ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সৎ নেতৃত্ব নির্বাচন অনিবার্য

মুুহাম্মদ ইজ্জত উল্লাহ |

মহান আল্লাহ পাক পৃথিবীতে নবী-রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন : ‘আমি আমার রাসূলদের সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ এবং হিদায়াত দিয়ে পাঠিয়েছি। তাদের সাথে কিতাব ও মিজান নাজিল করেছি যাতে মানুষ ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।’ (সূরা হাদিদ : ২৫)

নবী-রাসূলদেরকে যে উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছে তা হচ্ছে পৃথিবীতে মানুষের আচরণ এবং মানবজীবনের বিধিবিধান ব্যক্তিগত ও সামগ্রিকভাবেও যেন ন্যায়বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। একদিকে প্রতিটি মানুষ তার আল্লাহর অধিকার, নিজের অধিকার এবং আল্লাহর সেসব বান্দার অধিকার সঠিকভাবে জানবে এবং ইনসাফের সাথে আদায় করবে যার সাথে কোন না কোনভাবে তাকে জড়িত হতে হয়। অপরদিকে সামাজিক জীবনের বিধিবিধান এমন নীতিমালার ওপর নির্মাণ করতে হবে যাতে সমাজে কোন প্রকার জুলুম অবশিষ্ট না থাকে। সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতিটি দিক ভারসাম্যহীনতা থেকে রক্ষা পায়, সমাজজীবনের প্রতিটি বিভাগে সঠিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সমাজের সবাই যেন ইনসাফ মত যার যার অধিকার লাভ করে এবং নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পারে। অন্য কথায় ব্যক্তিগত ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাই ছিল নবী-রাসূলদের প্রেরণের উদ্দেশ্য। তারা প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত জীবনেও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে উদগ্রীব ছিলেন, যাতে তার মন-মগজ, তার চরিত্র ও কর্ম এবং তার ব্যবহারে ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। তারা গোটা মানবসমাজেও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী ছিলেন, যাতে ব্যক্তি ও ব্যষ্টি উভয়েই পরস্পরের আত্মিক, নৈতিক ও বৈষয়িক উন্নতির পথে প্রতিবন্ধক ও সাংঘর্ষিক হওয়ার পরিবর্তে সহযোগী ও সাহায্যকারী হয়। (তাফহিম সূরা হাদিদ টীকা-৪৫)

মহান আল্লাহ পাক ঈমানদারদের উদ্দেশে বলেন : হে ঈমানদারগণ! ইনসাফের পতাকাবাহী ও আল্লাহর সাক্ষী হয়ে যাও, তোমাদের ইনসাফ ও সাক্ষ্য তোমাদের নিজেদের ব্যক্তিসত্তার অথবা তোমাদের বাপ-মা ও আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে গেলেও। (সূরা নিসা : ১৩৫)

এ আয়াতে ঈমানদারদের এতটুকু বলে ক্ষান্ত হননি যে তোমরা ইনসাফের দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করো এবং ইনসাফের পথে চলো বরং বলেছেন : ইনসাফের ঝাণ্ডা নিয়ে এগিয়ে চলাই হবে তোমাদের কাজ। জুলুম খতম করে তার জায়গায় আদল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত করতে তোমাদের দৃঢ়সঙ্কল্প হতে হবে। (তাফহিম, সূরা নিসা-টীকা ১৬৪)

তাফসির মারেফুল কোরআনে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে সব মুসলমানকে ইনসাফ ও ন্যায়নিষ্ঠার ওপর অটল থাকতে এবং সত্য সাক্ষ্যদান করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা ও তার ওপর অবিচল থাকা শুধু সরকার ও বিচার বিভাগেরই বিশেষ দায়িত্ব নয়, বরং প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেন সে নিজে ন্যায়নীতির ওপর স্থির থাকে এবং অন্যকেও ইনসাফ ও ন্যায়নীতির ওপর অবিচল রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে। অবশ্য ইনসাফ ও ন্যায়নীতির একটি পর্যায় সরকার ও শাসন কর্তৃপক্ষের বিশেষ দায়িত্ব। তা হচ্ছে দুষ্টু ও অবাধ্য লোকেরা যখন ন্যায়নীতিকে পদদলিত করবে নিজেরাতো ন্যায়নীতির ধার ধারবেই না, বরং অন্যকেও ন্যায়নীতির ওপর স্থির থাকতে দেবে না, তখন তাদেরকে দমন করার জন্য আইনের শাসন ও উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। এমতাবস্থায় একমাত্র ক্ষমতাসীন সরকার ও কর্তৃপক্ষই ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

কোরআন হাদিস একদিকে পৃথিবীতে ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় বিধিবিধানের ব্যবস্থা করেছে, অপরদিকে এমন এক অপূর্ব নীতিমালা ঘোষণা করেছে তাকে পুরোপুরি গ্রহণ ও নিষ্ঠার সাথে বাস্তবায়ন করা হলে, জুলুম ও অত্যাচারে জর্জরিত দুনিয়া সুখ-শান্তির আধারে পরিণত হবে। আখেরাতে বেহেস্ত লাভের পূর্বে দুনিয়াতেই জান্নাতি সুখের নমুনা উপভোগ করা যাবে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আমার রব আমাকে নয়টি বিষয়ের নির্দেশ দিয়েছেন। তার একটি হলো সন্তুষ্ট অবস্থায় হোক আর রাগান্বিত অবস্থায় হোক না কেন ইনসাফের ব্যতিক্রম করা যাবে না। অর্থাৎ উভয় অবস্থায় ইনসাফ করতে হবে।

অত্যাচারী জালিমদের বিরুদ্ধে লড়াই:
‘তোমাদের কী হলো, তোমরা আল্লাহর পথে অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য লড়বে না, যারা দুর্বলতার কারণে নির্যাতিত হচ্ছে, তারা ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের রব! এই জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাও, যার অধিবাসীরা জালেম এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের কোন বন্ধু, অভিভাবক ও সাহায্যকারী তৈরি করে দাও।’ (সূরা নিসা : ৭৫)

‘এর আগে এমন অনেক নবী চলে গেছে যাদের সাথে মিলে বহু আল্লাহওয়ালা লড়াই করেছে। আল্লাহর পথে তাদের ওপর যেসব বিপদ এসেছে তাতে তারা মনমরা ও হতাশ হয়নি, তারা দুর্বলতা দেখায়নি এবং তারা বাতিলের সামনে মাথা নত করে দেয়নি। এ ধরনের সবরকারীদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন।’
(সূরা আলে ইমরান : ১৪৬)

বাংলাদেশের বর্তমান সমাজব্যবস্থা :
বাংলাদেশের বর্তমান সমাজব্যবস্থা এ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে সর্বত্র শোষকশ্রেণীর দ্বারা সাধারণ মানুষ জুলুম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সমাজে ধনিক ও সবল শ্রেণী, গরিব ও দুর্বল জনগণকে মিথ্যা মামলা দেয়া অতঃপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা এখন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধনী-গরিবের ব্যবধান আকাশচুম্বী। তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী থেকে বয়োবৃদ্ধা পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। পথে ঘাটে বখাটে ছেলেদের হাতে মেয়েরা ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে। এ কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও পর্যন্ত জড়িত হচ্ছে। কর্মসংস্থানের অভাবে বেকার যুবশক্তি চাকরির সন্ধানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিচ্ছে। ধনী তার গরিব প্রতিবেশীর সহায় সম্বল ভিটেমাটিটুকু আত্মসাৎ করার জন্য যারপরনাই তৎপর। বিধবা ভাতাসহ গরিব-দুঃখীদের জন্য সরকারি সুযোগসুবিধা অসৎ দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারীরা মন্ত্রী-এমপিদের সাথে মিলে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে আত্মসাৎ করছে। সরকারের জুলুম নির্যাতনসহ যে কোন অত্যাচারের বিপক্ষে মত প্রকাশ করলে গুম-খুনের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এমনি এক নাজুক পরিস্থিতিতে এ দেশের অসহায় নারী পুরুষ ও শিশুদের জন্য, জুলুম নির্যাতনে অতিষ্ঠ এই জনপদের মানুষদের জন্য মুক্তির ব্যবস্থা করা প্রতিটি ঈমানদারের দায়িত্ব।

কিভাবে এই মজলুম জনগণকে সাহায্য করা যাবে :
নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদিগকে নির্দেশ দেন যে, তোমরা যেন প্রাপ্য আমানতসমূহ প্রাপকদের নিকটে পৌঁছে দাও। আর যখন তোমরা মানুষের মাঝে বিচার ফায়সালা করবে, ন্যায় ও ইনসাফের সাথে সুবিচার করবে। (সূরা নিসা : ৫৮)
বোখারি শরিফের হাদিসে বলা হয়েছে : হযরত আবু হুরাইরা (রা:) বর্ণনা করেন, একদা কোন এক মজলিসে রাসূল (সা.) আলোচনা করছিলেন। একজন সাহাবী প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! (সা.) কিয়ামত কখন হবে? রাসূল (সা.) বললেন : যখন আমানতের খিয়ানত করবে তখন তুমি কিয়ামতের অপেক্ষা করো। লোকটি আবারো প্রশ্ন করলো হে আল্লাহর রাসূল! কিভাবে আমানত খিয়ানত করা হবে? রাসূল (সা.) বললেন: যখন নেতৃত্ব ও ক্ষমতা অসৎ ও অযোগ্য লোকের হাতে তুলে দেয়া হবে, (আর এটাই আমানতের খিয়ানত) তখন তুমি কিয়ামতের অপেক্ষা করো।

সূরা নিসার ৫৮ আয়াতের তাফসিরে মারেফুল কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে , আয়াতের প্রথম বাক্যটিতে আমানত পরিশোধের এবং দ্বিতীয় বাক্যে ন্যায়বিচারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে আমানত পরিশোধ বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়ার কারণসমূহ, এই যে এর অবর্তমানে কোথাও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতেই পারে না। কাজেই যাদের হাতে দেশের শাসনক্ষমতা থাকবে, তাদেরকে প্রথমে গচ্ছিত এই আমানতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। অর্থাৎ সরকারি পদসমূহে সেসব লোককেই নিয়োগ করতে হবে যাদেরকে সর্বাধিক যোগ্য বলে মনে করবে। কোন প্রকার স্বজনপ্রীতি আত্মীয়তার সম্পর্ক কিংবা কোন সুপারিশ অথবা ঘুষ উৎকোচ যেন কোনক্রমেই প্রশ্রয় পেতে পারে না। অন্যথায় এর ফলে অযোগ্য, অথর্ব, আত্মসাৎকারী ও অত্যাচারী লোক সরকারি পদের অধিকারী হয়ে বসবে। অতঃপর শাসকবর্গ যদি একান্তভাবেও দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা কামনা করেন তবুও তাদের পক্ষে সে লক্ষ্য অর্জন কোন অবস্থাতেই সম্ভবপর হবে না।

“মহান পরোয়ারদেগার সরকারি পদসমূহকেও আমানত বলে সাব্যস্ত করে প্রথমেই একথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, আমানত যেমন শুধুমাত্র তাদেরকে প্রত্যর্পণ করতে হয় যারা তার প্রকৃত মালিক, কোন ফকির-মিসকিনকে কারো আমানত দয়াপরবশ হয়ে দিয়ে দেয়া কিংবা কোন আত্মীয়-স্বজন অথবা বন্ধু-বান্ধবের প্রাপ্য হক আদায় করতে গিয়ে অন্য কারো আমানত তাদের দিয়ে দেয়া জায়েজ নয়। তেমনভাবে সরকারি পদ-যার সাথে সর্বসাধারণের অধিকার জড়িত, তাও আমানতেরই অন্তর্ভুক্ত এবং একমাত্র সে সমস্ত লোকই এসব আমানতের অধিকারী, যারা নিজেদের যোগ্যতা দক্ষতা ও সামর্থ্যরে দিক দিয়ে এসব পদের জন্য উপযোগী এবং উপস্থিত লোকদের মধ্যে উত্তম। আর বিশ্বস্ততা ও আমানতদারির দিক দিয়েও যারা অন্যান্যদের তুলনায় অগ্রগণ্য। এদের ছাড়া অন্য কাউকে এসব পদ অর্পণ করা হলে আমানতের মর্যাদা রক্ষিত হবে না।

এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে রাসূল করীম (সা.) এরশাদ করেছেন, যাকে সাধারণ মুসলমানের কোন দায়িত্ব অর্পণ করা হয়, তারপর সে যদি কাউকে তার যোগ্যতা যাচাই ছাড়াই একান্ত বন্ধুত্ব কিংবা সম্পর্কের কারণে কোন পদে নিয়োগ প্রদান করে, তবে তার ওপর আল্লাহর লা’নত হবে। না তার ফরজ কবুল হবে না নফল। এমনকি সে জাহান্নামে প্রবিষ্ট হবে।”

সূরা নিসার ৫৮ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফহিমুল কুরআনে বলা হয়েছে,বনি ইসরাইলদের একটি মৌলিক দোষ ছিল এই যে তারা নিজেদের পতনের যুগে আমানতসমূহ অর্থাৎ দায়িত্বপূর্ণ পদ, ধর্মীয় নেতৃত্ব ও জাতীয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে মর্যাদাপূর্ণ পদসমূহ এমন সব লোককে দেয়া শুরু করেছিল যারা ছিল অযোগ্য, সংকীর্ণমনা, দুশ্চরিত্র, দুর্নীতিপরায়ণ, খেয়ানতকারী ও ব্যভিচারী। ফলে অসৎ লোকদের নেতৃত্বে সমগ্র জাতি অত্যাচারে লিপ্ত হয়ে যায়। মুসলমানদেরকে উপদেশ দেয়া হচ্ছে। তোমরা বনি ইসরাইলিদের মতো আচরণ করো না। বরং তোমরা যোগ্য লোকদেরকে আমানত সোপর্দ করো। অর্থাৎ আমানতের বোঝা বহন করার যোগ্যতা যাদের আছে কেবল তাদের হাতে আমানত তুলে দাও।

ইনসাফ (ন্যায়নীতি) কায়েমের পথ :
সূরা নূরের ৫৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন : আল্লাহ্ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও সৎ কাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খেলাফাত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদের দান করেছিলেন। তাদের জন্য তাদের দীনকে মজবুত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে দিবেন। যাকে আল্লাহ তাদের জন্য পছন্দ করেন এবং তাদের ভয়ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দিবেন।

উপরোক্ত আয়াতে কোন সমাজে যদি ঈমানদার সৎ যোগ্য একদল লোক গড়ে তোলা যায়, যারা ঈমানদারি ও সততার সাথে সমাজ পরিচালনার যোগ্যতা অর্জন করে তাদেরকে আল্লাহপাক ঐ সমাজ পরিচালনার নেতৃত্ব (খেলাফত) দানের ওয়াদা করেছেন। সেখানে ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইনসাফ ও ন্যায়নীতি কায়েম সম্ভব হবে। সেই সমাজে দারিদ্র্যের ভয়, সম্মানহানির ভয়, প্রাণহানির ভয় তথা সকল ধরনের ভয়ভীতির পরিবর্তে আল্লাহপাক নিরাপত্তা দান করবেন। মানুষ সকল প্রকার জুলুম নির্যাতন, অত্যাচার-অবিচার থেকে মুক্ত হয়ে ন্যায় ও ইনসাফের জীবন যাপন করতে পারবে। একটি শান্তির সমাজ গড়ে উঠবে।

ন্যায়বিচারে উৎসাহ প্রদান ও জুলুমের বিরুদ্ধে নবীজির হুঁশিয়ারি:
১. হযরত ইয়ায বিন হাম্মার (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেছেন, জান্নাতবাসী তিন শ্রেণীর : ন্যায়বিচারক শাসক, প্রত্যেক মুসলিম আত্মীয়-স্বজনের প্রতি দয়ার্দ্র ও কোমল হৃদয় এবং বহু সন্তানের জনক সৎ ব্যক্তি। (মুসলিম)
২. হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেছেন, হে আবু হুরায়রা, এক ঘণ্টার ন্যায়বিচার ষাট বছরের এবাদাতের তথা রাতভর নামাজ পড়া ও দিনে রোযা রাখার চেয়ে উৎকৃষ্ট। হে আবু হুরায়রা, এক ঘণ্টার অত্যাচার আল্লাহর কাছে ষাট বছরব্যাপী নাফরমানি করার চেয়েও মারাত্মক। (ইসবাহনী)
৩. হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেছেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হবে ন্যায়পরায়ণ শাসক ও নেতা, আর সবচেয়ে ঘৃণিত ও ক্রোধভাজন ব্যক্তি হবে অত্যাচারী শাসক। (তিরমিজি ও তাবরানি) অপর বর্ণনা মতে! কেয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন আজাবে ভুগবে অত্যাচারী শাসক ও নেতা।
৪. হযরত তালহা বিন উবাইদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেছেন, শুনে রাখ, ওহে জনমণ্ডলী, আল্লাহ তায়ালা কোন অত্যাচারীর নামাজ কবুল করবে না। (হাকেম)
৫. হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেছেন, দশজন মানুষের নেতা এমন ব্যক্তি কেয়ামতের দিন শেকল বাঁধা অবস্থায় আসবে। একমাত্র ন্যায়বিচার করে থাকলেই সে মুক্তি পাবে। (আহমাদ)

ভালো লোক থাকা সত্ত্বেও অসৎ লোক নিয়োগের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি:
১. হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি সৎ লোক থাকা সত্ত্বেও কোন অসৎ আত্মীয়কে কর্মচারী নিযুক্ত করে, সে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও মুমিনদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। (হাকেম)

২. হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মুসলমানদের ওপর কোন বিষয়ে কর্তৃত্বশীল হবে, অতঃপর স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে কাউকে তাদের নেতা নিযুক্ত করবে, তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ। তার পক্ষে কোন সুপারিশ বা বিনিময় গ্রহণ করা হবে না এবং তাকে জাহান্নামে পাঠানো হবে। (হাকেম) (আত্ তারগিব ওয়াত্ তারহিব থেকে সংগৃহীত)

সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের গুরুত্ব :
১. হযরত আবু বকর (রা:) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি যখন লোকদের অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যাবে যে তারা অসৎ কাজ দেখবে কিন্তু তা পরিবর্তন করার চেষ্টা করবে না, জালিমকে জুলুম করতে দেখবে কিন্তু তার হাত টেনে ধরবে না তখন অসম্ভব নয় যে আল্লাহ তার আজাব সকলের ওপর চাপিয়ে দেবেন। আল্লাহর কসম! তোমরা লোকদেরকে উত্তম কাজ করার হুকুম দাও এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখো। অন্যথায় আল্লাহ তোমাদের ওপর এমন সব লোককে চাপিয়ে দেবেন যারা তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ এবং তারা তোমাদেরকে ভীষণ কষ্ট দেবে। তখন তোমাদের সৎ লোকেরা আল্লাহর কাছে দোয়া করবে কিন্তু তা কবুল হবে না। (তাফহিম সূরা মায়েদা-টীকা ১১৯)

২. মহান আল্লাহ বিশেষ লোকদের অপরাধের দরুন সর্বসাধারণকে শাস্তি দেন না, যতক্ষণ সাধারণ লোকদের অবস্থা এমন পর্যায়ে না পৌঁছে যায় যে, তারা নিজেদের চোখের সামনে খারাপ কাজ হতে দেখে এবং তার বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশের ক্ষমতাও রাখে এরপরও কোন অসন্তোষ প্রকাশ করে না। কাজেই লোকেরা যখন এমন অবস্থায় পৌঁছে যায় তখন আল্লাহ সাধারণ ও অসাধারণ নির্বিশেষে সবাইকে আজাবের মধ্যে নিক্ষেপ করেন। (তাফহিম সূরা আরাফ টীকা-১২৫)

আমাদের করণীয় :
সূরা নূরের ৫৫ নম্বর আয়াতের আলোকে একদল সৎ যোগ্য লোক তৈরি করে সূরা নিসার ৫৮ নম্বর আয়াতের আলোকে তাদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তুলে দেয়ার জন্য প্রত্যেক ঈমানদারকে সংঘদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। রাসূলে পাক (সা.)-এর তৈরি এক দল সৎ যোগ্য লোকদেরকে ঐ সমাজের অসৎ, অত্যাচারী, দুর্নীতিবাজ ও কুফরি শক্তির মোকাবেলা করতে হয়েছিল বদর, ওহুদ ও খন্দকসহ অনেক যুদ্ধক্ষেত্রে। যুদ্ধে বিজয়ী হয়েই সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ঐ সকল সৎ যোগ্য লোকদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে জুলুম নির্যাতন ও দুর্নীতি উচ্ছেদ করে সেখানে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বর্তমানকালেও এক দল সৎ ও যোগ্য লোক তৈরি করে প্রতিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অসৎ অত্যাচারী ও দুর্নীতিবাজ শক্তির সাথে মোকাবিলা করে করে বিজয়ী হতে হবে তাহলে বাংলাদেশের এই জমিনে জুলুম অত্যাচার নির্যাতন ও দুর্নীতি উচ্ছেদ করে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

জাতীয় সংসদ, সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য সৎ যোগ্য লোক মনোনয়ন দিয়ে নির্বাচন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ সকল প্রার্থী জনগণের সঙ্গে আন্তরিকভাবে মেলামেশার মাধ্যমে তাদের অভিভাবকে পরিণত হবে। জনগণের আশা ভরসার প্রতীক হিসেবে গড়ে উঠবে। সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে জনগণকে সৎ যোগ্য লোকদের নির্বাচিত করার আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে পাশাপাশি সকল প্রার্থীকে জনগণের বিপদ-আপদের কাণ্ডারি হিসেবে গড়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে। এভাবে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে অবশ্যই আল্লাহর মেহেরবানিতে সমাজে সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।

নেতৃত্ব পরিবর্তনে জিহাদ ও নির্বাচন :
‘লড়াই করতে থাকো তাদের সাথে যতক্ষণ না ফিতনা নির্মূল হয়ে যায় এবং দ্বীন একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়।’( সূরা বাকারা : ১৯৩) উপরোক্ত আয়াতে দ্বীন কায়েমের জন্য লড়াই করতে বলা হয়েছে। রাসূল (সা.)-এর যুগে কুফরি শক্তির বিরুদ্ধে বদর, ওহুদ, খন্দকসহ অনেক যুদ্ধে তরবারির লড়াই এর মাধ্যমে কুফরি শক্তিকে পরাজিত করে ইসলামী শক্তি বিজয় লাভ করে। এর ফলে সাহাবায়ে কেরাম দীন অনুযায়ী সমগ্র আরব ভূখণ্ড পরিচালনা করতে সক্ষম হন। বাংলাদেশকে দীন অনুযায়ী পরিচালনা করতে হলে জাতীয় ও স্থানীয় সরকারে ইসলামী নেতৃত্বকে সরকার পরিচালনায় ভূমিকা রাখতে হবে। গণতান্ত্রিক পন্থায় একমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমেই নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়ে থাকে। নির্বাচনের মাধ্যমে ইসলামী নেতৃত্ব বিজয়ী হয়ে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার পরিচালনার সুযোগ পেলে তারা দেশ ও সমাজকে দীন অনুযায়ী পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। দেশে দীনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পূর্বে তরবারির জিহাদে বিজয়ী হয়ে করতে হতো, বর্তমানে নির্বাচনী জিহাদে বিজয়ী হয়ে তা করা সম্ভব। পূর্বে একজন ব্যক্তি ঈমান আনলে মুমিন হওয়ার সাথে সাথেই তাকে মুজাহিদের ভূমিকা পালন করতে হতো।

বর্তমানে যারা দীনকে কায়েম করার জন্য ইসলামী আন্দোলনে যোগ দেন, তাদের অনেকে নির্বাচনী কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে রাজি হন না অথচ তাবুক যুদ্ধে যে সকল মুমিন মুজাহিদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হননি তাদেরকে মুনাফিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ ব্যাপারে ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদেরকে সতর্ক করা প্রয়োজন।

লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট