাত)

মুহাম্মদ (সা) প্রতিবেশীদের খবর নিতে, আসহাবে সুফফার লোকদের আহারের ব্যবস্থা না করে খাবার মুখে দেননি।
বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ দু’বেলা আহার করতে পারছে না, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে লাখ লাখ মানুষ। আমাদেরকে তাদের মুখে অন্ন ও পরিধানের বস্ত্র ও আর্তের চিকিৎসার জন্য লড়াই করতে হবে। রাসূল (সা) জীবনে কী ছিল? আমরা কোথায়, কোন ইবাদাতের মধ্যে জান্নাত খুঁজছি। আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে মানবতার সেবায়।
و تقرى الضيفُ
তিনি আরও বলেন, ‘আপনি অতিথির সেবা করেন।’

কাবা শরীফ মক্কায় অবস্থিত বিধায় হাজার হাজার বছর থেকে কাবাকেন্দ্রিক বিভিন্ন এলাকা ও জনপদ থেকে তীর্থযাত্রীরা ভিড় জমাতো। কোরাইশ পৌত্তলিকেরা বিদেশীদের জীবন সম্পদ লুণ্ঠনের উৎসব করত বিশেষ করে হজ মৌসুমে। যদিও জাতিগতভাবে আরবিরা অতিথিপরায়ণ কিন্তু অসৎদের আর মূল্যবোধের বালাই থাকে না।

মুহাম্মদ (সা) বাল্যকাল হতে অসহায় বিদেশী ও অতিথিদের সহায় সম্পদ লুণ্ঠনের দৃশ্য দেখে আসছিলেন। পরে হিলফুল ফুজুল সংগঠন সৃষ্টির উদ্দেশ্যও ছিল সমাজে শান্তিপ্রতিষ্ঠা, বিদেশীদের নিরাপত্তা প্রদান। চার বছর ধরে ফিজ্জার যুদ্ধ হয়েছিল আরব গোত্রদের মধ্যে। রাসূল (সা) এর বয়স তখন চৌদ্দ। পরের বছর রাসূল তার প্রিয় চাচা যুবায়ের বিন আবদুল মোত্তালিব আবদুল্লাহ বিন জুমআনের ঘরে বনি হাশিম ও বনি যুইবার বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে এক সভা বসে। গঠিত হয় পাঁচ দফার ওপর প্রতিজ্ঞা।

১. দেশ থেকে অশান্তি দূর করব ২. বিদেশী মেহমানদের জানমাল রক্ষা করব ৩. গরিব-দুঃখীকে সাহায্য করব ৪. দুর্বলদেরকে জালেমদের হাত থেকে প্রতিরক্ষা করব, ৫. আমরা বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনে চেষ্টা করব। এ পবিত্র প্রতিজ্ঞাবাণীর নাম ছিল ‘হিলফুল ফুজুল’। নবুওয়তের পর একদিন রাসূল (সা) বলেন, ‘আবদুল্লাহ বিন জুমআনের ঘরে যে প্রতিজ্ঞায় অংশ নিয়েছিলাম, আমাকে রক্তিম বর্ণের উট দান করলেও আমি সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করব না। আজও যদি কেউ আমাকে অত্যাচারিত হয়ে আহ্বান করে বলে হে ফজুল প্রতিজ্ঞার সদস্যগণ আমাকে সাহায্য কর তবে আমি সে ডাকে সাড়া দেবো। ইসলাম ন্যায়প্রতিষ্ঠা ও মজলুমদের সাহায্য করার জন্য এসেছে।

قال قال رسول اللهِ (ص) مَنْ كانَ يومِنُ باِاللهِ و اليَومِ الاخِرِ فليُكْرِمْ ضيْفَةُُ ( بُخارى)
“কেউ যদি আল্লাহ ও পরকালের ওপর ঈামন আনে সে যেন অতিথির সেবা করে।” (বুখারি)
আজকের বিশ্বে বিদেশী ও অতিথিদের কোনো সম্ভ্রম সংরক্ষিত আছে কি? সময় যেন দাবি করছে যুবকদের আবার ‘হিলফুল ফুজুলের’ প্রতিজ্ঞা করে অত্যাচার ও নিপীড়নমুক্ত সমাজ গঠনের শপথ করা। দুর্ভাগ্য আমাদের মুক্ত চেতনার নামে যুবক ও তরুণদেরকে কিভাবে কায়েমি স্বার্থবাদীরা নিজেদের লুণ্ঠনকে বহাল রাখা ও শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার জন্য নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করছে।

و تُعينُ على نَوَائبِ الحَقّ “সত্যের পথে নির্যাতিতদের আপনি সাহায্য করেন।”
খাদিজার এ উক্তিটিও তাৎপর্যপূর্ণ। হকের পথে, ন্যায়ের পথে যারা যে যুগেই চলতে চেয়েছে নিষ্ঠুর সমাজ তাদের চলার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে, তাদেরকে জুলুম-নিপীড়ন নির্যাতনের বিষাক্ত কাঁটা মাড়িয়ে চলতে হয়েছে। কারাগারের নির্যাতন, সেল ও ফাঁসির রজ্জু তাদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে যেন। এটি একটি কঠিন বিষয় যা মেনে নিতে মন চায় না। সত্যপথের পথিকদের জন্য জীবনকে কঠিন হতে কঠিনতর করা হয়েছে পরীক্ষার পর পরীক্ষার নির্মমতা লাজেম করা হয়েছে।

وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنْ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنْ الأَمْوَالِ وَالأَنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرْ الصَّابِرِينَ – الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ
“আমি তোমাদেরকে (মুমিনদের) ভয়ভীতি, ক্ষুধা, ধনসম্পদ, জীবন ও ফসলের ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব, তুমি ধৈর্যশীলদেরকে সুভসংবাদ দাও, যারা যেকোনো বিপদ-মুসিবতে বলে আমরা আল্লাহর কাছ হতে এসেছি এবং তারই নিকট ফিরে যাব।” (সূরা বাকারা : ১৫৫)

আর আল্লাহ তায়ালা জালেমদের শুধু অবকাশ দেন ও ঢিল দিতে থাকেন। তবে তা অনাদিকালের জন্য নহে, একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হলে রশি টান দেন।
اللَّهُ يَسْتَهْزِئُ بِهِمْ وَيَمُدُّهُمْ فِي طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُونَ
“আল্লাহ তাদের সাথে উপহাস করে পাপাচারে ঢিল দেন আর তারা অন্ধ হয়ে ছুটে চলে।” (সূরা বাকারা : ১৫)
সত্যের জন্য ন্যায়ের পথে চলতে গিয়ে যারা নির্যাতিত হয়েছেন নবুওয়তের আগে ও পরে মুহাম্মদ (সা) ছিলেন তাদের আশ্রয়ে। তিনি তাদের সান্তনা, আর নবীজি (সা) ছিলেন সকলের প্রিয়জন। হেদায়াতের দাওয়াত তাকে করেছে সবচেয়ে মজলুম। নবুওয়তের প্রথম দিন খাদিজা (রা) মুহাম্মদ (সা)-কে ওরাকার কাছে নিয়ে গেলে তিনি বলেন, ‘তোমার নিকট জিবরাইল এসেছে যিনি নবীদের নিকট আসেন। মূসা (আ)-এর নিকটও এসেছিলেন। আহা! আমি যদি বেঁচে থাকি তোমাকে যেদিন মক্কা হতে বের করে দেয়া হবে সেদিন আমি তোমার সাহায্যে পাশে দাঁড়াবো। নবীজি জিজ্ঞাসা করেন আমাকে কেন বের করবে? ওরাকা বলেন,
رجُل قطُّ بمثْلِ ما جِئتُ الَّا عُودِىَ بهياتِ لمْ যারা তোমার পূর্বে অহি বহন করেছিলেন সত্যের দাওয়াত দিয়েছিলেন জাতি তাদের সকলের সাথে শত্রুতা করেছে। (বুখারি)

হাদিসের শিক্ষা
মুহাম্মদ (সা)-এর সামাজিক ও মানবীয় চরিত্র যা খাদিজা (রা) বর্ণনা করেছেন সেগুলোই শিক্ষা যা উম্মতের জন্য গ্রহণীয়।
১. সে উত্তম ব্যক্তি যে তার স্ত্রীর বিবেচনায় উত্তম, খাদিজা কসম করে বলেন মুহাম্মদের চেয়ে উত্তম মানব ত্রিভুবনে নেই।
২. সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত মজলুমদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে।
৩. দরিদ্র্য সীমার নিচে রয়েছে কোটি কোটি বনি আদম, এরা মানবতার মূল স্রোতধারা, চেষ্টা করে যেতে হবে নিরন্নদের মুখে অন্ন তুলে দিতে তা-ই সর্বোচ্চ বন্দেগি ও ইবাদত বুঝতে হবে।
৪. অতিথি দেশী, বিদেশী, পরিচিত-অপরিচিত সকলের প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়াতে হবে-এটা মানবতার শিক্ষা।
৫. সমগ্র পৃথিবীর প্রতিটি জনপদে দ্বীনের দায়ীরা মজলুম। তাদের রক্ত বয়ে চলছে পিচঢালা কালো পথে, কারার অন্ধ প্রকোষ্ঠে তাদের ওপর চলছে রিমান্ডের নামে লোমহর্ষক জুলুমের ইতিকথা, ফাঁসির রজ্জু তাদের গলদেশে ‘যারা বলছেন আল্লাহ ছাড়া কারো আইন মানব না।’ তাদের সাহায্য করার জন্য যা আছে সব নিয়ে নামতে হবে।

উপসংহার
কোন আদর্শকে পৃথিবীর মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করা একটি সহজ বিষয় নয়। এ অসাধ্যকে সাধন করতে হলে দু’টি বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো গতিশীল নেতৃত্ব আর দ্বিতীয়টি হলো কর্মীদের গুণাবলি। যেকোনো আদর্শের নেতাকর্মীদের নৈতিক কিছু অপরিহার্য গুণাবলির সাথে প্রয়োজন সামাজিক চরিত্র। এ Social Charactar এতই গুরুত্বপূর্ণ যে তা ছাড়া ঐ আদর্শকে মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য করা কঠিন। আদর্শ কতটুকু মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ ও সঠিক এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আদর্শকে প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত কর্মীদের গুণাবলি ও যোগ্যতা। বিশ্বব্যাপী ইসলামী পুনর্জাগরণের সূচনা আজ মানবতার জন্য একটি শুভসংবাদ হলেও কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠিত ফেরাউনি শক্তি কখনও তাকে মেনে নেবে না। ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে চলমান ভূ-রাজনৈতিক আস্থা ও ইসলামের শত্রুদের কর্মকৌশল ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকলে বিপ্লব যে শুধু বিজয় বন্দরে নোঙর করতে পারবে না তা নয়, লাখ লাখ কর্মীর জানমাল বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। ইসলামকে বিজয়ী করার সিদ্ধান্ত যারা নিয়েছে তাদের মধ্যে নৈতিক যে গুণাবলি প্রয়োজন তা হলো,
১. ইসলামের সঠিক জ্ঞান যার উৎস আল্লাহর কিতাব ও হাদিসে রাসূল।
২. চরিত্র হবে নিষ্কলুষ ফরজ, ওয়াজিব পালন ও কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।
৩. ইসলামকে জীবন উদ্দেশ্য বানাতে হবে-জীবন ও মরণ ইসলামের জন্য নিবেদন করা।
৪. সর্বোচ্চ কোরাবানির জন্য প্রস্তুত থাকা- শাহাদাতে তামান্না সৃষ্টি করা।
৫. আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক-তাহাজ্জদ গুজার হওয়া।
আমি উল্লিখিত গুণাবলিকে নৈতিক বিবেচনা করে বলতে চাই এর মাধ্যমে আল্লাহর বান্দা জান্নাতে হয়তো যাবে কিন্তু বিপ্লব বিজয় করার জন্য তা যথেষ্ট হবে না। আরও কিছু সামাজিক চরিত্র প্রয়োজন হবে- যা করার জন্য মুহাম্মদী আখলাক বর্ণনা করতে গিয়ে খাদিজা বর্ণনা করেছেন।
১. মানবতার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা
২. দুস্থ ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকা।
৩. মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা।
৪. আত্মীয় ও প্রতিবেশীর সেবায় সর্বদা ব্যস্ত থাকা
৫. সত্যের পথে নির্যাতিতদের জন্য সর্বস্ব কোরবানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। বিপ্লবের কর্মীদেরকে নৈতিক ও সামাজিক গুণাবলির সমন্বয় সাধন করা আজ সময়ের অপরিহার্য দাবি। এরপর আমি শত্রুদের কৌশল সম্পর্কে সাবধান করতে চাই :
এক. মুসলিম যুবকদের চরিত্র ধ্বংস করতে তারা বদ্ধপরিকর। এ ব্যাপারে তারা তিনটি হাতিয়ার প্রয়োগ করছে এক, নারীদেরকে ব্যবহার করা নৈতিকভাবে দেউলিয়া করতে হলে এর আক্রমণ অব্যর্থ। এ জন্য আকাশ সংস্কৃতির অবাধ প্রবাহ যা প্রযুক্তির বদৌলতে প্রত্যেকের মোবাইলে ঢুকে পড়েছে। এই ভয়াল ছোবল থেকে কিছুই রেহাই পাবে না।
দুই, নেশাকে সহজলভ্য করে, নেশায় আসক্ত করা, আমাদের ছাত্রদের প্রায় ৩০ লাখের ওপর আসক্তদের সংখ্যা পৌঁছে গেছে। সত্যিকথা বলতে কী এর চেয়ে ভয়াবহ আর কিছু নেই। তিন, আমাদের যুবকদের হৃদয়ে তারা অর্থবিত্ত, আরাম-আয়েশ, গাড়ি, বাড়ির স্বপ্ন এঁকে দিয়েছে, মুছে দিয়েছে শাহাদাতের তামান্না। অথচ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, আল্লাহর শপথ, আমার হৃদয় হাহাকার করছে। আমি জিহাদ করি শহীদ হই, আবার জীবিত হই আবার শহীদ হই। (বুখারি)
২. ‘সন্ত্রাস’-কে তারা মুসলিম দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে, আমাদের যুবকদের হাতে এর গোলাবারুদ তুলে দেবে আর কেড়ে নেবে-আল কুরআন।
৩. মিডিয়ার মাধ্যমে অপপ্রচার। এর ক্ষমতা পরমাণুর চেয়েও বেশি। শত্রুরা দিনকে রাত, সাদাকে কালো, মুসলমানদেরকে তাদের হক জিহাদকে জঙ্গিবাদ বলে প্রচার করছে ও আর্থিকভাবে সফল হয়েছে। আফসোস, মুসলমান রাষ্ট্রনায়কদ ও তথ্যমন্ত্রীদের বক্তব্য ও মিথ্যাচার শুনলে মনে হয় শত্রু আজ দূরে নয়, তাদের অমবহঃ-রা শত্রুদের চেয়েও সার্থক ও ভয়ানক শত্রু এ মিল্লাতের জন্য। এত ষড়যন্ত্র ও প্রতিরোধের পরও আশ্চর্য যে
১. ইসলামের অগ্রযাত্রা কোনো বাধা ও প্রতিবন্ধকতা মানছে না। খোদ ইউরোপ, আমেরিকায়ও ইসলাম আজ এক অদম্য শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
২. এত রক্ত, শাহাদাত ও ফাঁসির আতঙ্ক খুন গুমকে পা দিয়ে মাড়িয়ে যুবকেরা সংগঠিত হচ্ছে বিপ্লব বিজয়ের উন্মাদনায়। এদের রক্তে আগুন ধরেছে, কার সাধ্য এ অনল নেভাবে। তাদের প্রতি আমার সবিনয়ে পরামর্শ :

এক, তোমাদেরকে কৌশলী হতে হবে। রাসূল (সা) বলেছেন, ‘যুদ্ধ হচ্ছে শত্রুকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানোর নাম।” চ্যালেঞ্জ নয়। তাদেরকে ঘুমন্ত রেখে অতি সন্তর্পণে লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।
দুই, সার্বক্ষণিক দায়ী হওয়া। এ দাওয়াতই ইসলামকে পৌঁছে দেবে সর্বত্র। তা শত্রুর হৃদয়েও অনুভূতি জাগাবে।
তিন, দাঁড়ানো, বসা ও চলন্ত অবস্থায় কুরআন পড়া-এর মধ্যে পৃথিবীকে বশীভূত করার জাদু আছে।
চার, আরাম নয়, বিলাস নয়, কঠোর সংগ্রামী জীবনকে বরণ করে নিতে হবে।
পাঁচ, দল নয়, জাতি নয়, মানবতাবাদী হও। মানুষের প্রতি মমত্ববোধ ইসলামের মূলমন্ত্র হতে হবে।
প্রভু! আমাদের যুবকদের যোগ্যতা দিয়ে দয়া কর। আমিন।