বাংলায় হিন্দু রেনেসাঁ, ইসলামবিদ্বেষ ও আজকের বাংলাদেশ

তারেকুল ইসলাম | 

আজকের প্রেক্ষাপটে শিল্পসাহিত্যে ইসলামী ভাবধারা থেকে যে যতবেশি বিচ্ছিন্ন, সে ততবেশি প্রগতিশীল হিসেবে গণ্য। ইসলাম ও মুসলমানদের সমালোচনা বা নিন্দা যতবেশি করা যায়, সেক্যুলার ও প্রগতিশীল পরিচিতি ততবেশি বাড়ে। কিন্তু প্রগতিশীল ও সেক্যুলারদের ভণ্ডামি সম্পর্কে মানুষ এখন যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। সাধারণ মানুষ খুব ভালো করেই জানে, ইসলামের বিরোধিতার নামই আজ প্রগতিশীলতা। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর অর্থই যেন সেক্যুলারিজম ও নাস্তিকতা। বস্তুতপক্ষে, প্রগতিশীলতা, এনলাইটেনমেন্ট ও সেক্যুলারিজমের মুখোশ পরে এদেশে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতিরোধ করার জন্য সাংস্কৃতিক আবরণে হিন্দুত্ববাদে দীক্ষিত হওয়াকে খাঁটি বাঙালিয়ানা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস সেই ঊনবিংশ শতকের হিন্দু রেনেসাঁ থেকে আজ অবধি চলমান।

ভারতবর্ষে মুসললিম শাসনের পতনপূর্বক ইংরেজদের ঔপনিবেশিক দখলদারিত্ব কায়েমের পর ব্রিটিশদের দালাল ও সেবাদাস অভিজাত ব্রাহ্মণ হিন্দুরা মুসলিম ভাবাদর্শ ও কালচারকে নিশ্চিহ্ন করতে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের অনুকরণে বাংলায় হিন্দু রেনেসাঁসের সূচনা করে। ঊনবিংশ শতক থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত চলমান বাংলার এই রেনেসাঁসের ভিত্তি হয়ে ওঠে হিন্দুত্ববাদ। এই হিন্দু রেনেসাঁস কোনোভাবেই সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ ছিল না, বরং ছিল প্রবলভাবে মুসলিমবিদ্বেষী। রাজা রামমোহন রায়, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত প্রত্যেকেই ইউরোপীয় রেনেসাঁর অনুপ্রেরণায় ধর্মীয় হিন্দুত্বকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রভাবশালী করে বাংলায় এক নব জাগরণ সৃষ্টি করেন। আর বিশেষত ‘হিন্দুত্ববাদ’-এর প্রবক্তা হিসেবে তখন আবির্ভূত হন কট্টর মুসলিমবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তার ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস হচ্ছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উসকে দেয়া উগ্র হিন্দুত্ববাদের পলিটিক্যাল ডকট্রিন। সেইসাথে তার রচিত ‘বন্দে মাতরম’ গানটি হচ্ছে হিন্দুত্ববাদের জাতীয় মূলমন্ত্র।

বঙ্কিমচন্দ্র তার উপন্যাসগুলোতে মোগল আমলের মুসলিম বাদশাহ ও সম্রাটদের চরিত্র হননপূর্বক চরম মিথ্যাচারের মাধ্যমে কুৎসা গেয়েছেন। এমনকি যবন, নেড়ে, ম্লেচ্ছ, পাতকী, পাষণ্ড, পাপিষ্ঠ, পাপাত্মা, দুরাত্মা, দুরাশয়, নরাধম, নরপিশাচ ইত্যাদি নিকৃষ্ট ভাষায় গালাগালি করে তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়েছিলেন। এছাড়া বঙ্কিম তার ‘আননন্দমঠ’ উপন্যাসে লেখেন, ‘কেহ চিৎকার করিতে লাগিল, “মার, মার নেড়ে মার।” কেহ গাহিল, “হরে মুরারে মধুকৈটভারে!”। কেহ গাহিল, “বন্দে মাতরম।” কেহ বলে, “ভাই, এমন দিন কি হইবে, মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধা-মাধবের মন্দির গড়িব?’ (তৃতীয় খণ্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ)। এখন মনে পড়ে, ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙে রাম মন্দির গড়ার জন্য। বর্তমান উগ্র হিন্দুত্ববাদী মোদির শাসনামলে সেখানে বাস্তবিকভাবেই এখন রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে।

এছাড়া গত শতকের প্রারম্ভে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সময় গুরু বঙ্কিমের উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘শিবাজী উৎসব’ নামক মুসলিমবিদ্বেষী কবিতা লিখে সমালোচিত ও নিন্দিত হন। রবি ঠাকুরের হিন্দু জাতিবাদী দর্শন সম্পর্কে জানা যায় তার ‘আত্মপরিচয়’ নামক প্রবন্ধে। তিনি লেখেন, ‘আমরা যে-ধর্মকে গ্রহণ করিয়াছি, তাহা বিশ্বজনীন তথাপি তাহা হিন্দুরই ধর্ম। এই বিশ্বধর্মকে আমরা হিন্দুর চিত্ত দিয়াই চিন্তা করিয়াছি, হিন্দুর চিত্ত দিয়াই গ্রহণ করিয়াছি। শুধু ব্রহ্মের নামের মধ্যে নহে, ব্রহ্মের ধারণার মধ্যে নহে, আমাদের ব্রহ্মের উপাসনার মধ্যেও একটি গভীর বিশেষত্ব আছেই; এই বিশেষত্বের মধ্যে বহুশত বৎসরের হিন্দুর দর্শন, হিন্দুর ভক্তিতত্ত্ব, হিন্দুর যোগসাধনা, হিন্দুর অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠান, হিন্দুর ধ্যানদৃষ্টির বিশেষত্ব ওতপ্রোতভাবে মিলিত হইয়া আছে। আছে বলিয়াই তাহা বিশেষভাবে উপাদেয়, আছে বলিয়াই পৃথিবীতে তাহার বিশেষ মূল্য আছে।’ এই রবীন্দ্রনাথই আজ হয়ে উঠেছে আধিপত্যবাদের ছদ্ম-হাতিয়ার আর এদেশীয় সেক্যুলার প্রগতিশীলদের ইসলামবিরোধী রাজনৈতিক প্রণোদনার কালচারাল অস্ত্র।

ইউরোপীয় রেনেসাঁ দ্বারা অনুপ্রাণিত হিন্দু রেনেসাঁস শেষ পর্যন্ত বঙ্কিমের উগ্র হিন্দুত্ববাদের আদর্শে পর্যবসিত হয়ে ধর্মীয় রিফর্মেশন বা রিভাইভালিজমে পতিত হয়। হিন্দুত্ববাদের পুনর্জাগরণই হয়ে ওঠে হিন্দু রেনেসাঁসের কেন্দ্রকোরক। ভারতবর্ষকে ‘শুদ্ধ হিন্দু’র দেশ বানানোই হয়ে ওঠে মূল এজেন্ডা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরবর্তীকালে বাংলার সেক্যুলার মুসলিম প্রগতিশীল মননেও হিন্দু রেনেসাঁসপ্রসূত হিন্দুত্ববাদের প্রভাব বেশ রয়ে যায়। আজ অবধি তা রয়ে গেছে। যার তীক্ষè প্রভাব ও প্রকাশ আজও আমরা দেখি এদেশের বর্তমান সেক্যুলার মুসলিম প্রগতিশীল মননেও। যারা প্রায়ই প্রগতিশীলতা ও মুক্তমনার নামে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ান। সুতরাং বুঝতে হবে, এর ঐতিহাসিক সম্পর্কসূত্র সেই হিন্দু রেনেসাঁস, যা একদিকে ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপের গোলামির মেজাজ ধারণ করে, আরেক দিকে আধুনিকতা, সেক্যুলারিজম ও প্রগতিশীলতার ধুয়া তুলে বিশেষত ইসলাম ও মুসলমানদের দমন করার প্রেরণা দেয়। ফলে দিল্লির এদেশীয় দালাল সেক্যুলার প্রগতিশীলদের কাছে ‘হিন্দুত্ববাদ’ কোনো সমস্যা নয়, বরং এটি আজও ইসলাম ও মুসলিমদের বিরোধিতার মোক্ষম অস্ত্র! এই ফ্যাসিবাদের কলিকালে দিল্লির মদদপুষ্ট হয়ে এদেশে হিন্দুত্ববাদের বীজ বপনের লোকাল পেইড এজেন্ট সেক্যুলার শিবসেনারা ইতোমধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

যাই হোক, এখন আমাদের জাতীয় পাঠ্যপুস্তক সম্পর্কে না বললেই নয়। হিন্দু সাম্প্রদায়িক বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা আমাদের পাঠ্যবইয়ে থাকতে পারলে ইসলামপন্থী শক্তিমান সাহিত্যিক ইসমাইল হোসেন সিরাজীর কোনো রচনা নেই কেন? এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই। না বললেই নয়, জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন কট্টর হিন্দুত্ববাদী। এমনকি তার বক্তব্যে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলিমবিদ্বেষের সুস্পষ্ট উপাদান আছে। অথচ আমাদের পাঠ্যবইয়ে সাম্প্রদায়িক শরৎচন্দ্রের গল্প রয়েছে। শরতের ‘লালু’ নামক পাঁঠাবলির নিয়ম-কানুন শেখানো এবং গরুর প্রতি মাতৃভক্তিবাদ শিক্ষা দেয়ার মতো গল্প থাকলেও মুসলমানদের কোরবানির গরু-জবাইয়ের নিয়ম-কানুন শেখানোর কোনো গল্প বা রচনা কিন্তু নেই! বরং কোরবানির নিয়ম-কানুন শেখানোর রচনা বা গল্প থাকলে সেক্যুলার প্রগতিশীলরা বহু আগেই ধর্মনিরপেক্ষতার জাত গেছে বলে রৈ-রৈ করে উঠত। শরৎচন্দ্র একজন ব্রাহ্মণ গোত্রীয় হিন্দু। শরৎ সম্পর্কে প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা এই মন্তব্য করেছিলেন, ‘এইরকম সাম্প্রদায়িক রচনা শরৎবাবুও লিখতে পারেন আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে’ (যদ্যপি আমার গুরু, আহমদ ছফা, পৃষ্ঠা-৫৬)।

এবার আসুন, বাংলা সাহিত্যের সবচে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের সাম্প্রদায়িক ও মুসলিমবিদ্বেষী চেহারাটা একটু পরখ করে দেখি। ১৯২৬ সালে বাঙলা প্রাদেশিক সম্মেলনে শরৎচন্দ্র ‘বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা’ শীর্ষক একটি ভাষণ দেন। এই ভাষণ পরবর্তীতে ১৯৩৩ সালে হিন্দু সংঘ পত্রিকায় বাংলা ১৯শে আশ্বিন সংখ্যায় ছাপা হয়। ওই ভাষণে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, ‘বস্তুত, মুসলমান যদি কখনও বলে- হিন্দুর সহিত মিলন করিতে চাই, সে যে ছলনা ছাড়া আর কি হইতে পারে, ভাবিয়া পাওয়া কঠিন। একদিন মুসলমান লুণ্ঠনের জন্যই ভারতে প্রবেশ করিয়াছিল, রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য আসে নাই। সেদিন কেবল লুট করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, মন্দির ধ্বংস করিয়াছে, প্রতিমা চূর্ণ করিয়াছে, নারীর সতীত্ব হানি করিয়াছে, বস্তুত অপরের ধর্ম ও মনুষ্যত্বের উপরে যতখানি আঘাত ও অপমান করা যায়, কোথাও কোন সঙ্কোচ মানে নাই। হিন্দু-মুসলমান-মিলন একটা গালভরা শব্দ, যুগে যুগে এমন অনেক গালভরা বাক্যই উদ্ভাবিত হইয়াছে, কিন্তু ঐ গাল-ভরানোর অতিরিক্ত সে আর কোনো কাজেই আসে নাই। এ মোহ আমাদিগকে ত্যাগ করিতেই হইবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘হিন্দুস্তান হিন্দুর দেশ। সুতরাং এ দেশকে অধীনতার শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিবার দায়িত্ব একা হিন্দুরই। মুসলমান মুখ ফিরাইয়া আছে তুরস্ক ও আরবের দিকে, -এ দেশে চিত্ত তাহার নাই। যাহা নাই তাহার জন্য আক্ষেপ করিয়াই বা লাভ কী, এবং তাহাদের বিমুখ কর্ণের পিছু পিছু ভারতের জলবায়ু ও খানিকটা মাটির দোহাই পাড়িয়াই বা কী হইবে! আজ এই কথাটাই একান্ত করিয়া বুঝিবার প্রয়োজন হইয়াছে যে, এ কাজ শুধু হিন্দুর,-আর কাহারও নয়।’ (শরৎ রচনাসমগ্র)।

