যুবকদের দুনিয়া এবং ইসলাম

প্রফেসর ডঃ মেহমেদ গরমেজ | 
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন, ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আ’লা আশরাফিল আম্বিয়ায়ী ওয়া আসহাবিহি আজমাইন।

সম্মানিত শিক্ষকমণ্ডলী, সম্মানিত ডীন, প্রিয় যুবক বন্ধুগণ, সম্মানিত উপস্থিতি আসসালামু আলাইকুম।
আমি আমার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এবং আমাদের দেশের যুবকদের আহবানে সাড়া দিয়ে তাদের আয়োজিত বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করি। মালেশিয়া, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, বসনিয়া সহ আরও অনেক দেশে যুবক ভাইদের সাথে মেশার চেষ্টা করেছি। তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করেছি এবং তাদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তবে তাদের কিছু কিছু প্রশ্ন আমার কাছে কঠিন মনে হয়েছে।

আমরা আমাদের মসজিদ, মাদ্রাসায়, বিশ্ববিদ্যালয়, সেমিনার ও কনফারেন্সে ইসলামকে বুঝানোর জন্য যে ভাষা ব্যবহার করি তার সাথে যুবকদের এবং শিক্ষার্থীদের সম্পর্কহীনতাকে বুঝতে চেষ্টা করেছি। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, একই বাড়িতে বসবাস কারী ২ ভাইয়ের মধ্যে যদি বয়সের ক্ষেত্রে ১ বছরেরও পার্থক্য থাকে কিন্তু তাদের দেখে মনে হয় তাদের মধ্যে যেন প্রজন্মের পার্থক্য আছে। এর কারণ হল দুনিয়ার দ্রুত পরিবর্তনশীলতা। আজ দুনিয়া খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। দুনিয়া আজ এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, যে কোন ধরণের তথ্য আজ খুব সহজেই এবং দ্রুত পাওয়া যায়। এমন একটি দুনিয়ায় যুবকদের দুনিয়ার সাথে আমার দুনিয়ার মধ্যে কিংবা পূর্বের প্রজন্মের সাথে পরবর্তী প্রজন্মের দুনিয়ার মধ্যে সম্পর্ককে বুঝতে চেষ্টা করেছি।

এই জন্য আমি আজকের এই কনফারেন্সের বিষয় নির্ধারণ করেছি, ‘যুবকদের দুনিয়া এবং ইসলাম’। তাই আমাদের ভবিষ্যৎকে বিনির্মাণ করার জন্য ‘যুবকদের দুনিয়া এবং এই দুনিয়ায় ইসলামের অবস্থান নির্ধারণ করা’ আজ আমাদের সবচেয়ে গুরত্ত্বপূর্ণ দায়িত্ত্ব।

প্রিয় যুবক ভাইয়েরা, এই জন্য আজ আমি তোমাদের দুনিয়া নিয়ে কথা বলার জন্য এখানে এসেছি। আমি তোমাদেরকে উপদেশ কিংবা নসিহত করার জন্য আসিনি। আজ আমি তোমাদের সাথে আমার অন্তরকে মিলিয়ে একত্রে তোমাদের দুনিয়া নিয়ে কথা বলতে চাই।

প্রথমত যুবকদের দুনিয়াকে বুঝার জন্য মানুষকে বুঝা জরুরী। মানুষ সৃষ্টির কারণ, এই পৃথিবীতে তার দায়িত্ত্ব এবং কর্তব্য কি এটা সঠিক ভাবে জানতে হবে। যে সকল মূল্যবোধ সমূহ মানুষকে মানুষ বানিয়েছে এবং সে সকল মূল্যবোধ সমূহ থেকে দূরে সরে গেলে কোন ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে এই সকল বিষয় সমূহকে খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে।

যুবকদের দুনিয়াকে বুঝার জন্য, এই পৃথিবীতে মানুষের দায়িত্ত্ব, মহান আল্লাহ কতৃক তাদেরকে খলিফা হিসেবে নির্বাচিত করণ, বিশ্ব জাহান এবং সমগ্র সৃষ্টিকুলকে তার কাছে আমানত রাখা, মানুষ এবং আল্লাহর মধ্যকার সম্পর্ক (মিসাক), মানুষ এবং আল্লাহর মধ্যেকার চুক্তি আমাদেরকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। এই সকল বিষয় নিয়ে চিন্তা গবেষণা করে বুঝা ব্যতিত যুবকদের দুনিয়াকে বুঝা সম্ভব নয়।

আজ আমরা যে দুনিয়ার বসবাস করছি এই দুনিয়া যুবকদের প্রতিষ্ঠিত কোন দুনিয়া নয়। প্রিয় যুবক ভাইয়েরা, আজ তোমরা আমাদের প্রতিষ্ঠিত দুনিয়ায় বসবাস করছ। তোমাদের পূর্বের প্রজন্মের প্রতিষ্ঠিত দুনিয়ায় বসবাস করছ।

আজকের দুনিয়ার যে অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার ও যুলুম নির্যাতন বিরাজ করছে এটা তোমাদের কর্মের ফলাফল নয়।কারণ এই দুনিয়াকে তোমরা প্রতিষ্ঠিত করনি। এই দুনিয়াকে তোমরা তোমাদের সামনে প্রস্তুত অবস্থায় পেয়েছ। তোমাদের জন্য এই দুনিয়াকে আমরা প্রতিষ্ঠিত করেছি। আজকের দুনিয়ায় যে যুদ্ধ-বিগ্রহ, শোষণ যে শোষণ চলছে এটা তোমাদের অপরাধ নয়। আজ ক্ষুধার কারণে মৃত্যুবরণকারী মানুষের চেয়ে মেদবহুলতার (Obesity) কারণে মৃত্যুবরণকারীর সংখ্যা বেশী। এর জন্য তোমাদের কোন জবাবদিহিতা নেই। কারণে এই দুনিয়াকে তোমরা প্রতিষ্ঠিত করনি। এই দুনিয়াকে তোমরা তোমাদের মীরাস (উত্তরাধিকার) স্বরূপ পেয়েছ।

আজকের এই দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে কামনা, বাসনা এবং স্বার্থপরতা ও স্বার্থন্ধতা। আজকের এই দুনিয়ায় যুলুম ও নির্যাতনকারীরা কতৃত্বশালী। এটা তোমাদের অপরাধ নয় কারণ এই দুনিয়াকে তোমরা প্রতিষ্ঠা করনি।

তবে একটি বিষয় গুরত্ত্বপূর্ণ, এটা তোমাদেরকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। তোমাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য এই দুনিয়াকে তোমাদের প্রস্তুত করতে হবে। আজকে যেমন আমরা তোমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মকে নিয়ে পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কথা বলছি, তোমাদের পরবর্তী বংশধরেরাও তোমাদেরকে নিয়ে আলোচনা করবে। তোমাদের পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলবে। তোমরা কি তাদের জন্য ভালো একটি দুনিয়া মিরাস হিসেবে রেখে যাচ্ছ নাকি খারাপ একটি দুনিয়া রেখে যাচ্ছ? এটা নিয়ে তারা আলাপ আলোচনা করবে। এই জন্য আজ তোমাদের সবচেয়ে গুরত্ত্বপূর্ণ দায়িত্ত্ব হল, তোমাদের কাছে যে দুনিয়া আছে সেটাকে খুব ভালোভেব মূল্যায়ন করা এবং আমাদের কাজের সমালোচনা করা। তবে তোমাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য সুন্দর একটি দুনিয়া রেখে যাওয়ার জন্য প্রানান্তকর প্রচেষ্টা চালানো। আমরা যে ভুল করেছি, যে ভুলের কারণে আমরা আজ যে তোমাদের সামনে সমালোচিত হচ্ছি, তোমারাও যদি আমাদের মত ভুক্তভোগী না হতে চাও তাহলে তোমাদের সুন্দর একটি দুনিয়া প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

প্রিয় যুবক ভাইয়েরা,
প্রত্যেক মানুষই দুনিয়াতে একবার আসে। আল্লাহ কতৃক নির্ধারিত সময়সীমাকে আমরা বয়স বলে থাকি। মহান আল্লাহ কতৃক প্রদত্ত্ব সময়কে যদি আমরা এই পৃথিবীকে বিনির্মাণ করার জন্য কাজে লাগাতে পারি তাহলে সেই জীবনই হবে কেবলমাত্র অর্থবহ একটি জীবন। অন্যথায় আল্লাহ প্রদত্ত্ব সময়কে আমরা অপচয়কারী বলে গণ্য হব। বয়সের আরবী হল عمر এই عمر এবং اعمار একই উৎস (মাসদার) থেকে উৎসারিত। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
هُوَ أَنشَأَكُم مِّنَ الْأَرْضِ وَاسْتَعْمَرَكُمْ فِيهَا
অর্থাৎঃ তিনি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি চান তোমরা যেন পৃথিবীকে বিনির্মাণ (اعمار ) কর।

একজন মানুষ পৃথিবীকে বিনির্মাণ করার জন্য যতটুকু বয়স (عمر) ব্যয় করে, সে মূলত ততটুকু সময়ই সঠিক ভাবে ব্যয় করে। তাছাড়া সে কেবলমাত্র বয়স (عمر) অপব্যয়কারী হিসেবে পরিগণিত হবে। একজন মানুষ পৃথিবীকে সভ্যতাকে বিনির্মাণ করার জন্য যতটুকু অবদান রাখে সে মূলত তার জীবনের ততটুকু সময়ই বেঁচে থাকে।

বয়স (عمر) বা জীবনের তিনটি পর্যায় রয়েছেঃ
১। শিশুকাল,
২। যৌবনকাল,
৩। বার্ধক্য।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার মহাগ্রন্থে প্রথম দুর্বল সময়, শক্তিশালী সময় এবং দ্বিতীয় দুর্বল সময় বলে আখ্যায়িত করেছেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন,
اللَّهُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن ضَعْفٍ
অর্থঃ আল্লাহই দুর্বল অবস্থা থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেন। (রুম-৫৪)
মানুষের সন্তান যে পরিমাণে দুর্বল হয়ে জন্ম গ্রহণ করে অন্য কোন কিছুর বাচ্চা এত দুর্বল হয়ে জন্ম নেয় না। অন্য যে কোন পশু কিংবা পাখির বাচ্চাকে একা একা রেখে দিলে সে বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু মানুষের নবজাতক সন্তানকে অল্প সময়ের জন্যও একা রেখে দিলে সে ক্ষুধা এবং পিপাসায় মৃত্যুবরণ করবে। এই জন্য শিশুকাল হল দুর্বল সময়কাল।
ثُمَّ جَعَلَ مِن بَعْدِ ضَعْفٍ قُوَّةً
তাঁরপর এ দুর্বলতাঁর পরে তোমাদের শক্তি দান করেন।
আয়াতে বর্ণিত এই শক্তি, আজ তোমরা যুবক হিসেবে যে শক্তির অধিকারী এই শক্তি।

ثُمَّ جَعَلَ مِن بَعْدِ قُوَّةٍ ضَعْفًا وَشَيْبَةً ۚ
এ শক্তির পরে তোমাদেরকে আবার দুর্বল ও বৃদ্ধ করে দেন।

প্রিয় যুবক ভাইয়েরা,
শিশুকাল হল ‘ তাকলিদের সময়’ বা অনুকরণের সময়। যৌবনকাল হল ‘তাহকীকের সময়’ বা কোন কিছুকে জেনে বুঝে চিন্তা করে শেখা। আর বৃদ্ধকাল হল ভোগ করার বা ব্যয় করার সময়। তোমরা যৌবনকালে যা অর্জন করবে বৃদ্ধ বয়সে এসে তা ব্যয় করবে। তোমরা যৌবনকালে যা শিখবে বৃদ্ধ বয়সে এসে তা শিক্ষা দিবে। এই জন্য জীবন নামক পূঁজি গুরুত্ত্বপূর্ণ। আর এই জীবন নামক পূঁজির মধ্যে যৌবনকাল হল সবচেয়ে বেশী গুরুত্ত্বপূর্ণ। এই জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকল নবীগণকে যুবকদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করেছেন।

এমন কোন নবী নেই যাকে বৃদ্ধ বয়সে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবী বলে ঘোষণা করেছেন। সকল নবীগণই যুবক ছিলেন। আল্লাহ তাদেরকে যুবক বয়সে এই জন্য নির্বাচিত করেছিলেন যে, যেন তারা সুন্দর একটি দুনিয়া বিনির্মাণ করতে পারে।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন,
ما بعث الله عز وجل نبيا إلا وهو شاب
আল্লাহ তার সকল নবীকে যুবকদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করেছেন।
এই কথা বলে যুবকদেরকে তিনি বার্তা দিয়েছেন।
ولا أوتي عالم علما إلا وهو شاب
এবং এমন কোন আলেম নাই যাকে যুবক বয়সে জ্ঞান দান করা হয়নি।

এখানে একটি বিষয় আমি তুলে ধরতে চাই, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন ধরণের ছবি ও ডকুমেন্টারী দেখানো হয়ে থাকে। সেই সকল চ্যানেলে যে সকল আলেমকে দেখানো হয় তাদের সকলের বয়সই ষাট কিংবা তার ঊর্ধ্বে। এর মাধ্যমে তারা আমাদেরকে একটি বার্তা দেয়, সেই বার্তাটি কি? সেই বার্তাটি হল, ইসলাম হল ষাট ঊর্ধ্ব বৃদ্ধদের জন্য আর বৃদ্ধ হওয়া ছাড়া আলেম হওয়া যায় না! এই দ্বীন যুবকদের জন্য নয়। এই দ্বীন যুবকদেরকে উদ্দেশ্য করে কথা বলে না। কিন্তু বাস্তবতা আসলে কি? আমি এটা নিয়ে আপনাদের সামনে কয়েকটি উপমা তুলে ধরতে চাই।

আমাদের সকলের পরিচিত একটি হাদিস গ্রন্থের নাম হল রিয়াদুস সালিহীন। পৃথিবীর সকল প্রান্তের মুসলমানগনই এই গ্রন্থটি পাঠ করে থাকে। এই কিতাবের লেখক ইমাম নববী মাত্র ২২ বছর বয়সে এই গ্রন্থটি রচনা করেছেন। এবং তিনি মাত্র ৩৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। যুবক বয়সেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

ইমাম গাজালী, সবচেয়ে বড় উসূলের গ্রন্থ ২১ বছর বয়সে রচনা করেন। যা আজ ইসলামী জ্ঞানের অন্যতম গুরুত্ত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ রূপে আমাদের সামনে রয়েছে। তিনি ৫১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। অথচ তোমাদের মনমস্তিষ্কে ও কল্পনায় ইমাম গাজালীকে ১০০ বছর বয়সী বৃদ্ধ একজন মানুষ বলে অঙ্কিত করা হয়েছে। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইহইয়াহু উলুমুদ্দীন’ যখন তিনি লেখা শুরু করেছেন তখন তার বয়স ছিল তিরিশের কোটায়। গাজালীর সমগ্র গ্রন্থ সমূহকে যদি হিসাব করা হয় তাহলে দেখা যায় যে, তিনি দিনে গড়ে ৮০ পৃষ্ঠা করে লিখতেন। ‘মুয়াল্লাফাতুল গাজালী’ বা গাজালীর রচিত গ্রন্থ সমূহ নিয়ে আমাদের কাছে একটি গ্রন্থ রয়েছে। এটি মূলত একটি পিএইচডি থিসিস। গবেষক এখানে গবেষণা করে বের করেছেন যে, ইমাম গাজালীর লিখিত বইয়ের সংখ্যা ৫০৭ টি। শুধুমাত্র তার লিখিত বই সমূহ দিয়েই একটি লাইব্রেরী ভর্তি করা সম্ভব। তার লিখিত গ্রন্থ সমূহ সাধারণ মানের কোন গ্রন্থ নয়। ফিলোসফি বা দর্শন শাস্রের সর্বোচ্চ মান সম্পন্ন গ্রন্থ সমূহও লিখেছেন আবার উসূলে ফিকহের উপরেও সর্বোচ্চ মানের গ্রন্থ রচনা করেছেন। কেবলমাত্র ইমাম গাজালীর বই সমূহের নামের উপর ভিত্তি করেই একটি সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

তাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, এত কম সময়ের জীবনে এত বেশী কাজ কিভাবে করেছেন?
তিনি তাদেরকে জবাবে বলেন যে, ‘আমি আল্লাহর কাছে সময়ের মধ্যে সময় চেয়েছিলাম’। আমি আমার প্রত্যেকটি দোয়াতেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে বলেছি যে, হে আল্লাহ আমাদের জীবন খুবই অল্প সময়ের জন্য, কিন্তু কাজ অনেক বেশী। তুমি আমার প্রতি অনুগ্রহ করে আমাকে সময়ের মধ্যে সময় দান কর। আমি যেন কম সময়ের মধ্যে অনেক ভালো কাজ করতে পারি’। এইভাবে ইমাম গাজালী, গাজালীতে পরিণত হন।

আজ আমাদের তুরস্কে ১০০ র বেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামীক থিওলজি ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। গাজালী একাই ইসলামী সভ্যতা বিনির্মাণে যে অবদান রেখেছেন, আমাদের এই সকল ডিপার্টমেন্ট সমূহ কি সেই ভূমিকা পালন করতে পারবে? ১০০ বছর বা ২০০ বছর পরে মুসলিম উম্মাহ আমাদেরকে কিভাবে মূল্যায়ন করবে? আজ আমাদের নিজেদেরকে এই প্রশ্ন করা উচিত।

প্রিয় যুবক ভাইয়েরা,
মুসলিম উম্মাহ আজ গাজালীদের অপেক্ষায়। মুসলিম উম্মাহ আজ ইবনে সিনাদের অপেক্ষায়। মুসলিম উম্মাহ আজ ফখরুদ্দীন রাজীদের অপেক্ষায়। আমাদের নিকট অতীতের আলেম ও দার্শনিক হলেন আল্লামা ইকবাল, আলিয়া ইজ্জেত বেগভিচ। আজ তোমাদেরকে তাদের শুন্যস্থানকে পূরণ করতে হবে।

সকল নবীগণই ছিলেন যুবকদের মধ্য থেকে। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) যখন নমরুদের প্রতিষ্ঠিত মেসোপটেমিয়ায় ‘তাওহীদের সংগ্রাম’ পরিচালনা করেন তখন তিনি একজন যুবক ছিলেন। কোরআনের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে কোরআন বলেছে,

قَالُوا سَمِعْنَا فَتًى يَذْكُرُهُمْ يُقَالُ لَهُ إِبْرَاهِيمُ
(কেউ কেউ) বললো, “আমরা এক যুবককে এদের কথা বলতে শুনেছিলাম, তার নাম ইবরাহীম৷” (আম্বিয়া – ৬০)
এই যুবক ইব্রাহীম পৃথিবীকে শিরকের নাগপাশ থেকে মুক্ত করার জন্য একাই তাওহীদের এক মহাসংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। হাজার হাজার বছর পরে এসে মুহাম্মাদ রাসূলূল্লাহ (সঃ) বলেছিলেন, আমি আমার পিতা ইব্রাহীমের দোয়ার ফল।
হযরত ইসমাইল যখন তার পিতার সাথে এই সংগ্রামে শামিল হোন, তিনিও তখন একজন যুবক ছিলেন।

হযরত ইউসুফ পূর্বে কূপে নিক্ষিপ্ত হোন এবং যুবক বয়সে এসে মিশরের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হোন।
হযরত ঈসা, হযরত মূসা সহ সকল নবীগণ যুবক বয়সে নবুয়ত প্রাপ্ত হয়ে আল্লাহ প্রদত্ত্ব দায়িত্ত্বকে বাস্তবায়ন করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
যুবকগণ যখন আমাদেরকে প্রশ্ন করেন যে, উস্তাজ আমরা কাকে দেখব? আমাদের সামনে তো কোন রোল মডেল নাই। আমি মনে করি এই প্রশ্ন করার অধিকার তাদের রয়েছে।
আমি তাদেরকে এই প্রশ্নের জবাবে বলি, কোরআন খুলে দেখ, সেখানে উল্লেখিত নবীগনের সকলেই যুবকদের জন্য রাহবার (অনুকরনীয় ব্যক্তিত্ত্ব)। আল্লাহর নবীদের চেয়ে কী আর কোন বড় রোল মডেল বা অনুকরনীয় আদর্শ হতে পারে?
মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে বলা হয়েছে,
فَبِهُدَاهُمُ اقْتَدِهْ
তুমিও তাদের পথে চল, তাদের অনুসরণ কর। (সূরা আনআম-৯০)
নবীগণই শুধুমাত্র যুবক ছিলেন না, তারা তাদের সংগ্রামের জন্য, তাদের সঙ্গীদেরকেও যুবকদেরকে মধ্য থেকে নির্বাচিত করেছিলেন। সকল নবীদের প্রথম সারির সঙ্গী সাথী গণ ছিলেন যুবকদের মধ্য থেকে।

প্রিয় যুবক ভাইয়েরা,
বড় বড় সাহাবীদেরও সকলেই ছিলেন যুবকদের মধ্য থেকে। কিন্তু আজ বই-পুস্তক, উপন্যাস, গল্প এবং সিনেমার মাধ্যমে তাদেরকে বৃদ্ধ বলে আমাদের সামনে উপস্থাপণ করা হয়েছে। মক্কায় রাসূলে আকরাম (সঃ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হল দারুল আরকাম। আপনারা কি জানেন কে এই আরকাম? যে তার ঘরকে আল্লাহর রাসূলের সাহাবীদের জন্য উম্মুক্ত করে দিয়েছিলেন? যেখানে বসে রাসূল (সঃ) তার সংগ্রামকে পরিচালনা করতেন। এই আরকাম তখন ছিলেন মাত্র ১৯ বছর বয়সী একজন যুবক।

রাসূলে আকরাম (সঃ) এর প্রথম প্রজন্মের সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী বয়স্ক কে ছিলেন? হযরত আবু বকর (রাঃ)। হযরত আবু বকর (রাঃ) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তিনি কত বছর বয়স্ক ছিলেন? তখন তার বয়স ছিল ৩৭ বছর! হযরত উমর (রাঃ) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তার বয়স ছিল ৩০ বছর। হযরত উসমান (রাঃ) ৩৩ বছর বয়সী ছিলেন। হযরত আলী (রাঃ) মাত্র ৯ বছর বয়সী ছিলেন এবং তিনি যখন ইসলামের পতাকা হাতে নিয়ে জিহাদের ময়দানে এগিয়ে যান তখন তিনি ছিলেন ২০ বছর বয়সী।

হিজরতও সর্বপ্রথম শুরু করেন যুবকরা। হাবেশিস্তান এবং মদিনায় সর্বপ্রথম হিজরত করেন যুবকগণ। রাসূলে আকরাম (সঃ) বিভিন্ন অঞ্চলে গভর্নর প্রেরণ করেন, এই সকল গভর্নরদের সকলেই ছিলেন যুবক। ইসলামী সভ্যতার মৌলিক বিষয়সমূহকে শিক্ষাদানকারী হাদীস সমূহের রাবী হযরত মুয়াজ ইবনে জাবালকে যখন ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে পাঠানো হয় তখন তার বয়স ছিল ২১ বছর।

প্রিয় যুবক ভাইয়েরা,
এই জন্য তোমাদের জন্য সবচেয়ে বড় আদর্শ (রোল মডেল) হলেন নবীগণ, তাদের সাহাবীগণ এবং ইসলামী সভ্যতার মহান আলেমগণ।
যুবকদেরকে জীবনকে ধ্বংসকারী ৩ বিষয় রয়েছে,
১। অবসর সময়,
২। অবসর মস্তিষ্ক
৩। অবসর অন্তর।

তোমরা যদি এই ৩ টি জিনিসকে ভালোভাবে পরিপূর্ণ করতে পার তাহলে তোমরা আজকে যে অভিযোগে আমাদেরকে অভিযুক্ত করছ, তোমাদের পরবর্তীগণ তোমাদেরকে এই সকল অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারবে না। এই তিনটি বিষয়কে যদি ভালোভাবে পূর্ণ করতে পার, তাহলে তোমরা তোমাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য অনেক সুন্দর একটি দুনিয়া রেখে যেতে পারবে।

যুবক ভাইয়েরা আমাদের জীবনে যেন অবসর সময় বলতে কোন বিষয় যেন না থাকে। কেননা কিয়ামতের দিন যে সকল প্রশ্ন করা হবে তার মধ্যে গুরত্ত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, عَنْ عُمْرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ , وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلاهُ অর্থাৎ তার জীবন সম্পর্কে সে কোথায় তা ব্যয় করেছে, এবং তার যৌবনকাল সম্পর্কে সে কোথায় তা ব্যয় করেছে।

এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সমগ্র জীবনকালের মধ্যে যৌবনকালের ব্যাপারে আলাদা ভাবে হিসাব নেওয়া হবে। তোমরা এমন যুব সমাজ যারা হক্বের পথে চলছ। হক্বের পথের পথিক যুবকরা তাদের জীবনকে ভার্চুয়াল জগতের অধিনস্ত করে রাখতে পারে না। জীবনকে ভার্চুয়াল জগতের কাছে সমর্পণ করে দিয়ে হাকীকত থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং সময় ব্যয় করা একটি জাতির বিকাশের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। এই জন্য আমাদের জীবন পরিকল্পিত হওয়া উচিত। যদিও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে পরিকল্পনা মাফিক করে দিয়েছেন। কিন্তু তোমাদের উচিত হবে নিজের জীবনকে সাজিয়ে নেওয়া যেন এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট না হয়।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি যুবকদের জন্য বিপদজনক তা হল, ফাঁকা (অলস) মস্তিষ্ক। এই ফাঁকা মস্তিষ্ককে যে মূল্যবান জিনিস দিয়ে পূর্ণ করতে হবে তা হল, ইলিম, হিকমাহ এবং মারিফাত। এই বিষয় সমূহই কেবলমাত্র আমাদের মস্তিষ্ককে পরিপূর্ণভাবে পূর্ণ করতে পারবে। অন্য কোন কিছু নয়। তোমাদের উচিত হবে সর্বদায় উপকারী জ্ঞানের পেছনে দৌড়ানো। তোমরা তোমাদের মস্তিস্ককে ভর্তি করবে এবং পূর্ণ করবে।

তবে এই বিষয়টির প্রতি খেয়াল রাখতে হবে, মস্তিষ্ককে কেবলমাত্র তথ্য দ্বারা ভর্তি করে রাখার নাম মস্তিষ্ককে পূর্ণ করা নয়। আজ আমাদের এই যুগে হান্দাসাতুল জাহলিয়া বা মূর্খতার ইঞ্জিনিয়ারিং সব জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই পদ্ধতি মানুষকে শিক্ষা দিয়ে মূর্খ বানায়। হান্দাসাতুল জাহলিয়া বা মূর্খতার ইঞ্জিনিয়ারিং যুবকদের হাতে সার্টিফিকেট তুলে দিয়ে তাদেরকে মূর্খ বানিয়ে রাখে। সবচেয়ে খারাপ মূর্খতা হল, শিক্ষিত জাহিল বা মূর্খ। সবচেয়ে বিপজনক মূর্খতা (জাহেলিয়াত) হল শিক্ষা দানের মাধ্যমে যে মূর্খতা (জাহেলিয়াত) শিক্ষা দেওয়া হয়। এই জন্য তোমাদের নির্বাচক হতে হবে। তোমাদের মস্তিষ্ক ও মেধা অপ্রয়োজনীয় তথ্যভাণ্ডারের ডাস্টবিনে যেন পরিণত না হয়।
তোমাদের মস্তিষ্ক সমূহ যেন কেবলমাত্র হাকীকত, সুন্দর, সঠিক এবং উপকারী জ্ঞানের ভাণ্ডারে পরিণত হয়।

প্রিয় যুবক ভাইয়েরাঃ
আজকে আমরা এমন এক দুনিয়ায় বসবাস করছি যে দুনিয়ায় সবচেয়ে সহজ বিষয় হল তথ্য আহরণ করা। যে কোন মুহূর্তে যে কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া আজ অনেক সহজ সাধ্য হয়েছে। দীর্ঘ ২০ বছর বিরতীর পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় ক্লাস নেওয়া শুরু করেছি। ২০ বছর আগে যখন ক্লাস নিতাম তখন আগে ক্লাসে প্রবেশ করে চক দিয়ে প্রথম ১৫ মিনিটে হাদীস সমূহ এক এক করে লিখতাম। এর পর লাইন ধরে ধরে ওই সকল হাদীস শিক্ষার্থীদেরকে বুঝাতাম।

২০ বছর পরে ক্লাসে ঢুকে দেখি আগের সেই চক আর নাই। এখন মার্কার কলম। খুব ভালো, লিখতেই সহজ  । আমার সেই আগের অভ্যাসের মতই বোর্ডে হাদীসের প্রথম শব্দ লেখার সাথে সাথে ক্লাসের সকলেই সেই সম্পূর্ণ হাদীস আমাকে পড়ে শোনায়! তাদের আওয়াজ শুনে আমি আশ্চর্য হয়ে তাদের দিকে তাকাই।

তাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করি যে, তোমরা কি সকলেই হাদীসের হাফেজ নাকি! তারা বলে যে না উস্তাজ! এখন হযরতে গুগলের যুগ! পরে আমি আমার লিখিত হাদীসকে মুছে ফেলে তাদেরকে বলি যে আমি পড়ি তোমরা তাহলে হযরতে গুগল থেকে দেখো।

অথচ আমি আমার পিএইচডি থিসিস লেখার সময় এমনো হয়েছে যে, একটি হাদীস খুঁজে পাওয়ার জন্য এশার নামাজ পড়ে বসতাম খুঁজতে খুঁজতে ফজরের আজান দিয়ে দিত তবুও অনেক সময় ওই হাদীস খুঁজে পেতাম না। আর এখন একটি বা দুইটি শব্দ লিখলেই, কোন হাদীস গ্রন্থের কোথায় কতবার এই শব্দটি এসেছে সেটা সহ মুহূর্তের মধ্যে সামনে চলে আস। আমরা এমন একটি যুগে বাস করছি। আজ তথ্য প্রবাহের যুগে তথ্য খুঁজে পাওয়া আজ সহজ হয়ে গিয়েছে। তবে আমাদের সামনে বড় যে চ্যালেঞ্জ তা হল তথ্যের নির্বাচন। সঠিক এবং ভুল তথ্যের মধ্যে পার্থক্য করা। যে উসূল এবং মেথডলজি জানে না তাকে আমরা জ্ঞানী বলতে পারব না।

এই জন্য আমাদের শিক্ষাবীদদের উচিত হল, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবা। তথ্য আপলোড করার শিক্ষা ব্যবস্থার যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে। আজ এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রনয়ন করা প্রয়োজন যে শিক্ষা ব্যবস্থার কল্যাণে শিক্ষার্থীরা সুন্দর এবং অসুন্দর, ভালো এবং মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে। এই জন্য কেবল মাত্র মস্তিষ্ককে পূর্ণ করলেই হবে না, আমাদের মস্তিষ্ককে হাকীকতের দ্বারা পূর্ণ করতে হবে।

সাবধান! জ্ঞান অর্জন করার ক্ষেত্রে জ্ঞানের মধ্যে কোন ধরণের পার্থক্য করবে না। আমি সবসময় এই কথাটি বলে থাকি, “মুসলিম উম্মাহর পতন শুরু হয়েছে যখন তারা জ্ঞানকে, দ্বীনী শিক্ষা ও দুনিয়াবী শিক্ষা বলে জ্ঞানকে বিভাজিত করেছে”।
আমি সবসময় বলি, “ আল্লাহর কিতাবকে ব্যাখাকারী তাফসীর যতটুকু দ্বীনী জ্ঞান, আল্লাহর বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কিত জ্ঞান সমূহও (পদার্থবিদ্যা, রয়াসন, জীববিজ্ঞান ও গণিতবিদ্যা) ততটাই দ্বীনী”।
“অতীত জাতি সমূহের উপর ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহ নিয়ে লিখিত ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান এগুলোও দ্বীনী জ্ঞান”
সাবধান ভুলেও এগুলোকে একটি অপরটির সাথে পৃথক করবে না।

ইতিহাসকে খুব ভালোভাবে অধ্যয়ন করবে। সভ্যতার ইতিহাসকে খুব ভালোভাবে শিক্ষা করবে। বিজ্ঞানের ইতিহাসকে পড়। মানবজাতির ইতিহাসকে পড়। যে সকল জ্ঞান তোমাদেরকে হাকীকতের দিকে নিয়ে যাবে, সে সকল জ্ঞানকে খুব ভালোভাবে অর্জন করবে।

আজ আমরা ডিজিটাল জগতে বসবাস করছি। এখন দেখে দেখে এবং শুনে শুনেই জ্ঞান অর্জন করা যায়। আগে মসজিদের মিম্বার থেকে ওয়াজ করা হত এখনো আছে, এখন ডিজিটাল মিম্বার আবিষ্কৃত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ডিজিটাল ওয়ায়েজীন গনেরও জন্ম হয়েছে বিপুল পরিমানে। ডিজিটাল ওয়ায়েজীন ডিজিটাল কুরসী থেকে মানুষের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রেখে চলছে।

প্রিয় যুবক ভাইয়েরাঃ
হাকীকতে পৌঁছার জন্য কারোর কাছে নিজেকে বন্দক দিয়ে রাখবে না। নিজের আকলকে সব সময় উম্মুক্ত রাখবে। যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা বলে সকলের কাছ থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করবে কিন্তু তোমাদেরকে নিজেদের জীবনকে, হাকীকতকে ব্যক্তি নির্ভর করে গড়ে তুলবে না। হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, ‘হাকীকতকে ব্যক্তির আলোকে বিবেচনা করবে না বরং হাকীকতের আলোকে ব্যক্তিকে নিরূপণ করবে’। বাকী (স্থায়ী) হাকিকত সমূহকে ফানী (অস্থায়ী) ব্যক্তির উপরে নির্ভর করে গড়ে তুলবে না। ইসলামের আলোকে আলেমগণ, উস্তাজগন ও ব্যক্তিগণ হাকীকতের কোন উৎস নয়, তারা হাকীকতের (মুয়াল্লিম) শিক্ষাদানকারী মাত্র।
তিনটি কিতাবকে (বইকে) সব সময় পড়ার চেষ্টা করবে।
১। ইনসান (মানুষ)
২। মহা-বিশ্ব,
৩। কোরআন।

মানুষ সম্পর্কে সকল ধরণের জ্ঞান অর্জন করার চেষ্টা করবে। যে সকল বই পড়লে মহাবিশ্ব এবং মহান আল্লাহর সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে জানতে পারবে সেই সকল বই পড়বে। আর মহাগ্রন্থ আল-কোরআনকে সবসময় বেশী বেশী করে পড়বে ও চিন্তা করবে।

আর তৃতীয় যে জায়গাটিকে কখনোই অবসরে বা ফাঁকা রাখা যাবে না তা হল কালব। আমি পুনরায় বলছি, একজন যুবককে ধ্বংস করে তিনিটি বিষয়, অবসর সময়, অবসর কালব এবং অবসর মস্তিষ্ক। তমাদের অন্তরকে ফাঁকা রাখবে না। কিন্তু সেই ফাঁকা স্থানটিকে ক্ষণস্থায়ী ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করবে না।
সাবধান! কখনোই অন্তরে পদ-পদবী ও লালসার স্থান বানাবে না।
অন্তরকে শান-শওকতের ভালোবাসায় পূর্ণ করবে না।
অন্তরকে দুনিয়াবী যশ-খ্যাতি পাওয়ার ভালোবাসা দ্বারা পূর্ণ করবে না।
আজে-বাজে মানুষকেও অন্তরে স্থান দিয়ে অন্তরের জায়গাকে নষ্ট করবে না।
তোমরা তোমাদের অন্তরকে মহান-প্রভুর ভালোবাসায় পূর্ণ কর! যে প্রভু তোমাদেরকে সৃষ্টি করে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। সকল কিছুর পূর্বে আল্লাহর ভালোবাসাকে স্থান দিবে। এরপর মানুষ এবং মহান আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টিকে ভালোবাসবে। মহান আল্লাহর সকল সৃষ্টিকে ভালোভাসার দৃষ্টিতে দেখার জন্য শিক্ষা দিবে এমন গ্রন্থ মহান আল্লাহ আমাদেরকে দিয়েছেন।
ۗ أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
আর জেনে রাখো, কেবলমাত্র আল্লাহর জিকিরই অন্তরকে প্রশান্ত করতে পারে।

প্রিয় যুবক ভাইয়েরাঃ
انسان ইনসান, نسيان নিসইয়ান এবং عصيان ইসইয়ান এই তিনটি শব্দকে সবসময় মনে রাখতে হবে। মানুষের সবচেয়ে বড় ইসইয়ান (অবাধ্যতা) শুরু হয়েছিল নিসইয়ানের (ভুলে যাওয়ার) মাধ্যমে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ عَهِدْنَا إِلَىٰ آدَمَ مِن قَبْلُ فَنَسِيَ
আমি এর আগে আদমকে একটি হুকুম দিয়েছিলাম কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল। (তাহা-১১৫)

মানুষের যত বড় বড় ইসিয়ান বা অবাধ্যতা সব শুরু হয়েছে নিসইয়ান বা ভুলে যাওয়ার মাধ্যমে। এই জন্য যদি ভুলে যাও, তাহলে তোমাকেও ভুলে যাওয়া হবে। নিসইয়ানের মধ্যে ডুবে থেকে তোমাদের জীবনকে পরিচালনা করতে পারবে না। ইনসান বা মানুষ হওয়ার অর্থ হল নিসইয়ান থেকে মুক্ত থেকে স্মরণ করা। এই জন্য সকল নবীদের অন্যতম একটি নাম হল ‘মজাক্কির’ ( যিনি স্মরণ করিয়ে দেন)। আমরা যে মানুষ, আমাদের দায়িত্ত্ব ও কর্তব্য এই বিষয়টিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদেরকে পাঠিয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনে অন্য একটি নাম হল ‘যিকির’।

প্রিয় যুবক ভাইয়েরাঃ
এই জন্য ‘যিকরুল্লাহ’ পরিভাষাকে সবসময় মনে রাখতে হবে। তবে কেবলমাত্র হাতে তসবীহ নিয়ে আল্লাহ, আল্লাহ যিকির করার নাম যিকরুল্লাহ নয়। কারণ আল্লাহ এমন কোন কিছু নয় যে, শুধুমাত্র তাসবীহ হাতে নিলেই তাকে স্মরণ করতে হবে।
তাহলে সত্যিকারের যিকরুল্লাহ কি? সত্যিকারের যিকরুল্লাহ হল, জীবনে সকল ক্ষেত্রে আল্লাহকে স্মরণ রেখে কাজ করা। জ্ঞান অর্জন করার সময়, ব্যবসা করার সময়, রাজনীতি করার সময় সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ রেখে কাজ করার নাম হল যিকরুল্লাহ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবতার জন্য বিধান দিয়েছেন সে বিধানকে স্মরণ রেখে বসবাস করার নাম হল যিকরুল্লাহ।

প্রিয় যুবক ভাইয়েরাঃ
আজকে আমরা এমন এক দুনিয়ায় বসবাস করছি যে দুনিয়াতে মানুষকে সব কিছু ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। আজকের দুনিয়াটাকে এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যে, মানুষ যেন সব কিছু ভুলে থাকে। সব কিছুই আজ আমাদের নিজেদেরকে ভুলিয়ে দিচ্ছে। হাতে মোবাইল নিলে আমরা নিজেদের কথা ভুলে যাই। ইন্টারনেটে ঢুকলে সেটাও তোমাদের নিজেদেরকে তোমাদের সম্পর্কে বেখবর বানিয়ে দেয়। টেলিভিশন চালু করলে সেটাও তোমাদেরকে তোমাদের আত্মা সম্পর্কে ভুলিয়ে দেয়। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হল, এই সকল বিষয়কে আমরা বিনোদন নামে নামকরণ করা শুরু করেছি। বর্তমান দুনিয়ার মূলনীতি হল, ‘ তুমি যত বেশী ভুলে থাকবে, ততবেশী বিনোদন উপভোগ করবে’।

কিন্তু আল্লাহ বলেন ভিন্ন কথা, তুমি যতবেশী ভুলবে ততবেশী ক্লান্ত হবে। যত বেশী ভুলে যাবে তোমাদের কালবও ততবেশী ক্লান্ত হয়ে পড়বে। তোমরা যতবেশী ভুলে যাবে মেধা-মস্তিষ্ক ততবেশী দুর্বল হয়ে পড়বে। ইসলামের সকল মূলনীতি সমূহ, ইবাদত, কোরআন ও সুন্নাহ সকল কিছুই আমাদের নিজেদের স্মরণের জন্যই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

মুয়াজ্জিন দিনে পাঁচবার মসজিদের মিনার থেকে আমাদের নিজেদেরকে নিজেদের সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য সফলতার দিকে আহবান করে থাকেন। আমরা যেন আমাদের নিজেদেরকে ভুলে না যাই, এই জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়েছে। কোরআন পড়া, একে অপরকে সালাম দেওয়া, এক সাথে বসে গল্প করা এই সকল কিছুই আমাদের নিজেদের সম্পর্কে সদা জাগরূক থাকার জন্য। কিন্তু আমরা নিজেদের জন্য এমন এক দুনিয়া প্রতিষ্ঠা করেছি যে দুনিয়া প্রতিনিয়ত আমাদের নিজেদের কাছে আমাদের নিজেদের সত্ত্বাকে ভূলিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে।

এমন একটি দুনিয়ায় বসবাসকারী যে যুবক নিজেকে ভুলে না গিয়ে নিজের দায়িত্ত্ব সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন নিঃসন্দেহে সে একজন বীর! আত্মপূজা ও আত্মপ্রবঞ্চনার এই যুগে যে যুবক নিজেকে সকল ধরণের খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে পেরেছে, নিঃসন্দেহে সে একজন বীর।

প্রিয় যুবক ভাইয়েরাঃ
তিনটি বিষয়কে এক সাথে বিবেচনা করতে হবে,
১। আমিত্ত্ব (Individuality)
২। ব্যক্তিত্ব ( Personality)
৩। পরিচয় (Identity)

আমিত্ত্ব (Individuality)। আমি কে? তোমাদের উচিত সবসময় নিজেদেরকে এই প্রশ্ন করা।
আমি কেমন একজন মানুষ? এই প্রশ্নের জবাব ব্যক্তিত্ব ( Personality) কে গঠন করে থাকে। আমি কার সাথে সম্পৃক্ত? আমি কোথায় সম্পৃক্ত? আমি কোন সভ্যতার সাথে সম্পৃক্ত? এই সকল প্রশ্নের জবাব পরিচয়কে তুলে ধরে।

আমরা যা কিছু অধ্যয়ন করব সে সকল অধ্যয়নের উদ্দেশ্য যেন এই প্রশ্ন তিনটির উত্তরকে খুঁজে পাওয়ার জন্য হয়। আমরা যদি ‘আমিত্ত্ব (Individuality),ব্যক্তিত্ব ( Personality), পরিচয় (Identity)’ এই তিনটি বিষয়কে ভালোভাবে বুঝতে পারি তাহলে আমাদের কালব, আমাদের মস্তিষ্ক পূর্ণ হবে এবং আমরা আমাদের সময়কেও সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারব।

প্রিয় যুবক ভাইয়েরা,
আমি সহ অন্যান্য উস্তাজরা মসজিদে, সেমিনারে, সিম্পোজিয়ামে, টেলিভিশনে, ইন্টারনেটে এবং ওয়াজ করার সময় যুবকদেরকে উদ্দেশ্য করে যে সকল দ্বীনী আলোচনা করে থাকেন সে ক্ষেত্রে কি কি ভুল করে থাকেন সে গুলো আমি আলোচনা করেই আমার আজকের আলোচনার ইতি টানতে চাই। এই ভূল সমূহকে আমি নির্ণয় করি নাই, এই সকল সমস্যা সমূহকে তোমরাই চিহ্নিত করেছ। মাঝে মধ্যে ফজরের নামাজের পর যুবকদের সাথে বসে গল্প করি। যুবকদের বন্ধু হতে পেরেছি বলে সবসময় আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি। বিভিন্ন সময়ে তাদের করা প্রশ্ন থেকে আমি ছয়টি বিষয় নির্ধারণ করেছি। এই ছয়টি বিষয়ে আমরা ভুল করে থাকি।

১। দ্বীন এবং মানুষের মধ্যকার সম্পর্কঃ
দ্বীনী (ধর্মীয়) বিষয়ের সাথে ইনসানীতের (মানবিক) সম্পর্ক কি? ইনসানী বিষয়ের সাথে ইসলামী বিষয়ের সম্পর্ক। মাঝে মধ্যে আমরা এমন ধরণের (ভুল) দ্বীনী কথা বার্তা বলে থাকি মনে হয় ইসলাম এবং ইনসানিয়াত (মানবিকতা) পরস্পরের বিপরীত। আমরা এমনভাবে কথা বলে থাকি যে, যেটা ইনসানী (মানবিক) সেটা ইসলামী নয়। আমি সহ যদি কোন আলেমের কাছ এমন দ্বীনের (ধর্মের) নামে এমন কোন কথা শুনে থাকেন যা ইনসানিয়াতকে ইসলামের মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে দেয়, মানুষের মান-সম্মান-ইযযতকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় তাহলে মনে রাখবে এখানে দুটি বিষয়ের যে কোন একটি।
১। হয়ত সে আলেম বা শিক্ষকের ব্যাখা ভুল অথবা
২। তার ফিতরাত নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

কারণ সবচেয়ে সুদৃঢ় দ্বীন হল ফিতরাত নিজেই। মহান আল্লাহ বলেন,
ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ
অর্থাৎঃ এটিই পুরোপুরি সঠিক ও যথার্থ দীন৷
আয়াতের শুরু দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাই,
فِطْرَتَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا
আল্লাহ মানুষকে যে ফিতরাতের (প্রকৃতির) ওপর সৃষ্টি করেছেন তাঁর ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও৷
لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ
আল্লাহ তৈরি সৃষ্টি কাঠামো পরিবর্তন করা যেতে পারে না৷
ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ
এটিই পুরোপুরি সঠিক ও যথার্থ দীন৷

আমরা যে সকল ভুল করে থাকি এর মধ্যে একটি হল এটা।
তবে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, সেটা হল ইনসানিয়াত (মানবিকতা) আর মানবিকতাবাদ (Humanism) এক বিষয় নয়। মানবিকতাবাদ (Humanism) বলতে আমি কি বুঝাতে চাচ্ছি? মানবিকতাবাদ (Humanism) বলতে যা বুঝাতে চাচ্ছি তা হল, পাশ্চাত্যে গির্জার কতৃত্ব ও প্রভাব (Hegemony) থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য সৃষ্ট মতবাদ ‘মানবিকতাবাদ (Humanism)’ এর কথা বলছি। মানুষের স্বাধীনতাকে, স্বাধীন ইচ্ছাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য পাশ্চাত্যে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সে আন্দোলনকে আমি সমর্থন করি কিন্তু পরবর্তীতে আল্লাহকে বাদ দিয়ে মানবিকতাবাদ (Humanism) এর যে ধারণাকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেটাকে আমি সমর্থন করতে পারি না। পরবর্তীতে সারা পৃথিবীতে মানবিকতাবাদ (Humanism) এর নামে যা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তা মানবিক (ইনসানী) নয়। মানুষকে তার মূলসত্ত্বা থেকে, মানুষকে মেটাফিজিক্স থেকে, মানুষকে তার রব থেকে, মানুষকে তার রূহ থেকে, মানুষের রূহকে মহামান্বিতকারী মূল্যবোধ থেকে পৃথককারী মানবিকতাবাদ (Humanism) কক্ষনো মানবিক হতে পারে না। কিন্তু দ্বীনে মুবীন ইসলাম মানবিক (ইনসানী)। ইসলাম উৎসগত দিক থেকে ইলাহী আর প্রায়োগিক দিক থেকে ইলাহী।

সামনে রমযান মাস আসছে, মসজিদের ইমামগণ এবং আলেম উলামাগণ তখন তোমাদের সামনে রোজার আয়াত পাঠ করবেন এবং বলবেন যে, আল্লাহ আমাদেরকে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এটা শুনে প্রথমেই তোমরা একটু আশ্চর্য হয়ে যেতে পার। হয়ত মুখে প্রকাশ না করলেও মনে মনে বলবে যে, আল্লাহ খাওয়া দাওয়া করার জন্য এত কিছু দিয়েছেন আবার এই গরমের দিনে কোন কিছু খাবে না পানও করতে পারবে না, এই নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। এটা কেমন একটা বিষয়? কিন্তু একটু পরেই ইনসানী (মানবিক) দিকের কথা বিবেচনা করে বলবেন যে,
فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ

যদি তোমাদের কেউ হয়ে থাকে রোগগ্রস্ত অথবা মুসাফির তাহলে সে যেন অন্য দিনগুলোয় এই সংখ্যা পূর্ণ করে ৷
ইসলামের প্রতিটি মূলনীতিতে এমন একটি ইনসানী (মানবিক) বিষয় রয়েছে। পরিবর্তিত খ্রিষ্টান ধর্ম মতে এই দুনিয়াতে তোমরা নিজেরা যত বেশী কৃচ্ছতা সাধন করতে পারবে তোমাদের রূহ আল্লাহর ততবেশী নিকটবর্তী হবে। কিন্তু ইসলাম কৃচ্ছতাকে রাহবানিয়াতকে হারাম ঘোষণা করেছে।
মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ
আল্লাহর সামনে এমনভাবে দাঁড়াও যেমন অনুগত সেবকরা দাঁড়ায় ৷
এখানে নামাজে দাঁড়ানোর কথা বলা হয়েছে। বলা হচ্ছে তোমরা তোমাদের রবকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য খুশু খুজুর সাথে তার সামনে দাড়াও। যদি দাঁড়ানোর মত অবস্থা না থাকে তাহলে?
পরেই আয়াতেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলে দিচ্ছেন,
فَإِنْ خِفْتُمْ فَرِجَالًا أَوْ رُكْبَانًا
অর্থঃ অশান্তি বা গোলযোগের সময় হলে পায়ে হেঁটে অথবা বাহনে চড়ে যেভাবেই সম্ভব নামায আদায় করো।
প্রতিটি মূলনীতিই এমন।
রাসূলে আকরাম (সঃ) বলেছেন, يسروا (সহজ করে দাও)। কিন্তু আমরা কঠিন করে দিয়েছি। রাসূলে আকরাম (সঃ) বলেছেন بشروا (সুসংবাদ দাও) কিন্তু আমরা দুঃসংবাদ দিচ্ছি। এই জন্য প্রথম বিষয় হল, ইসলাম এবং মানবিকতার মধ্যকার সম্পর্ক।

২। দ্বীন এবং দুনিয়ার মধ্যকার সম্পর্কঃ
আমরা দ্বীনকে মানুষের সামনে এমন ভাবে তুলে ধরি যেন মহান আল্লাহ দ্বীনকে এই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন দুনিয়াকে খাটো করে দেখানোর জন্য। মহান আল্লাহর কিতাবে এবং রাসূলে হাদীসে এমন কোন আয়াত বা হাদীস নেই যা ‘ দুনিয়াকে দুনিয়া হওয়ার জন্য খাটো/ছোট করে দেখানো হয়েছে’। কোরআন হাদীসে যেটার সমালোচনা করা হয়েছে সেটা হল ‘ দুনিয়াপ্রীতি’। ফানী (ক্ষণস্থায়ী) জীবনের জন্য অনন্ত জীবনকে বেছে নেওয়ার সমালোচনা করা হয়েছে। কোরআন এবং হাদীসে ওই জীবনের সমালোচনা করা হয়েছে যে জীবন আল্লাহ এবং আখিরাতকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র দুনিয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে। সেটার নাম হল সেকুলারিজম, দুনিয়াপ্রীতি, দুনিয়াপ্রেম এবং দুনিয়া ভক্তি। যে সকল কথা বার্তা দ্বীন এবং দুনিয়াকে, দুনিয়া এবং আখিরাতকে পরস্পরের মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে দেয়, তা কোন ক্রমেই ইসলামী নয়। জান্নাত এমন এক বাগান যে বাগানের বীজকে এই দুনিয়াতেই বপন করতে হয়। জাহান্নাম এমন একটি অগ্নিকুণ্ড যার আগুনকে এই দুনিয়া থেকে নিয়ে যেতে হয়। খুব সুন্দর একটি গল্প রয়েছে আমাদের ওয়ায়েজীনরা বলে থাকেন, বাহলুল নামে একজন লোক রয়েছেন, তিনি খলিফা হারুনুর রশীদের বৈমাত্রেয় ভাই। বাহলুল বাগদাদের দরজা দিয়ে প্রবেশ করার সময় তাকে জিজ্ঞাসা করে যে, বাহলুল কোথা থেকে আসতেছ?
বাহলুল জবাবে বলে যে, জাহান্নাম থেকে আসতেছি।
বাহলুল, জাহান্নামে তোমার কি কাজ ছিল? যে জাহান্নামে গিয়েছিলেন?
একটু আগুনের দরকার হইছিল তো, এই জন্য আগুন আনতে জাহান্নামে গিয়েছিলাম,
কই দেখি? জাহান্নামের আগুন কেমন?
বাহলুল জবাবে বলে যে, খুঁজে পাই না।
কি বল বাহলুল! জাহান্নামে গিয়ে তুমি আগুন খুঁজে পাও নাই? এটা কেমন কথা?
আমিও তো অবাক হইছি। ওখানে যারা ছিল তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারা বলে যে, এখানে যারা আসে তারা আগুনকে দুনিয়া থেকে নিয়ে আসে। তারা বলে দিছে যে এখানে আগুন নাই। পরে বাহলুল এই আয়াত পাঠ করেন,
وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ
মানুষ এবং পাথর হবে যার জ্বালানী৷

এই বিষয়কে সামনে রেখে দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য আমাদেরকে খুব সুন্দর একটি দোয়া শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। সেই দোয়া হল,
رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
হে আমাদের রব! আমাদের দুনিয়ায় কল্যাণ দাও এবং আখেরাতেও কল্যাণ দাও এবং আগুনের আযাব থেকে আমাদের বাঁচাও ৷
প্রিয় যুবকরা!

মনে রাখবে, দ্বীন হল দুনিয়ার রূহ! যার ফলে দুনিয়া হল দ্বীনের শরীর সমতুল্য। রূহ ছাড়া যেমন শরীর অকল্পনীয় তেমনি ভাবে শরীর ছাড়াও রূপ অকল্পনীয়। আমরা দেখতে পাই যে, কেউ দুনিয়া এমন ভাবে আঁকড়ে ধরে আছে যেন দুনিয়া থেকে কোন দিন প্রস্তান করবে না। নিজের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে সকলের উপর হুকুমদারী করছে। আবার অপর দিকে এমন এক ধরণের লোক রয়েছে, দুনিয়াকে বাদ দিয়ে জীর্ণ শীর্ণ একটি জীবন যাপন করছে। যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে, কেন দুনিয়ার নিয়ামত থেকে উপকৃত হচ্ছেন না? তখন তারা বলে যে এই দুনিয়া দিয়ে কি হবে? ঠিক আছে আমরা সকলেই এই দুনিয়া থেকে চলে যাব। এই দুনিয়াতে কেউ থাকবে না। তবে এটা সব সময় মনে রাখতে হবে যে, আমরা মু’মিন হিসেবে এই দুনিয়াকে বিনির্মাণ করার, ইমার করার এবং বসবাস যোগ্য করে গড়ে তোলার দায়িত্ত্ব মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে দিয়েছেন।
দুনিয়াকে সবচেয়ে সুন্দর করে প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ত্ব আমাদের মুসলিম উম্মাহর।

৩। দ্বীন ও আকলের মধ্যকার সম্পর্কঃ এটি হল তৃতীয় বিষয়। যে বিষয় সম্পর্কে আমরা যুবকদেরকে ভালো ধারণা দিতে পারি না বা আমরা ভুল বুঝিয়ে থাকি। এটা আমার কথা নয়। তোমরা এবং তোমাদের মত যুবকদেরই কথা। আকল এবং দ্বীনের মধ্যকার সম্পর্ক। কোনটা আকলী কোনটা নাকলী? ইসলামের মত আকলকে এত গুরুত্ত্ব দিয়ে থাকে সমগ্র দুনিয়াতে এমন কোন পদ্ধতি, চিন্তা ও দর্শন পাওয়া যাবে না। ইসলাম আকলকে মর্যাদার চোখে দেখে থাকে। যদি এমন কোন কিছু শোনে থাক যা আকলকে ছোট করে, আকলকে অপ্রয়োজনীয় ভাবে, তাহলে জেনে রাখ সেটা ইসলামী নয়। যেটা দ্বীনী সেটা একই সাথে আকলী। এটাও আমরা শুনে থাকি, যদি আকলকে এক কিনারায় রেখে না দাও তাহলে জান্নাতে যেতে পারবে না!

আল্লাহ কি বলে এই ব্যাপারে? আল্লাহ এই বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলে থাকেন,
আল্লাহ বলেন, ﴿وَقَالُوا لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ أَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِي أَصْحَابِ السَّعِيرِ﴾
তারা আরো বলবেঃ আহা! আমরা যদি শুনতাম এবং বিবেক -বুদ্ধি দিয়ে বুঝতাম৷ তাহলে আজ এ জ্বলন্ত আগুণে সাজাপ্রাপ্ত দের মধ্যে গন্য হতাম না৷
দেখুন হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী আকল এবং নাকীল (দ্বীন ও আকল) এর মধ্যকার সম্পর্ক বুঝানোর ক্ষেত্রে কি বলেন। তিনি বলেন,
الوحي عقل من الخارج
ওহী হল এমন আকল যা বাহির থেকে মানুষের কাছে এসেছে।
العقل وحي من الداخل
আর আকল হল মানুষের ভেতর থেকে আগত ওহী।

আকল এবং ওহীর মধ্যকার সম্পর্ককে বুঝানোর জন্য আমাদের ইসলামী সভ্যতার ইতিহাস যে পরিমানে গ্রন্থ লেখা হয়েছে সে সকল গ্রন্থকে যদি একত্রিত করি তাহলে একটি বিশাল লাইব্রেরী কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যাবে। এত পরিমাণে গ্রন্থ লেখা হয়েছে এই আকল সম্পর্কে।

কিন্তু সেই আকলের কোন মূল্য নেই যে আকল ওহীকে বাদ দেয়। সেটা বলা হয় রেশনালিজম বা যুক্তিবাদ (Rationalism)। ওহীকে বাদ দিয়ে আকলকে যারা একমাত্র জ্ঞান এবং সত্যের উৎস বলে থাকে আমি তাদের কথা বলছি না। কিন্তু আল্লাহর দ্বীন মানুষের আকলকে উদ্দেশ্য করে কথা বলে থাকে। আল্লাহর কিতাব মহাগ্রন্থ আল-কোরআন যেমন আল্লাহর একটি কিতাব তেমনি ভাবে মানুষের আকলও আল্লাহর একটি কিতাব (সৃষ্টি)। এখানে শুধুমাত্র আকলের সীমাবদ্ধতা সমূহ সম্পর্কে তোমাদের জানতে হবে। আর আমাদের দায়িত্ত্ব হল এর সর্বদায় এর সীমানাকে বৃদ্ধি করা। আমরা যদি মানব সভ্যতার ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, মানুষ সব সময় তার আকলের সীমানাকে বর্ধিত করার চেষ্টা করেছে। যদি তা না করত তাহলে এই সকল নিত্য-নতুন আবিষ্কার আমাদের চোখে পড়ত না।

৪। দ্বীন এবং ইলমের মধ্যকার সম্পর্কঃ
চতুর্থ বিষয় হল দ্বীন এবং ইলমের মধ্যকার সম্পর্ক। আমরা এমন ভাবে কথা বলে থাকি যে, তা শুনে মনে হয় যে দ্বীন যেন ইলমের বিরোধী। এর উপর ভিত্তি করে এক বিশেষ ধরণের চিন্তা ধারা আমাদের যুবকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যুবকদের অনেক প্রশ্ন এই বিষয়ের উপর ভিত্তি করে এসে থাকে। একটু আগেও আমি বলেছি মহা-বিশ্বের আয়াত সমূহের সাথে মহা-গ্রন্থের আয়াত সমূহের বিভাজন মোটেও কাম্য নয়। ফিজিক্স এবং গণিতকে তাফসীরের থেকে আলাদা করতে পারব না। পৃথিবীর সমস্ত বিজ্ঞানী গণ তাদের জ্ঞান-গবেষণার মাধ্যমে কেবলমাত্র ততটুকুরই ব্যাখা করতে পারবেন, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যতটুকু আইন কানুন এই মহা-বিশ্বের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন।এর বেশী কিছু নয়। বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসির খুব সুন্দর একটি ঘটনা রয়েছে। এটা যিনি নিজের কানে শুনেছিলেন তিনি আমাকে বলেছেন, একদিন সাঈদ নুরসীর কাছে স্কুল ও কলেজের কিছু শিক্ষার্থী আসেন। তারা তাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, আমাদের শিক্ষকরা আমাদেরকে নাস্তিকতার দিকে দাওয়াত দেয়। এমতাবস্থায় আমরা কি করতে পারি?

তাদের এই প্রশ্ন শুনে সাঈদ নুরসী তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন যে, কোন শিক্ষকরা?
জবাবে শিক্ষার্থীরা বলে যে, পদার্থ ও রসায়নের শিক্ষকগণ।
এই জবাব শুনে তিনি শিক্ষার্থীদেরকে বলেন যে, তোমরা তোমাদের শিক্ষকদের কথা বাদ দিয়ে পদার্থ ও রসায়নকে ভালোভাবে পড়। তাহলে সেখানে দেখবে যে, মহান আল্লাহ এই দুনিয়ার জন্য যে সকল অপরিবর্তনীয় আইন-কানুন লিখে দিয়েছেন সে সকল আইন-কানুন ও নীয়মনীতিই ওই সকল বইয়ে লেখা আছে। তোমাদের শিক্ষকরা তোমাদেরকে নাস্তিকতার দিকে নিয়ে গেলেও ওই সকল বই তোমাদেরকে মহান প্রভুর কাছে নিয়ে যাবে। যে প্রভু তোমাদেরকে শুন্য থেকে সৃষ্টি করেছেন।

৫। দ্বীন এবং সংস্কৃতির মধ্যকার সম্পর্কঃ
আমি এই ব্যাপারে তোমাদেরকে একটি ঘটনা বলতে চাই। একই সাথে এই ঘটনাটি এমন একটি ঘটনা যে ঘটনা মুসলিম উম্মাহ হিসেবে আমাদের মাথাকে ছোট করে দিয়েছে। বন্ধু এবং ভ্রাতৃপ্রতিম একটি দেশের ধর্ম মন্ত্রীকে একটি প্রশ্ন করা হয়। দেশটি হল সৌদি আরব।
প্রশ্নটি ছিল, নারীদের গাড়ি চালানো জায়েজ কিনা?
সেই সময়ে জবাব দেওয়া হয় যে না, জায়েজ নয়। এটা আমাদেরকে খারাপের দিকে নিয়ে যাবে।
لانها تودي الي المفاسد
আমাদের ইসলামী সভ্যতার একজন বড় আলেম রয়েছেন। নাম হল ইবনুল জাওজিয়্যাহ। তিনি বলেন, পৃথিবীতে যারা সবচেয়ে সীমা ছাড়িয়ে যায়, তারা হল আল্লাহর দ্বীনের নামে ফতওয়া জারী কারীরা।
المفتي الموقع عن الله تعالي
মুফতি হল এমন ব্যক্তি যে আল্লাহর নামে স্বাক্ষর করে। এটা হল মুফতির সংজ্ঞা।
সে মৃত্যুবরণ করার পর তার যিনি স্থলাভিষিক্ত হোন, তাকেই এই একই প্রশ্ন করা হয়। তিনিও জবাবে বলেন যে, জায়েজ নয়।
আল্লাহর হালাল কৃত বিষয়কে তারা কোন দলীলের উপর ভিত্তি করে হারাম করেছে? মানুষ যার মধ্য দিয়ে উপকৃত হতে পারে সেটাকে কেন হারাম ঘোষণা করা হল?
আমি দুই বছর আগে সৌদি আরবে যাই, সেখানে আলেমদের সাথে বৈঠকে বসি। আমি তাদেরকে বলি যে, আপনারা কি এই ফতওয়াকে পুনর্বিবেচনা করতে চান না?
তারা আমাকে বলে যে কেন?

আমি তাদেরকে পুনরায় প্রশ্ন করি যে, কিসের উপর ভিত্তি করে আপনারা এটাকে হারাম বলেছেন? আমাদেরকে দলীলটা বলতে পারবেন? আল্লাহ যে বিষয়কে মুবাহ গণ্য করেছেন, মানুষ যার মাধ্যমে উপকৃত হতে পারবে এটাকে আপনারা কিভাবে হারাম বলেন? এই কর্তৃত্ব আপনারা কোথায় পেলেন?
আমাকে বলে যে سد الذرائع এর উপর ভিত্তি করে। سد الذرائع এবং درء المفاسد নামক ফিকহের মূলনীতি দুইটি কি আল্লাহ তায়ালার হালাল কৃত বিষয়কে হারাম করতে পারে?
দয়া করে আপনারা এখান থেকে সরে আসেন।
তারা জবাবে বলে যে, না সম্ভব না।
পরবর্তীতে কি ঘটেছে?

শাসন গোষ্ঠীর মধ্যে পরিবর্তন হয়েছে। উম্মাহকে দেওয়া আল্লাহ প্রদত্ত্ব সম্পদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করেছে। এর পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি ঘোষণা পত্র জারী করা হয়। কিন্তু কয়েক মাস পূর্বে সৌদি প্রিন্স তার অ্যামেরিকার সফর কালে একটি ঘোষণা পত্র জারি করেন। সে ঘোষণা পত্রে বলা হয় যে, নারীরা এখন থেকে গাড়ি চালাতে পারবে। এই ঘোষণা জারী হওয়ার পর ট্রাম এবং তার স্ত্রী সৌদি আরবের নারীদেরকে অভিনন্দন জানায়। বিশ্ববাসীর সামনে এই ব্যাপারটি আমাদের মাথাকে নিচু করে দিয়েছে। এরকম হওয়া অসম্ভব। তাদের হারামকৃত একটি বিষয় কি করে আজ হালাল হয়ে গেল?

জাতিসংঘের মহাসচিব, জাতিসংঘের এক অধিবেশনে ৫ মিনিট ধরে শুধুমাত্র এই বিজয়ের কীর্তিগাথা বয়ান করেন।
আল্লাহ যে বিষয়টিকে নারীদের জন্য হালাল করেছেন সে বিষয়টিকে তারা سد الذرائع নামে হারাম করে রেখেছিল! পরে ট্রাম্পের পরামর্শে নারীদের জন্য হালাল করে দেওয়া হল!

এই ঘোষণা শোনার পরে আমি ওই সকল আলেমদের ব্যাখা শুনার জন্য ঘাটাঘাঁটি করি। ওই সময় আমাকে যারা হারাম বলেছিল, তারাও বলে যে আমরা سد الذرائع এর উপর ভিত্তি করে হারাম বলেছিল। এখন সেই খারাপটা আর নেই তাই নারীরা গাড়ি চালাতে এখন আর কোন বাঁধা নেই!

প্রিয় যুবক ভাইয়েরাঃ
আমি এই কাহিনী কেন বললাম? আমি এটা খুব ভালো করেই জানি যে, আমরা কোন ভুল কথা বললে বা ভুল ফতওয়া দিলে তোমরা নিজেদের মধ্যে এগুলো নিয়ে পুংখানু পুঙ্খ ভাবে বিশ্লেষণ করে থাক। এরকম বিষয় যখন শুনবে দয়া করে এই সকল ফতওয়াকে আল্লাহর দ্বীনের অংশ বলে মনে করবে না। এই সকল বিষয় শুনলে আল্লাহর দ্বীনের প্রতি তোমাদের মুহাব্বাত ও ভালোবাসা যেন না কমে। আমাদের ভূলের কারণে, আমাদের ভূল ব্যাখার কারণে দ্বীনের প্রতি তোমাদের অফুরন্ত শ্রদ্ধাবোধ যেন কমে না যায়। তার পরিবর্তে তোমরা আলেম এবং আলেমা হওয়ার সিন্ধান্ত নেও। ইসলামকে মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করো। ইসলামের মহা-সত্যেকে খুঁজে পাওয়ার জন্য, হাকীকতকে খুঁজে পাওয়ার জন্য নিজেকে জ্ঞান অর্জনের পথে ন্যাস্ত করে দাও।

জ্ঞান সম্রাট আলিয়া ইযযেত বেগোভিচের সুন্দর একটি কথা রয়েছে,
‘আকাশের শিক্ষার্থী হওয়া ছাড়া, দুনিয়ার শিক্ষক হওয়া যায় না’।
প্রিয় যুবক ভাইয়েরা, নিজেদেরকে ইসলামের জন্য প্রস্তুত কর। ইসলামী সভ্যতার পতাকাকে পুনরায় মানবতার সামনে উড্ডীন করে তুলে ধরার জন্য সকল ধরণের ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত হও। তোমাদের পড়াশুনা যেন কেবলমাত্র ডিগ্রী অর্জন এবং ভালো একটি ক্যারিয়ারের জন্য না হয়।
আমি রাসূলে আকরাম (সঃ) এর একটি হাদীস পাঠ করেই আমার বক্তব্য শেষ করতে চাই,
منْ سَلَكَ طَريقًا يَبْتَغِي فِيهِ علْمًا سهَّل اللَّه لَه طَريقًا إِلَى الجنةِ، وَإنَّ الملائِكَةَ لَتَضَعُ أجْنِحَتَهَا لِطالب الْعِلْمِ رِضًا بِما يَصْنَعُ، وَإنَّ الْعالِم لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ منْ في السَّمَواتِ ومنْ فِي الأرْضِ حتَّى الحِيتانُ في الماءِ، وفَضْلُ الْعَالِم عَلَى الْعابِدِ كَفَضْلِ الْقَمر عَلى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ،

অনুবাদ: বুরহান উদ্দিন | আঙ্কারা, তুরস্ক