ব্যবসার মূলনীতি : ইসলাম কী বলে

ইসলাম যেহেতু পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা, তাই অন্য সকল বিষয়ের মতো ব্যবসার ক্ষেত্রেও ইসলামে নির্ধারিত ও সুনির্দিষ্ট মূলনীতি রয়েছে। কেননা, আল্লাহর সৃষ্টি মানুষ কোনো ক্ষেত্রেই বল্গাহীন স্বাধীনতা পেতে পারে না। ব্যবসার ক্ষেত্রে ইসলামে মৌলিকভাবে দু’টি মূলনীতি রয়েছে—

এক. ব্যবসায়িক পণ্য, উপাদান ও কায়কারবারগুলো বৈধ হতে হবে। কেননা, অবৈধ পণ্যের ব্যবসা ও অবৈধ কায়কারবারকে ইসলাম বৈধতা দেয় না। যেমন, মদ, জুয়া, সুদ, ঘুষ ইত্যাদির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হওয়া ইসলামে অনুমোদন নেই। কারণ, এসব বিষয়কে ইসলামে মৌলিকভাবেই হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।

দুই. ব্যবসা-বাণিজ্য সকল অবস্থায় বৈধ পন্থায় হতে হবে। অর্থাৎ সেখানে কোনো ধরনের ধোঁকাবাজি, ভেজাল ও ফাঁক-ফোকর থাকতে পারবে না। কোনো ধরনের মিথ্যার আশ্রয় থাকতে পারবে না।

ব্যবসায় কারো ক্ষতি করা যাবে না : অর্থাৎ ব্যবসার মাধ্যমে মানুষের উপকার করার মানসিকতা থাকতে হবে। কারো ক্ষতি যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন— নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং অন্যের ক্ষতি করা কোনোটিই উচিত নয়। [বুখারি]

কারণ হলো, যখন ব্যবসায়ী ও গ্রাহক উভয় পক্ষ অনুভব করবে আমরা উপকৃত হয়েছি তখন সেখানে একটি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হবে। ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ হবে। যা একটি সুগঠিত সমাজের জন্য অত্যন্ত অপরিহার্য।

ধোঁকা ও প্রতারণা করা যাবে না : এ ধরনের অপকর্ম ইসলামে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত। মন্দ জিনিস ভালো বলে চালিয়ে দেওয়া, ভালোর সঙ্গে মন্দের মিশ্রণ ঘটিয়ে ধোঁকা দেওয়া সম্পূর্ণ হারাম। আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত— একদিন রাসূল (সা.) বাজারে গিয়ে একজন খাদ্য বিক্রেতার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, তিনি খাদ্যের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দেখলেন ভিতরের খাদ্যগুলো ভেজা বা নিম্নমানের। তিনি বললেন— এটা কী? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল, এতে বৃষ্টি পড়েছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি সেটাকে খাবারের উপরে রাখলে না কেন; যাতে লোকেরা দেখতে পেত? যে ধোঁকা দেয় সে আমার উম্মত নয়। [মুসলিম]

মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া যাবে না : মিথ্যা এমনিতেই একটি নিন্দনীয় অপরাধ। ব্যবসার ক্ষেত্রে তা আরও মারাত্মক ও ক্ষতিকর। আল্লাহ তাআলা বলেন— তোমরা সত্যের সঙ্গে অসত্যের মিশ্রণ ঘটাবে না। জেনেশুনে সত্য গোপন করো না। [সূরা বাকারা, আয়াত ৪২]

তা ছাড়া একজন মুমিনের মধ্যে মিথ্যা ও খিয়ানতের দোষ কোনোক্রমেই শরীয়ত মেনে নেয় না । রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো— একজন মুমিন দুর্বল হওয়া কি স্বাভাবিক? তিনি বললেন, হ্যাঁ, হতে পারে। আবারও জিজ্ঞাসা করা হলো, মুমিন কি কৃপণ হতে পারে? বললেন, হ্যাঁ। তারপর জিজ্ঞাসা করা হলো, একজন মুমিন মিথ্যুক হতে পারে? বললেন, না । [তিরমিজি]

রাসূল (সা.) বলেছেন— চারটি গুণ যখন তোমার মধ্যে থাকবে, তখন দুনিয়ার সব খুঁয়ে গেলেও তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমানত সংরক্ষণ, কথায় সততা, উত্তম চরিত্র, হালাল খাদ্য। [মুসনাদে আহমাদ]

ওজনে নিজ স্বার্থরক্ষায় কমবেশি করা যাবে না : অন্যকে দেওয়ার সময় ওজনে কম দেওয়া আর নেওয়ার সময় বেশি করে নেওয়া জঘন্য অপরাধ। আল্লাহ তাআলা বলেন— ধ্বংস যারা পরিমাপে কম দেয় তাদের জন্য। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে। আর যখন তাদেরকে মেপে দেয় অথবা ওজন করে দেয় তখন কম দেয়। [সূরা মুতাফফিফীন, আয়াত ১-৩]

ওজনে কম দেয়ার কারণে শুআইব (আ.) -এর জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে আসমানি গজবে । কোরআনে তার বিস্তারিত বর্ণা এসেছে ।

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন— যখন কোনো সম্প্রদায়ের লোকেরা ওজনে বা মাপে কম দেয়, তখন শাস্তিস্বরূপ তাদের খাদ্য-শস্য উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং দুর্ভিক্ষ তাদের গ্রাস করে। [আবু দাউদ]

পণ্য বিক্রির জন্য মিথ্যা শপথ করা যাবে না : মিথ্যা বলে বা মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। রাসূল (সা.) বলেছেন— কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তিন ব্যক্তির সাথে কোনো ধরনের কথা বলবেন না, তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন যে তার ব্যবসায়িক পণ্যকে মিথ্যা কসম খেয়ে বিক্রি করে। [মুসলিম]

অপর একটি হাদীসে এ দৃষ্টান্ত এভাবে তুলে ধরা হয়েছে— এক ব্যক্তি আসরের পর তার পণ্য সম্পর্কে কসম খেয়ে বলে, তাকে পণ্যটি এত এত মূল্যে দেওয়া হয়েছে। তার কথা ক্রেতা বিশ্বাস করল, অথচ সে মিথ্যুক। [মুসলিম ও বুখারি]

ব্যবসার সাথে সুদকে মেশানো যাবে না : সুদ একটি মারাত্মক অপরাধ। সুদ থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। ব্যবসার নামে কোনো প্রকার সুদ শরীয়ত সমর্থন করে না। সুদের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন— যারা সুদ খায় তারা কিয়ামতের দিন দণ্ডায়মান হবে শয়তানের আসরে মোহাবিষ্টদের মতো। কারণ, তারা বলে ক্রয়-বিক্রয় (ব্যবসা) ওতো সুদের মতো, অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন । [সূরা বাকারা, আয়াত ২৭৫]

হাদিসে এসেছে, জাবের ইবন আব্দুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন— আল্লাহর রাসূল (সা.) সুদ গ্রহণকারী, প্রদানকারী, হিসাবকারী এবং সাক্ষী সকলের প্রতি অভিশাপ দিয়েছেন এবং তিনি বলেন তারা সকলেই সমান। [মুসলিম]

অনুমান ভিত্তিক ব্যবসা করা হতে বিরত থাকা : এ জাতীয় ব্যবসাকে বলে মুজাবানা । অর্থাৎ বৃক্ষস্থিত ফলকে বৃক্ষ হতে আহরিত ফলের বিনিময়ে অনুমান করে বিক্রি করা বিভিন্ন ধরণের মুযাবানা বর্তমানেও প্রচলিত আছে। ক্ষেতে অকীর্তিত খাদ্য শস্য যথা গম, বুট ইত্যাদিকে শুকনা পরিষ্কার করা খাদ্য যথা, গম, বুট ইত্যাদির বিনিময়ে অনুমান করে বিক্রি করাকে মুহাকালা বলে। সুদের আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসুল (সা.) এগুলোকেও সুদের অন্তর্ভুক্ত করে দেন। [মুসলিম]

অপরের মাল হনন করার চেষ্টা করা যাবে না : ব্যবসার জটিল মারপ্যাঁচে অন্যের মাল হরণ করা হারাম। আল্লাহ তাআলা বলেন— হে ঈমানদারগণ তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। [সূরা নিসা, আয়াত ২৯]

হাদীসে এসেছে একটি ব্যবসায়িক লেনদেনে উভয় পক্ষই খুঁতসহ পণ্যেও সঠিক বর্ণনা দিতে হবে। ইসলামের বিজনেস কন্ডাক্ট সম্পর্কে জাবির (রা.) এভাবে বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন— আল্লাহ তার প্রতি দয়া বর্ষণ করুক যে বিক্রির সময়, ক্রয়ের সময় এবং অভিযোগের সময় সদয় থাকে। [বুখারি]

ব্যবসারা ক্ষেত্রে এগুলিও হলো সামগ্রিক মূলনীতি । আল্লাহা তায়ালা আমাদের সবাইকে সুন্দর ও সঠিক পন্থায় ব্যবসা করা তৌফিক দান করুন ।

[তথ্যসূত্র : ১. অর্থনীতিতে রাসুল (সা.)-এর দশদফা, শাহ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, ২. ব্যবসা-বাণিজ্য : করণীয় বর্জণীয়, জাকের উল্লাহ আবুল খায়ের]