এছাড়া বাংলার রেনেসাঁসের (পড়ুন হিন্দু রেনেসাঁস) অগ্রনায়ক রাজা রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র ও স্বামী বিবেকানন্দরাই প্রথম বাঙালি জাতীয়তাবাদের কেতন ওড়ানো শুরু করেন এবং একে অবলম্বন করেই হিন্দু জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক ও আদর্শিক উত্থান ঘটে। এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের মর্মবাদীরা মনেপ্রাণে ছিলেন কট্টর হিন্দুত্ববাদী। তারা সেক্যুলার ছিলেন না, ফলে তাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ মানেই যে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদের কথাবার্তা’, সেটা বিখ্যাত লেখক প্রয়াত এম আর আখতার মুকুলও তাঁর ‘কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী’ বইয়ে লিখেছিলেন। কট্টর হিন্দুত্ববাদকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের জাগরণে বাঙালি মুসলমানদের শরিক করার কোনো সুযোগ তারা রাখেননি; কারণ বঙ্কিমচন্দ্র তার উপন্যাসগুলোর মাধ্যমে তীব্র মুসলিমবিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতেন এবং পরবর্তীতে শরৎচন্দ্রের মতো ঔপন্যাসিকও বাঙালি মুসলমানদের ‘মোহামেডান’ বলে সম্বোধন করতেন। এ থেকেই বোঝা যায়, সেকালে হিন্দুত্ববাদীরা বাঙালি মুসলমানদের ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করত না। লক্ষণীয়, আজকে যখন হাজার বছরের বাঙালি কিংবা বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যের জিগির তোলা হয়, তখন আমাদেরকে সচেতনভাবেই বুঝে নিতে হবে যে, হাজার বছরের সেই ‘বাঙালি’ হচ্ছে হিন্দু, মোটেও সে মুসলমান নয়। ফলে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি কিংবা বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য ইত্যাদি চটকদার রেটোরিক ব্যবহার করে হিন্দুদের বিভিন্ন পৌত্তলিক রিচুয়্যালকে ‘সর্বজনীন’ আখ্যা দিয়ে প্রপাগান্ডা চালানোটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আর ঐতিহাসিকভাবেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কালে এমন একটা ধারণা প্রচলিত ছিল যে, বাঙালি মানেই হিন্দু, আর হিন্দু মানেই বাঙালি।

গোঁড়া হিন্দুদের পাশাপাশি ব্রাহ্মধর্মবাদী রবীন্দ্রনাথরাও পুরো ভারতবর্ষকে শুদ্ধ হিন্দুর দেশরূপে কল্পনা করতেন। হিন্দু রেনেসাঁসের গুরু বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ গানের মূল নির্যাসও ছিল হিন্দুত্ববাদ এবং মহা হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রেরণা, যা আজও জাতীয় সঙ্গীতের নামে ভারতের মুসলমানদের ওপর জোরজবরদস্তি করে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা লক্ষণীয়। সুতরাং বাঙালি-অবাঙালি সব মুসলমানকে হিন্দু বানানোর প্রকল্প ঐতিহাসিক এবং কয়েক শতাব্দীর বাঙালি জাতীয়তাবাদী প্রকল্প। এজন্যই হিন্দুধর্মের রিচুয়্যাল বা ধর্মাচার পালনের বেলায় ‘সর্বজনীনতা’র বিভ্রম তৈরি করা হয়। সুতরাং বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম মুসলিম-অধ্যুষিত রাষ্ট্রের মুসলমানদেরকে সেক্যুলারিজম, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি ও সর্বজনীনতার বিভ্রমের মধ্য দিয়ে এবং মন-মগজে হিন্দুত্ববাদের বীজ বপন করে তাদের মুসলিম জাতিসত্তার আত্মপরিচয় বিনাশ করার ষড়যন্ত্র অদ্যাবধি চলমান।

মুঘল আমলের সুদীর্ঘ মুসলিম শাসনামলের ধারাবাহিকতায় উপমহাদেশে ইসলামী মূল্যবোধসম্পন্ন একটি জাতিগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। বাংলার মুসলিম নবাবদের শাসনামলে বাংলাভাষী বৃহৎ একটি জাতিগোষ্ঠীর মর্মেও ইসলাম স্থান করে নেয়- হিন্দু সম্প্রদায়ের অমানবিক বর্ণপ্রথা ও জাতপাতের বৈষম্যের বিপরীতে সাম্য ও মানবতার জয়গান গেয়ে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী বাঙালি জাতিবাদীরা কখনোই মুসলমানদের এখানকার স্থানীয় জনমানুষ বলে স্বীকার করেনি। এমনকি যারা নৃতাত্ত্বিকভাবে বাঙালি এবং এখানকার স্থানীয় অধিবাসী যদি তারা মুসলমান হয়, তাহলে আর তাদেরকে বাঙালি বলা যাবে না বরং আগন্তুক হিসেবে ভাবতে হবে- এমন উদ্ভট মত পোষণ করত সেকালের বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা। মূলত তাদের মনের মধ্যে জেনোফোবিয়া (বিদেশভীতি) কাজ করত। ফলে আরব থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা ইসলামের প্রভাব ও মাহাত্ম্য তাদের সহ্য হতো না। বাংলাভাষী হোক কিংবা এখানকার স্থানীয় মানুষ হোক, যদি মুসলমান হয়, তাহলে তার বাঙালিত্ব শেষ- এমন ধারণা সাম্প্রদায়িক বৈকি। কারণ ধর্মীয় পরিচয় কিংবা রাজনৈতিক ইতিহাস ও পরিচয় কোনো মানুষ বা জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় বদলাতে পারে না। নৃতাত্ত্বিক পরিচয় প্রাকৃতিক, ফলে অপরিবর্তনীয়।

দেশভাগের সময়ই উপমহাদেশের বাঙালি-অবাঙালি সকল মুসলমানের মুসলিম জাতিসত্তার রাজনৈতিক পরিচয় নির্মিত হয়। আর একাত্তরে বাংলাদেশের মুসলিম বাঙালিরা পাকিস্তানি ফ্যাসিবাদ ও জুলুমতন্ত্রের প্রতিরোধ করে নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করে। একাত্তরের এই সশস্ত্র গণলড়াই ছিল ফ্যাসিবাদ ও শোষণ থেকে জাতীয় মুক্তির রাজনৈতিক লড়াই। অথচ আজ একশ্রেণির বাম সেক্যুলাররা বলছেন, ‘একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা’র জন্যই নাকি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল! হা হতোস্মি! ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বললে, একাত্তরে যদি মুসলিম জাতিসত্তার পরিচয় ত্যাগ করে সেক্যুলারিজমকে মনেপ্রাণে আমরা চাইতাম, তাহলে আজকে তো ভারত থেকে আমাদের আলাদা থাকার কথা ছিল না।

তাছাড়া হিন্দুত্ববাদীদের আগ্রাসী সাম্প্রদায়িক আচরণের অনিবার্য ফসল দেশভাগ। দেশভাগ না হলে পাকিস্তান হতো না, আর পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মলাভের রাজনৈতিক পরিণতিও আসত না। ইতিহাসের এই বাস্তব সমীকরণ অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে উগ্র সেক্যুলার গোষ্ঠীর নির্জলা মিথ্যাচার ও বিকৃতি মূলত ইসলামবিদ্বেষপ্রসূত। দেশভাগ ও বাংলা ভাগের সময়ই আমাদের রাজনৈতিক আত্মপরিচয়ের ভিত্তি নির্মিত হয়েছিল। তাই আমাদের মুসলিম জাতিসত্তার পরিচয় শুধু ধর্মীয় নয়, ভূ-রাজনৈতিক পরিচয়েরও মূল ভিত্তি। এজন্যই ভারতের অঙ্গরাজ্য কলকাতার বাঙালি অধিবাসীদের সাথে আমাদের ভাষাগত নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য থাকলেও আমাদের স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় ও ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণের ফলেই আমরা জাতিরাষ্ট্র হিসেবে তাদের থেকে আলাদা। আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের অধিকারী।

সেক্যুলারিজমের মুখোশধারী এবং হিন্দুত্ববাদের ধারক বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই নব্য মুৎসুদ্দীরা আজ বাংলাদেশের বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর মুসলিম জাতিসত্তার আত্মপরিচয় বিনাশকল্পে বিভিন্ন হিন্দুধর্মী পৌত্তলিক রিচুয়্যাল আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। এ যেন আমাদের মুসলিম জাতিসত্তা ও আত্মচেতনার কেবলাকে হাজার বছরের পুরনো পৌত্তলিক হিন্দুত্বের দিকে প্রত্যাবর্তন (ঘার ওয়াপসি) করানোর এক মহাযজ্ঞ! অথচ এই বঙ্গীয় সেক্যুলাররা এতই অদূরদর্শী যে, তারা বুঝতে চায় না- এই মুসলিম জাতিসত্তার রাজনৈতিক পরিচয় পরিত্যাগ করে সেক্যুলারিজম গ্রহণপূর্বক রবীন্দ্রনাথ-প্রস্তাবিত ‘হিন্দুরূপী মুসলমান’ হলে আমাদের চারপাশ ঘিরে থাকা ব্রাহ্মণ্যবাদ ও নয়া আধিপত্যবাদের আগ্রাসন আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও স্বাতন্ত্র্য হরণপূর্বক জাতিরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশকে একটি করদরাজ্যে পরিণত করবে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Email: [email protected]