মুসলিম উম্মাহঃ সমস্যা ও আমাদের করনীয়

প্রফেসর ডঃ মেহমেদ গরমেজ
আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন, ওয়াস-সালাতু ওয়াস-সালামু আ’লা মুহাম্মাদিন ওয়া আ’লা আলিহি ওয়া আহসাবিহি আজমাইন। আমাদেরকে শুন্য থেকে অস্তিত্ব দানকারী, আমাদেরকে আমাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিতকারী, আমাদেরকে মুসলিম উম্মাহর একজন গর্বিত সদস্য হিসেবে সৌভাগ্যদানকারী, ইসলাম পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার তওফিক দানকারী মহান প্রভুর আল্লাহ রাব্বুল আ’আলামীনের দরবারে লাখো-কোটি শুকরিয়া জ্ঞাপণ করছি।

সম্মানিত উপস্থিতি এবং সামনে উপবিষ্ট সুপ্রিয় শিক্ষকমণ্ডলী:
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সকলকে কেবলমাত্র তার সন্তুষ্টির জন্য ইখলাস ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করার তওফিক দান করুণ। আমাদেরকে সকল প্রকার প্রদর্শনেচ্ছা, প্রপাগান্ডা থেকে দূরে থাকার তওফিক দান করুণ। নবী করীম (সঃ) ইরশাদ করেছেন- “যে তার কোন মুসলমান ভাইয়ের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ায় না, সে তাদেরদলভুক্ত নয়’। মুসলিম উম্মাহর সমস্যায় ও তাদের দুঃখ কষ্টে আপনারা শরীক হয়েছেন বলে এবং মুসলিম উম্মাহর প্রবাহিত রক্ত বন্ধ করার জন্য আপনারা প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বলে আপনাদের সকলের প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে একজন মুসলমানও যদি নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন আমাদেরকে তাদের পাশে থাকার তওফিক দান করেন।

আজকে আমরা মুসলিম বিশ্ব বুঝাতে- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা ভৌগলিক কোন পরিচয়কে ধর্তব্যের মধ্যে নিয়ে আসব না। আজকে আমার এই আলোচনায় মুসলিম বিশ্ব বলতে- কোন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল কিংবা কোন ভৌগলিক অঞ্চল কিংবা কোন দেশ সম্পর্কে কথা বলব না। মুসলিম পরিচয় ধারণকারী সকল মু’মিন ভাইদেরকে নিয়ে আজকে কথা বলব।

‘ইসলামী বিশ্ব’ এই পরিভাষাটি আমাদের সভ্যতার তৈরিকৃত কোন পরিভাষা নয়। ‘ইসলামী দুনিয়া’ বা ‘মুসলিম বিশ্ব’ এই পরিভাষাটি এই শতাব্দীর শুরুতে তৈরিকৃত একটি পরিভাষা। তারা (পাশ্চাত্য) এই পারিভাষিক শব্দের মাধ্যমে আমাদেরকে নির্দিষ্ট একটি ভুখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায়। অথচ আল্লাহর কিতাব অনুসারে, পবিত্র কোরআনের মতে, “সমগ্র দুনিয়াই হল ইসলামের”। ইসলাম একটি নির্দিষ্ট ভুখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখার মত কোন দ্বীন নয়। আমাদের রব বিশ্বজাহানের রব। আমাদের প্রিয় নবীকে সমগ্র বিশ্বজাহানের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করা হয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে সমগ্র বিশ্ব জাহানই হল ইসলামের। সমগ্র দুনিয়াই ইসলামের। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, أَفَغَيْرَ دِينِ اللَّهِ يَبْغُونَ وَلَهُ أَسْلَمَ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا
“এখন কি এরা আল্লাহর আনুগত্যের পথ (আল্লাহর দীন) ত্যাগ করে অন্য কোন পথের সন্ধান করছে ? অথচ আকাশ ও পৃথিবীর সবকিছুই স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আল্লাহর হুকুমের কাছে সমর্পণ করেছে”।

এই সমর্পণ (تسلمية) কে আমরা কেবলমাত্র দুইভাগে ভাগ করতে পারি। একটা হল স্বেচ্ছায় সমর্পণ (تسلمية) আর অপরটি হল অনিচ্ছায় সমর্পণ (تسلمية)। আয়াতের শাব্দিক অর্থ করলে আমরা দেখতে পাই, সমগ্র মহাবিশ্বই মুসলমান। সমগ্র মহাবিশ্বই ইসলামের। ইসলামকে কেবলমাত্র ছোট একটি ভৌগলিক অঞ্চলের মধ্যে, ছোট্ট একটি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ করে রাখা এবং শুধুমাত্র সে অঞ্চলকে মুসলিম বিশ্ব বলে আখ্যায়িত করা সম্ভব নয়। প্রসিদ্ধ ভুল হিসেবেও যদি আমরা কোন একটি নির্দিষ্ট ভুখণ্ডের জন্য, কোন এক ভৌগলিক অঞ্চলের জন্যও যদি ব্যবহার করি তাহলে আমরা মুসলিম বিশ্ব বলতে কোন অঞ্চলটিকে বুঝাচ্ছি?

হিজাজ অঞ্চলকে কি বুঝাচ্ছি?
নাকি বিলাদি শাম (শাম অঞ্চল) বা বিলাদী ইরাক (ইরাক অঞ্চল) কে বুঝাচ্ছি?
শুধু কি মধ্যপ্রাচ্যই ইসলামী বিশ্ব?
OIC র ৫৭ টি সদস্য রাষ্ট্র রয়েছে। শুধু কি এই ৫৭ টি রাষ্ট্র ইসলামী বিশ্ব?
ল্যাটিন অ্যামেরিকাতে বসবাসকারী ৭০ লক্ষ মুসলমানকে আমরা কোথায় রাখব?
রাশিয়াতে বসবাসকারী ৫ কোটি মুসলমানকে আমরা কোথায় রাখব?
চীনে ও চীনের উইঘুর অঞ্চলে বসবাসকারী মুসলমানদেরকে কোন বিশ্বের সাথে সম্পৃক্ত করব?
কেবল মাত্র উইঘুর মুসলমানগণ যে ভূমিতে বসবাস করেন, তার পরিমান পাঁচটি ফ্রান্সের সমান! তাদেরকে আমরা কোথায় রাখব? তাছাড়া হাইতি থেকে ডমিনিক প্রজাতন্ত্র পর্যন্ত, কিউবা থেকে ব্রাজিল পর্যন্ত, ভিয়েতনাম থেকে জাপান পর্যন্ত, দুনিয়ার সকল প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এবং অন্তরে ইসলামের আলোকে সম্মানের সাথে ধারণকারী মু’মিন ভাইদেরকে কি আমরা ইসলামী বিশ্বের (عالم اسلامي) বাহিরে বলে বিবেচনা করব? আসলে মুসলিম বিশ্ব কোথায়?

বর্তমান সময়ে চারটি পরিভাষাকে এক সাথে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
১। মুসলিম দেশ সমূহ,
২। ইসলামী রাষ্ট্র সমূহ,
৩। ইসলামী অঞ্চল,
৪। মুসলিম বিশ্ব

এই প্রতিটি পরিভাষাতেই সমস্যা রয়েছে। যে সকল রাষ্ট্র ইসলামী আইন ও কানুন অনুসারে পরিচালিত হয় সে সকল রাষ্ট্রকে কেউ কেউ ইসলামী রাষ্ট্র বলে থাকেন। শুধুমাত্র সংবিধানে লেখাটাই কি যথেষ্ট? আমি মনে করি- মুসলিম দেশ, মুসলিম অঞ্চল, মুসলিম বিশ্ব এই শব্দ সমূহ মহাগ্রন্থ আল কোরআন আমাদের মুসলমানদের জন্য যে সীমারেখা অঙ্কন করে দিয়েছে তার সাথে যথাযথভাবে খাপ খায় না। যে পরিভাষাটি আমাদেরকে সবচেয়ে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে তা হল ‘মুসলিম উম্মাহ’ । মহান আল্লাহ রাব্বুল

আলামীন বলেছেন,
إِنَّ هَٰذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ
“তোমাদের এ উম্মত আসলে একই উম্মত৷ আর আমি তোমাদের রব৷ কাজেই তোমরা আমার ইবাদাত করো”।
মহান আল্লাহ অন্য একটি আয়াতে বলেন,
وَإِنَّ هَٰذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاتَّقُونِ
“আর তোমাদের এ উম্মত হচ্ছে একই উম্মত এবং আমি তোমাদের রব, কাজেই আমাকেই তোমরা ভয় করো”।

আরবীতে ‘উম্মাতুন’ শব্দটি ‘উম্ম’ শব্দের সাথে একই উৎস (মাসদার) থেকে উদগত। উম্মুন অর্থ হল ‘মা’। আমরা একই মায়ের সন্তান। উম্মাহ হওয়ার অর্থ হল, একই মায়ের সন্তান হওয়া। রক্ত এবং দুধের সম্পর্কের ভাইয়ের চেয়ে ‘ইসলামী ভ্রাতৃত্ব’ কে উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই উম্মাহকে একই সাথে ‘কেন্দ্রীয় একটি উম্মাহ’ হওয়ার দায়িত্বও প্রদান করেছেন। কোরআনের পরিভাষায় ইস্তিখলাফের দায়িত্ব দিয়েছে।

‘কেন্দ্রীয় উম্মাহ’ হওয়ার অর্থ হল দুনিয়ার গতিপথকে নিয়ন্ত্রণকারী উম্মাহ হওয়া। একপাশে ও কেনারায় দাঁড়িয়ে দুনিয়ার ঘটনা-প্রবাহ সমূহের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার নাম কেন্দ্রীয় উম্মাহ নয়।

কেন্দ্রীয় উম্মাহ হল,
وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا
এখানে ব্যবহৃত ওয়াসাত শব্দটিকে ‘মধ্যপন্থা’ বলে অনুবাদ করতে পারি না। ওয়াসাত হল জগতের অক্ষ, বিশ্ব জাহানের কেন্দ্র, এমন একটি উম্মাহ যাদের চতুর্দিকে বিশ্বমানবতা ঘূর্ণায়মান হবে, অর্থাৎ আদিল (ন্যায় পরায়ণ একটি উম্মাহ)। মুসলিম উম্মাহ এমন উম্মাহ, যে উম্মাহ আদালতকে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করে রাখবে। এই আয়াতের ‘ওয়াসাত’ কালিমার উপর ভিত্তি করে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে “মারকাজুল ওয়াসাতিয়্যা সমূহ’’ প্রতিষ্ঠিত হওয়া শুরু হয়েছে। বিভিন্ন চরমপন্থীদের মোকাবেলার নামে ‘লিবারেল ইসলাম সেন্টার’ নামক বিভিন্ন ধরণের প্রতিষ্ঠান সমূহ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে এই আয়াতের উপর ভিত্তি করে। অথচ আয়াতের পরবর্তী অংশে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ‘ওয়াসাত’ শব্দের উদ্দেশ্য (মাকসাদ) কি সেটা আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন।

أُمَّةً وَسَطًا لِّتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ
ইসলামের আদালতকে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করে সমগ্র মানবতার কাছে সাক্ষ্যদাতা হওয়ার জন্য। শহীদ এবং শাহীদ একই সাথে উদাহরণ অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই বিষয়টি অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এভাবে বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ
এই আয়াতের قسط শব্দটি এবং পূর্ববর্তী আয়াতের وَسَطً শব্দটি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সমগ্র পৃথিবীতে আদালত (ন্যায়-বিচার) প্রতিষ্ঠার জন্য, নিজেদের জীবনে আদালতকে বাস্তবায়ন করে আদালতের প্রতীক হয়ে সমগ্র মানবতার সামনে নিজেদেরকে উপস্থাপন করবে এই উম্মাহ। এভাবে তারা খিলাফাত এবং ইসতিখলাফের দায়িত্ব পালন করবে এবং এভাবেই তারা কেন্দ্রীয় একটি উম্মাহ হবে। এর পাশাপাশি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই উম্মাহকে অন্য একটি দায়িত্ব দিয়ে বলেন;
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ
এখন তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম দল৷ তোমাদের কর্মক্ষেত্রে আনা হয়েছে মানুষের হিদায়াত ও সংস্কার সাধনের জন্য ৷

تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ
“তোমরা নেকীর হুকুম দিয়ে থাকো, দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখো”।
এই আয়াতের অর্থ এটা নয় যে, তোমরা নিজেরা ঘরের মধ্যে বসে থেকে অন্যকে ভালো কাজের আদেশ দিবে। تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ এ আমর শব্দটি ক্রিয়াবাচক অর্থে, যা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ হল, তোমরা মারুফের আলোকে জীবন যাপন করবে। ۖ وَمَا أَمْرُ فِرْعَوْنَ بِرَشِيدٍ এই আয়াতে আমর শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হয় উপরোক্ত আয়াতে আমর শব্দটিও একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ۖ وَمَا أَمْرُ فِرْعَوْنَ بِرَشِيد এই আয়াতে আমর শব্দটি আচরণ, কর্ম, এই সকল অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।
أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنسَوْنَ أَنفُسَكُمْ
তোমরা অন্যদের সৎকর্মশীলতার পথ অবলম্বন করতে বলো কিন্তু নিজেদের কথা ভুলে যাও।
এসকল আয়াতের মূল কথা হল- তোমরা নিজেদের জীবনে মারুফকে বাস্তবায়ন করবে আর পৃথিবী থেকে অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার নির্মূল করবে ও দূর করার চেষ্টা করবে।

প্রিয় ভাইয়েরা,
এজন্য আমরা যখন মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের দিকে তাকাই তখন দেখতে পাই, মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের কোথাও মুসলিম বিশ্ব, ইসলামী বিশ্ব, ইসলামী রাষ্ট্র, ইসলামী রাষ্ট্র সমূহ এই সকল শব্দ ব্যবহার করেনি। এই সকল শব্দের পরিবর্তে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন আমাদেরকে মুসলিম উম্মাহ বলে সম্বোধন করেছে। এসকল দিকের বিবেচনায় ফিকাহ শাস্রের ‘দারুল ইসলাম’ শব্দের ক্ষেত্রে আমি নিজে একজন হানাফী মাজহাবের অনুসারী হওয়ার পরেও ইমাম শাফেয়ীর ইজতিহাদকে গুরুত্ত্বপূর্ণ বলে মনে করি। তার মতে- “একটি জমিনে বা একটি ভূখণ্ডে ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে কিয়ামত পর্যন্ত সেই অঞ্চল দারুল ইসলাম”। তাই আমি মনে করি আন্দালুসিয়া এখনো দারুল ইসলাম হিসেবেই আমাদের অন্তরে স্থান দখল করে আছে। সকল মুসলমান যেন কিয়ামত পর্যন্ত এই চিন্তা ও চেতনার আলোকে নিজেদেরকে গড়ে তুলে। কোরআন আমাদের জন্য যে পরিভাষাটি ব্যবহার করেছে বা নির্বাচন করেছে তা হল ‘মুসলিম উম্মাহ’। আজকের ভূগোলবিদরা, স্ট্রাটেজিস্টরা পশ্চিমে মরক্কো, মরিতানিয়া সেনেগাল থেকে শুরু হয়ে পূর্বে চীন-তুর্কিস্তান সীমান্ত পর্যন্ত অঞ্চলকে মুসলিম বিশ্ব বলে আখ্যায়িত করে থাকে। এর মধ্যে ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ সমূহ রয়েছে। যদি আমরা কেবলমাত্র এই অঞ্চলকেই মুসলিম বিশ্ব হিসেবে মনে করে থাকি তাহলে আমাদেরকে এই কথাটি বলতে হবে যে, এই অঞ্চলেই সর্বপ্রথম মানুষ বিশ্বের বুকে পা রেখে তার অস্তিত্বের জানান দেয়। অর্থাৎ পৃথিবীতে মানুষের বংশধারা এখান থেকেই শুরু হয়েছে। হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে মুহাম্মাদ (সঃ) সকল নবী রাসূল গণ মহান আল্লাহর বানী নিয়ে সর্বপ্রথম এই অঞ্চলেই আবির্ভূত হয়েছিলেন। সকল বড় বড় সভ্যতার জন্ম এই অঞ্চলেই হয়েছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার সবচেয়ে বড় বড় নিয়মত সমূহও এই অঞ্চলে দান করেছেন। এই অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশী প্রাকৃতিক সম্পদ মওজুদ রয়েছে। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যাবসায়িক রাস্তাসমূহও এই অঞ্চল দিয়েই বিশ্বের বুকে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ অঞ্চলটি হল সমগ্র দুনিয়ার কালব বা অন্তর। এ অঞ্চল না হলে দুনিয়া তার জীবন প্রবাহকে অব্যাহত রাখতে পারবে না। তাদের কাছ থেকে ধার নিয়ে বলতেছি, এই দুনিয়াই (অঞ্চলটিই) যদি কেবলমাত্র মুসলিম বিশ্ব হয়, তাহলে এই অঞ্চল হল সমগ্র বড় বড় সভ্যতার উৎসমূল। এত গুরত্বপূর্ণ অঞ্চল হওয়ার কারণে কিয়ামত পর্যন্ত এই অঞ্চলের উপর সকলের সতর্ক দৃষ্টি থাকবে। যদি মুসলমানগণ ঐক্যবদ্ধ না হয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের খেলার পুতুল হওয়া থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে না পারে, এই অঞ্চলকে যদি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শক্তি প্রদর্শনের অসুস্থ খেলা থেকে বের করে না আনতে পারে, তাহলে কিয়ামত পর্যন্ত এই অঞ্চলে দ্বন্দ্ব সংঘাত লেগেই থাকবে।

এই অঞ্চলে আজ রক্তাক্ত ভূমিসমূহ রয়েছে। আবার কোন ক্রমে একটু হলেই ব্যান্ডেজ করে হাসপাতালের বেডে শুইয়ে রাখা রয়েছে এমন অঞ্চল সমূহও রয়েছে। ইয়েমেন আজ রক্ত-গঙ্গায় ভাসছে, সিরিয়াতে রক্তপাত এখনো বন্ধ হয়নি, ইরাক তার যখমকে এখনো শুকাতে সক্ষম হয়নি, লিবিয়াতে গৃহযুদ্ধ এখনো বিদ্যমান, মিশর আপাতদৃষ্টিতে তার কিছু যখম শুকাতে সক্ষম হয়েছে, এক কথায় বলতে গেলে পাশ্চাত্যের পরিভাষায় মুসলিম অঞ্চল এখনো বড় বড় সংকটে নিমজ্জিত।

উত্তর দিকে মালাবি-মোজাম্বিক, দক্ষিনে আলবেনিয়া, কাজাকিস্তান, ওজবেকিস্তান এসকল অঞ্চল সহ বিশেষ করে শেষ শতাব্দীতে এই অঞ্চল সমূহ থেকে অন্যান্য অঞ্চল সমূহে অনেক মানুষ অভিবাসিত হয়েছে। এই অঞ্চল থেকে (মুসলিম বিশ্ব নামক এই অঞ্চল থেকে) অনেক মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অভিবাসিত হয়েছে। যুদ্ধ, দারিদ্রতা এবং শিক্ষা গ্রহণের জন্য অনেক মানুষ এই অঞ্চল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অভিবাসিত হয়েছে। শুধুমাত্র নিজেদের বাসভূমি থেকে নির্বাসিত হয়ে অনেক মানুষ বিভিন্ন দেশে বসবাস করা শুরু করেছে। ফিলিস্তিনিগণ, বসনিয়াবাসীগণ, চেচেনিয়াবাসীগণ, ক্রাইমিয়ান তাতারগণ, আহস্কি তারকিশগণ এবং আফ্রিকা থেকে বিশেষ করে পৃথিবীর সকল প্রান্তে শোষিত মুহাজির নামক একটি বড় জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। ফ্রান্সের শোষণের পরে আলজেরিয়া এবং মরক্কো থেকে বিশাল এক জনগোষ্ঠী ফ্রান্সে অভিবাসিত হয়েছে, হিন্দুস্তান এবং পাকিস্তান থেকে ইংল্যান্ড অভিমুখী অভিবাসিত এক বিশাল জনগোষ্ঠী , ইন্দোনেশিয়া থেকে হল্যান্ড অভিমুখী অভিবাসীগণ, আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইউরোপ অভিমুখে যাত্রাকারী জনগোষ্ঠী বিভিন্ন মুসলিম দেশ এবং অঞ্চল থেকে অ্যামেরিকা, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া অভিমুখে যাত্রাকারী অভিবাসীগণকেও সামনে রেখে এই সকল পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

প্রিয় ভাইয়েরা,
আমি আমার সরকারী দায়িত্ব পালনকালে সমগ্র পৃথিবীতে বসবাসকারী সমগ্র মুসলিম উম্মাহ সম্পর্কে আপনাদের সামনে আলোচনা করার চেষ্টা করব। আমি যে সকল মানুষকে একদম কাছ থেকে দেখেছি এবং কাছ থেকে চিনেছি তাদের সম্পর্কে কিছু কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরব।

আমি ৯ টি পয়েন্টে সমগ্র পৃথিবীতে বসবাসকারী মুসলমাদের সম্পর্কে আপনাদেরকে সংক্ষিপ্তভাবে অবগত করার চেষ্টা করব। এই বিষয়টি অনেক বড় হওয়ায়র দরুন অতি সংক্ষিপ্ত ভাবে সারা পৃথিবীতে বসবাসকারী আপনাদের মুসলিম ভাইদের সম্পর্কে ৯ টি পয়েন্টে আপনাদের সামনে মুসলিম উম্মাহর অবস্থানকে তুলে ধরার চেষ্টা করব যেন তা আপনাদের মাথায় এবং অন্তরে একটি চিত্র অঙ্কিত করে দেয়।

এক. রাশিয়া, মধ্য এশিয়া, ককেশিয়া এবং বাল্টিক প্রজাতান্ত্রিক দেশসমূহে বসবাসকারী মুসলমানগণ সম্পর্কে। সরকারী হিসাব মতে রাশিয়াতে প্রায় ৩০ মিলিয়িন (৩ কোটি) মুসলমান রয়েছে। বেসরকারী হিসাব মতে সেখানে মুসলমানদের সংখ্যা আরও অনেক বেশী(কারও মতে ৫ কোটি)। অতীতের পুরাতন ছোট ছোট রিপাবলিকান দেশ সমূহ রয়েছে। যদিও অর্থের দিক থেকে অনেক বড়। তাতারিস্তান কাজান যেটার রাজধানী, চুবাশিস্তান, বাশ কুর্দিস্তান শুধুমাত্র কয়েকটি। আসলে এই অঞ্চল সমূহে ইসলামের প্রচার ও প্রসার এক প্রকারের মুজিজা।

প্রিয় ভাইয়েরা, এই উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে আপনাদের একজন ভাই হিসেবে, খুব গুরুত্ত্বপূর্ণ একটি উপদেশ দিতে চাই। যদিও আপনাদেরকে উপদেশ দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। রাসূলে আকরাম (সঃ) এরপরে বিশেষ করে মক্কা এবং মদীনায় ইসলাম একটি শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর সমগ্র পৃথিবীতে ইসলাম কিভাবে ছড়িয়ে পড়ল এই সম্পর্কে আমাদের সন্তানদেরকে জানানো এবং আমাদের নিজেদের খুব ভালোভাবে জানা উচিত। এটি জ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। ইনতিশারি ইসলাম (ইসলাম প্রচারের ইতিহাস) ওরিয়েন্টালিস্টরা লিখেছে, আমরা এখনো লিখতে পারি নাই। প্রতিটি অঞ্চলে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ইসলামের এক একটি মুজিজা। চীনের পেকিন শহরের একটি মসজিদে আমার খুতবা দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল সে মসজিদটি আজ থেকে ১১০০ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আমি এটা দেখে আশ্চর্যান্বিত হলে সেখানে অবস্থানরত মুসলমানগণ আমাকে বলেন যে, চীনের অন্য একটি অঞ্চলে ১৩০০ বছরের প্রাচীন মসজিদ রয়েছে।

এই কাজান অঞ্চলে আমরা যে অঞ্চলকে তাতারিস্তান নামে অভিহিত করে থাকি, এই ইদিল-ভলগা নদীর পাদদেশে প্রতিষ্ঠিত সর্বপ্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের নাম হল ‘বুলগার ইসলামী রাষ্ট্র’। এই রাষ্ট্রটি ১১৪০ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১১৪০ বছর পূর্বে সেখানে শান-শৌকতে পূর্ণ একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরে কাজান হানলি, ওরদু রাষ্ট্রসহ আরও অনেক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের প্রতিষ্ঠিত সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের গবেষণা করা প্রয়োজন। আফ্রিকাতে ইসলাম কিভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে? একটু পরে ইন্দোনেশিয়া সম্পর্কে আলোচনা করব। ইন্দোনেশিয়াকে আমরা বাহিরে ফেলে রেখে দিয়েছি। কারণ পাশ্চাত্যের ভূগোলবিদদের নামাঙ্কিত মুসলিম বিশ্বের মধ্যে এশিয়া প্যাসিফিকের অঞ্চল সমূহ একটুও স্থান পায়নি। অথচ ২৫০ মিলিয়ন মুসলমান নিয়ে ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম রাষ্ট্র। ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া সহ এদের আশে পাশে ২৬ টির বেশী দ্বীপ-উপদ্বীপ রয়েছে। এই সকল দ্বীপের প্রত্যেকটিতেই মুসলমানগণ রয়েছে।

ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া কিভাবে মুসলমান হল? ইয়েমেনের উপর দিয়ে যাওয়া মুসলমান ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। আমি সব সময় এই কথাটি উল্লেখ করে থাকি। ইসলাম প্রচারের ইতিহাস পড়ার সময় আমি খুব আশ্চর্যান্বিত হয়ে যাই। আমি মনে করতাম যে, পৃথিবীতে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রেখেছে আলেমগণ কিন্তু আমি ইসলাম প্রচারের ইতিহাস পড়ে জানতে পারি যে, পৃথিবীর সকল স্থানে ইসলামের বাণী সর্বপ্রথম পৌঁছিয়ে দিয়েছেন ব্যাবসায়ীগণ। এই সম্মানের মালিক সৎ ব্যবসায়ীগণ। এর কারণ কি? এই উত্তর পাওয়ার জন্য গবেষণা করে যা পাই তা হল, ব্যবসায়ীগণ আলেম-উলামাদের মত আগে ঈমান এবং ইলিম নিয়ে যায় নাই। তারা সর্বপ্রথম হালাল এবং আখলাককে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে ঈমান এবং ইসলামকে নিয়ে যায়।

আগে গিয়েছিল হালাল এবং আখলাক, পরে যায় ঈমান এবং ইসলাম।
আফ্রিকা মহাদেশের দেশ ক্যামেরুন, মোজাম্বিক, সোমালিয়া এবং কেনিয়াতে ইসলাম কিভাবে হাবশিস্তান (ইথিওপিয়া) এর মাধ্যমে প্রচারিত ও প্রসারিত হয়েছিল আমাদের সন্তানদেরকে এইসব কিছু জানানো প্রয়োজন।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সিলেবাসে ২ টি বিষয় থাকা উচিত।
১। সারা পৃথিবীতে ইসলাম কিভাবে প্রচারিত হয়েছে।
২। মুসলিম উম্মাহর বর্তমান অবস্থা।

এই দুটি বিষয় এই জন্য থাকা প্রয়োজন যেন আমাদের সন্তানগণ উম্মাহর চেতনা নিয়ে বেড়ে উঠে। মুসলিম উম্মাহ সম্পর্কে যেন তারা অবগত থাকে। আমাদের প্রিয় কবি নুরী পাকদিলের পাশ্চাত্যের স্মৃতি কথা নামক বইয়ে আফ্রিকা নামে একটি সুন্দর অধ্যায় রয়েছে। তিনি সেখানে বলেন, রাসূলে আকরাম (সঃ) তার এত সাহাবীর মধ্যে বিলাল কে নির্বাচন করার মাধ্যমে আফ্রিকা মহাদেশে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন।

আমরা সকলেই জানি যে OIC সদস্য রাষ্ট্রসংখ্যা ৫৭ টি, এর মধ্যে ২০ টি মুসলিম দেশ আফ্রিকা মহাদেশের। রাশিয়ার বাহিরে মধ্য এশিয়ার তারকিশ রিপাবলিক সমূহ অজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজাকিস্তান, কিরগিজিস্তান, আজারবাইজান আপনারা এই সকল দেশ সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই জানেন। এদিকে ককেশাস অঞ্চল এমন একটি অঞ্চল যে অঞ্চলটি ইসলামের আশক (ভালোবাসা) এবং মুহাব্বাতকে বহন করে চলছে। কাবারদিনো-বালকারিয়া, কারাচায়-চেরকেসিয়া, আডিগেয়া, ইঙ্গুশেতিয়া, চেচেনিয়া, দায়েস্তান অসাধারণ একটি অঞ্চল।

এছাড়াও বাল্টিক প্রজাতন্ত্র সমূহ রয়েছে, বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধের পরে মধ্য এশিয়া থেকে এই অঞ্চলে অনেক মুসলমান হিজরত করে। বেলারুশ, লিথুনিয়া, ইউক্রেনে অনেক মুসলমান রয়েছে। এছাড়াও ঐ অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ এবং সভ্যতার কেন্দ্রভূমি ক্রাইমিয়া সেখানে অবস্থিত। এই ক্রাইমিয়াতে অনেক মুসলমান বসবাস করে থাকে। এই অঞ্চলকে অর্থাৎ রাশিয়ার অভ্যন্তরে বসবাসকারী মুসলমানগণ, ককেশাস অঞ্চল, মধ্য এশিয়ার তারকিশ রিপাবলিক সমূহ এবং বালটিক প্রজাতন্ত্রের দেশ সমূহে বসবাসকারী মুসলমানদের দিকে যদি আমরা তাকিয়ে দেখি, তাহলে এই অঞ্চলেই রয়েছে এক বিশাল মুসলিম বিশ্ব!
আচ্ছা, এই অঞ্চলের সর্বশেষ অবস্থা এখন কি? ১০০ বছরের এক দীর্ঘ বিরতির পর তাদের মুসলিম পরিচয়কে উদ্ধার করার জন্য অনেক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্র ভূমি থেকে এই সকল অঞ্চলে কিছু ভুল তথ্য ও প্রতিষ্ঠান গিয়েছে। যা একটি বড় ভুল।

প্রিয় ভাইয়েরা, আমাদের নিকট থেকে এই অঞ্চলের শেখার কিছু নেই। এই অঞ্চলের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হল তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠিত সভ্যতাকে যেন খুজে পেতে পারে সেজন্য তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করা। আমাদের দায়িত্ব হল, তারা যেন তাদের মাওয়ারাউন নাহর সভ্যতাকে পুনরায় খুজে পায় সেজন্য তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করা। এসভ্যতা উসুলের সাথে দর্শনকে, হাদীসের সাথে তাসাউউফকে, জ্যোতির্বিদ্যার সাথে ফিকহকে একত্রিত করেছিল।

নাকলী (ওহী) ইলিমের সাথে আকলী ইলিমের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছিল। চোখ ধাধানো মহান এক সভ্যতার উপর তারা বসবাস করছে। এই অঞ্চলটি এমন এক অঞ্চল যে অঞ্চল হাদীস শাস্রের সবচেয়ে বড় আলেম ইমাম বুখারীর সাথে দর্শন শাস্রের সবচেয়ে বড় পণ্ডিত ইবনে সিনাকে একই অঞ্চলে প্রতিপালিত করেছে।

এই অঞ্চল এমন অসাধারণ এক অঞ্চল, যে অঞ্চল দর্শন শাস্রের মহা-পণ্ডিত, আল মাদিনাতুল ফাদিলা গ্রন্থের লেখক আবুল ফজল আল-ফারাবীর সাথে আহমেত ইয়েসেবীকে এক সাথে গড়ে তুলেছে। ইমাম সারখসীর সাথে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ উলু বেয়কে এক সাথে গড়ে তুলেছে। ইমাম মাতুরিদির এবং ইমাম তিরমিজিকে একসাথে গড়ে তুলেছে।

এজন্য এখানে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের কিতাবুত তাওহীদকে নিয়ে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। কেননা সেখানে ইমাম মাতুরিদির কিতাবুত তাওহিদ আব্দুল ওয়াহাবের ১০০০ বছর পূর্বে লিখিত হয়েছে। অন্য একটি চিন্তা, অন্য একটি দর্শন, অন্য একটি আদর্শ সেখানে নিয়ে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। আমাদের উচিত ছিল, তারা যেন নিজেদেরকে খুজে পায় এজন্য তাদেরকে সাহায্য করা। এই অঞ্চলে ফেতুল্লাহ গুলেনের স্কুল সমূহ নিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য বড় ভুল, এটা করে আমরা অপরাধ করেছি। উপসাগরীয় দেশ সমূহে বের হওয়া নতুন ধর্মীয় ফেরকা সমূহকে এই অঞ্চলে নিয়ে যাওয়ায় মুসলমানরা অনেক বড় গুনাহ করেছে।

অথচ আমাদের মূল দায়িত্ব ছিল, তারা যেন তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠিত সভ্যতাকে খুজে পেতে পারে সে লক্ষ্যেই তাদেরকে সাহায্য করা। কিন্তু আজ তারা এই সুযোগ থেকে অনেক বেশী মাহরুম (বঞ্চিত)। এখনো তারা বঞ্চিত হয়েই চলছে।

এ অঞ্চলে বসবাসরত মুসলমানদের আজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল, নিজেদের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে নিজেদের ইসলামী পরিচয়কে প্রতিষ্ঠা করা। আর এই ক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য তাদের এই কাজে সাহায্য সহযোগিতা করা। সেলচুকলু, ওসমানী এবং আমরা আজ যে ইতিহাসের উত্তরাধিকারী এর মূল উৎস হল এই অঞ্চলে। মাওয়ারাউন নাহরে। কিন্তু আজ তারা দারিদ্রতার যাতাকলে নিষ্পেষিত।

আমি এই স্মৃতিটি কক্ষনোই ভুলতে পারি না, ইমাম আজম আবু হানিফার পরে হানাফি মাজহাবের সবচেয়ে বড় আলেম ইমাম সারাখসানির কবর ওজগেন শহরের একটি বাড়ীর জরাজীর্ণ একটি আঙিনায়। এটা জানার পর আমি খুবই আশ্চর্যান্বিত হয়ে যাই। সে কূপের পাশে বসে ৩০ খণ্ডের আল মাবসুতি নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেন তার পাশের একটি ঘরের পাশেই তার কবর!

দুই. দ্বিতীয় অঞ্চল দক্ষিন পূর্ব ইউরোপ।আমরা যে অঞ্চলকে বালকান অঞ্চল বলে চিনে থাকি। কিন্তু এই অঞ্চলকে আমাদের ইউরোপে বসবাসরত মুসলমানদের সাথে চিন্তা করা উচিত। দক্ষিন পূর্ব ইউরোপ আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, কসোভা, সানজাক, রোমানিয়া, মেসিডোনিয়া। এই সমগ্র অঞ্চলটি এমন এক অঞ্চল এই অঞ্চলে বসবাসরত মুসলমানদের সাথে ৫০০-৬০০ শত বছর একসাথে বসবাস করেছি, একই সভ্যতাকে একে অপরের সাথে ভাগ করে নিয়েছি, একই মসজিদে নামাজ পড়েছি এবং একই রণাঙ্গনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছি।

এই অঞ্চলটিও ১০০ বছরের দীর্ঘ এক বিরতীর পর নিজেদের মূল পরিচয়কে খুজে পাওয়ার চেষ্টা করছে। তারা যেন তাদের সেই অতীতের ৫০০-৬০০ বছরের মহান সেই সভ্যতাকে খুজে পেতে পারে এই জন্য আমাদের উচিত তাদেরকে সাহায্য করা। আমাদের এতটুকু সাহায্যই তাদের জন্য যথেষ্ট এর বেশী কিছু নয়। এই অঞ্চলটি সবসময় ভয়াবহ এক হুমকির সম্মুখীন। কারণ ইউরোপ এই অঞ্চলকে তার সামগ্রিকতাকে বিনষ্টকারী একটি অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। তারা এই অঞ্চলকে তাদের সভ্যতা ও ধর্মীয় চিন্তার আলোকে গড়ে তোলার জন্য সকল ধরণের মিশনারী কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। পৃথিবীর এমন কোন বড় মিশনারী গোষ্ঠী নেই যারা বালকান নামক এই ছোট্ট অঞ্চলটিতে নেই। ভৌগলিক দিক থেকে এই অঞ্চলটি ছোট হতে পারে কিন্তু মুসলিম উম্মাহর নিকট ও সমগ্র দুনিয়ার নিকট এর গুরুত্ত্ব অনেক বেশী।

তিন. তৃতীয় অঞ্চল, এই অঞ্চল নিয়ে অনেক কথা বলা যায় কিন্তু সময় কম হওয়ার কারণে আমাকে সংক্ষিপ্ত করতে হবে। তৃতীয় অঞ্চল হল আফ্রিকা। আফ্রিকা এটি এমন একটি অঞ্চল, এমন কোন গর্হিত কাজ নেই যা সাম্রাজ্যবাদীরা এই অঞ্চলে করেনি। আল্লাহ প্রদত্ত্ব সমগ্র নিয়ামতকে সাম্রাজ্যবাদীরা শোষণ করে নিয়ে গিয়েছে এই অঞ্চল থেকে। সকল নিয়ামতে পরিপূর্ণ বিশাল এক মহাদেশ হল আফ্রিকা মহাদেশ। সাহাবায়ে কেরাম বিলাদি হাবশিস্তান (বর্তমান ইথিওপিয়া) এ হিজরত করার মাধ্যমে সর্বপ্রথম এই মহাদেশে পা রাখেন। আফ্রিকান সম্রাট বাদশাহ নাজ্জাশির দুনিয়া। ইসলামে সভ্যতার বিনির্মাণে অনেক বড় ভূমিকা পালনকারী মিশর এবং সুদান এই অঞ্চলে। উত্তর আফ্রিকার মাধ্যমে শুধুমাত্র আফ্রিকা নয়, ইউরোপকে আলোকিত এবং মানব ইতিহাসের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী সভ্যতার প্রতিষ্ঠাকারী আন্দালুসিয়াও এই আফ্রিকার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উপনিবেশবাদীরা যাওয়ার পরে আফ্রিকার জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল নিজের পায়ের উপরে দাঁড়ানো এবং তাদের অতীত হারানো ইতিহাসকে পুনঃরোদ্ধার।

সাম্রাজ্যবাদীরা এই মহাদেশে ভয়াবহ দুইটি অপকর্ম করে। প্রথমে তারা দাসের বাণিজ্য করে আফ্রিকান সন্তানদেরকে, আফ্রিকান মানুষদেরকে তাদের দাসে পরবর্তীতে তারা শোষণের মাধ্যমে তাদের আধুনিক দুনিয়া প্রতিষ্ঠা করে। এই মহাদেশের মানুষকে শোষণ করে নিজেরা উন্নতির চরম শিখরে উপনীত হয়। তারা যখন এই অঞ্চলের মানুষকে বঞ্চিত করে তখন একমাত্র তাদের সামনে বাঁধা হিসেবে দাঁড়ায় উসমানী খিলাফত। এই মহাদেশের মানুষকে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য উসমানী খিলাফতের প্রচেষ্টা ও অবদান অনস্বীকার্য। এই অঞ্চলের মুসলমানগণ যেন তাদের ইসলামী পরিচয়কে ফিরে পেতে পারে এবং সম্মানের সাথে বসবাস করতে পারে এই জন্য দুনিয়ার সকল মুসলমানের উচিত তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করা। এখানে কুয়েত কাতার সহ অন্যান্য দেশ থেকে অনেকেই উপস্থিত আছেন। তারাও আফ্রিকার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাহায্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করছেন। তুরস্কের সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা সমূহও সেখানে অনেক কাজ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সমস্যা হল এই সকল সংস্থা ও সংগঠনের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। কোন অঞ্চলের জন্য আগে কি প্রয়োজন সেগুলোর তালিকা করে সেই অনুযায়ী সাহায্য করা প্রয়োজন।

আফ্রিকা মহাদেশের এমন অনেক অঞ্চল রয়েছে যেখানে কোরআনে কারীমের মুসহাফ এখনো পৌঁছেনি। যে কিতাবের উপর ঈমান এনে তারা মুসলমান হয়েছে সেই কিতাব দেখার সৌভাগ্যও এখনোও অনেকের হয়নি। সেখানের শিশুরা কাঠের খণ্ডের উপর, পাতার উপরে, পাথরের উপরে কোরআনের আয়াতকে লিখে লিখে পবিত্র কোরআনকে মুখস্ত করে থাকে। এই সকল বিষয়কে সামনে রেখে আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করা প্রয়োজন।

চার. চতুর্থ অঞ্চল ভারতীয় উপমহাদেশ। হিন্দুস্তান (ভারত), পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানগণ বিশেষ করে জহির বাবর শাহ যে ইসলামী সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সে সম্পর্কে আমাদের সন্তানদেরকে শিক্ষা দিতে হবে, তাদেরকে ইসলামের সমুহান সভ্যতা সম্পর্কে অবগত করতে হবে। হিন্দুস্তান (ভারত) কিভাবে ভাগ হয়ে পাকিস্তান হল এবং পরবর্তীতে পাকিস্তান ভেঙ্গে কিভাবে বাংলাদেশের জন্ম হল এবং ঐ অঞ্চলকে সব সময় অস্থিতিশীল করে রাখার জন্য কাশ্মীর সমস্যাকে কিভাবে জাগ্রত করে রাখা হয়েছে এই সম্পর্কে আমাদের ভালোভাবে জানতে হবে। একটি দেশ ও একটি সমাজের জন্য দ্বীনী ঐক্য, দ্বীনের নিরাপত্ত্বা, দ্বীনী স্থিতিশীলতা কত যে গুরুত্ত্বপূর্ণ এই শিক্ষা আমাদেরকে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে গ্রহণ করতে হবে। এই মুসলিম সমাজের জন্য এই বিষয় সমূহ কত বেশী গুরুত্ত্বপূর্ণ এই বিষয়ে আমাদের বিস্তর গবেষণা করতে হবে। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের কাছ থেকে যেমন আমাদের শিক্ষা নেওয়ার মত অনেক কিছু আছে তেমনি ভাবে তাদেরকে দেওয়ার মতও আমাদের অনেক কিছু আছে। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় তাদের মধ্যে অনৈক্যের দেয়াল রয়েছে। এই দেয়ালকে ভেঙ্গে ফেলার জন্য ভূমিকা পালন করতে হবে।

পাঁচ. পঞ্চম অঞ্চল হল চীন। চীনের আশে পাশের মঙ্গোলিয়া সহ আরও কিছু মুসলিম অঞ্চলকে আমরা চীনের সাথে বিবেচনা করতে পারি। কিন্তু চীনের মুসলমানদেরকে নিয়ে আমাদের আলাদাভাবে গবেষণা করা প্রয়োজন। ২০০৮ সালে OIC র একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করি। সম্মেলনের বিষয় ছিল সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়। কিন্তু সম্মেলনের বিষয়বস্তু যাই হোক সবাই ঘুরে ফিরে শুধু ফিলিস্তিনের দিকেই আসতেন এবং ফিলিস্তিন নিয়ে আলোচনা করতেন। ফিলিস্তিন অবশ্যই আমাদের সকলের জন্য সবচেয়ে বেশী গুরত্ত্বপূর্ণ বিষয় এবং মুসলিম উম্মাহ যদি তার উপরে অর্পিত ইসতিখলাফের দায়িত্ত্ব পালন ও কেন্দ্রীয় একটি উম্মাহ হতে হতে চায় তাহলে ফিলিস্তনকে মুক্ত করে বাইতুল মুকাদ্দাস ও কুদুসকে রাজধানী সমূহের রাজধানী ঘোষণা করার কোন বিকল্প নেই। আমাদের সব চেয়ে বড় সমস্যা হল, আমরা একটা বিষয় নিয়ে যখন কাজ করি তখন অন্যান্য বিষয় ও সারা দুনিয়ার কথা ভুলে যাই।

ঐ সম্মেলনে আমি কথা বলার সুযোগ চাই এবং চীনের মুসলমানদেরকে সম্পর্কে সম্মেলনে উপস্থিত সকলকে অভিহিত করি। আমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করি আপনাদেরকে হাতে চীনের মুসলমানদের সম্পর্কে কোন রিপোর্ট আছে কি? চীনে কতগুলো ফিলিস্তিন রয়েছে আপনারা কি জানেন? আমার বক্তব্যের পর সম্মেলন শেষে ডেক্লারেশন ঘোষণার সময়ে চীন সম্পর্কে একটি ধারা যোগ করা হয় এবং OIC র পক্ষ থেকে চীনে একটি পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর সিধান্ত নেওয়া হয়। আমাকেও সেই দলের একজন সদস্য করা হয়।

কুয়েতের ভাইয়েরা এখানে আছেন কুয়েতের সাবেক ওয়াকফ বিষয়ক মন্ত্রী আমার বন্ধু আব্দুল্লাহ মাতুফও সেই প্রতিনিধি দলে ছিলেন। বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে অংশগ্রহণকারী একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে আমরা চীনে যাই। এই প্রতিনিধি দলের মধ্যে রাজনীতিবিদ সহ অনেক আলেম উলামাও ছিলেন। প্রথমে হুই মুসলমানগণ বসবাসকারী অঞ্চলে, কানসু প্রদেশে, নিজিয়া প্রদেশে বসবাসকারী মুসলমানদের সাথে দেখা করি। পরে সিংজাঙ্ক সায়ত্ত্ব শাসিত প্রদেশে যাই। উরুমচি, কাশগর, হটন, তুরফানে যাই। আমার জীবনে প্রথম এই সকল অঞ্চলে জিয়ারত করতে যাই। কাশগরের মাহমুদ এবং ইউসুফ হাজ হাজিবির সাথে দেখা করি। অসাধারণ এক সভ্যতার উপর প্রতিষ্ঠিত সেই অঞ্চলকে খুজে পাওয়ার পর বিগত ২০০ বছর যাবত মুসলিম উম্মাহ থেকে বিছিন্ন হয়ে বসবাস করার ফলে যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে সেগুলো সরেজমিনে দেখার সুযোগ হয়।

ঐ সময়ের একটি স্মৃতি আমি সব সময় আপনাদের সামনে বলে থাকি। ঐ অঞ্চলে ২০ জন মানুষ কেবলমাত্র ১ টি মুসহাফ (কোরআন শরীফ) দিয়ে হাফেজ হচ্ছিল। ১ টি কোরআন শরীফকে একজন পড়ার পর আরেকজন পড়ত। তাদের কাছে কিছুই ছিল। মহান আল্লাহর শুকরিয়া জানাই পরে তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক স্থাপণ হয় এবং আমরা তাদের মাধ্যমে অনেক কিছু করতে সক্ষম হই। আমাদের মননে ও মানসে যে বিষয়টি সবসময় লালন করতে হবে তা হল, মুসলিম উম্মাহ অনেক বড়, সমগ্র পৃথিবীতেই আমাদের বিচরণ রয়েছে। সরকারী হিসাবে বলা হয়ে থাকে যে চীনে নাকি ২০ মিলিয়ন মুসলমান রয়েছে, এই তথ্যটি সঠিক নয়। চীনের ভেতরে ১০০ মিলিয়ন তথা ১০ কোটির বেশী মুসলমান রয়েছে। চীনের মুসলমানগণ এখনো তাদের মুসলিম পরিচয়কে ধারন করে আছে। কয়েক বছর আগে কয়েক হাজার চাইনিজ মুসলমান হজ্জ করতে গিয়েছিল এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। বিভিন্ন অঞ্চলে মসজিদ সমূহ নতুন করে আস্তে আস্তে খুলে দেওয়া দেওয়া হচ্ছে। শিশুরা আস্তে আস্তে কোরআন শিখছে। তবে আমাদের উচিত হল এই দুনিয়ার সাথে সঠিক একটি সম্পর্ক স্থাপন করা এবং চীনের মুসলমানদের সাথে সম্পর্ক করতে চাইলে পেকিনের উপর দিয়ে করতে হবে। অন্য কোন স্থান থেকে নয়। আমি কিছুক্ষণ পূর্বে চীনের একটি মসজিদ সম্পর্কে বলেছিলাম। সেই মসজিদে নামাজ পড়ার পর বের হয়ে দেখি মসজিদের সামনে বিশাল এক দেয়াল।

-একজন এসে আমাকে বলেন যে, আপনি কি জানেন এই দেয়ালের পেছনে কি রয়েছে?
– আমি তাকে জবাবে বললাম কি আছে?
– তিনি আমাকে জবাবে বলেন, ‘এখানে সুলতান আব্দুল হামিদের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে’।

তার এই জবাব শুনে আমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে যাই। সেখানে আমি যাদের মুসাফির ছিলাম তাদেরকে অনুরোধ করি যে, আমাকে কিছু এই দেয়ালের পেছনে একটু দেখানো যাবে? আমার কথা শুনে তিনি মুচকি হেসে দরজা খুলে দেন। দরজা খোলার পর অনেক বড় একটি শিলালিপি দেখতে পাই। সেই শিলালিপিতে লেখা ‘দারুল উলুমুল হামিদিয়্যা’।

সুলতান আব্দুল হামিদ হান সেই সময়ে মুসলমানদেরকে একটি প্রতিনিধি দল সেখানে প্রেরণ করেন এবং সেখানে মুসলমানদের শিক্ষা দীক্ষার জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সকল অঞ্চল এবং সেখানে বসবাসরত মুসলমানদের সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। চীনের মুসলমানদেরকে সম্পর্কে সবচেয়ে গুরত্ত্ব পূর্ণ এবং তথ্যসমৃদ্ধ বই লিখেছে একজন ইসরাইলী ইয়াহুদী!

এই সকল বিষয় বলতে অনেক কষ্ট লাগে। আজকে আমাদের চীনের মুসলমানদের সম্পর্কে আমাদের কয়টি মাস্টার্স এবং ডক্টরেট রয়েছে?

ছয়. আমাদের ষষ্ঠ শিরোনাম প্যাসিফিক এশিয়ার মুসলমানদেরকে নিয়ে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং এর আশে পাশের অঞ্চল। এই অঞ্চলের মানুষদের মুসলমান হওয়া একটি মুজিজা। এখানে যুব সমাজের ইসলাম নিজে যে জজবা এটা আমাদের সকলের মধ্যে একটি প্রেরণা সৃষ্টি করে। কিন্তু এখানেও পাকিস্তান, হিন্দুস্তান ও আফগানিস্তানের মত সমস্যা রয়েছে। এই ব্যাপারে একটু পরেই উদাহরণ দিব।

সাত. ল্যাটিন অ্যামেরিকা। এই ল্যাটিন অ্যামেরিকাতে ৭০ লাখ মুসলমান রয়েছে।
কয়েক বছর পূর্বে ব্রাজিলের একজন আলেম আমার কাছে আসেন।
-তিনি আমাকে বলেন আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।
-আমি বললাম বলেন, তিনি বলেন, ‘বাগদাদের আব্দুর রহমান এফেন্দীর ব্রাজিল সফর কাহিনী খুজে বের করে আমাদের ভাষায় অনুবাদ করতে পারবেন?’
-আমি তার কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে বললাম উনি কে?
-তিনি জবাবে বলেন, ব্রাজিলে ইসলাম প্রচারকারী ব্যক্তি।
-আমি তাকে জবাবে বলি যে, আমি জানি না।
এর পরে সুলেয়মানিয়া কুতুবখানা তে খুজা খুজি করে সেই বই খুজে পাই।

১৮৬০ সালের দিকে উসমানী খিলাফতের দুটি প্রতিনিধি দল বসরায় যাওয়ার জন্য রওনা করেন। কিন্তু ঝড়ের কবলে পড়ে পথ হারিয়ে ফেলেন। পথ হারিয়ে ভালই হয়েছিল। কয়েকমাস পরে তারা নিজেদেরকে ব্রাজিলের Rio de Janeiro নামক সৈকতে আবিষ্কার করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন বাগদাদের ইমাম আব্দুর রহমান এফেন্দী। ইমাম আব্দুর রহমান এফেন্দী জুব্বা আর পাগড়ী পড়া অবস্থায় সমুদ্র সৈকতে নামলে দলে দলে মানুষ এসে তাকে সালাম দিতে থাকেন ‘আসসালামু আলাইকুম’।

-তাদের সালাম শুনে আব্দুর রহমান এফেন্দী তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন তোমরা এটা কিভাবে জান? এখানে মুসলমান আছে নাকি?
-জবাবে তারা বলেন যে, হ্যাঁ আমরা মুসলমান।
-পর্তুগীজরা যুদ্ধ করার জন্য আফ্রিকা থেকে আমাদেরকে গোলাম হিসেবে এখানে নিয়ে এসেছে তাদের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য।

আমাদের পূর্ব পুরুষ সকলেই মুসলমান। আমাদেরকে এখানে নিয়ে এসে তারা গোলাম বানিয়ে রেখেছে। আমরা এখানে মুসলমান দাস।
-তিনি তাদের এই কথা শুনে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, এখানে তোমাদের সংখ্যা কত হবে?
-জবাবে তারা বলেন যে, অনেক আছে।
-কিছুকাল পরে আব্দুর রহমান এফেন্দী আবিষ্কার করেন যে, ব্রাজিলে বড় একটি মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে। কিন্তু নামাজ কি, রোজা কি, ঈদ কি, কোরআন কি এই সবের কিচ্ছু জানে না। শুধুমাত্র ‘লা ইলাহা ইল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ আর ‘আসসালামু আলাইকুম’ এছাড়া আর কিচ্ছু জানে না।

সেখানে কিছুদিন থাকার পর বসরার উদ্দেশ্যে গমনকারী প্রতিনিধিদল যখন আবার সেখান থেকে যাত্রা করবেন তখন আব্দুর রহমান এফেন্দী বলেন যে, আমি এখান থেকে যেতে পারব না। এখানে অবস্থান করা আমার জন্য ওয়াজিব। এখানে অবস্থান করে এই সকল মুসলমানকে দ্বীন শিক্ষা দিতে হবে। এই কথা শুনে প্রতিনিধি দলের আমীর তাকে বলেন যে, তুমি যদি এখানে থাকতে চাও তাহলে ফিরে গিয়ে আমাকে বলতে হবে যে, তুমি হারিয়ে গিয়েছ।

-আব্দুর রহমান এফেন্দী তাকে বলেন যে, আচ্ছা তাই করো, সমস্যা নেই। পরে প্রতিনিধি দলের আমীর তার খাতায় লিখেন যে, Rio de Janeiro সৈকতে নামার পরে আব্দুর রহমান এফেন্দী হারিয়ে গিয়েছেন। আমীর সেখান থেকে ফিরে আসার সময় পেছনের দিকে তাকিয়ে আব্দুর রহমান এফেন্দী ডাক দিয়ে বলেন যে, উস্তাজ এদিকে একটু আসেন। আসার পর তিনি তার হাতে কিছু স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে বলেন এটা আমার পক্ষ থেকে উপহার।

এর পরে আব্দুর রহমান এফেন্দী সেখানে দীর্ঘ ৬ বছর অবস্থান করেন। তার লেখা ‘ব্রাজিলের সফরনামা’ নামক বইটি আমরা কয়েক বছর পূর্বে প্রকাশ করেছি। সকলকে অনুরোধ করব বইটি পড়ার জন্য। ৬ বছর পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করার পর তার স্মৃতি কথা মূলক এই বইটি রচনা করেন।

ল্যাটিন অ্যামেরিকাতে শুধুমাত্র মুসলমানরা কি এরাই? না।
১। আফ্রিকা থেকে যে সকল মুসলমানকে ধরে নিয়ে সেখানে গোলাম বানিয়ে রাখা হয় তারা, তারও পূর্বে আন্দালুসিয়া থেকে পালিয়ে সেখানে আশ্রয় নেওয়া মুসলমানগণ। আন্দালুসিয়া থেকে সমুদ্র পথে যাত্রা করলে তাদের মধ্যে অনেকেই সাগরে ডুবে মরে আবার অনেকেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে সক্ষম হয়।
২। উসমানী খিলাফতের শাসনাধীন অঞ্চল লেবানন, বৈরুত থেকে খ্রিষ্টানদের সাথে মুসলমানগণও সমুদ্র পথে সেখানে যান। ফিলিস্তিন সহ আরও অনেক অঞ্চল থেকে মুসলমানগণ ব্রাজিলে যান এবং তাদের সমন্বয়ে মুসলমানদের এই বৃহৎ একটি সম্প্রদায় গঠিত হয়।

শুধুমাত্র ল্যাটিন অ্যামেরিকা নয়, ক্যারিবিয়ান সাগরের আশে পাশে হাইতি, ডমিনিক প্রজাতন্ত্রেও অনেক মুসলমান রয়েছে। হাইতি হল এমন এক স্থানের নাম, এই স্থানটিকে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের দাস ব্যবসার টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য সেখানে পূর্বে থেকে বসবাস কারীদের উপরে গণহত্যা চালায় এবং সকলকে হত্যা করে। সেখানের মূল অধিবাসীদেরকে হত্যা করার পরে তারা তাদের আনুগত্য পরায়ণ দাসদেরকে সেখানে পুনর্বাসন করে। পরে যখন দাস ব্যবসা শেষ হয়ে যায় তখন তারা তাদেরকে ভুলে যাওয়ায় সেখানে অবস্থানকারী দাসরা সেখানে একটি নতুন সম্প্রদায় গড়ে তুলে। কিন্তু এর পরেও ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীদের নির্যাতন থেমে থাকেনি। শুধু মাত্র চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যে সেখানে বসবাসরত দাসদেরকে দিয়ে আখ চাষ করারনোর জন্য ফরাসীরা সেই অঞ্চলকে আরও ১০০ বছর উপনিবেশ করে রাখে। শুধুমাত্র একটি প্রয়োজনকে পূরণ করার জন্য তারা এমন ভয়াবহ নির্যাতন চালায়।এটাই হল পাশ্চাত্যের আসল রূপ।

আট. অষ্টম অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্য। আরব বিশ্ব ,উপসাগরীয় দেশ সমূহ এবং তুরস্ক ইরাক এবং ইরান। আপানারা এই অঞ্চলে বসবাস করার কারণে এই অঞ্চল সম্পর্কে ভালো ভাবেই জানেন এই জন্য আমি এই অঞ্চল সম্পর্কে বেশী আলোচনা করব না। শুধুমাত্র এই অঞ্চল সম্পর্কে উল্লেখ করলাম।

নয়. এটি হল সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ অংশ। এই অংশে আমরা মুসলমান সংখ্যালঘুদেরকে নিয়ে আলোচনা করব। প্রিয় ভাইয়েরা আপরা জানেন, ইউরোপের ভেতরে ৩৫ মিলিয়ন তথা সাড়ে তিন কোটি মুসলমান রয়েছে। কিন্তু ইউরোপের তৈরি করা ইসলাম ফোবিয়ার কারণে সব সময় তারা আতঙ্কে থাকে। অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা সহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে। একটু আগে আমি বলেছি যে, ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে ছোট ছোট অনেক দ্বীপ ও দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে। এই সকল দ্বীপের প্রত্যেকটিতেই মুসলমান জনগোষ্ঠী রয়েছে।

মিউকালোডনিয়া নামে একটি দেশ রয়েছে, এই দেশে নেতাদের সাথে দেখা হলে আমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করি এখানে কতজন মুসলমান রয়েছে? তিনি আমাকে জবাবে বলেন যে, দশ হাজার বা তার চেয়ে বেশী।
-আমি তাদেরকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাড়া কোথা থেকে এখানে এসেছেন?
-তিনি আমাকে জবাবে বলেন যে, ফরাসীরা আলজেরিয়াকে দখল করে তাদের উপনিবেশ বানালে আলজেরিয়ান মুসলমানরা ফরাসীদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী চার হাজার মুসলমানকে বন্দী করে এই দ্বীপে নিয়ে এসে বন্দী করে রাখে। আজকের গুয়ান্তোনামার মত তারা এই দ্বীপকে সেই সময়ের গুয়ান্তোনামা বানিয়ে রেখেছিল। তখন থেকে আমরা এখানে। প্রতিটি অঞ্চলেই এমন মুসলমান সংখ্যালঘু রয়েছে কিন্তু তাদেরকে দেখার, তাদের খুজ নেওয়ার মত কেউ নেই। অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপে বসবাসকারী মুসলমানদেরকে নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করা দরকার বলে আমি মনে করি।

এখন আমি মূল কথায় আসতে চাই। প্রিয় ভাইয়েরা, আজকে আপনাদের এই প্রোগ্রামের নাম ‘মুসলিম বিশ্বে ঐক্যের মডেল এবং ভবিষ্যৎ’
মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাঁধা কি? কোন বাঁধাটি আমাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকার করে রেখেছে?
সেটা কি? যে দ্বীন এসেছিল আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য। আমাদেরকে উম্মাহ বানানোর জন্য, আজকে আমরা সেই দ্বীনের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা, বেহুদে এবং অর্থহীন বিষয় সমূহ নিয়ে বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে আজ সেই দ্বীনকে আমরা আমাদের মধ্যে বিভক্তির কারণে পরিণত করেছি।

বড় বড় সভ্যতার পতন শুরু হয় দ্বীনের শাখা-প্রশাখা এবং অর্থহীন বিষয় সমূহ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক এবং এই সব বিষয় নিয়ে দলাদলি করার ফলে। অর্থহীন বিষয় সমূহকে বড় করে দেখিয়ে উম্মাহকে আজ বিভক্ত করে রাখা হয়েছে। অথচ আমাদেরকে যে বিষয়টি ঐক্যবদ্ধ করে তা হল, লা ইলাহা ইল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। এর বাহিরে যা আছে তা সব গুরুত্ত্বহীন। আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে ইসলামের আদালত। আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করবে আখলাক।

আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করবে ইমাম আজম আবু হানিফার সেই গুরত্ত্বপূর্ণ মূলনীতি, ‘আহলে কিবলাকে তাকফীর করা যাবে না’। এটা কতই না বড় একটি মূলনীতি। যে মানুষ ‘লা ইলাহা ইল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ বলবে’ তাকে তাকফীর করা যাবে না। এটা কতই না বড় একটি মূলনীতি।

ইমাম আযম আবু হানিফার ফিকহুল আকবর গ্রন্থের একটি শ্লোগান হল, من امن بالتنزيل، لا يكفر بالتاوبيل অর্থাৎ যারা আল্লাহর অবতীর্ণ গ্রন্থের প্রতি ঈমান এনেছে তাদেরকে সেই কিতাবের তা’বিল (ব্যাখা, বিশ্লেষণ) এর কারণে তাকফির (কাফির বলা যাবে না) করা যাবে না।

আমরা কোন কোন বিষয়ের কারণে বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়েছি? প্রথমে, ইমামমত ও সিয়াসেত (রাজনীতির) উপর ভিত্তি করে শিয়া, সুন্নিতে বিভক্ত হয়েছি পরবর্তীতে সেটা আরও গভীর থেকে গভীরতর হয়ে সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে। পরবর্তীতে সেটা বিভিন্ন জাতীয়তাবাদের সাথে মিলে আরও বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। আজ এগুলো বিভিন্ন জাতীয়তাবাদের সাথে মিলে মিশে তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে।

এর পরে মাজহাবের উপর ভিত্তি করে বিভক্ত হয়েছি। যে মাজহাব সমূহ দ্বীনে মুবিন ইসলামকে সহজভাবে বুঝার জন্য আমাদের সামনে ইসলামকে উপস্থাপন করেছিল আমরা সেটাকে অন্যভাবে বুঝে নিজেদেরকে বিভক্ত করে ফেলেছি। এরপর ইসলামের মূল বিষয় সমূহের উপর বিভক্ত হয়ে পড়েছি। আহলে কোরআন ও আহলে হাদীস নামে দলের সৃষ্টি হয়েছে। কোরআন এবং সুন্নাহ হল ইসলামের এমন একটি বিষয় একটা থেকে অপরটিকে আলাদা করলে যেখানে দ্বীনে মুবিন ইসলামই ধ্বসে পড়বে আমরা সেই বিষয়ের উপর ভিত্তি করে নিজেদেরকে বিভক্ত করে রেখেছি। এরপর ইরাদী এবং কুদরত তথা ইলমে কালামের উপর ভিত্তি করে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। এটা নিয়ে অনর্থক বাড়াবাড়ি এবং তর্ক-বিতর্ক করার কারণে আমরা বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়েছি। এর তারিকাত এবং তাসাউফের উপরে ভিত্তি করে বিভক্ত হয়েছি। আমাদের অন্তরকে বিশুদ্ধ করার জন্য যে মক্তবের সৃষ্টি হয়েছিল, যে মক্তব বা চিন্তা সমগ্র আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছে সেই তাসাউফের উপর ভিত্তি করে আমরা বিভক্ত হয়েছি। এরপর রাজনৈতিক বিভাজন সমূহ। আমি শুধু মাত্র এই সকল বিষয়ের উপরে ২ টি উদাহরণ পেশ করব। একটি হল ভারতীয় উপমহাদেশের অপরটি হল ইন্দোনেশিয়ার।

ভারতীয় উপমহাদেশের কাহিনীটি হল, আড়াই বছর আগে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আমাকে পাকিস্তানে আমন্ত্রন করেন। আমি তার দাওয়াতে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানে যাই। পরে লাহোরে তার ভাই শাহবাজ শরীফের বাসায় বসে আমাকে যে কথাগুলি বলেছিলেন তা আমি কোনদিনই ভুলব না,

তিনি বলেন, “ উস্তাজ! আমরা ভারতে হিন্দুদের সাথে শতাব্দীর পর শতাব্দী এক সাথে বসবাস করেছি। পরে আমরা দেখলাম যে আর এক সাথে বসবাস করা সম্ভব নয়। পরে আমরা চিন্তা করলাম যে, তাদের থেকে পৃথক হয়ে আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করব। আমাদের পূর্বপুরুষ গণ এই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য আন্দোলন করে এবং শেষ পর্যন্ত আমরা পৃথক হয়ে আলাদা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হই এবং পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করি। পাকিস্তানে আমাদের যেই বিষয়টি আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করবে তা ছিল কেবলমাত্র ইসলাম। আমাদের মধ্যে গোত্র প্রথা, আঞ্চলিকতা এবং ভাষার ভিন্নতা একটি একটি বিভাজনের বড় কারণ।কিন্তু আমাদেরকে একটি বিষয় ঐক্যবদ্ধ করেছিল তা হল ‘ লা ইলাহা ইল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সঃ)’।

তাদের একটি বিখ্যাত শ্লোগান রয়েছে, আল্লামা ইকবাল এই শ্লোগানটির জনক। তা হল, ‘পাকিস্তান কা মতলব কিয়া লা ইলাহা ইল্লাহ’। কোন সমাবেশে তারা যখন বলে পাকিস্তান কি? তখন সবাই সমস্বরে বলে উঠে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আমরা এমন একটি ভালোবাসা ও চিন্তার উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান থেকে পৃথক হই। শুধুমাত্র ভারত থেকে পাকিস্তানে হিজরত করার সময় বিভিন্ন স্থানে সংঘাত ও সংঘর্ষের কারণে আড়াই লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ার কয়েকবছর পরেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বন্দ চরম আকার ধারণ করে এবং পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে ‘বাংলাদেশ’ নামক আলাদা একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আজকে আমরা এমন এক অবস্থায় উপনীত হয়েছি যে, আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধকারী একমাত্র উপাদান ‘ইসলাম’ আজকে আমাদের মধ্যে বিভাজনের সৃষ্টি করেছে। প্রতিটি মসজিদ আজকে একটি মাজহাব, প্রতিটি মাদরাসা আজকে একটি ফিরকায় (দলে) পরিণত হয়েছে। এই জন্য আমি সকল আলেমকে এক সাথে করেছি। আপনি অনুগ্রহ করে তাদের সাথে একটু কথা বলেন”।

এরকম একটি উদ্দেশ্যে আমি পাকিস্তানে গিয়েছিলাম। পাকিস্তানের কাদিয়ানী, আহমাদিয়া, আহলে হাদীস, আহলে কোরআন এরকম যারা বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে তাদেরকে যদি এক পাশে রেখে দেই, তবুও আমরা দেখতে পাই যে পাকিস্তানের বড় একটি জনগোষ্ঠী ২ টি জামায়াতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটি হল বেরেলভী, অপরটি হল দেওবন্দী।এগুলো অবিভক্ত ভারতের সময়ে এই বড় দুইটি মাদরাসার নাম ছিল। কিন্তু বেরেলভীদের অনুসারীর সংখ্যা ৭০ মিলিয়ন আর দেওবন্দীদের অনুসারীদের সংখ্যা ৪৮ মিলিয়ন। এই দুই গ্রুপের উভয় গ্রুপই মুসলমান, উভয় গ্রুপই হানাফী, উভয় গ্রুপই মাতুরিদী, উভয় গ্রুপই সুফী কিন্তু মাঝে মধ্যে তারা একে অপরের পেছনে নামাজ পর্যন্ত আদায় করে না। তাদের মধ্যকার দন্দ্ব সম্পর্কে আমি আলোচনা করব না। ইখতিলাফের বিষয় যাই হোক না কেন, এরকল ফিরকাবাজী মুসলমানদেরকে মানায় না।

ব্রিটিশরা ভারতকে শাসন (শোষণ) সময়ে বেরেলভী মাদরাসার সূচনা হয়। তারা রাসূল (সঃ) কে জীবিত এবং সকল স্থানে হাজির ও নাজির হিসেবে জানে। শুধুমাত্র একটি ব্যাখ্যার কারণে তারা ইখতিলাফ করে থাকে। এই সকল বিষয় সমূহ নিয়ে ইখতিলাফ করা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। এই সকল বিষয় ইখতিলাফের বিষয়বস্তু না হওয়া দরকার। আমি আপনাদেরকে দুইটি আকাঈদ গ্রন্থের মধ্যকার পার্থক্যকে বুঝানোর জন্য ঐ দুইটি আকাঈদ গ্রন্থের প্রথম বাক্যসমূহ আপনাদের সামনে পেশ করব।

আবু মুইন আন-নাসাফীর আকাঈদ গ্রন্থের প্রথম বাক্য হল,
قال اهل الحق حقائق الاشياء ثابتة و العلم بها متحقق خلافا للسوفسطائية ـ و اسباب العلم للخلق ثلاثة الحواس السليمة والخبر الصادق و العقل
আহলে হক্বগণ বলেন যে, মূল বস্তুগুলো বাস্তবে বিদ্যমান। এই সম্পর্কিত জ্ঞানসমূহ সত্য। এই সকল সত্য বিষয় সমূহ সুফাস্তাইয়্যাহ সম্প্রদায় এর সম্পূর্ণ বিপরীত। আর ইলমের উৎস তিনটি। সুস্থ পঞ্চইন্দ্রিয় এবং আক্বল।

বর্তমান সময়ে সারাপৃথিবীতে একটি আকাঈদ গ্রন্থ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যার প্রথম বাক্য হল,

نواقض الايمان عشرة
ঈমান ভঙ্গের কারণ দশটি
الأولى زيارة القبور
এর প্রথমটি হল কবর সমূহ জিয়ারত করা।

এই পার্থক্য একটু চিন্তা করুণ! একটি গ্রন্থ তার প্রথম বাক্যে আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে বিষয় সমূহের হাকীকত সম্পর্কে আর অপরটি শিক্ষা দিচ্ছে তাকফীর!

এই জন্য এই সকল বিষয় সমূহ মুসলিম উম্মাহর বিতর্কের বিষয় সমূহ থেকে যত দ্রুত সম্ভব বাদ দেওয়া প্রয়োজন। আমাদেরকে মূলের দিকে ফিরে আসা প্রয়োজন। আমাদেরকে আমাদের মূলনীতি সমূহের দিকে ফিরে আসা প্রয়োজন। দ্বীনের মূল এবং অপরিবর্তনীয় মৌলিক বিষয় সমূহের দিকে ফিরে আসা প্রয়োজন।

ব্রিটিশ শাসনামলে বেরেলভী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন আহমেদ রেজা খান। এর পরে আমজাদ আলী, আহমেদ ইয়ারখান এরা এই ধারাকে বজায় রাখেন। তারা যে সকল বিষয় নিয়ে ইখতিলাফ করে আপনারা পরে বিস্তারিত দেখে নিতে পারেন।

একই ভাবে দেওবন্দী মাদরাসা ইসলাহ এবং তাজদীদ এর মূলনীতি হিসেবে নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রখ্যাত দেহলভী মাদরাসা বা ধারা এই মাদরাসা থেকে বের হয়। আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি এই ধারা থেকে বের হোন, নদভী মাদ্রসা এই ধারা থেকে বের হয়, আজামী মাদরাসা এই ধারা থেকে বের হয় এবং পরবর্তীতে তাবলীগ জামায়াত বের হয়। আপনারা সকলেই জানেন ইউসুফ খান দেহলবীর লেখা হায়াতুস সাহাবা নামক বইকে দাওয়াতের গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহার কারী মুহাম্মাদ ইলিয়াস আলী এই তাবলীগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা।

যেই বিষয়টি বলার জন্য আপনাদের সামনে এই উদাহরণের অবতারণা করেছি তা হল, আজকে পাকিস্তানে দ্বীনের নিরাপত্ত্বা ও দ্বীনী স্থিতিশীলতাকে আজ হুমকীর মুখে ফেলে দিয়েছে এই গ্রুপ সমূহ। তাদের মধ্যকার ইখতিলাফী দ্বন্দ মুসলমানদেরকে আরও বেশী বিভাজিত করে রেখেছে।

পাকিস্তানের মত একই অবস্থা ইন্দোনেশিয়াতেও। ইন্দোনেশিয়াতেও রয়েছে নাহদাতুল উলামা এবং আহমাদিয়া। নাহদাতুল উলামার সদস্য সংখ্যা ৭০ মিলিয়িন, আহমাদিয়া আন্দোলনের সদস্য সংখ্যা ৫০ মিলিয়িন। উভয় সংগঠনের শত শত বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রামে মহল্লাতে হাজার হাজার স্কুল এবং হাসপাতাল সমূহ রয়েছে। এই গুলোকে কি কল্যাণের জন্য ব্যবহার করা সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব। কখন? যখন তারা এক সাথে বসে কাজ করবে। বেহুদা বিষয় সমূহ নিয়ে বিতর্ক করা থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তারা এটা না করবে তখন পর্যন্ত এই সকল বিষয় সমূহ তাদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি করেই যাবে।

আমি শুধুমাত্র এই দুইটি উদাহরণ দিলাম। এরকম অনেক উদাহরণ সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মধ্যেই বিদ্যমান রয়েছে। সুদান, মিশর, আফ্রিকা সহ সারা দুনিয়াতেই এর উদাহরণ সমূহ রয়েছে। এই জন্য আগামী দিনে ইসলামী ঐক্য গঠনের পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা এই তাফরিকা (দলাদলি) কে আমাদের খুব গুরত্ত্বের সাথে বিবেচনা করার প্রয়োজন।

বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী তার বিখ্যাত খুতবা খুতবায়ে শামিয়েতে মুসলিম উম্মাহর তিনটি বড় সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। এগুলো হল,
১। তাফরিকা (দলাদলি)
২। দারিদ্রতা
৩। জেহালেত (মূর্খতা)
এই তিন সমস্যা এখনো আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। মুসলিম উম্মাহার মধ্যে এই সমস্যা ভয়াবহ রূপ ধারন করেছে। তবে বিশেষ করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য প্রবাহ সহজতর হওয়ার ফলে এই তাফরিকা আরও বেশী বেড়েছে। মুসলিম উম্মাহর ইসলাম সম্পর্কে ধারণা আরও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। তুরস্কেও ইসলামের ধারণা দিন দিন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে।

এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য, ইসলামের বিশ্বজনীন বানীকে পুনরায় জাগ্রত করার জন্য কোরআন এবং সুন্নাহর স্থায়ী বিষয় সমূহকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে এবং রাসূলে আকরাম (সঃ) এর বিশ্বজনীন রহমতের বানীকে মূলনীতি হিসেবে নিয়ে, সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে সাথে নিয়ে আমাদেরকে ভ্রাতৃত্বে বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। তাহলেই কেবল এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আমি গতকাল রাতেই বলেছি, এই বিষয়ে আমাদের উপর অনেক দায়িত্ত্ব কর্তব্য অর্পিত হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্রে বসবাসকারী ভাইয়ের উপরে এই ব্যাপারে অনেক দায়িত্ত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।

কেবলমাত্র মুসলিম উম্মাহর জন্য আশার প্রতীক হয়ে বসে থাকলেই চলবে না, তাদের আশার বাস্তব প্রমান আমাদের দিতে হবে।
মুসলিম উম্মহার বিভিন্ন প্রান্তে আমরা ভ্রাতৃত্বের বানীকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছি এটা খুবই সুন্দর। সত্য, সুন্দর ও ভালোকে বহন করে নিয়ে যাওয়া অসাধারণ একটি বিষয়। তবে শুধুমাত্র কোরবানী নয়, কোরবানীর সাথে সাথে উৎসর্গিত প্রানকেও নিয়ে যেতে হবে, খাদ্যে ও অন্যান্য পণ্য সামগ্রীর প্যাকেট বহন করাই যথেষ্ট নয় এর সাথে সাথে ইলিম এবং হিকমাহর প্যাকেটও বহন করা প্রয়োজন। আমাদেরকে জ্ঞান (ইলিম) ও হিকমাহ নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। শুধুমাত্র সুন্দরকে নয় এর সাথে মারিফেত এবং শান্তিকে আমাদের সাথে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।

আমাদের তুর্কীর বিভিন্ন সংগঠন আফ্রিকার বিভিন্ন প্রান্তে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে গিয়ে থাকেন, কিন্তু একই সাথে তারা তাদের নিজেদের চিন্তা ও মতাদর্শকেও সেখানে নিয়ে গিয়ে থাকেন। এটা কোন ক্রমেই সঠিক নয়, দয়া করে মুসলিম উম্মাহর এই ক্ষতি করবেন না। যদি মধ্য এশিয়ায় সাহায্য করতে যান তাহলে তাদের প্রতিষ্ঠিত মাওয়ারাউন নাহর সভ্যতাকে পুনরায় খুজে পাওয়ার জন্য তাদেরকে সাহায্য করুণ। দয়া করে এখান থেকে নিজেদের চিন্তা, মতাদর্শ, মাজহাব ও তারিকাতকে নিয়ে যাবেন না। যদি আফ্রিকাতে যান তাহলে দয়া করে আপনাদের নিজেদের বিশেষ ধরণের টুপি, পাগড়ি ও জুব্বাকে নিয়ে যাবেন না। কারণ তাদের স্থানীয় পোশাক তাকে আরও বেশী সুন্দর মানায়। নিজেদের সংস্কৃতি ও মাজহাবকে নিয়ে যাইয়েন না দয়া করে। সেখানে আখলাক নিয়ে যান, সেখানে আদালত নিয়ে যান। জ্ঞান (ইলিম) নিয়ে যান, হিকমাহ নিয়ে যান। আমাদের নিজেদের সমস্যা ও অসুস্থ চিন্তাকে যেন আমরা সেখানে বইয়ে না নিয়ে যাই।

যদি আমরা তা করতে না পারি তাহলে মুসলিম উম্মাহর এই ভয়াবহ সংকট মুহূর্তে একটি গ্রুপ (ফেতুল্লাহ গুলেন ও তার সংগঠন) ১৫ জুলাই তুর্কীতে এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর যে ক্ষতি করেছে তাদের শিক্ষা থেকে আমরা কোন শিক্ষাই নিতে পারব না। তারা তাদের নিজস্ব চিন্তাকে মুসলিম দেশ সমূহে নিয়ে গিয়ে মুসলিম উম্মাহর অনেক বড় ক্ষতি করেছে। তারা ইসলামের নামে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

আমি পুনরায় আপনাদের এই সম্মেলনের সফলতা কামনা করে আমার এই বক্তব্য এখানেই শেষ করছি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আপনাদের এই ঐক্যকে মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে যেন কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে এই জন্য মহান আল্লাহর কাছে তওফিক কামনা করি। আপনাদের সকল কাজ যেন ইখলাস এবং কেবল মাত্র বারী তা’য়ালার সন্তুষ্টির জন্য হয় এবং কোন প্রকার প্রদর্শন ও দুনিয়াবী কোন উদ্দেশ্যে না হয়। আপনাদের কাজ যেন কোন প্রোপ্যাগান্ডা ও প্রচারের জন্য না হয়, এই কাজ যেন মুসলিম উম্মাহর ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইটের কাজ করে এবং আমাদের সকলকে মহান আল্লাহর মুখলিস বান্দা হওয়ার তওফিক দান করেন। এই দোয়া করে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

অনুবাদ: বুরহান উদ্দিন
আঙ্কারা, তুরস্ক