মুসলমানদের দায়িত্ব কি?

মুহাম্মদ সায়েম মুহাইমিন |

মুসলমানদের দায়িত্ব হচ্ছে সত্যের সাক্ষী হওয়া। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন, “হে ঈমানদারগণ তোমরা আল্লাহর জন্য সত্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়াও।” (সূরা নিসা: ১৩৫)

এখন প্রশ্ন হলো এখানে কোন সত্যের সাক্ষ্য দিতে বলা হচ্ছে? এ হলো সেই সত্য যার প্রথম বাণী হলো “লা ইলাহা ইল্লালাহ।” আমাদের কাছে এই সত্যের পূর্ণাঙ্গরূপ হিসেবে পুরো আল কুরআন রয়েছে এবং এই সত্য যে শূন্য থেকেও বাস্তবায়ন করা সম্ভব তার সাক্ষী হলেন মুহাম্মাদ (সা.) এবং মুহাম্মদ (সা.) এর ব্যাপারে সাক্ষী হলেন বিদায় হজ্বের সোয়া দুই লক্ষ সাহাবী।

আচ্ছা আমরা কেন এই দায়িত্ব পালন করব? না করলেই বা কি হবে? জবাবে আল কুরআন সুস্পষ্টরূপে ঘোষণা দেয়: “যার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন সাক্ষ্য বর্তমান রয়েছে সে যদি তা গোপন রাখে তবে তার চেয়ে বড় জালিম আর কে হতে পারে।” (সূরা বাকারা: ১৪০)

উপরের আয়াতদ্বয় থেকে এটা স্পষ্ট যে কুরআন ও সুন্নাহর অধিকারী হওয়ায় আমাদের দায়িত্ব হলো সত্যের সাক্ষ্য দেওয়া। আমাদেরকে এই সাক্ষ্য শুধুমাত্র ব্যক্তি হিসেবে নয়, উম্মাহ হিসেবেও দিতে হবে। এই ব্যাপারেও কুরআনুল কারীমে আলোকপাত করা হয়েছে: “তোমাদেরকে মধ্যমপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি, যাতে তোমরা মানব জাতির জন্য সাক্ষ্যদাতা হতে পার এবং রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষ্যদাতা হতে পারেন।” (সূরা বাকারা: ১৪৩)

আচ্ছা বুঝলাম আমাদেরকে সত্যের সাক্ষ্য দিতে হবে। এখন কথা হলো সাক্ষ্য প্রদানের পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের প্রতি কি কোন নির্দেশনা রয়েছে? হুম অবশ্যই রয়েছে। সাক্ষ্য প্রদানের পদ্ধতি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “আমি সুসংবাদদাতা ও ভয়-প্রদর্শনকারী হিসেবে নবী-রাসূল পাঠিয়েছি যাতে করে মানুষ এরূপ বিতর্ক তোলার সুযোগ না পায় যে আমরা তো বেখবর ছিলাম, আমাদেরকে কেউ এ ব্যাপারে জানায় নি। আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশীল, প্রাজ্ঞ।” (সূরা নিসা: ৬৫)

যুগে যুগে নবীদের ওফাতের পর তাঁদের উম্মতের উপর এই দায়িত্ব বর্তায়। সেই ধারাবাহিকতায় মুসলিম উম্মাহ হিসেবে সকল জাতির কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে দ্বীনে মুবিন ইসলামের, আল্লাহর রহমতের- মারহামাতের সুসংবাদ পৌঁছে দেওয়া এবং সিরাতুল মুস্তাকিম ব্যাতীত অন্য পথে চলার ব্যাপারে, জুলুম করার ব্যাপারে সর্তক করা, ভীতি প্রদর্শন করা আমাদের দায়িত্ব। কেননা শেষ বিচারের দিন যখন সকল অপরাধীকে জিজ্ঞেস করা হবে “তোমার কাছে কি কোন সতর্ককারী আসেনি।” আর তখন তাদের উত্তর যদি হয় ‘না’, তবে জালিম হিসেবে আমাদেরকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে।

