তাকওয়া অর্জনের খোদায়ি ট্রেনিং রমজান

“হজরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, নবীয়ে কারিম (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও এহতেসাবের সাথে রমজান শরীফে ‘সিয়ামুন্নাহার’ পালন করবে তার অতীত অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমান ও এহতেসাবের সাথে রমজান শরীফে ‘কিয়ামুল্লাইল’ পালন করবে তারও অতীত জীবনের গুনাহসমূহ মার্জনা করে দেয়া হবে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি কদরের রজনীতে দণ্ডায়মান থাকবে তারও পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ প্রমার্জন করা হবে।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

ইলমুল হাদিস
যে জ্ঞানের সাহায্যে আমরা রাসূল (সা)-এর কথা, কাজ ও অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারি তাই ইলমুল হাদিস। কুরআনের পরে সকল প্রকার জ্ঞানের মধ্যে ইলমুল হাদিসের বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মুহাদ্দিসগণ নবী কারিম (সা)-এর মত সাহাবীদের কথা ও কাজকে হাদিসের ইলমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন এমনকি তাবেয়িদের কর্মকাণ্ড ও রায়কে এর মধ্যে শামিল করা হয়েছে। মুহাদ্দিসগণের রায় এই যে, নবীয়ে কারিম (সা)-এর কথা ও কাজকে হাদিসে মারফু, সাহাবীদের কথা ও কাজকে হাদিসে মাওকুফ এবং তাবেয়িদের কথা ও আমলকে মাকতু বলা হয়।

হাদিস সঙ্কলন
হিজরি তৃতীয় শতকের শুরুতে মুসলিম জাহানের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা হাদিসে রাসূল (সা) এর মানিক রতনগুলো সংগ্রহ, যাচাই ও বাছাই এবং সঙ্কলনের এক কঠিন কাজ সম্পাদিত হয়। অনেক মুহাদ্দিস তাদের জীবনকে এ দায়িত্বের জন্য উৎসর্গ করেছেন। তাদের মধ্যে (১) ইমাম আহমদ, (২) ইমাম বুখারী, (৩) ইমাম মুসলিম, (৪) ইমাম তিরমিযী, (৫) ইমাম নাসাঈ, (৬) ইমাম ইবনে মাজাহ, (৭) ইমাম আবু দাউদের নাম উল্লেখযোগ্য। তাদের সকলের মধ্যে যিনি সবচেয়ে হাদিস বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন ও বিশেষজ্ঞ তিনি মুহাম্মদ বিন ইসমাইল বুখারী (রহ)। যাঁর সম্পর্কে তার যোগ্য ছাত্র প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ ইমাম মুসলিমের উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন-
“আমার উস্তাদ ইমাম বুখারী (রহ) ছিলেন সমগ্র পৃথিবীর সকল মুহাদ্দিসের নেতা ও উস্তাদতুল্য, তিনি ছিলেন হাদিস রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।”

আলোচিত হাদিসের বিশুদ্ধতা
হাদিস সঙ্কলনের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ যে দু’টি হাদিস গ্রন্থ ‘সহীহুল বুখারী ও মুসলিম শরীফের মধ্যে উক্ত হাদিস গৃহীত হয়েছে। আজকের যুগে সহীহ হাদিস পাওয়া ও চেনা অনেকটা সহজ। কঠিন ও দুর্বহ দায়িত্বটা পালন করেছেন পূর্ববর্তীরা। মুহাদ্দিসদের জানা রয়েছে ইমাম বুখারী (রহ) কোন হাদিসকে সহীহ্ বলার পর তার দিকে সন্দেহের আঙুল উঁচু করা রীতিমত অসাধ্য ব্যাপার। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনি (রহ) বুখারী শরীফের বিখ্যাত তাফসির ‘উমদাতুল কারীর’ ভূমিকায় ইমাম বুখারী (রহ) এর উক্তি উল্লখ করে বলেন-
“আমি প্রত্যেকটি হাদিস সম্পর্কে ইস্তেখারার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা থেকে জ্ঞান হাসিল না করে, দুই রাকাত সালাত আদায় না করে ও হাদিসের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে একটি হাদিসও এ কিতাবে সংযোজিত করিনি।”

এ মহামূল্যবান কিতাবটিকে তিনি কিয়ামতের কঠিন দিনে মুক্তির দলিল হিসেবে পেশ করে বলেন- “আমি এ কিতাবখানি আমার ও আল্লাহতায়ালার মধ্যে নাজাতের দলিল রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি।”
ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (রহ) উভয় মনীষী এ হাদিসখানা মারফু হাদিস হিসেবে ও মুত্তাসিল সনদে সহীহ্ হিসেবে তাদের সহীহ্ হাদিসদ্বয়ে গ্রহণ করেছেন।

