হাসান তুরাবির ভাবনায় ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা

জোবায়ের আল মাহমুদ

এডিটর’স নোট:
সুদানের ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ড. হাসান তুরাবির এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ব্রিটিশ স্কলার ও সাংবাদিক জিয়াউদ্দীন সরদার। ব্রিটিশ টেলিভিশন চ্যানেল ফোর-এর সিরিজ প্রোগ্রাম ‘ইসলামিক কনভারসেশনস’-এ ২০১২ সালে এটি প্রচারিত হয়। এই সাক্ষাৎকারে ‘সলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে ড. তুরাবি তাঁর আন্ডারস্ট্যান্ডিং খোলামেলাভাবে তুলে ধরেছেন। ইসলামী রাষ্ট্র কী? কীভাবে এটি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? নাগরিক জীবনে এর প্রভাব কী? ইসলামী রাষ্ট্রে ভিন্ন মতাদর্শের অবস্থান কী হবে? – এ ধরনের সমকালীন যুগজিজ্ঞাসার জবাব এতে পাওয়া যাবে।পাঠকদের জন্যে অনুবাদ করেছেন জোবায়ের আল মাহমুদ।

জিয়াউদ্দীন সরদার: ইসলামী রাষ্ট্র মানে কী?

হাসান তুরাবি: মুসলিম রাষ্ট্র মানে মুসলিম আধিপত্যশীল রাষ্ট্র। তবে ইসলামী রাষ্ট্র মানে – যে রাষ্ট্রে ইসলামী নীতি-আদর্শকে কেবল ব্যক্তিজীবনে নয়, বরং প্রকাশ্য জনপরিমণ্ডলে চর্চা করা হয়।

জিয়াউদ্দীন সরদার: এ কথার মানে কী?

হাসান তুরাবি: এর মানে হচ্ছে – যেখানে রাজনীতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ সবকিছুই হবে ইসলাম দ্বারা অনুপ্রাণিত। যেহেতু ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা।

জিয়াউদ্দীন সরদার: তারমানে আপনি কি মোল্লা শাসিত কোনো রাষ্ট্রের কথা বলতে চাচ্ছেন?

হাসান তুরাবি: না। খ্রিষ্টানদের বেলায় রাষ্ট্র পরিচালিত হতো তাদের ধর্মীয় যাজকদের মাধ্যমে। কারণ খ্রিষ্টান যাজকরা মনে করত, স্রষ্টা রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন না। ফলে তারা নিজেদেরকে স্রষ্টার খাস প্রতিনিধি মনে করত এবং সবসময় গণমানুষের জীবনে হস্তক্ষেপ করত। যদিও খ্রিষ্টান ধর্মের সাথে রাজনীতির তেমন বিদ্বেষ ছিল না, বিদ্বেষ ছিল ধর্মীয় যাজকদের সাথে বিপ্লবীদের। এর বিপরীতে, ইসলামে কোনো মোল্লাতন্ত্র নেই। এখানে প্রত্যেক মানুষ সরাসরি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। সুতরাং মোল্লারা নয়, বরং ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা করবে বিশ্বাসী মানুষেরা।

জিয়াউদ্দীন সরদার: এই সিদ্ধান্ত কে দেবে? মোল্লারা?

হাসান তুরাবি: না। মুসলিমরাই ইসলামী রাষ্ট্রের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে। মোল্লারা হলেন আধুনিক সেক্যুলার রাষ্ট্রে আইনজীবীদের মতো কিংবা অর্থনীতি বিষয়ক পরামর্শদাতাদের মতো। তারা কেবল তাদের মতামত, ফতোয়া বা পরামর্শ দিতে পারেন। সমাজই নির্ধারণ করবে – কার মতামত গ্রহণ করা হবে এবং কারটা গ্রহণ করা হবে না।

জিয়াউদ্দীন সরদার: আপনার মডেলটা কি ইরান কিংবা কোনো মোল্লা শাসিত রাষ্ট্রের চেয়ে আলাদা?

