ইসলামের মাধ্যমে আত্মার শান্তি খুঁজে পেয়েছিলে যে তারকা

জার্মান নারী ক্রিশ্চিয়ানি ব্যাকার। ছোটকাল থেকেই ছিল শিল্পকলার প্রতি অত্যাধিক আগ্রহ। তিনি তার জীবনের প্রথম ২০ এর দশকে ‘এমটিভি ইউরোপ’ এর একজন উপস্থাপক হিসেবে তার স্বপ্নের মধ্যই বাস করছিলেন। মাইক জগের এবং বনো’র মতো সেলিব্রিটিদের সঙ্গে নিয়মিত অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। বাইরে থেকে দেখলে, তিনি যা কিছু আশা করেছিলেন তার সবই পেয়েছেন। কিন্তু ভেতরের দিকে, কখনো কখনো বিষণ্নতা ও নিষ্পেষণের অনুভূতি তাকে প্রচণ্ড হতাশ করে দিত।
এরপর হঠাৎ করে তিনি বিখ্যাত পাকিস্তানি ক্রিকেটার ইমরান খানের সান্নিধ্যে আসেন। ইমরান খান তাকে সঙ্গীতের মাধ্যমেই ইসলামের আলোয় নিয়ে আসেন এবং আধ্যাত্মিক শান্তির এক নতুন ধারণা দেন।

ক্রিস্টিয়ান বেক্যারের বই ‘এমটিভি থেকে মক্কা: ইসলাম যেভাবে আমার জীবনে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে’ এর কভার পেজ

ইমরান খান সম্পর্কে ক্রিশ্চিয়ানি ব্যাকার বলেন, ‘তিনিই ছিলেন আমার ইসলামের প্রথম সূচনা। আমি বলতে চাই, আমি এটি দেখতে পাইনি, আমি এটি খুঁজে পেয়েছি।’

একজন জার্মান হিসেবে ব্যাকার হ্যামবুর্গে বেড়ে ওঠেন। তিনি সবসময়ই শিল্পকর্মের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। ইমরান খানের আমন্ত্রণে লাহোরে একটি ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে তিনি পাকিস্তান সফর করেন। ওই সফরে তিনি সুফি ইসলামের সুর-সঙ্গীত ‘কাওয়ালি’ গানের সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। একজন শিল্পানুরাগী হিসেবে এর সৌন্দর্য খুব স্বাভাবিকভাবেই তাকে আকৃষ্ট করে।
তিনি এর প্রতি এতটাই বিমোহিত হয়ে পড়েন যে, এসব গানের প্রতিটি কথা, প্রতিটি কণ্ঠস্বর তার কাছে মনে হত যেন প্রেমের এক উচ্চতর বিন্যাসের সঙ্গে সংযুক্ত; যেটি মানুষের মধ্যে অনুভূত হতে পারে না।
ব্যাকার বলেন, সঙ্গীতের পাশাপাশি পাকিস্তানি জনগণের মানবতাবোধ, আতিথেয়তা, উষ্ণতা তাকে খুব বেশি স্পর্শ করেছে। তিনি জানান, যে সমস্ত লোকের কাছে তিনি অর্থ সাহায্যের জন্য গিয়েছিলেন, তাদের আর্থিক অবস্থা যাই হোক না কেন, ইমরানের দাতব্য প্রকল্পের জন্য সহায়তা করতে তারা খুবই আন্তরিক ছিল।
তিনি বলেন, “আমরা পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ি দরিদ্র এলাকার জনগণের সঙ্গে সাক্ষাত করেছি। তারা অত্যন্ত উদারতার সঙ্গে আমাদের স্বাগত জানায়।’
তিনি বলেন, ‘একেবারে ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত অনেক পুরুষ ইমরানের হাসপাতালের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তারা তাদের সাধ্যমত এই তহবিলে কিছু রুপি দান করেন। নারীরা তাদের গহনা বের করে এনে তা হাসপাতালে জন্য দান করেন।’

আমি বলতে চাই, আমি ইসলামকে দেখতে পাইনি, আমি তা খুঁজে পেয়েছি।

ব্যাকারের মনে সশ্রদ্ধ ভয় ছিল। তার বিনোদন শিল্প জীবনের অভিজ্ঞতা, বিশেষত পশ্চিমা পপ সঙ্গীতের বহিরঙ্গ এবং পাকিস্তানে তার প্রত্যক্ষ করা আত্মিকতার মনোভাবের মধ্যে যে পার্থক্য তা তাকে বিস্মিত করে।
চূড়ান্তভাবে ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে তিনি তিন বছর সময় নেন। পাকিস্তানে তার ওই সফরের পর থেকে তার মনকে সেতারের তারের মতো আঘাত করতে থাকে। পরে ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা করতে শুরু করেন তিনি।
ইমরান খানের ক্রমাগত উন্মুক্ত করা তার ধর্ম ও জীবনধারার সঙ্গে পরিচিত হতে তিনি অনেক দিন সময় নেন। পরে তিনি স্বীকার করেন, এটি তার আধ্যাত্মিকতা জাগ্রত করতে তাকে সাহায্য করে এবং এর মধ্য দিয়ে তিনি জীবনের একটি উপায় আবিষ্কার করেন; যার সঙ্গে তিনি সত্যিকার অর্থে নিজেকে খুঁজে পেতে পারেন।
তিনি বলেন, ‘আমি ইমলাম নিয়ে অনেক বই পড়েছি এবং আমি যা আবিষ্কার করেছি তা ছিল অবাক করার মতো চিন্তাকর্ষক। এটি ছিল আমার কাছে সম্পূর্ণ একটি নতুন মহাবিশ্বের মতো। ইসলাম নিয়ে আমার পড়া প্রথম বই আমাকে দারুনভাবে মুগ্ধ করে এবং এ বিষয়ে আরো জানতে আমাকে উৎসাহিত করে। আমি বুঝতে পারি… ঈশ্বর একজনই … এবং আমরা আমাদের নিজেরদের কর্মের জন্য নিজেরাই দায়ী। শিশুরা জন্ম নেয় পবিত্র হয়ে, পাপীদের মতো নয়। … এছাড়াও আমি শিখেছি কোরআনের আয়াতসমূহ কিভাবে দৈনন্দিন জীবনে আমাকে সাহায্য করতে পারে।’
এসব কিছুই ব্যাকারকে দারুনভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
ব্যাকার বলেন, ‘সত্যি বলতে আমি এসবে অত্যন্ত দৃঢ়প্রত্যায়ী হয়ে ওঠি। আমি ধর্মান্তরিত হয়েছি কারণ ঈশ্বরকে আমি আমার জীবনের মধ্য আনতে চেয়েছি এবং আমি আমার নিজেকে আত্মিকতার মাধ্যমে শুদ্ধ করতে চেয়েছি।’
কিন্তু ব্যাকারের ইসলামের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধির মতোই কিছু একটা তার জীবনকে আবারো বদলে দেয়। তিনি ইমরান খানকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আকস্মিকভাবে তাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় এবং পরে ইমরান খান অন্য এক নারীকে বিয়ে করেন।
সেই সময়ে ইসলামের ব্যাখ্যা বুঝার মতো প্রত্যক্ষ ক্ষমতা ব্যাকারের ছিল না। ওই সময় তিনি ইমরান এবং তার ধর্মের বিরুদ্ধে পশ্চাদপসরণ করতেই পারতেন এবং তাতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। কিন্তু ইসলামকে অগ্রাহ্য করার পরিবর্তে তিনি তা আকঁড়ে ধরেন এবং অবশেষে ধর্মান্তরিত হন।
ইসলাম ব্যাকারের মনে স্বস্তির সুবাতাস নিয়ে আসে। একই সঙ্গে ইমরান খানের পিছুহটা ও ঘটা করে অন্য নারীকে বিয়ে ইত্যাদি বিষয়ে সম্মানিত থাকার শক্তি প্রদান করে। একজন ব্যক্তিকে ভালবাসার মাধ্যমে উদ্ভূত আবিষ্কারের যাত্রা; শাশ্বত ভালবাসা আবিষ্কারের যাত্রায় পরিণত হয়। আর সেটি হল আল্লাহ।
ব্যাকারের নতুন গৃহীত বিশ্বাস তার চাকচিক্যময় পপ আইকন ওয়ার্ল্ডের জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে; যেখানে পূর্বে তার কাছে মনে হতো সমাজে তার স্থান অনিশ্চিত। তিনি ইসলামের মাধ্যমেই ইউরোপীয় সংস্কৃতির অর্থ খুঁজে পান। তার জীবনে এখন আর কোনো কালো মেঘ নেই; বিভ্রান্তি এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এতদিনে কেটে গেছে।
এক কঠিন প্রস্তরময় ধর্মান্তর 