সাহেবুল হাদিস
প্রখ্যাত হাদিস বর্ণনাকারী রাসূলুল্লাহ (সা) এর প্রিয়তম সাহাবীদের অন্যতম হজরত আবু হোরাইরা (রা)। তিনি সপ্তম হিজরিতে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আসেন। তাঁর ইলমের পিপাসা ছিল প্রবল ও অতৃপ্ত। লোহার গুঁড়া যেমন চুম্বকের সাথে লেগে থাকে তেমনি তিনি নবুওয়তের মহা চুম্বকের সাথে লেগে থাকতেন। অন্য সাহাবীরা যেখানে ব্যবসা বাণিজ্য বা অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি নিজে বলেন- “আমার মুহাজির ভাইয়েরা ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন আর আমি রাসূলের সাথে লেগেই থাকতাম।” (সহীহ বুখারী)

তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে মায়ের সেবায় নিয়োজিত থাকতেন। জীবিতাবস্থায় মায়ের একাকীত্বের ভয়ে তিনি হজ আদায়ের জন্যও যাননি। তিনি খাইবর, মক্কা বিজয়, হুনাইন ও তাবুকের যুদ্ধে বিশ্বনবীর সাথে ছিলেন। রাসূল (সা) এর ওফাতের পর তিনি হজরত আবু বকর (রা)-এর সাথে জাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে ও ভণ্ড নবীদের দমনের যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন। হযরত উমর (রা) এর যুগে তিনি বাহরাইনের গভর্নর নিযুক্ত হন। দায়িত্ব পালন শেষে যখন ৪ লাখ দিরহাম অর্থ নিয়ে মদিনায় আসেন হজরত উমার (রা)-কে বায়তুলমালের জন্য দেন। হযরত উমার প্রশ্ন করেন, তোমার নিজের জন্য কী এনেছ? তিনি বললেন, ‘‘২০ হাজার দিরহাম।” খলিফা জিজ্ঞেস করেন, কেমন করে এ অর্থ হাসিল করেছ, জবাবে তিনি বলেন ‘ব্যবসার মাধ্যমে।’ আমিরুল মোমেনিন বললেন, “হে আবু হুরাইরা তোমার মূলধন রেখে বাকি সমুদয় সম্পদ বায়তুলমালে জমা দিয়ে দাও।” তিনি রোমানদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ ইয়ারমুকের যুদ্ধে অংশ নেন ও কঠিন ভূমিকা পালন করেন। হজরত উসমান (রা)-এর শাহাদাতের নির্মম ঘটনায় তিনি এতই মর্মাহত হয়েছেন যে এরপর তিনি নির্জনতা অবলম্বন করেন। তিনি অধিক সংখ্যক হাদিস বর্ণনাকারীদের অন্যতম। তাঁর বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ৫,৩৭৪টি এর মধ্যে ৩২৫টি বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারীর বর্ণনা মতে হজরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে হাদিস বর্ণনাকারী আটশরও বেশি।

৫৮ হিজরিতে আবু হুরাইরা (রা) কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। বাঁচার আশা নেই, তাঁর চোখে অশ্রু“, লোকেরা ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, “দুনিয়ার মায়া আমার ক্রন্দনের কারণ নয়, আমি কাঁদছি এই জন্য যে আখেরাতের দীর্ঘ সফরে আমার কোন পাথেয় নেই। আমি জানি না জান্নাত ও জাহান্নামের আমি কোথায় থাকব।” ৭৮ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। মদিনার আমির ওয়ালিদ বিন উৎবা হজরত আবু হুরাইরার জানাজার ইমামতি করেন। আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) তার জানাজায় হাজির ছিলেন। জান্নাতুল বাকির কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

হাদিসের ব্যাখ্যা
হাদিসে রাসূল (সা) এর বিশাল সমুদ্র থেকে আজকে সিয়ামু রমাদানের বিষয়ে হাদিসটি চয়ন করা হয়েছে। এ হাদিসটির মধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচিত হয়েছে-
১. রমাদান শরীফের দিনে সিয়াম পালন এর ফজিলত
২. রমাদানে তারাবিহ ও সেহেরির জন্য রাত জাগরণের গুরুত্ব
৩. মহা সম্মানিত রজনী ‘লাইলাতুল কদরের’ রাতে ইবাদাতের প্রসঙ্গে। আসুন আমরা এক একটি করে আলোচনায় যাই :
“যারা ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে ‘সিয়াম’ পালন করবে তাদের অতীত জীবনের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।”

‘সিয়ামে রমাদানকে’ ইসলামের ৫টি বুনিয়াদি বিষয়ের একটির মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। যে সিয়ামকে আল্লাহতায়ালা অতীত সব জাতির ওপর ফরজ করেছেন আখেরি রাসূলের আনীত কিতাবেও ফরজ যাতে মানুষ তাকওয়ার গুণে ভূষিত হতে পারে।

