মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা

ড. মোহাম্মদ আতীকুর রহমান

‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে / আসে নাই কেহ অবনী পরে, / সকলের তরে সকলে আমরা / প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’ -কামিনী রায়

মহানবী সা: বলেছেন, ‘সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। সমগ্র সৃষ্টির ভেতর আল্লাহর কাছে অধিকতর প্রিয় সেই ব্যক্তি যে তার পরিবারের (সৃষ্টির) প্রতি দয়ালু।’ তিনি আরো বলেন, মানুষের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ যে মানুষের উপকার করে।

প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তিনবারের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ইন্তেকালের পর তার কুলখানির মেজবানে কমিউনিটি সেন্টারে ভিড়ের চাপে পদদলিত হয়ে ১০ জনের মৃত্যুর ঘটনাটি মর্মান্তিক। এমন করুণ মৃত্যু মেনে নেয়া সত্যিই কঠিন। পদপিষ্ট হয়ে ১০ জনের মৃত্যু ছাড়াও ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন। তাদের মধ্যে চারজনের অবস্থা গুরুতর। আমরা এ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় গভীরভাবে মর্মাহত ও শোকাহত। যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবার ও স্বজনদের প্রতি রইল আন্তরিক সমবেদনা।

শ্রদ্ধেয় মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানির অনুষ্ঠানে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল, তদন্তের মাধ্যমে তা বিশদভাবে জানা যাবে হয়তো। কিন্তু যারা চলে গেলেন তাদের আমরা আর ফিরে পাবো না সত্য, কিন্তু ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় তার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবশ্যই সজাগ দৃষ্টি রাখবেন বলে আমরা আশা করব। নিহতদের পরিবারের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করা সম্ভব না হলেও তাদের পরিবার যাতে অন্যের দয়ার ওপর নির্ভর না করে তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা সরকার ও শ্রদ্ধেয় মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করি। আশা করব, নিহতদের পরিবার সর্বাত্মক সাহায্য পেয়ে কিছুটা হলেও সান্ত¡না লাভ করবে। আর যারা আহত হয়ে হাসপাতালে আছেন, তাদের সুচিকিৎসার ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

ইসলাম অমুসলিম নাগরিকদের প্রতি যে মানবতা প্রদর্শন করেছে তা সত্যিই অতুলনীয়। এ ধর্মে প্রত্যেক অমুসলিম নাগরিকের মর্যাদা ও অধিকার অক্ষুন্ন রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিধর্মীরাও ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে। আল্লাহ বলেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে জোরজবরদস্তি নেই।’ (সূরা বাকারা : ২৫৬)। ‘তাদের ধর্ম তাদের জন্য আর আমার জন্য আমার ধর্ম।’ (সূরা কাফিরুন : ৬)। মূলত রাষ্ট্রে প্রত্যেকেই যে যার ধর্ম পালনের অধিকার রাখে, সর্বাত্মক নিরাপত্তাসহকারে বসবাস করতে পারবে। তাদের জান ও মাল রক্ষা করা রাষ্ট্রীয় কর্তব্য।

মহানবী সা: শিখিয়েছেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা বা এলাকা নির্বিশেষে মানুষের কল্যাণ কামনা করা। এককথায়, মানবপ্রেমে উদ্ভাসিত হওয়া ও মানুষ তথা সৃষ্টির সেবা করা। বর্তমান বাস্তবতায় পীড়াদায়ক হচ্ছে, ধর্ম-বর্ণ-জাতিভেদ, ভাষা, রঙ ও জাতিগত কারণে হত্যা, লুণ্ঠন এমনকি মা-বোনদের সম্ভ্রমের ওপর আঘাত করছে। তার মানে পৃথিবীর মানুষেরা প্রায়ই নিজ ধর্ম সঠিকভাবে পালন করছে না। কেননা কোনো ধর্মই তো মানুষের অকল্যাণে কোনো নির্দেশ দেয় না। কারণ ধর্ম মানুষের জন্য, মানুষ ধর্মের জন্য নয়। যে ধর্ম মানুষের কল্যাণ সাধন করে না, তা অন্য কিছু হতে পারে, ধর্ম হতে পারে না।

মানুষ যদি তার কর্ম ও সাধনায়, সেবায় ও ইবাদতে ঐকান্তিক না হয়। যদি কোনো হীন স্বার্থবুদ্ধি বা অন্য কোনো মানুষের প্রশংসা প্রাপ্তি তার জীবনের লক্ষ্য হয়, তাহলে মনুষ্যত্বের সাধনায় ও আল্লাহর পথে চলার সচ্ছলতা হারিয়ে যায়। মানবতা যেন মাঝপথে বিচ্যুত না হয়, প্রবৃত্তির ওপর বিজয়ী না হয়, পার্থিব জ্ঞান যেন নববী জ্ঞানের ওপর কর্তৃত্ব না করে সে জন্য মানুষকে সদা সতর্ক থাকতে হবে। মানবতার সাধনা, মনুষ্যত্বের পথপরিক্রমা বড় পিচ্ছিল বিধায় মানুষকে বিনয়ী হতে হবে। আহঙ্কার ও আত্মম্ভরিতা মানুষকে বিপথে নিয়ে যায়। মানবতার অধঃপতন হয়। আল্লাহর অধীনতাই প্রকৃত মানবতা বিকশিত হয়। বিশ্বনবী সা: শুধু একটি সর্বাত্মক ভারসাম্যপূর্ণ ও গতিশীল মানবতাবাদের শুভসূচনা করেননি, তিনি দেখিয়েছেন কী করে এটি সব ধরনের বিচ্যুতি, অপূর্ণতা ও সঙ্কট মোকাবেলা করে চির বহমান থাকে।

ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এই বিশ্বে মহানবী সা:-এর মানবপ্রেমের অনুসরণ ও বাস্তবায়ন নিতান্তই প্রয়োজন ও অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। যার মাধ্যমে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, রঙ ও ভাষা নির্বিশেষে মানবসমাজে সহনশীলতা, সমবেদনা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও প্রেম স্থাপিত হতে পারে। আমরা যেকোনো বর্ণ, গোত্র বা স্থানের অধিবাসী হই না কেন আমরা সবাই তো এক আল্লাহর সৃষ্টি এবং এক মাতা, পিতা হজরত আদম আ: ও হাওয়া আ:-এর সন্তান। এই নীতি বা আদর্শের ওপর ভিত্তি করেই বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এটাই ছিল মহানবী সা:-এর মানবপ্রেমের ভিত্তি। মানবপ্রেম তথা সৃষ্টিপ্রেম ছাড়া কোনো মতেই স্রষ্টার প্রেম অর্জন করা যায় না। তাই মহানবী সা:-এর মানবপ্রেমের আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমেই শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে শান্তি স্থাপন করা সম্ভব।

মহিউদ্দিন চৌধুরীর মেজবান খেতে গিয়ে যে ১০ জন বনি আদম মারা গেলেন তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি ও যারা আহত হয়েছেন তাদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। সাথে সাথে আশা করছি, ভবিষ্যতে এ ধরনের অনুষ্ঠানে আয়োজক ও কর্তৃপক্ষ সতর্ক থাকবেন। এমন দুঃখজনক ঘটনার অবতারণা যেন আর না হয়। কারণ একজন ব্যক্তির দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু একটি পরিবারকে সারা জীবনের জন্য কষ্টে ফেলে দেয়। তাই আমাদের সতর্ক হওয়া একান্ত প্রয়োজন।

লেখক : গবেষক