হাসান তুরাবি: আপনি জানেন, ইরানী শিয়ারা বিশেষ একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠী। সেখানে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানগুলো খুবই ক্ষমতাশীল। বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে বিজ্ঞ আলেমরা থাকেন, তারা রাষ্ট্রকে পরামর্শ দেন। রাষ্ট্র চাইলে যে কোনো একজন স্কলারের মত গ্রহণ করতে পারে এবং অন্য স্কলারের মত বর্জন করতে পারে।

ইসলামী রাষ্ট্র ও জাতিরাষ্ট্র

জিয়াউদ্দীন সরদার: আচ্ছা, জাতিরাষ্ট্রের সাথে কি ইসলামের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির কোনো বিরোধ আছে?

হাসান তুরাবি: এটা নির্ভর করছে জাতিরাষ্ট্র বলতে আপনি কী বোঝাচ্ছেন, তার ওপর। জাতিরাষ্ট্র বলতে আপনি যদি অন্ধভাবে একটা ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ থাকতে চান, অন্যদের প্রবেশাধিকার বা সমঅধিকার না দেন, আপনার সীমানার বাইরে যেসব জাতি আছে তাদেরকে এলিয়েন বা শত্রু মনে করেন, কিংবা অন্যায়ভাবে আপনার জাতিকে সমর্থন করেন – তাহলে ইসলাম অবশ্যই এমন জাতিরাষ্ট্র ধারণার বিরুদ্ধে। আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি না। তবে এটা শুধু এ জন্যে নয় যে, আমরা মুসলিম; বরং আফ্রিকান হওয়াটাও এর অন্যতম কারণ। আফ্রিকায় আমাদের প্রতিবেশীদের সাথে জাতীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা নেই বললেই চলে।

ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মসহ সকল ধর্মই প্রতিবেশীর সাথে চমৎকার ও ঘনিষ্ট সম্পর্ক রাখার কথা বলে। তাই আমাদের আশপাশের সব প্রতিবেশীকে নিয়ে আমরা আঞ্চলিক ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করবো। যদি শক্তিশালী ইউরোপীয় দেশগুলো একটা কমিউনিটি হিসাবে কাছাকাছি আসতে পারে, তাহলে দরিদ্র দেশ হিসাবে আফ্রিকানদের মধ্যে একটা আঞ্চলিক সংস্থা ও কমিউনিটি গড়ে তোলা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় আরো বেশি প্রয়োজন।

আমাদের দেশে যে কেউ আসতে চাইলে তাকে স্বাগতম। এক্ষেত্রে তারা মুসলিম নাকি অমুসলিম – তা বিবেচনা করা হবে না। তারা ইচ্ছা করলে এখানে থাকতে পারবে, নাগরিক হতে পারবে এবং পূর্ণ অধিকার লাভ করবে। আমাদের মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এসব সীমানা সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো মোটেও চূড়ান্ত কোনো বাধা নয়।

জিয়াউদ্দীন সরদার: অন্যান্য মুসলিম দেশের যারা আপনাকে অনুসরণ করতে চায়, তাদের জন্যে আপনার বক্তব্য কী?

হাসান তুরাবি: আসলে ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিকভাবে সুদান একটা দুর্বল দেশ। তৎসত্বে সুদান ইসলামী নীতি-আদর্শকে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সামাজিক মূল্যবোধের সাথে সরকারের সমন্বয় করার চেষ্টা করছে। আমি মনে করি, সকল মুসলমানেরই এভাবেই কাজ করা উচিত।

মুসলিম দেশগুলোতে আমরা কখনোই একটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবো না, যদি আমরা প্রকৃত অর্থেই একটি ইসলামি সরকারব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারি। আমরা কখনোই একটি ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবো না, যদি সকল মুসলমান ধর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের উন্নয়নের জন্যে কাজ না করে। শুধু উন্নয়ন নয়, বরং টেকসই উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠাও করতে হবে। এ সকল কাজ করতে হবে ইসলাম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে।

প্রত্যেক মুসলিম দেশের প্রতি আমার পরামর্শ হলো, জনগণের বিরুদ্ধে না গিয়ে শান্তিপূর্ণ ও ধৈর্যের সাথে প্রত্যেকটা কাজ বাস্তবায়ন করতে হবে। ইসলাম এমনটাই বলেছে। জনগণের ওপর স্বৈরতন্ত্র বা আমদানী করা কোনো ব্যবস্থা জোর করে চাপিয়ে দেয়া যাবে না।

নাগরিক স্বাধীনতা

জিয়াউদ্দীন সরদার: আপনার ইসলামী রাষ্ট্রে নাগরিকরা কেমন স্বাধীনতা ভোগ করবে? বিশেষ করে সেক্যুলার জীবনযাপনের ক্ষেত্রে?