“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম সাধনাকে ফরজ করা হয়েছে, যা তোমাদের পূর্ববর্তী সকল নবীর শরীয়তে ফরজ করা হয়েছিল যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার।” (সূরা বাকারা : ১৮৩)

‘সিয়াম’ শব্দের অর্থ বিরত থাকা। সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌন প্রয়োজন পূর্ণ করা থেকে বিরত থাকাই সিয়াম। ‘সিয়াম’ পালন একটি উদ্দেশ্যবিহীন ইবাদাত নহে। বরং তা একটি লক্ষ্যে পৌঁছার মাধ্যম মাত্র। আর লক্ষ্য হচ্ছে তাকওয়ার গুণ অর্জন। নবীজি (সা) বলেন, কিছু সিয়াম পালনকারী এমন রয়েছে যারা অনুভূতিহীন, ক্ষুধার কষ্ট ছাড়া সিয়াম তাদের জীবনে আর কিছুই আনে না। মানবজীবন ধ্বংসের ও বিপর্যয়ের মূল কারণ গুনাহ। জলে-স্থলে যত অশান্তি ও গজবের সুনামি আসছে এর মূল কারণের প্রতি আমাদের আজও দৃষ্টি পৌঁছেনি। তা আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘন করা ছাড়া আর কিছু নয়। মানব ইতিহাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যেসব জাতির আসমানি গজবের ভয়াবহতা আঘাত হেনেছে কওমে নূহ, কওমে আদ, কওমে সামুদ, কওমে ইবরাহিম, কওমে শোয়াইব, কওমে লুত এদের সকল জাতিকে নবীগণ পাপাচার থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছিলেন। সীমালঙ্ঘনকারী জাতিগণ নবীদের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে খোদার গজবকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। কিন্তু বিরান হয়ে যাওয়া জনপদের অহঙ্কারী মানুষগুলো বারবার একটি বিষয়কে বুঝেও যেন বুঝেনি। তাদের সম্পদ, প্রাচুর্য, শক্তি, জনবল, হাজার উপায়, উপকরণ ও কলাকৌশল সব কিছু আল্লাহর হুকুমের সামনে এক মুহূর্ত দাঁড়াবার কোন ক্ষমতাই রাখে না। আল্লাহতায়ালা পাপাচারীদেরকে একটি অবকাশ দেন যেন তারা ফিরে আসতে পারে যেমন ইউনুস (আ) এর জাতি ফিরে এসেছিল। সম্ভবত এটাই একমাত্র ব্যতিক্রম জাতি বলে ইতিহাস সাক্ষ্য প্রদান করে। বাকি জাতিরা তো আল্লাহর শাস্তিকে আহবান করেছিল- “তাদের প্রত্যেককে আমি তাদের অপরাধের জন্য শাস্তি দিয়েছিলাম। তাদের কারও প্রতি পাঠিয়েছিলাম প্রচণ্ড সাইক্লোন, কাকেও আঘাত করেছিলাম কানের পর্দা ছিঁড়ে যাওয়ার মত ভয়াবহ আওয়াজ দিয়ে, আবার কাকেও আমি মাটির মধ্যে গেড়ে ফেলেছিলাম, আবার কাকেও মহাপ্লাবন দিয়ে ডুবিয়েছিলাম। আল্লাহ তাদের প্রতি কোন জুলুম করেননি, বরং তারা নিজেরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছিল।” (সূরা আনকাবুত : ৪০)

সুপ্রিয় পাঠক! পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার আগে জীবন পাতা থেকে গুনাহের কাল দাগ মুছে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অপরাধের বোঝা নিয়ে পরকালের কঠিন ঘাঁটিগুলো অতিক্রম করা কঠিন হবে। নবী কারিম (সা) বলেন, “সিয়াম পালনে যত্নশীল যারা সিয়ামই আদের জীবন থেকে গুনাহের কালিমা মোচন করবে।”

এক হাদিসে রাসূল (সা) বলেন, ‘সিয়াম’ আমাদেরকে গুনাহ থেকে এভাবে নিষ্পাপ করে দেবে যেমন নবজাতক সন্তানকে তার মা নিষ্পাপ অবস্থায় প্রসব করে। ” (নাসাঈ)

সিয়াম যেন কঠিন এক তাওবাহ যা আমাদের কলুষমুক্ত জীবন গঠনে সাহায্য করে। যারা জীবনের গুনাহের জং তুলে দিতে পারে আর জীবনকে করতে পারে নির্মল ও অমলিন। সে সিয়ামটির দু’টি বৈশিষ্ট্য এ হাদিসে রয়েছে- যারা ঈমান ও এহতেসাবের সাথে সিয়াম পালন করে তাদের সকল গুনাহ ক্ষমা করা হবে। এবার বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাই।

