সর্ব প্রথম প্রকাশ্যে কুরআন তেলাওয়াতকারী

মাসউদুর রহমান |

মধ্যাহ্নের কিছু আগে, কোরায়েশ নেতারা রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে চিন্তিত। একে একে তাঁর কর্মকাণ্ডের কারণে সব নেতাদের খাওয়া ঘুম যেন হারিয়ে গেছে। সবাই যখন তাঁকে রোধ করার পরিকল্পনায় ব্যস্ত ঠিক সেই সময় মাকমে ইব্রাহিমের সামনে এসে এক যুবক দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে পড়ছে, “বিসমিল্লাহির রাহ মানির রাহিম। আর রাহমান, আল্লামাল কুরআন, খালাক্বাল ইনসান।”

কি ব্যাপার? কোরায়েশ নেতারা তো কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মত হয়ে গেল। ক্ষনিকের জন্য দারুন-নাদওয়া (যেখানে তারা পরামর্শ করতো) নিরব হয়ে গেল। তারপর একজন প্রশ্ন করলো ইবনু উম্মু আবদ না? তার ধ্বংস হোক। সে তো মুহাম্মদ যা বলে তাই পাঠ করছে। আর দেরি না করে সমস্ত ক্রোধের আগুনের লেলিহান শিখা বুকে নিয়ে আবুজাহল, উতবা, শাইবা, ওয়ালিদ, উমাইয়া প্রমুখ নেতারা ছুটে গেল কাবার সামনে।

বেদম প্রহার শুরু করলো। তিনি সে সময় ও তেলাওয়াত করে চলছেন, মার খেতে খেতে সারা শরীর থেকে রক্ত ঝরতে লাগলো। আর তেলাওয়াত যতটুকু সম্ভব হ্, ততটুকু করতে করতে যন্ত্রণায় ছুটে চললেন সংগীদের নিকট। সঙ্গীরা বললেন, আমরা এই আশংকাই করেছিলাম। জবাবে তিনি বলেছিলেন “আল্লাহর কসম, আমার কাছে আল্লাহর শত্রুরা এখন অতি তুচ্ছ যা আগে ছিল না। আমি আগামীকাল ও যাব।”

হ্যাঁ সেই উম্মে আবদ নামে ডাকা সাহাবী ছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)। তিনিই সাহাবীদের মধ্যে সর্বপ্রথম ভূ-পৃষ্ঠে প্রকাশ্যে কুরআন তেলাওয়াত করার গৌরব অর্জন করেছিলেন।

যেদিন এই ঘটনা ঘটে সেদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কয়েকজন সাহাবী নিয়ে বসেছিলেন, যখন তারা ছিল সংখ্যায় অল্প আর দূর্বল। সাহাবীরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল যে কখনও প্রকাশ্যে কোরায়েশদের সামনে কোরআন তেলাওয়াত করা হয়নি। “কে আছে তাদের মধ্যে যে এমন কাজ করার সাহস রাখে?”

দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)। অন্য সাহাবীরা বলেছিলো, তোমার ব্যাপারে আমাদের ভয় হচ্ছে। আমরা এমন কাউকে পাঠাতে চাই যার লোক লস্কর আছে। কেউ বাধা দিলে তাকে তারা রক্ষা করতে আসবে। ইবনে মাসউদ (রা.) বললেন, আমাকে অনুমতি দিন। আমার হিফাজত আল্লাহ করবেন। তারপর উপরোক্ত ঘটনাটি ঘটে।

একদিন হযরত ওমর (রা.) রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলেন, তিনি আবু বকরের সাথে মুসলমানদের বিভিন্ন অবস্থা নিয়ে আলাপ করছিলেন, তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তারা বাহিরে বের হলেন। দেখতে পেলেন একজন ব্যক্তি মসজিদে নামাজে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু কেউ তাকে চিনতে পারলেন না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুক্ষণ দাড়িয়ে তার তেলাওয়াত মন ভরে শুনলেন আর ওমর, আবু বকর (রা.) এর দিকে তাকিয়ে বললেন। “যে ব্যক্তি বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করে আনন্দ পেতে চায় যেমন তা অবতীর্ণ হয়েছে, সে যেন উম্মে আবদ এর অনুরুপ তেলাওয়াত করে।”

তারপর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ দু’আ শুরু করলেন আর রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপে চুপে বললেন- “চাও দেওয়া হবে, চাও দেওয়া হবে।” আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের পা দুটি ছিলো স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা ছোট। তার পা দেখে অনেকে তাকে বিভিন্ন নামে ডাকত। আবু জাহল যখনি তাকে রাস্তায় দেখতে পেত তখনই বলে উঠত, ইয়া ইবনে উম্মে আবদ। তাকে জনসম্মুখে অপমান করত।

সেই ছোট্ট পায়ের মুল্য কি হতে পারে একটু ভাবা যায়? তিনি সেই পা দিয়ে বুকের উপর দাঁড়িয়ে ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ দুশমন আবু জেহেলের দাঁড়ি ধরে গলা থেকে মাথা আলাদা করে দিয়েছিলেন। আবার সেই পা নিয়ে যখন সাহাবীরা একদিন হাসাহাসি করছিল তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝতে পেরে তাদের উদ্দেশ্য করে পায়ের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ননা করেন এভাবে, “তোমরা ইবনে মাসউদের পা নিয়ে ঠাট্টা করছো? তার পা একপাশে রেখে ওহুদ পাহাড় একপাশে রাখলে তার পা বেশি ভারি হবে।”

হ্যাঁ, তাই হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের অবদান ইসলামে অতুলনীয়। তিনি অনেক নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করেছেন। তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ছায়ার মত অনুসরণ করতেন। তার সাথে সফরে ঘরে বাহিরে একসাথে থাকতেন। তাঁর জুতা পরিয়ে দেওয়া, তাঁর ঘুম থেকে জাগিয়ে দেওয়া, মিসওয়াক,লাঠি বহন করা থেকে যাবতীয় সহযোগিতা তিনি করতেন। এমনকি তার ঘরে যাওয়ার জন্য সব সময় তার জন্য অনুমতি থাকত।

উপরের প্রত্যেকটি ঘটনাসহ, ইবনে মাসউদের জীবন থেকে রয়েছে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা। আমরা কি পারবো তার মত করে কুরআন তেলাওয়াত করতে? তাফসির, ফিকহ নিয়ে গবেষণা করতে? আমরা কি পারবো আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) মতো ইসলামের খাদেম হতে?

লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।