হাসান তুরাবি: আমি মনে করি, জীবনের এমন কোনো অংশ নেই যা ধর্মের বাইরে। মানুষ যদি স্রষ্টায় বিশ্বাসী হয় – হোক সে মুসলিম কিংবা খ্রিষ্টান – তাহলে তাকে বিশ্বাস করতে হবে যে, স্রষ্টা সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান। স্রষ্টার ক্ষমতা কেবল গির্জা বা মসজিদে সীমাবদ্ধ নয়। সুতরাং আপনি যদি স্রষ্টাকে বিশ্বাস করতে না চান, তাহলে আপনি সম্পূর্ণ স্বাধীন। এতে স্রষ্টার কোনো ক্ষতি নেই।

ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয়, ধর্ম হলো সামগ্রিক জীবনব্যবস্থার নাম – হোক সেটা ইহুদী বা খ্রিষ্টান ধর্ম। স্রষ্টা আপনার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। আপনি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা বলুন কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতার কথা বলুন – সবকিছুই স্রষ্টাপ্রদত্ত দিকনির্দেশনার আওতাভুক্ত। ক্ষমতা পেয়েছেন বলে আপনি স্বৈরাচারী হয়ে যাবেন, এটা ইসলামের শিক্ষা নয়। জনগণকে ভালোভাবে পরিচালনা করা ইসলামে ইবাদাততুল্য কাজ। আমাদের জীবনের সবকিছু স্রষ্টার কাছে নিবেদন করতে হয়। এটা আসলে ইহুদী ও খ্রিষ্টান ধর্মেরও শিক্ষা। ইসলাম কখনো বলে না যে, এটা কেবল মোহাম্মদ (সা) এর বার্তা। ইসলাম বলে এটা ইব্রাহিম (আ), মুসা (আ), ঈসা (আ) এবং মোহাম্মদ (সা) সহ সকল নবী-রাসূলের বার্তা।

ইসলামী রাষ্ট্র কি সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা?

জিয়াউদ্দীন সরদার: আপনি কি সবকিছু রাষ্ট্রের অধীনে কেন্দ্রীভূত করার পক্ষে?

হাসান তুরাবি: কখনো না। রাষ্ট্রের চেয়ে সমাজ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এটা কোনো সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্র নয়। অধিকাংশ ধর্মীয় মূল্যবোধই আইনের অধীন নয়। পুলিশ বা বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে এসব মূল্যবোধ সৃষ্টি করা যায় না। আসলে ভালো একটি সমাজে রাষ্ট্র বা সরকার খুব সামান্যই এদিক-সেদিক করতে পারে।

জিয়াউদ্দীন সরদার: ইসলামী রাষ্ট্রের যে মডেল আপনি দিয়েছেন, সেখানে গণতন্ত্রের স্থান কোথায়?

হাসান তুরাবি: পশ্চিমা গণতন্ত্রের চেয়েও এ রাষ্ট্র অনেক বেশি গণতান্ত্রিক…।

জিয়াউদ্দীন সরদার: মুক্তবাজার?

হাসান তুরাবি: এখানে মুক্তবাজার অর্থনীতি থাকবে, তবে পশ্চিমা বাজার থেকে অনেক বেশি সাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা সমাজতন্ত্রের মতো শোনালেও রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ থাকবে খুবই সামান্য। আসলে সমাজ যত স্বনির্ভর হয় রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ তত কমে যায়।

জিয়াউদ্দীন সরদার: আপনার সরকারের সাথে অন্য যে কোনো রক্ষণশীল সরকারের পার্থক্য কোথায়?