এই ব্যাপারে কুরআন বলে “যার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন সাক্ষ্য বর্তমান রয়েছে, সে যদি তা গোপন রাখে তবে তার চেয়ে বড় জালিম আর কে হতে পারে।” (সূরা বাকারা: ১৪০)

বিষয় যখন এই, তখন আমাদেরকে সত্যের সাক্ষ্য মৌখিক এবং বাস্তব উভয় প্রকারেই দিতে হবে। যেমন আমরা ‘লা ইলাহা ইল্লালাহ’ বলার মাধ্যমে আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ বা উপাস্য হিসেবে মেনে নিই। ফলে আমরা হই তাঁর গোলাম, আর তিনি হন আমাদের উপাস্য। এই গোলামীর সাক্ষ্য স্বরূপ আমরা ৫ ওয়াক্ত সালাত আদায় করি। আল্লাহর সামনে সিজাদাহ অবনত হই।

এই সিজদাহ সম্পর্কে একবার হযরত আলী (রা.) কে প্রশ্ন করা হয়েছিল “হে আলী আমরা প্রতি রাকাতে দুইবার করে কেন সিজদাহ দিই?

হযরত আলী (রা.) বলেন, “প্রথম সিজদায় আমরা যখন মাটির সাথে মাথা লাগাই তখন এই সাক্ষ্য দেই যে আমার ছিলাম মাটি। অতঃপর যখন মাথা তুলি তখন আমাদেরকে মাটি থেকে তৈরি করা হয়েছে এই সাক্ষ্য দেই। অনুরূপভাবে দ্বিতীয়বার যখন মাটির সাথে মাথা লাগাই তখন স্বীকার করি আমরা মাটিতে সমাহিত হবো। অতঃপর যখন মাথা তুলি, তখন সাক্ষ্য দেই আমাদেরকে আবারো মাটি থেকে পুনুরুত্থিত করা হবে।”

এই ভাবে শুধু সিজদাহর মাধ্যমে আমরা অনেকগুলো সাক্ষ্য দিয়ে থাকি। আমরা যদি ইসলামের পাঁচটি রুকনের দিকের তাকাই তবে সেখানেও দেখতে পাই ঈমান আনার সাক্ষী হচ্ছে বাকি চারটি রুকন।
সাক্ষ্য দানের পূর্ণতা:

একটা বাড়ির পিলার বা স্তম্ভ তৈরি হলেই যেমন বলা যায় না ইঞ্জিনিয়ারের কাজ শেষ ঠিক তেমনি ইসলামের ৫ টি স্তম্ভকে ধারণ করার মধ্য দিয়ে আমাদের সাক্ষ্য দানের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।

যেমন এই যে, সারা বিশ্বসহ আমরা মুসলমানরা সুদী অর্থব্যবস্থাকে গ্রহণ করলাম এর মাধ্যমে সত্যের সাক্ষী হওয়া দূরে থাক। আমরা তো সুদকে হারাম ঘোষণা করা এই আয়াতকে “আল্লাহ তাআলা ব্যবসাকে বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।” (সূরা বাকারা: ২৭৫) মিথ্যা প্রতিপন্ন করলাম ।

শুধু কি তাই! বিট্রিশ লেখক লরেন্স ব্রাউন তার দ্যা প্রসপেক্টাস অফ ইসলাম নামক বইতে আমাদেরকে সাক্ষী হিসেবে মিথ্যুক প্রমাণিত করে ছেড়েছেন। দেখুন না সে কি বলে, “আমরা যখন ভারতে ইসলামের দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইনকে সেকেলে ও অকেজো মনে করে রহিত করে দিয়ে কেবল মুসলিম পার্সনাল ল’ হিসেবে রেখে দিলাম তখন তারা খুব ক্ষুদ্ধ হলো। কারণ এর ফলে তাদের অবস্থা এককালীন ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম যিম্মীদের অনুরূপ হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু এখন আমাদের নীতি শুধু ভারতীয় মুসলমানদের মনঃপুতই হয়নি বরং মুসলিম রাষ্ট্রগুলোও আমাদের অনুসরণ করছে। তুরস্ক এবং আলবেনিয়া তো বিবাহ ,তালাক ও উত্তরাধিকার আইন পর্যন্ত আমাদের মানদন্ডে সংশোধন করে নিয়েছে। এথেকে এ কথাই প্রমাণিত হচ্ছে যে “আইনের উৎস হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছা মাত্র”- মুসলমানদের এ ধারণাটি নিছক একটি পবিত্র কাহিনী (PIOUS FICTION) ছাড়া আর কিছুই ছিল না।”