ক. ঈমান : যা সমস্ত নেক আমলের বুনিয়াদ। যা হৃদয়ে না থাকলে কোন ইবাদাত গ্রহণ করা হবে না। নবুওয়তের জীবনে বেশির ভাগ সময় এ ঈমানের জন্য ব্যয় হয়েছে। ইহা নবীগণের দাওয়াতের মূল বিষয়। এই বিশ্বাসকে হৃদয়ে বদ্ধমূল করে নিতে হবে। আর ঈমানকে দৃশ্যমান জগৎ থেকে তুলে গায়েবের ওপর প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ গায়েব হচ্ছে ইন্দ্রিয় যাকে আয়ত্তে আনতে পারবে না। আর তা আল্লাহ তায়ালা যিনি সকল শক্তির আধার, যিনি কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক। এ ঈমানের সাথে প্রতিনিয়ত সম্পর্ক রেখে সিয়াম পালন করতে হবে। ঈমান ব্যতিরেকে ‘সিয়াম’ পালন মানে সিয়ামের নামে শুধু উপবাস করা, সিয়াম যখন আল্লাহর হুকুম হিসেবে পালিত হবে। যখন তা আল্লাহতায়ালার অলংঘনীয় বিধান হিসেবে ঈমান এনে পালন করা হবে তখনই ‘সিয়াম’ ইবাদতের মধ্যে গণ্য হবে।

খ. ইহতেসাব : ইহতেসাবের সাথে সিয়াম পালনের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। ইহতেসাবের অর্থ হিসাব নিকাশ ও আত্মবিশ্লেষণসহ সিয়াম পালন করা। তার অর্থ অনুভূতিসহ ও হাকিকত উপলব্ধি করে সিয়াম পালন করা। কোন ইবাদাতের মূল উদ্দেশ্য না বুঝে, হাকিকতকে না জেনে পালন নিছক আনুষ্ঠানিকতা বৈ আর কিছু নয়। ‘ইহ্তেসাব’ হচ্ছে সিয়ামের জীবনতুল্য। তাছাড়া সিয়াম পালন একটি নিঃপ্রাণ, অর্থহীন, পানাহার বর্জন করার কসরত। অনুভূতিহীন ও ইহতেসাববিহীন সিয়ামকে ক্ষুধার্ত পিপাসার কষ্ট বলা হয়েছে- “নবীজি (সা) বলেন, এমন কতেক সিয়াম পালনকারী রয়েছে, যারা সিয়ামের নামে শুধু উপবাসের যাতনাই ভোগ করে।”

কী প্রয়োজনে একটি নির্দিষ্ট সময় সুবহে সাদেক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সমস্ত হালাল খাদ্য ও পানিয়কে হারাম করা হলো, নিজ স্ত্রীর সাথে সহঅবস্থান ও মিলনকে বর্জন করা ফরজ করা হলো এর কারণ উপলব্ধিসহ সিয়াম পালনই ইহ্তেসাবের সাথে সিয়াম করা।

আমরা জানি ‘নফস’ সর্বদা আমাদেরকে সীমালংঘন ও গুনাহের প্রতি বাড়াবাড়িতে লিপ্ত করতে চায়। কোন কিছুই যেন নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। নফসের চাহিদা হচ্ছে উৎকৃষ্ট খাদ্য পানীয় ও যৌন মিলন। একটি মাত্র ইবাদাত ‘সিয়াম’ যা নিয়ন্ত্রণহীন এ নফসের মুখে লাগাম কষে দিতে পারে। কারণ নফস শুধু উপবাসের নিকট অসহায় ও আতত্মসমর্পণ করতে পারে। এ অনুভূতিসহ সিয়াম পালন করলে তা অসংখ্য কল্যাণের মুখ খুলে দেবে। ঐ সিয়াম পালনকারীর হায়াতের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেবে আর মৃত্যুর পর পরম সুখের জান্নাতে দাখিল করা হবে।

হাদিসের দ্বিতীয় অংশের ব্যাখ্যায় যেতে চাই- “যারা ঈমান ও ইহ্তেসাবের সাতে রমজানের রাতে জাগরণ করবে তাদেরও জীবনের গুনাহ খাতা মাফ করে দেয়া হবে।” হাদিসের এ অংশে রমজানের রাত জাগরণের ফজিলত আলোচনায় উঠে এসেছে।

এমনিতে রাতের শেষে জাগরণ ও তাহাজ্জুদের বিষয় বিশুদ্ধ হাদিসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে- “প্রতিরাতের শেষাংশে আল্লাহতায়ালা পৃথিবীর নিকটতর আসমান থেকে জমিনের দিকে ঘোষণা দেন, হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের মধ্যে কোন কিছু পার্থক্য করার আছে কি? আমি তোমার আবেদন মঞ্জুর করব।

তোমাদের মধ্যে গুনাহ মাফ চাওয়ার কেউ আছে নাকি? আমি গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেব। আমার নিকট কোন কিছু কেউ আছে নাকি আমি তা তোমাকে দান করব।” (সহীহ বুখারী)

প্রিয় পাঠক! রমজানের প্রতিটি মুহূর্ত সময় অতি মূল্যবান। যেখানে লাখ লাখ নফল ইবাদাত একত্র করলে একটি ফরজের সমান হবে না কিন্তু রমজান শরীফের একটি নফল ইবাদাত অন্য মাসের একটি ফরজের সমান।

এ মাসের ক্ষুদ্র এবাদত অন্য মাসের পাহাড়ের তুল্য। তাই এ মাসের সময় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ পবিত্র ও পূণ্যবান মাসের সময় অপচয় হতে দেয়া যাবে না । প্রতিটি মুহূর্ত সময় পরিকল্পিতভাবে ব্যয় করতে হবে। এক ফিরিস্তা প্রতিনিয়ত এ মাসের গুরুত্ব ও ইবাদত বন্দেগিতে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে ঘোষণা দিতে থাকে।

হাদিস শরীফে এসেছে- “হজরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত নবী করিম (সা) বলেন, রমজানের চন্দ্র উদয় হলে আসমান থেকে এক ফিরিস্তা জমিনের দিকে ঘোষণা করে হে নেক আমলের ইচ্ছা পোষণকারী তোমরা উঠ ও কোমর বাঁধ, হে পাপাচারী তোমরা সংযত হও । জাহান্নাম থেকে মুক্তির সময় আসন্ন, পুরা রমজান মাস তা চলতে থাকে।” (তিরমিজি)

প্রিয় পাঠক! এ মাসের দিনে যেমন সিয়াম সাধনায় নিরন্তর ব্যস্ত থাকতে হবে তেমনি রাতকেও ইবাদাতের জন্য জাগ্রত রাখতে হবে। এশারের সালাত আদায় শেষে দীর্ঘ ২০ রাকাত সালাতুত তারাবিহ তাও খতমে কুরআনের সাথে আদায় করতে হবে। অল্প সময়ের নিদ্রা শেষে আবার উঠতে হবে সেহেরি খাওয়ার জন্য এর পর সালাতুত্ তাহাজ্জুদ চলবে ফজর সালাতের পূর্ব পর্যন্ত। এভাবে পুরো রমজানের ৩০টি রাত ইবাদাতের ব্যস্ততায় কাটাতে হবে। প্রতিটি সালাতুল মাকতুবা আদায় করতে হবে জামায়াতের সাথে। নিরন্তর কুরআন তেলাওয়াত ও অধ্যয়নে দিন ও রাত কাটাতে হবে, অপ্রয়োজনীয় ও অপবিত্র কথা বলা থেকে জিহ্বা এবং কাজ করা থেকে স্বীয় অঙ্গকে হিফাজত করতে হবে। মোদ্দাকথা একটি কঠোর রুটিনের মধ্যে রমজানের প্রতিটি দিন ও রাত অতিবাহিত করতে হবে। নবীয়ে কারিম (সা) বলেন, রমজানে যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহ্তেসাবের সাথে রাত জাগরণ করে আল্লাহতায়ালা তার সমগ্র জীবনের গুনাহ মাফ করে দেবেন। তবে ঈমান ও ইহ্তেসাব ব্যতিরেকে এ রাত জাগরণ অর্থহীন। হাদিস শরীফে এসেছে-

“অনুভূতিহীন অনেক রোজাদার রয়েছে তাদের রোজা শুধু ক্ষুধার যাতনা ভোগ করা, আর অনুরূপ এমন কিছু রাত জাগরণকারী আবেদ আছে তাদের রাত জাগরণ বা কিয়ামুল লাইল অনিদ্রার কষ্ট ভোগ করা ছাড়া আর কিছু লাভ হয় না।” (দারামী শরীফ)

হাদিসে রাসূল স্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন দিনের সিয়াম বা রাতের কিয়াম ইবাদাত গ্রহণযোগ্য হওয়ার শর্ত ঈমান বা ইহতেসাবের সংযোগ, তা ছাড়া সবকিছু অর্থহীন। ইতঃপূর্বে ঈমান ও ইহ্তেসাব বিষয়ে বিস্তারিত না হলেও মোটামুটি আলোচনা হয়েছে। তাই এখানে পুনরাবৃত্তি থেকে বিরত রইলাম।

হাদিসের তৃতীয় অংশের ব্যাখ্যায় যেতে চাই
“যে ব্যক্তি লাইলাতুল ক্বাদরের পবিত্র রাতে ঈমান ও ইহ্তেসাবের সাথে রাত জাগরণ করবে আল্লাহতায়ালা তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবে।” এই কদরের রজনী অতি পূণ্যবান, মহা পবিত্র একরাত। যে রাতে আল্লাহর আখেরি কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এ রাতের বুজুর্গির ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে সূরা অবতীর্ণ হয়েছে।

“নিশ্চয়ই আমি কুরআনকে কদরের রাতে নাজিল করেছি। তোমরা কি জান ক্বদরের রাত কি? তা এক সহস্র মাসের চেয়ে অধিক মর্যাদাবান। (সূরা ক্বাদর : ১-৩)

এ এক রাতের ইবাদত এক সহস্র মাসের নিরস্তর ইবাদাতের সমষ্টির চেয়ে বেশি। কুরআনুল কারীমেও হাদিসে রাসূলের দিকে দৃষ্টিপাত করলে সহজে অনুমেয় হবে এই কদরের মূল্যবান রজনীর চেয়ে অধিক সম্মানিত ও মূল্যবান কোন সময় কালের ইতিহাসে নেই, ছিল না, হবে না। এ রাতের এক মুহূর্ত সময়ের মধ্যে শত শত বছর ঘুমিয়ে রয়েছে। এ রাতের অšে¦ষণে রাসূল কারিম (সা) পরিবার পরিজন ছেড়ে দিয়ে মদিনার মসজিদে এতেকাফ করছেন এবং ইবাদাতের কঠোর সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন। হাদিস শরীফে এসেছে- “হজরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা) কে রমাদানের শেষ ১০ দিন-রাত কঠোর ইবাদাতের সাধনায় নিয়োজিত দেখা গেছে এমনটি অন্য সময় দেখা যায়নি। (মুসলিম শরীফ)

সে মহান রাতটি সঠিকভাবে স্পষ্ট নয়, তবে বিশুদ্ধ হাদিসের ভাষ্যমতে তা রমজানের শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতের মধ্যে। নবীয়ে করিম (সা) বলেন, “তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে শবে ক্বদর অন্বেষণ কর।” এ মহান রাতে হজরত জিবরাইল ফিরিশতাদের দলসহ পৃথিবীতে অবতরণ করেন। (সহীহ বুখারী)

“লাইলাতুল কদরের রজনীতে একদল ফিরিশতাসহ জমিনে অবতরণ করেন তারা রাত জাগরণকারী ইবাদাতে মশগুল বান্দাদের সাথে মোসাফাহ করেন, তাদের জন্য দোয়া করেন ও তাদের মুনাজাত কবুল হওয়ার জন্য ‘আমিন’ বলেন এবং ফজর পর্যন্ত তা চলতে তাকে।” (বায়হাকী শরীফ)

এ সময়ে লায়লাতুল কদরের পবিত্র রাতের অন্বেষণে নবীয়ে করিম (সা) নিজ বাড়িঘর ছেড়ে রমজানের শেষ দশদিন মসজিদে নববীতে এতেকাফ করতেন। হাদিস শরীফে রয়েছে “একদিনের এতেকাফে জাহান্নামকে তার থেকে তিন খন্দক দূরে নিয়ে যায় আর এক খন্দক এর দূরত্ব আকাশ ও জমিনের ব্যবধান।” (তিবরানী)

এ মহান রাতে বান্দাদের কী করা উচিত সূর্যাস্ত থেকে ভোর হওয়া পর্যন্ত রাতের সময়।
নবী কারিম (সা) লাইলাতুল ক্বদরের জন্য কী কঠিনভাবে ইবাদাত করেছেন।

হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত, “রমজানের শেষ দশকের রাতগুলোতে নবী কারিম (সা) তাঁর পায়জামার রশি মজবুত করে বেঁধে নিতেন, নিজে সারা রাত সালাতে দণ্ডায়মান থাকতেন ও আহলদেরকে জাগিয়ে দিতেন।” (সহীহ বুখারী)

তাই উম্মতের নর-নারীকে এ রাতসমূহে জাগ্রত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। আর প্রতি মুহূর্ত সময়কে অপচয় না করে বন্দেগিতে লিপ্ত থাকতে চেষ্টা করতে হবে।

দণ্ডায়মান করতে হবে দীর্ঘ কিয়ামের সাথে সালাত আদায়ে, আর যে কুরআনকে বেশি তিলাওয়াত ও অধ্যয়নে ব্যস্ত থাকবে আর নিজের ও গোটা উম্মতের জন্য চোখের পানিতে সিক্ত দোয়া ও মুনাজাত করবে এবং গুনাহ ক্ষমা চেয়ে আল্লাহর দরবারে তাওবাহ ও ক্রন্দনে রাত শেষ করবে। হযরত আয়েশা (রা) নবী করিম (সা) কে জিজ্ঞাসা করেন , “আমি যদি লাইলাতুল ক্বাদরের রাত পেয়ে থাকি তবে আমি আল্লাহর কাছে কী চাইব? নবীজি (সা) উত্তরে বলবে তুমি বলবে “হে প্রভু! তুমি বান্দাদের ক্ষমা কর তাই আমাকে ক্ষমা কর।” (আহমদ)

সুপ্রিয় পাঠক! পূর্বে আলোচনায় এসেছে গাফেলদের ইবাদাত, অনুভূতিহীনদের সিয়াম ও কিয়ামের প্রতি আল্লাহতায়ালা নজর করেন না। এ হাদিসের মধ্যেও পূর্বের শর্তটি সংযুক্ত হয়েছে। যারা শবে কদরের পবিত্র রজনীতে ইবাদাত পালন করে ঈমান ও ইহ্তেসাব সহকারে তাদের জীবনের সমস্ত অপরাধসমূহ আল্লাহতায়ালা মার্জনা করে দেন। তাই ঈমান ও আত্মবিশ্লেষণ সকল ইবাদাত মকবুল হওয়ার জন্য অপরিহার্য এক বিষয়।

হাদিস থেকে শিক্ষণীয় বিষয়
১.‘সিয়ামকে আল্লাহতায়ালা উম্মতে মুহাম্মদী (সা)-এর উপর ফরজ করেছেন যেমন পূর্বের নবীদের উম্মতের ওপর ফরজ করেছেন।
২.সিয়াম সাধনাকে আল্লাহতায়ালার নিকট গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হলে তা ‘ঈমান’ ও ‘ইহতেসাবের’ সাথে পালন করতে হবে।
৩.মকবুল সিয়াম আমাদের জীবন থেকে গুনাহের সমস্ত কালিমা মোছন করে দেবে।
৪.রমজান শরীফের প্রতিটি মুহূর্ত অতি মূল্যবান। একটি কঠিন পরিকল্পনার মাধ্যমে সময় অপচয় রোধ করতে হবে।
৫.এ মাসে কঠোরভাবে ইবাদাত পালনে যেমন সচেষ্ট হতে হবে তেমনি পাপাচার থেকে তাওবাহ করে ফিরে আসতে হবে।
৬.এ মাসের গুরুত্বপূর্ণ রাত লাইলাতুল কদরকে রিয়াজতের মাধ্যমে নিরন্তর ইবাদাতে কাটাতে হবে।
৭.এ মাস কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার মাস, তাই কুরআনকে তিলাওয়াত ও অধ্যয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে বানাতে হবে।
৮.এ মাসে যাদের জীবন পাপমুক্ত হবে না অথচ রমজান বিদায় হবে তাদের ব্যাপারে নবীয়ে কারিম (সা) অভিসম্পাদ দিয়েছেন।

উপসংহার
যে পাঁচটি খুঁটির ওপর ইসলামের বিশাল প্রাসাদ দাঁড়িয়ে রয়েছে তার অন্যতম স্তম্ভ সিয়াম। তা অতিব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ইবাদাত। তা তাকওয়া অর্জনের খোদায়ি ট্রেনিং। কোন ইবাদাত আল্লাহ ভীতিকে মানব মনে এইভাবে বদ্ধমূল করে না সিয়াম প্রতিটি মুহূর্কে খোদাভীতিকে যেভাবে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করে। একজন রোজা পালনকারী ভয়ানক তৃঞ্চার্ত অবস্থায় পানির দরিয়ায় ডুব দেয়, ইচ্ছা করলে পানি পান করতে পারে একান্ত সংগোপনে কিন্তু শুধু আল্লাহর ভয় ছাড়া কেউ রুখতে পারবে না। এ প্রশিক্ষণ চলতে থাকে প্রতি মুহূর্তে? প্রতিটি ১০ দিন করে ৩ বার লাগাতার এ ট্রেনিং চলতে থাকে। আবার গোটা বিশ্বের প্রতিটি জনপদে মুসলমানদের জীবনে এ তরবিয়াত চলে এক সাথে। একটি স্বর্গীয় আবহ যেন চারদিকে বহমান থাকে। মানুষের জীবনে যত প্রকার পাপাচার রয়েছে সমস্ত সীমালংঘনের মূল উৎস নফসের বাড়াবাড়ি। শয়তানের বড় এজেন্ট হচ্ছে ‘নফসে আম্মারা’। একে বশীভূত করতে না পারলে বিপর্যয়ের পর বিপর্যয় শুধু আমাদেরকে গ্রাস করবে। সিয়াম খাদ্য পানীয় ও জৈবিক দাবি পূরণে বিরত থাকার লাগাম কষে দিয়ে নফসকে আল্লাহর নির্দেশের নিকট ঝঁৎৎবহফবৎ করতে বাধ্য করে। উপবাস ছাড়া আর কোন কিছু নফসকে এমনি বশীভূত করতে পারে না। অসংযত নফসকে সিয়ামের লাগাম কষে নিয়ন্ত্রণের খাঁচায় বন্দি করি।

প্রিয় পাঠক! রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে মাহে রমজান আমাদের মাথার ওপর ছায়া বিস্তার করছে। আমরা একটি কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি আর অবগাহন করি রহমতের অতল সমুদ্রে। একটি মানুষের সমগ্র জীবনের নফল ইবাদাত যোগ করলে একটি ফরজ ইবাদাতের সমান হবে না অথচ এ মাসের একটি নফল একটি ফরজের বরাবর এ সুযোগ জীবনে আর হয়তো পাব না এ কথা স্মরণে নিয়ে আসুন আমরাই ইবাদাতের জন্য কোমর বাঁধি। জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে তাকাতে ভয় লাগে সেখানে রয়েছে আল্লাহর নাফরমানি, পাপাচার ও গুনাহের বাড়াবাড়ি। মাহে রমজান নিয়ে এসেছে মাগফিরাতের অফুরন্ত সুযোগ। সেহেরি, তাহাজ্জুদ, তারাবিহ, ইফতার ও কদরের প্রতিটি সময়ে ক্ষমা ও নাজাতের সুসংবাদ এসেছে আল্লাহর কিতাব ও নবীজি (সা) এর বিশুদ্ধ হাদিসে। মা সন্তানকে যেভাবে নিষ্পাপ অবস্থায় জন্ম দেয় রাসূল (সা) বলেন, সিয়াম সেভাবে নিষ্পাপ করে দেয় রোজাদারকে। রমজান ছাড়া আর কোন মাসে পাপ মার্জনার এ দুর্লভ সুযোগ নেই। এ সুযোগ সে হাতছাড়া করেছে তার জন্ম না হলে যেন ভাল ছিল। নবীজি (সা) তার ওপর লা’নত বর্ষণ করেছে, অভিষাপ দিয়েছে সাইয়্যেদেনা জিবরিল। ‘হে প্রভু! আমাদেরকে নাজাত প্রাপ্তদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করুন।’

আমরা জানি এ মাসে কুরআন নাজিল হয়েছে। অবাক হওয়ার বিষয় আল্লাহর সমস্ত আসমানি কিতাব এ মাসে নাজিল হয়েছে বলে হাদিসের সমর্থন রয়েছে। এ মাসের এত মর্যাদার কারণও যেন কিতাবের নাজিলে। যে কুরআন নাজিল হওয়ার কারণে এ মাস হলো এত ধন্য, নাজিলের রজনী হলো হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আমরা অনেকে জীবনের এতটা বছর পেরিয়ে এসেওে আল্লাহর অবতীর্ণ মহামূল্যবান ও অমর এ কিতাবটি আজও পড়া হলো না, জানা হলো না এর অতলান্ত রহস্যাবলি মানা হলো না এর হালাল ও হারামের বিধান। আর নয়, এবারের রমজানে আল কুরআন ও কাগজ কলম নিয়ে বসে যাই, শুরু করি গভীর অধ্যয়ন।

এতেকাফের ১০ দিন সময় শুধু কুরআনের সাথে থাকি। যে কথাটি না বলে ইতি টানতে পারছি না, মাহে রমজান সহানূভূতি ও সহমর্মিতার মাস। ক্ষুধার্ত মানুষের বেদনা কত তীব্র তা আমরা এ মাসে অনুভব করতে পারি। আমাদের প্রিয় দেশের ৫০ ভাগের চেয়ে বেশি মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বাস করে। কোটি কোটি মানুষ বিনা চিকিৎসায় কাতরাচ্ছে। শুধু অপুষ্টিতে অসংখ্য শিশু অন্ধ হয়ে জন্ম নিচ্ছে। সামর্থ্যবানদেরকে তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে সিয়াম আমাদের চেতনাকে পীড়ন দিচ্ছে। সদকা ও জাকাত তাদেরকে সুন্দর জীবন গঠনে ও দরিদ্র বিমোচনে বড় অবদান রাখতে। তাই বলতে চাই আত্মগঠনে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে মানবিকতার বিকাশ সাধনে সিয়াম আমাদের জীবনে আসুক আলোর বন্যা হয়ে। স্বাগতম হে মাহে রমজান।