হাসান তুরাবি: রক্ষণশীল গোষ্ঠী আসলে তাদের প্রথাগত ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করে। অথচ ইসলাম একটি যুগোপযোগী ধর্ম। এখানে স্থান-কালের প্রথাগত কোনো কাঠামোয় আবদ্ধ হবার সুযোগ নেই। এখন আমরা হয়তো ঐতিহ্যের ভিত্তিতে ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করি, কিন্তু ইসলাম আমাদের জীবনকে প্রতিনিয়ত নবায়ন করার শিক্ষা দেয়। যেসব ঐতিহ্যগত প্রথা ইসলামী মূল্যবোধের বিপরীত, মুসলিমরা তা থেকে দূরে থাকে। ইসলামের মূল্যবোধগুলো সবসময় একই থাকবে, কিন্তু আমাদের বিভিন্ন প্রথা ও কাজের পদ্ধতি যুগের পরিবর্তনে পরিবর্তিত হবে। আমরা রক্ষণশীল নই; বরং অন্যদের চেয়ে বেশি উদার।

জিয়াউদ্দীন সরদার: তাহলে বর্তমান সময়ের ইসলামী রাষ্ট্রগুলো কেনো এত কর্তৃত্ব ও সর্বাত্মকবাদী?

হাসান তুরাবি: এরা কেউ আসলে ইসলামিক নয়। তারা বরং সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করছে। যখন কেউ এই ধরনের সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতার ভিত্তিতে শাসন করে, তখন সে পুরোপুরি সর্বাত্মকবাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। এমনকি জাতীয়তাবাদী সরকারও একনায়কতন্ত্র এবং স্বৈরাচারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আসলে তারা কেউই ইসলাম অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করছে না। কেননা, ইসলাম মানে হলো – যে কেউই ক্ষমতায় যাক না কেনো, সে আসলে চূড়ান্ত ক্ষমতার মালিক নয়। ফলে সে আল্লাহর কাছে সমস্ত ক্ষমতা সমর্পণ করে। সুতরাং যদি কেউ ক্ষমতায় গিয়ে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে, তাহলে সেটা মূলত ইসলামী শাসন নয়।

জিয়াউদ্দীন সরদার: আপনার ইসলামী রাষ্ট্র কি একদলীয় রাষ্ট্র হবে?

হাসান তুরাবি: দেখুন, পশ্চিমা সমাজেও নানা ধরনের দল থাকার তেমন কোনো গুরুত্ব এখন আর নেই। একসময় তাদের দেশে পুঁজিবাদীরা এক ধরনের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইত, আবার সমাজতন্ত্রীরা অন্য ধরনের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইত। কিন্তু এখন ইংল্যান্ড বা ‌আমেরিকায় সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী কোনো দল নেই। মোটাদাগে দুটি গ্রুপ কেবল ক্ষমতা নিয়ে প্রতিযোগিতা করছে। গণতন্ত্র মানে কেবল দল গঠন নয়…।

জিয়াউদ্দীন সরদার: আপনি কি বিভিন্ন মতাদর্শের দলকে আপনার রাষ্ট্রে অনুমোদন দিবেন? যেমন- মার্কসিস্ট, কমিউনিস্ট কিংবা ক্যাপিটালিস্ট?

হাসান তুরাবি: আমি মনে করি, রাজনৈতিক দল দ্বারা সমাজের কোনো উন্নয়ন হয় না। বিভিন্নজন বিভিন্ন মতাবলম্বী হতে পারে, কিন্তু কেউ কোনো পক্ষপাত করতে পারবে না। যেমন থাইল্যান্ডে আপনি এ ধরনের কোনো রাজনৈতিক দল পাবেন না।

অমুসলিমদের অধিকার

জিয়াউদ্দীন সরদার: আপনার ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অবস্থা কী হবে?

হাসান তুরাবি: ইসলামে এটা কোনো জটিল ব্যাপার নয়। প্রতিষ্ঠার প্রথমদিন থেকেই ইসলাম সবাইকে নিয়ে ভিন্ন ধরনের এক পদ্ধতি চালু করেছে। স্বয়ং রাসূল (স)-ই মুসলিম এবং ইহুদীদের নিয়ে মদিনা রাষ্ট্র গঠন করেছেন এবং সবাইকে নিয়ে সংবিধান রচনা করেছেন। সেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। এমনকি প্রত্যেক ধর্মীয় গোষ্ঠীর স্ব স্ব বিচার ব্যবস্থারও স্বীকৃতি ছিল।

জিয়াউদ্দীন সরদার: আপনার ইসলামী রাষ্ট্রে কি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলোর অধিকার সংরক্ষিত থাকবে?