আজ আমরা সারা দুনিয়ার মুসলমানরা সম্মিলিত ভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে যে সাক্ষ্য প্রদান করছি; এ হচ্ছে তার নমুনা। আমরা মুখে যাই বলি না কেন আমাদের সামগ্রিক কার্যকলাপ একথারই সাক্ষ্য বহন করছে যে, এই দীন ইসলামের কোন নিয়ম নীতিই আমাদের মনঃপুত নয় এবং রাসূল (সা.) এর প্রদর্শিত পথেও আমাদের কোন কল্যাণ ও মুক্তি নেই ।

আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর পূর্বে লরেন্স ব্রাউনের উল্লেখিত এই অবস্থা আজকের সময়ে এসে আরো বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত এই অবস্থার পরিবর্তন করছি না ততক্ষণ পর্যন্ত সাক্ষ্যদানে পূর্ণতা তো দূরে থাক সত্য গোপনের অপরাধে আমাদেরকে জালিম হিসেবে আল্লাহর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।

কয়েকশ বছর ধরে আমরা সত্য গোপন করে আসছি। আর আল্লাহ রব্বুল আলামীন ওয়াদা মোতাবেক এর শাস্তি আমাদেরকে আখিরাতে তো দিবেনই দুনিয়াতেও দিচ্ছেন যেমনটা আমাদের আগে সত্য গোপনকারী জাতি বনি ইস্রায়েলের ইহুদী ও নাসারাদেরকে দিয়েছেন; যা কুরআনে এভাবেই তুলে ধরা হয়েছে “লাঞ্চনা, গঞ্চনা, অপমান, অধঃপতন ও দুরবস্থা তাদের উপর চেপে বসলো এবং তারা আল্লাহর গযবে পরিবেষ্টিত হয়ে পড়লো।” (সূরা বাকারা: ৬১)

আমরাও আজকে একই অবস্থার সম্মুখীন। সারা দুনিয়াতে মুসলিম নামটি এখন আর সম্মানের নয়। বরং সারা বিশ্বেই মুসলমান মানেই অসহায়, দরিদ্র, শরণার্থী, জঙ্গি, অশিক্ষিত মূর্খ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ আমাদের কাছে সত্য হিসেবে কুরআন এবং তাঁর বাস্তবায়নকারী সুন্নাহ উপস্থিত রয়েছে।

হে আমার উম্মাহ! আল্লাহর কাছে কি জবাব দিবে? প্রিয় রাসূলের সামনে কীভাবে দাঁড়াবে? তাঁকে কি বলবে? বলবে হে রাসূল আপনার পথ আমাদের কাছে ভালো লাগেনি। তাই আমরা পাশ্চাত্যকে অনুসরণ করেছি। হযরত আবু বকর (রা.), উমর (রা.), উসমান (রা.), আলীদের (রা.) সাথে মিলবে কি করে? তাদেরকে কি বলতে পারবে আমরাও বিশ্ব বিজয়ী মুসলিম উম্মাহর গর্বিত সন্তান! একটু ভেবে দেখার অনুরোধ।

সর্বশেষ উস্তাদ নাজমুদ্দিন এরবাকানের একটা উক্তি দিয়ে শেষ করি, “একটি ফুল দিয়ে কখনো বসন্ত হয় না, ঠিক কিন্তু প্রতিটি বসন্তের সূচনা একটি ফুল দিয়েই হয়।”

লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।