ব্যাকারের বয়স এখন ৫১। জার্মানিতে ইসলামে ধর্মান্তরিতদের মধ্য অত্যন্ত সুপরিচিত একটি মুখ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তার ধর্মান্তরের বিষয়টি তার বাড়ির সবাই ভালভাবে মেনে নেয়নি।
ব্যাকার বলেন, ‘সবাই যখন জানতে পারে যে আমি একজন মুসলিম, তখন আমার বিরুদ্ধে একটি নেতিবাচক প্রচারাভিযান চালানো হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি ছিলাম একজন পুরস্কার বিজয়ী টিভি উপস্থাপক। সাত বছর ধরে উপস্থাপনা করার কারণে বলতে পারেন আমি ছিলাম অত্যন্ত জনপ্রিয় আইকন এবং হঠাৎ করেই আমাকে সন্ত্রাসীদের সমর্থক হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। খুব শিগগিরই আমার সব টিভি অনুষ্ঠান থেকে আমাকে বরখাস্ত করা হয় এবং বাস্তবে জার্মানিতে আমি আমার পেশাগত কর্মজীবনকে হারাই।’

এটা ভালো হয় যদি আপনি আপনার পেট দেখান এবং মিনিস্কার্ট পরেন, কিন্তু লম্বা কাপড় এবং হিজাব পরা কি ভাল? ওটা ভুল।

এই প্রতিক্রিয়া ব্যাকারকে বিস্মিত করে। কারণ তিনি কেবলই তার মুসলিম জীবনে শালীনতা বৃদ্ধির অনুভূতি উপভোগ করছিলেন।
তিনি বলেন, ‘প্রথমত আমি আমার পোশাকে সামান্য পরিবর্তন আনি। আমি মিনিস্কার্ট পড়া ছেড়ে দেই। এতে আমি নিজেকে আরো নারীবাদী অনুভব করলাম।’
‘আমি যে শিল্পে কাজ করছিলাম যেখানে নীতি ছিল: ‘যদি আপনি আপনার নিজেকে খোলামেলাভাবে প্রদর্শন করতেন।’
তিনি বলেন, ‘আর এখন আমি শালীনতার ধারনা সম্পর্কে বুঝতে শিখেছি। আপনি জানেন, এটি (হিজাব) প্রকৃতপক্ষে নারীদেরকে অধিক বেশি সম্মানিত করে। এটি নারীর সম্পদের আবরণ এবং সবাইকে দেখানো থেকে তাদের বিরত রাখে।’
কিন্তু অন্যরা তার আকস্মিক বিশ্বাস পরিবর্তনকে বুঝতে পারে নি। মুসলমান নারীদের বিভ্রান্তির বিষয়টিকে তিনি ছলনা বলে মনে করেন।
‘এটা ভাল হয় … যদি আপনি আপনার পেট দেখান এবং মিনিস্কার্ট পরেন। কিন্তু লম্বা কাপড় ও হিজাব পরিধান করা কি আসলে ভাল? ওইটা ভুল।’
তার বাবা-মাও ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচলিত ভুল ধারণাকে বিশ্বাস করেন এবং যদিও তার ধর্মান্তর সত্ত্বেও তারা তাকে ভালোবাসতো, তবুও তারা তাকে ইসলাম থেকে ফেরাতে অনেক সংগ্রাম করেছিল।
এমটিভি ইউরোপের উপস্থাপক থাকাকালীন সময়ে আইরিশ গায়ক-গীতিকার বব জেলডফের সাক্ষাত্কার নিচ্ছেন ব্যাকার।
ব্যাকার বলেন, ‘ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের বেশ কিছু গুরুতর বিদ্বেষ ছিল, বিশেষ করে মুসলিম পুরুষদের বিরুদ্ধে। আমাদের সম্পর্ক শেষ করে দেয়ার জন্য ইমরানের গৃহীত পন্থা নিয়েও তাদের বিদ্বেষ ছিল।’
অতীতকে স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমি তাদের বুঝানোর চেষ্টা করেছি যে, আমি আমার নিজের জন্য ধর্মকে আবিষ্কার করেছি এবং নিজেই এটিকে নিজের জন্য তৈরি করেছি । ইমরান কেবল আমার জন্য দরজা খুলে দিয়েছিল … আমার বাবা এমনকি ‘সর্বেশ্বরবাদ’ শব্দটিও উল্লেখ করেছেন। তার মতে, মুসলমানেরা পুরো পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণে নিতে চেয়েছিল। ঘটনাক্রমে তিনি আমাকে ইসলাম সম্পর্কে কথা বলা বন্ধ করতে বলেন এবং তারপর থেকে বিষয়টি বাড়িতে নিষিদ্ধ হয়ে যায়।’
এই প্রতিক্রিয়া তাকে এখনো হতাশ করে। ব্যাকারের অভিজ্ঞতায়, জার্মান পরিচয় ইসলামি পরিচয় থেকে আলাদা নয়। তাই কেন তাকে এই দুইয়ের মধ্যে বাছাই করতে হবে?
তিনি বলেন, ‘জার্মান হওয়ার অর্থ এই নয় যে, তাকে বিয়ার পান করতে হবে এবং তাকে জাতীয়তাবাদী হতে হবে। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি এবং জানি, ইসলামিক মূল্যবোধ কেবল জার্মান মূল্যবোধের সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এটি ইউরোপীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সাধারণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইসলাম হচ্ছে সব সময় এবং সমস্ত বিশ্বের জন্য একটি ধর্ম এবং আমাদের প্রজন্মের ও বয়সের ইউরোপীয়দের জন্যও। আমি হচ্ছি তার বাস্তব প্রমাণ এবং তার আগে জার্মানরা এটি প্রমাণ করেছে।’
ইসলাম ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়ার সময় তিনি কেবল জোহান উলফগ্যাং ভন গেটে, মার্টিন হেইডেগার এবং জোহান ক্রিশটফ ফ্যাদরিচ ভন শিলারের পদচিহ্ন অনুসরণ করেছিলেন। জার্মান চিন্তাবিদরা ফার্সী কবি জালালুদ্দিন রুমী ও হাফিজসহ পাশ্চাত্য ও ইসলামিক গ্রন্থের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছেন।
কিন্তু ব্যাকারের নিজের দৃঢ়তা তার বাড়ির অনুভূতিতে পরিবর্তন করতে পারেনি এবং তার নিজের জন্য অনেক জার্মানদের দরজাই বন্ধ দেখতে পেয়েছেন। জার্মানিতে তার কর্মজীবনকে উদ্ধার করা কঠিন হবে উপলব্ধি করে তিনি লন্ডনে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন; যেখানে তিনি ১৯৮৯ সালে ‘এমটিভি ইউরোপ’ এর উপস্থাপনা শুরু করেন এবং বসবাস করেছেন।
ইংল্যান্ডে ব্যাকার তার গৃহীত ধর্মীয় পরিচয়ের একটি বিরাট অভ্যর্থনা পেয়েছে। সমগ্র ইউরোপ জুড়ে অব্যাহত ইসলামভীতি সত্ত্বেও, যুক্তরাজ্যজুড়ে মুসলমানরা অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত গ্রুপ।
তিনি জানান, এটি মূলত এ কারণে যে ইংল্যান্ডে মুসলমানরা প্রায়ই শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের জন্য দেশটিতে আসে, অন্যদিকে যখন তারা জার্মানিতে প্রবেশ করে ঐতিহাসিকভাবে তারা অতিথি শ্রমিক হিসেবে আসেন।
‘আমি সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করি এবং জানি, ইসলামি মূল্যবোধ শুধু জার্মান মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তা সাধারণত ইউরোপীয় মূল্যবোধের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।’
কিন্তু এখানে মুসলমান হিসাবে জীবন-যাপন পুরোপুরি সহজ নয়, বিশেষ করে ধর্মান্তরিতদের জন্য। ব্যাকার জানান, সাধারণভাবে মুসলমানদের মধ্যে একটি সম্প্রদায়ের অনুভূতি রয়েছে, যা ধর্মান্তরিতদের অনেকটাই আলাদা করে দেখা হয়। ফলে ধর্মান্তরিতরা একাকী অনুভব করে।
তিনি বলেন, ‘আমরা হচ্ছি সংখ্যালঘুদের মধ্যে সংখ্যালঘু। আমরা কোথায় গিয়ে প্রার্থনা করব তা নিয়ে চিন্তা করতে হয়। আমরা কোন মসজিদ যাব- পাকিস্তানি, ফার্সি বা তুর্কি মসজিদে?’
প্রাথমিকভাবে ব্যাকারকে ইংল্যান্ডের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে তার স্থান খুঁজে পেতে লড়াই করতে হয়েছে। এটা ছিল একটি জাতিগত গ্রুপের উপর প্রতিবন্ধকতা। এছাড়াও, তিনি বন্ধু তৈরি করতে পারেন নি এবং রমজানের সময় তার উপবাস ভাঙ্গার জন্য তার কাছে পরিবার ছিল না। একজন ধর্মান্তর হিসাবে তার অবস্থান তাকে বহিরাগত হিসেবে চিহিৃত করেছিল। তবে, আজকের দিনে ব্যাকার এসব খুব কমই অনুভব করেন। তিনি যেখানে বসবাস করেন তার কাছাকাছি এলাকায় বহুসংস্কৃতির একটি ক্ষুদ্র মসজিদ গড়ে ওঠেছে এবং তিনি নিয়মিত তার বন্ধুদের বৃহৎ গ্রুপের সঙ্গে সেখানে ইফতার করেন।
ধর্মান্তরের জন্য ব্যাকারকে অনেক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া মোকাবেলা করতে হয়েছে এবং এই প্রতিকূলতাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে তার সক্ষমতা একটি আন্তঃধর্মীয় সেতু হিসেবে কাজ করছে। ইসলাম নিয়ে মিডিয়াতে কথা বলার জন্য তাকে আরো বেশি দৃঢ়সংকল্প করেছে।
রিজেন্ট পার্ক মসজিদে ঈদের নামাজ শেষে বের হয়ে আসছেন ব্যাকার
ব্যাকারের কাছে এটি শুধু গতানুগতিক লড়াই নয়, বরং দেখাচ্ছে কিভাবে তার দৈনন্দিন জীবন ইউরোপীয় জীবনের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং তিনি আশা করেন পশ্চিমের অন্যান্য মুসলমানরাও অনুরূপভাবে তা অনুসরণ করতে পারেন।
পশ্চিমা সমাজে একত্রিত হতে সংগ্রাম করা মুসলিমদের উদ্দেশ্য তিনি বলেন, ‘আপনি আপনার কাজ করে যান। ভাল কাজের জন্য মানুষ আপনাকে প্রশংসা করবে। আপনি যাই কিছু করেন না কেন আপনাকে মনে রাখতে হবে- আপনি কেবল আল্লাহর দাস নয়, ইসলামের একজন দূতও।’
কিন্তু ব্যাকার জানেন যে, মুসলমানরা তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাল কাজ করতে পারে। এ পর্যন্ত মিডিয়ার একজন সদস্য হিসাবে তিনি পশ্চিমা সংস্কৃতিতে মুসলিমদের আরো শক্তিশালী এবং আরো নির্ভুলভাবে উপস্থাপনের জন্য এডভোকেসির দায়িত্ব পালন করছেন।
ইসলামভীতির আলোকে তিনি বলেন, মুসলিম সংস্কৃতি নিয়ে ডকুমেন্ট তৈরি করতে হবে এবং এতে মুসলমানদের চরিত্রের প্রতিফলন ঘটাতে হবে এবং তা প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
ইসলাম ও মুসলমানদের আরো সঠিক প্রতিনিধিত্বের জন্য তিনি তার বিশ্বাসের যাত্রা সম্পর্কে একটি বই প্রকাশ করেন। বইটির নামকরণ করা হয়ছে ‘ফ্রম এমটিভি টু মক্কা: হাউ ইসলাম ইন্সপায়ার মাই লাইফ’ বা এমটিভি থেকে মক্কা: ইসলাম যেভাবে আমার জীবনে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে’। বইটিতে ব্যাকার ইউরোপীয়দের দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, তাদের দেখা সন্ত্রাস ও নির্যাতনের খবরের বাইরে অধিকাংশ মুসলমান প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষ, তাদের সমাজের জন্য ফলদায়ক সদস্য।
এবং ইতোমধ্যে তিনি এর ফলাফল দেখতে পেয়েছেন। ইউরোপে ইসলামের পক্ষে একজন মুখপাত্র হিসেবে তার নতুন ভূমিকায় জার্মানিতে তার উন্নতির দিকে কিছু দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করেছেন।
ব্যাকার জানান, তারপরেও ইসলামের প্রকৃত ভবিষ্যত নির্ভর করছে সম্প্রদায়ের যুবকদের উপর। তার ওপর নয়।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইসলাম যে একটি আধুনিক ধর্ম তা বিশ্বকে জানানোর দায়িত্ব তরুণ মুসলিমদের নিতে হবে এবং মানুষকে দেখাতে হবে যে, এটি পশ্চিমের সঙ্গে পশ্চাদপদ নয় কিংবা অসঙ্গত নয়।
ব্যাকার বলেন, ‘ইউরোপে ইসলাম হচ্ছে সামান্য জীবাশ্মমাত্র এবং এটিকে এগিয়ে নিতে তরুণদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। একইসঙ্গে ইসলামের উৎস সন্ধানে সমসাময়িক এবং শাস্ত্রীয় পন্ডিতদের মাধ্যমে ধর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অধ্যয়ন করতে হবে এবং তারপর শুধু মূলধারার সমাজকেই শিক্ষিত করলে হবে না, তরুণদের সঙ্গে তাদের নিজের মা-বাবাকেও শিক্ষিত করতে হবে। কারণ আমি আপনাদের বলছি, যখনই আমি শুনি যে এখানকার তরুণ মুসলিমরা তাদের বিশ্বাস হারাচ্ছে, তখন সেটি আমাকে সবসময়ই হতাশ করেছে।’

এটা হচ্ছে অন্য মানুষের বন্ধুত্ব; এজন্য মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে। যেভাবে আমি মুসলিম হয়েছি। কারণ আমি মুসলমানদের উদারতা ও বন্ধুত্বের দ্বারাই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি।

 ‘এটা হচ্ছে অন্য মানুষের বন্ধুত্ব; এজন্য মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে।’ তিনি বলেন। ‘এভাবেই আমি মুসলিম হয়েছি। কারণ আমি মুসলিমদের উদারতা ও বন্ধুত্ব এবং তাদের বিস্ময়কর আচরণ দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছি।’
পশ্চিমা মুসলিমদের প্রতি তার পরামর্শ- ‘কেবল আপনার নিজের মুসলিম বুদবুদে পশ্চাদপসরণ করবেন না…মূলধারার সমাজের সঙ্গে মিশ্রিত হোন।’
তিনি বলেন, ‘পশ্চিমের প্রফেশনাল মুসলমানরা হঠাৎ যদি তাদের অফিসে তাদের নামাজের মাদুর নিয়ে আসেন এবং নামাজ ও রমজানের রোজা রাখা শুরু করে দেন, তবে সহকর্মীরা ইসলামের প্রতি উন্মুক্ত হবেন এবং এভাবেই তারা এটিকে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারবে।’
সবশেষে ব্যাকার বলেন, ‘ইসলামের সুন্দর মূল্যবোধ এবং আমাদের মহান নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর শিক্ষার অনেক কিছুই পশ্চিমাদের কাছে এখনো অজানা। সময় এসেছে সেই শিক্ষার পর্দাটি তাদের কাছে তুলে ধরার।’
ব্যাকার ইউরোপ এবং মুসলিম বিশ্বের মধ্যে একটি সেতু
-হাফিংটন পোস্ট অবলম্বনে