হাসান তুরাবি: অবশ্যই, এটা আমি গ্যারান্টি দিতে পারি; যেহেতু আমি মুসলিম। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো – ইউরোপ আজ সেক্যুলার হয়েছে বটে; তবে তারা কখনো মুসলিমদের অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সে আপনি শুক্রবারে কোনো ছুটি পাবেন না; কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরা রবিবারে এবং মুসলিমরা শুক্রবারে ছুটি পাবে। এমনকি জার্মান, ইংল্যান্ড বা আমেরিকায় আপনি আপনার ব্যক্তিগত আইনেরও কোনো স্বীকৃতি পাবেন না। সেখানে ব্যক্তিগত আইন খ্রিষ্টান ঐতিহ্যের আলোকে গঠিত। কার্যত মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় ব্যক্তিগত আইন মানতে বাধ্য হয়।

আমাদের রাষ্ট্রে এমনটা হবে না। এখানে অমুসলিমরা তাদের ব্যক্তিগত আইন চর্চা করতে পারবে। কেননা, ব্যক্তিগত আইন হচ্ছে ব্যক্তিজীবনেরই একটি অংশ; সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের উপায়। যেমন, মানুষের বিশ্বাস বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ব্যক্তিগত আইনের অধীন। সুদানে যে কেউ যে কোনো ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাস বা আচার-অনুষ্ঠান গ্রহণ করতে পারবে; হোক সে পৌত্তলিক বা অন্য কোনো ধর্মের অনুসারী। এমন স্বাধীনতা আপনি পশ্চিমা বিশ্বেও পাবেন না। ফ্রান্সে যদি কোনো তরুণী হিজাব পরতে চায়, আপনি নিশ্চয় জানেন তার কী অবস্থা হবে…! তারা বলবে – হিজাব আমাদের সংস্কৃতি বিরোধী, তাই এটা পরতে দেয়া যাবে না। অথচ সুদানে একজন অমুসলিমকে পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়া হয়।

জিয়াউদ্দীন সরদার: কোনো অমুসলিম কি আপনার রাষ্ট্রে ক্ষমতায় আসতে পারবে?

হাসান তুরাবি: যে কোনো সরকারী অফিসে অমুসলিমরা কাজ করতে পারে – এতে ইসলামের কোনো বাধা নেই। যেহেতু কোনো দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে; সেহেতু মুসলিমরা তাদের জন্যে একজন মুসলিম প্রতিনিধি নির্বাচন করবে – এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার।

ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন মডেল হতে পারে কি?

জিয়াউদ্দীন সরদার: আপনার ইসলামী রাষ্ট্র কি ‘একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র’, নাকি অন্যতম ‘একটি ইসলামী রাষ্ট্র’?

হাসান তুরাবি: আমি মনে করি, এটি ‘একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র’ নয়। ভবিষ্যতে যে কোনো দেশ হয়তো আমাদের সাথে যুক্ত হয়ে একটি বড় ইসলামী রাষ্ট্র তৈরি করবে। কেননা সকল মুসলিমই উম্মাহর অংশ। আমি খুব আনন্দিত হবো, যদি ভবিষ্যতে সমগ্র উম্মাহ একত্রিত হয় এবং তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়াদি পরস্পরের সাথে বিনিময় করে। আসলে আমি এমন একটি সময়ের অপেক্ষা করছি – যখন দেশ-কাল, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানবজাতি একে অপরের নিকটবর্তী হয়ে যাবে। আমার চূড়ান্ত ইচ্ছা, একটি বিশ্ব-মানবরাষ্ট্র গঠন করা – যেখানে মুসলিম ও অমুসলিম সবাই সমানভাবে বসবাস করবে, প্রত্যেকে তাদের মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করবে এবং পরস্পর মূল্যবোধ বিনিময় করবে।

জিয়াউদ্দীন সরদার: অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মতো এটা কি একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হবে না?

