লিথুনিয়ায় মুসলমানদের ইতিহাস

ছাকিবুর রাহাত | 

আমি যেই জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে আছি, এটি লিথুনিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াস। এখানে যদি আপনি ছয়শ বছর আগে আসতেন, তাহলে এখানকার গ্রামগুলোতে শত শত মসজিদ দেখতে পেতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালেও অন্তত ২৫ টি মসজিদ ছিলো শুধু লিথুনিয়াতেই। কিন্তু সেই শত শত মসজিদের হাতেগুণা কয়েকটি এখন আছে। তাও শুধু শুক্রবার এবং ঈদের সময় সাধারণত খোলা হয় মসজিদ ক’টা।

লিথুনিয়ায় মুসলমানদের ইতিহাস অনেক পুরোনো। প্রায় ৬০০ বছর পুরোনো। মুসলমানদের ইতিহাস বলতে ক্রিমিয়ান তাতার মুসলমানদের ইতিহাসই গুরুত্বপূর্ণ। ১৩৯৮ সালের দিকে গ্রুনওয়াল্ড এর যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় লিথুনিয়ার গ্রান্ড ডিউক ভিতাওতাস সাথে করে প্রচুর সংখ্যক তাতার মুসলমান এবং কিছু কারাইট ইহুদী নিয়ে আসে। মুসলমানদের জমি এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয় ভিতাওতাস। তাতার মুসলমানরা বসতি শুরু করে এবং লিথুনিয়ার জন্য নিজেদের উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠিত হয়নি। তাতার পিটিশনে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায় – “আমরা আমাদের তরবারির উপর শপথ করেছি, লিথুনিয়াকে রক্ষা করবো। যুদ্ধের ভাগ্য আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে। ভিতাওতাস আমাদের মধ্যে অনেক শ্রদ্ধেয়। সে বলেছিলো, লিথুনিয়ার জলভূমি স্থলভূমি আমরা নিজেরা ভাগাভাগি করে ভোগ করবো” সে সময় অসংখ্য মসজিদ তৈরি হয়। দুটি মসজিদ এখনো টিকে আছে, তাতার নেমেজিস মসজিদ আর কেতুরিয়াদেসমিত ততরিউ গ্রামের মসজিদ। কেতুরিয়াদেসমিত ততরিউ অর্থ হলো চল্লিশ তাতার। এই নামের কারণ হিসেবে দুটো গল্প প্রচলিত আছে। একটা হলো, ভিতাওতাস এর আমন্ত্রণে আসা চল্লিশটি তাতার পরিবার এখানে বসতি শুরু করেছিলো। সেখান থেকেই এই নামের উদ্ভব। আবার কেউ কেউ মনে করে চল্লিশ মানে উসমানীয় পরিভাষায় “অনেক” বুঝানো হয়।

আর অন্য মসজিদটি হলো এখন আমি যেই জায়গায় আসলাম সেখানে। জায়গার নাম নেমেজিস। এটি হলো তাতার অধ্যুষিত এলাকা, রাজধানীর পাশেই এই গ্রাম। এখানে বর্তমানে ১২০ এর মতো তাতার বাস করে।

প্রশ্ন হলো এসব এলাকায় একসময় শত শত মসজিদ ছিলো, মুসলিম আলেম ছিলো, বাচ্চাদের মক্তব ছিলো এসব কোথায় গেলো? এখন নেই কেনো?

ফাতিমা
তাতার মুসলিম মহিলা ফাতিমা

বিভিন্ন সময়ে মসজিদগুলো কমতে থাকে। তাতারদের আলেমরাও কমতে থাকে। সবচেয়ে মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ চলে সোভিয়েতদের হাতে। তারা ইসলামকে নিষিদ্ধ করে। সমস্ত মসজিদ পুড়িয়ে দেয় না হয় বন্ধ করে দেয়। আলেমদের হত্যা করে না হয় সুদূর সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করে। ইসলামী বই এবং লাইব্রেরি পুড়িয়ে দেয়। তখন হাতেগুণা কয়েকটা মসজিদ গোপনে চালু রাখা হয়। সবাই ভাবতো এসব স্টোররুম বা অন্য কিছু। “এই গোপন মসজিদ গুলোই আমরা শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে পেরেছি, এসব আমাদের সম্বল। আমাদের বাচ্চাদের বিশ্বাস ধরে রাখতে। তাতার সম্প্রদায় এবং ইমাম এই মসজিদটি টিকিয়ে রেখেছেন” বলেন ফাতেমা নামক প্রায় আশি বছর এক বয়ষ্ক তাতার মুসলিম মহিলা।

ইউরোপের মুসলমানদের শেকড়ের গল্প
ছাকিবুর রাহাত | লিথুনিয়া | ২০২২