হাসান তুরাবি: না, কখনোই না। মুসলিম রাষ্ট্র কখনো কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র হতে পারে না। কেননা, মুসলিমদের সকল কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহর কাছে সমর্পণ করতে হয়। এটাই প্রকৃতপক্ষে ইসলামের আক্ষরিক অর্থ। সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্রে কেউ কারো ওপর একতরফাভাবে কর্তৃত্ববাদী হবার সুযোগ নেই।

সুদানে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রেক্ষাপট ও চ্যালেঞ্জসমূহ

জিয়াউদ্দীন সরদার: তাহলে সুদানে কেনো এখন সেনা-স্বৈরতন্ত্র শাসনে চলছে?

হাসান তুরাবি: তারা প্রতিজ্ঞা করেছে যে, এ বছর সম্পূর্ণ সুদানে নির্বাচন দিবে এবং আগামী বছর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে – যেখানে জনগণ স্বাধীন ও স্বচ্ছভাবে ক্ষমতা ও সংসদ নির্বাচন করবে।

জিয়াউদ্দীন সরদার: সুদানকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করা জরুরি হলো কেনো?

হাসান তুরাবি: ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা পেয়েছি। এ দেশে ছয়টা অস্থিতিশীল সরকার শাসন করেছে। কিন্তু দেশের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র, সামরিক একনায়কতন্ত্র – সকল ব্যবস্থাই এখানে প্রয়োগ করা হয়েছে; কেউ দেশের জন্যে কিছু করতে পারেনি। না পেরেছে গৃহযুদ্ধ নিরসন করতে, না পেরেছে গোত্রীয় সমস্যার সমাধান করতে এবং না হয়েছে দেশের উন্নয়ন। কৃষিতে বিশ্বের অন্যতম সম্ভাবনাময় দেশ হয়েও মানুষকে না খেয়ে থাকতে হয়েছে। এর কারণ হলো, আমাদের পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বণ্টন না হওয়া।

এ দেশে কোনো প্রকৃত স্বাধীনতা ছিলো না। গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতা কেবল দুই পরিবারের দুইজন ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত করে রাখা হয়েছিলো। যার ফলে স্বাধীনতার কোনো স্বাদ পাওয়া, সামাজিক শান্তি বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল পাওয়া ছিল অসম্ভব ব্যাপার। পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলো আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। কিন্তু আমরা কিছুই পাইনি। অতএব, ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে – আমাদেরকে আসলে আমাদের প্রকৃত মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যে ফিরে যেতে হবে।

জিয়াউদ্দীন সরদার: ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কীভাবে গৃহযুদ্ধ নিরসন করা সম্ভব?

হাসান তুরাবি: প্রথমত আমরা প্রত্যেকটা প্রদেশ নিয়ে ফেডারেশন পদ্ধতি চালু করব – যা সুদান আগে কখনো পায়নি। এটি ইসলামের প্রাথমিক যুগে স্বয়ং রাসূল (সা) প্রতিষ্ঠা করেছেন – যেখানে ইহুদীদের বিভিন্ন গোত্র তাদের স্বকীয়তা বজায় রেখে চলত, আবার মুসলিমদেরও একাধিক কমিউনিটি ছিল। প্রাথমিকভাবে আমরা এই পদ্ধতিটা অনুসরণ করব। দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশদের মতো আমরা শরীয়াহকে সুদানের জাতীয় আইন বানিয়ে ফেলব না। আপাতত আমরা কেবল দক্ষিণ সুদানে শরীয়াহ প্রয়োগ করব। কারণ দক্ষিণ সুদানে প্রায় প্রায় ৯৮ শতাংশ মুসলমানের বসবাস। যদিও তাদের কেউ কেউ খ্রিষ্টান বা পৌত্তলিকদের চেয়েও বেশি খ্রিষ্টান বা পৌত্তলিক। সেক্ষেত্রে তারা শরীয়াহকে গ্রহণ বা বর্জনের সুযোগ পাবে। এর আগে অন্য কোনো আইনের ক্ষেত্রে সুদান এমন সুযোগ পায়নি; এটি সুদানের জন্যে সম্পূর্ণ নতুন।

নারী অধিকার ও শাস্তি আইন

জিয়াউদ্দীন সরদার: যখনি আমরা শরীয়াহর কথা বলি, তখন দুটি বিষয় চলে আসে – নারী অধিকার ও শাস্তি আইন। শরীয়াহ কি নারীদের নিগৃহীত করে না? অন্যদিকে, শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে শরীয়াহ কি খুব নিষ্ঠুর নয়?

হাসান তুরাবি: ইংল্যান্ড বা আমেরিকায় কি অপরাধের শাস্তি হয় না? আপনি সাধারণভাবে বিবেচনা করলে দেখবেন, সেখানকার আর্মি এবং পুলিশ সার্বক্ষণিক দেশের বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র নিয়ে ঘুরাঘুরি করছে এবং তাদের দ্বারা অনেক মানুষই নিহত হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বের অপরাধের চিত্র বিবেচনা করলে দেখবেন, তারা অপরাধ মোকাবেলায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তাদের দেশে অপরাধ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। পুলিশ ও চোরের হাতে প্রচুর মানুষ নিহত হচ্ছে। এমনকি তারা নিজেরা নিজেদের হত্যা করছে। কিন্তু সুদানে গত ছয় মাসে মাত্র দুটি ঘটনায় চুরির সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে। এই তো গেল একটা দিক।

অন্যদিকে, এ দেশের নারীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে। এটা পশ্চিমা নারী স্বাধীনতার আন্দোলনের ফলে হয়নি; হয়েছে ইসলামী আন্দোলনের ফলে। এ দেশে নারীরা মসজিদে যাবার অধিকার ফিরে পাচ্ছে। আগে তাদের সে অনুমতি ছিল না। এখন নারীরা সামনে আসছে এবং তাদের রাজনৈতিক অধিকার পাচ্ছে। তারা এখন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হতে পারছে, কেউ রাষ্ট্রদূত হচ্ছে, কেউ বিচারক হচ্ছে।

জিয়াউদ্দীন সরদার: তাহলে নারীরা কি পশ্চিমা ফ্যাশনের পোশাক পরে রাতের বেলা রাস্তায় হাঁটতে পারবে?

হাসান তুরাবি: কোনো ধরনের পোশাকের ব্যাপারে আমাদের আইনগত কোনো বাধা নেই। মুসলিমরা ভালো পোশাকের ব্যাপারে নৈতিক পরামর্শ দেয়; কিন্তু আইন চাপিয়ে দেয় না। খ্রিস্টান সিস্টার উপাসনালয়ে যেমন খ্রিষ্টান ধর্মের আদর্শ পোশাক পরে, আমরাও তাদের মতোই একটা পোশাকের কথা বলি। তারপরেও কোনো মুসলিম নারী যদি ঠিকভাবে পোশাক না পরে, আমরা তাকে জোর করতে পারি না। কারণ তার কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। পোশাক এখানে আইনের দ্বারা নির্ধারিত হয় না, হয় নৈতিকতার ভিত্তিতে।

ইসলামী ও সেক্যুলার মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব

জিয়াউদ্দীন সরদার: ভবিষ্যতে ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সেক্যুলার মূল্যবোধের কোনো দ্বন্দ্ব হবে বলে কি আপনি মনে করেন?

হাসান তুরাবি: হ্যাঁ, কিছু পার্থক্য তো থাকবেই। আমি মনে করি, মানবজাতির মধ্যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য থাকা উচিত। গণতন্ত্র মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন মত গ্রহণের স্বাধীনতা দেয়। মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে তার মত প্রকাশ করবে, পরস্পর মত বিনিময় করবে। পশ্চিমারা যেমন তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য ব্যবস্থাকে একমাত্র স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে বাদবাকি বিশ্বের উপর চাপিয়ে দেয়, আমরা তেমনটা করতে পারি না। মানবজাতির জন্যে এটা মোটেও গণতান্ত্রিক কোনো পদ্ধতি নয়। মুসলিম, ইহুদী, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিক নির্বিশেষে সবাইকে তাদের মূল্যবোধ প্রকাশ এবং তাদের মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেয়া উচিত। আমরা যে কারো সাথে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ উপায়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত।