অধীনস্থদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য

حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ حَرْبٍ قَالَ حَدَّثَنَا شُعْبَةُ عَنْ وَاصِلٍ الْأَحْدَبِ عَنْ الْمَعْرُورِ بْنِ سُوَيْدٍ قَالَ لَقِيتُ أَبَا ذَرٍّ
بِالرَّبَذَةِ وَعَلَيْهِ حُلَّةٌ وَعَلَى غُلَامِهِ حُلَّةٌ فَسَأَلْتُهُ عَنْ ذَلِكَ فَقَالَ إِنِّي سَابَبْتُ رَجُلًا فَعَيَّرْتُهُ بِأُمِّهِ فَقَالَ لِي النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَا أَبَا ذَرٍّ أَعَيَّرْتَهُ بِأُمِّهِ إِنَّكَ امْرُؤٌ فِيكَ جَاهِلِيَّةٌ إِخْوَانُكُمْ خَوَلُكُمْ جَعَلَهُمْ اللَّهُ تَحْتَ أَيْدِيكُمْ فَمَنْ كَانَ أَخُوهُ تَحْتَ يَدِهِ فَلْيُطْعِمْهُ مِمَّا يَأْكُلُ وَلْيُلْبِسْهُ مِمَّا يَلْبَسُ وَلَا تُكَلِّفُوهُمْ مَا يَغْلِبُهُمْ فَإِنْ كَلَّفْتُمُوهُمْ فَأَعِينُوهُمْ) رواه البخاري-1-52.

সরল অনুবাদ : বিশিষ্ট সাহাবী মা’রু ইবনে সুয়াইদ রা. বলেন, আমি সাহাবী আবু যার গিফারীর রা. সাথে “রাবাযা”নামক স্থানে সাক্ষাত করলাম। দেখলাম তার গায়ে একটি দামী বিদেশী পোষাক, এবং তারই চাকরের (খাদেম) গায়েও একই ধরনের পোষাক পরা। তখন আমি এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম! জবাবে আবু যার গিফারী রা. বলেন, আমি জনৈক ব্যক্তিকে (চাকর) বকাঝকা, গালিগালাজ করছিলাম। এক পর্যায়ে তার মায়ের নাম ধরে গালি দিলাম একথা শুনে রাসূল সা. আমাকে বললেন হে আবু যার, তুমি তার মায়ের নাম ধরে গালি দিলে! (তুমি মুসলিম হওয়ার পরও) নিশ্চয়ই তোমার মাঝে জাহেলী বা অন্ধকার যুগের চরিত্র রয়ে গেছে। তারা তোমাদের সম্পর্কিত ভাই (বিভিন্ন সম্পর্কের ভাই)। কর্মচারীদেরকে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অধিনস্ত করে দিয়েছেন। অতএব যদি কারোর ভাই (যেকোনো সম্পর্কের ভাই) তার অধীনে কর্মচারী হয় তাহলে তিনি যা খাবেন কর্মচারীকে তাই খাওয়াবেন। তিনি যা পরবেন, কর্মচারীকে তাই পরাবেন। তাদের সামর্থের অতিরিক্তি কোনো দায়িত্ব বা কাজ দিওনা। আর যদি অতিরিক্ত দায়িত্ব দিতেই হয় তাহলে তাদেরকে সাহায্য কর। (সহীহ বুখারী ১/৫২)

হাদীসখানার সনদ যাচাই : আলোচ্য হাদীসখানা সহীহ বুখারী মুসলিম শরীফসহ বিভিন্ন সহীহ হাদীস গ্রন্থে উল্লেখিত রয়েছে বিধায় হাদীসখানা সন্দেহাতীতভাবে সহীহ। উল্লেখ্য যে, সহীহ বুখারী ও মুসলিম ব্যতিরেকে যেকোনো হাদীস গ্রন্থের হাদীসের সনদের মান যাচাই করা একান্ত জরুরী। সহীহ বুখারী মুসলিমে একটিও জাল বা জয়িফ হাদীস নেই বলে সকল উলামায়ে কেরাম একমত। কারণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফেরকা, মাযহাব, বক্তা, দরবারী আলিম, কবি ইত্যাদিগণ তাদের সুবিধামতো জাল বা বানোয়াট হাদীস বানিয়ে মুসলিম উম্মাহর মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন। আবু ইসমাহ ইবনে আবি মারইয়াম একাই চার হাজার জাল হাদীস বর্ণনা করেন। (তাদবিনুস্সুন্নাহ ১/১৮৭)

রাবী পরিচিতি : বিশিষ্ট সাহাবী আবু যার গিফারীর নাম জুনদুব ইবনে জুমাদা আল গিফারী। তিনি প্রথম যুগে ইসলাম গ্রহণকারীদের একজন। বলা হয় তিনি চতুর্থ নম্বর ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবী। তিনিই মদীনা হিজরতের পর থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের খেদমতে দিন কাটাতেন। নবীর খেদমতের পর বাকি সময়টুকু তিনি মসজিদে নববীতে ঘুমিয়ে কাটাতেন। তিনি দুইশত একাশিটি হাদীস বর্ণনা করেন। আরবে বনী গিফার গোত্রের প্রভাশালী ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। যাকাতের আয়াত নাযিল হওয়ার পরপরই তিনি প্রায় সম্পূর্ণ সম্পদ দান করে সাদামাঠা জীবন-যাপন শুরু করেন। হযরত ওসমান রা. এর খেলাফতের সময়ে তিনি ধনীদের পঞ্জুভত সম্পদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নিয়ে সকলের মাঝে সমবন্টনের ব্যাপারে চরম বিদ্রোহ শুরু করেন। রাষ্ট্রীয় শৃংখলা ও তাঁর সম্মান, মর্যাদা ও নিরাপত্তার স্বার্থে উসমান রা. তাঁকে মদীনার মুনাওয়ারার অদূরে ‘রাবাযা’ নামক স্থানে তাঁকে পূর্নবাসিত করেন। ৩২হিজরীতে ‘রাবাযা’ নামক গ্রামে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়।

হাদীস বর্ণনার প্রেক্ষাপট বা শানে অরুদ : সাহাবী আবু যার গিফারী রা. কে হযরত উসমান রা. কর্তৃক ‘রাবাযা’ নামক স্থানে পূর্নবাসিত করা হলে খলিফার পক্ষ থেকে তাঁর সর্বশেষ অবস্থার খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য সাহাবী সুয়াইদ রা. কে পাঠানো হয়েছিল। তিনি আবু যার রা. এবং তার চাকরের পরনে একই রকম পোষাক দেখে আবু যার রা. এর কাছ থেকে রাসূল সা. এক চাকরের গালি দেওয়ার ঘটনা জানতে পারেন। সে প্রেক্ষিতেই মহানবী (সা.) বিশ্ব মুসলিম উম্মাহকে কর্মচারীদের প্রতি সমতা, উদার, সহিঞ্চু ও মানবিক হওয়ার নির্দেশ দেন।

হাদীসের ব্যাখ্যা :
*بِالرَّبَذَةِ মদীনার মুনাওয়ারার অদূরে ‘রাবাযা’ পললী একটি প্রশিদ্ধ জনপদের নাম।
*وَعَلَيْهِ حُلَّةٌ وَعَلَى غُلَامِهِ حُلَّةٌ তৎকালীন যুগের সবচেয়ে দামী পোষাকের নাম ছিল ‘হুল্লাহ’। যা সাহাবী আবু যার গিফারী নিজেও পরেছিলেন তার চাকরকেও একই পোষাক পরিয়েছিলেন।আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, { نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُم مَّعِيشَتَهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَتَّخِذَ بَعْضُهُم بَعْضًا سُخْرِيًّا }(الزخرف الآية: ৩২)- ”আমি দুনিয়াতে তাদের জীবন যাত্রার মান বন্টন করে দিয়েছি…(সুরা যুখরুফ: ৩২) *سَابَبْتُ رَجُلًا فَعَيَّرْتُهُ بِأُمِّهِ আমি আমার এক চাকরকে গালি দিতে দিতে তার মাকে পর্যন্ত অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেছিলাম। এখানে মৌলিক তিনটি অপরাধ হয়ে গেল। ১.অপর ভাইকে গালি দেয়া ২.অপরভাইকে তাচ্ছিল্ল করা ৩.তার মাকে টেনে আনা।*إِنَّكَ امْرُؤٌ فِيكَ جَاهِلِيَّةٌ নিশ্চয় তোমার মাঝে জাহেলী কুঅভ্যাস রয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ তুমি প্রথম যুগের প্রথম স্তরের মুসলিম হওয়ার পরও জাহেলী যুগের অন্ধকার সমাজের কুঅভ্যাস তোমার মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। *إِخْوَانُكُمْ خَوَلُكُمْ তারা তোমাদের বিভিন্ন সম্পর্কে ভাই। অর্থাৎ অধিনস্ত কর্মচারী, চাকর, দাস-দাসী সবাই যেকোনো দিক থেকে, যেকোনো সম্পর্কের ভাই। কারণ সকলেরই প্রথম পিতা মাতা আদম-হাওয়া আ.। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.) অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে শ্রমিকের হাতে চুমু খেতেন। তিনি আনসারির হাতে চুমু খেয়ে বললেন, “এই হাতে কখনো জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবেনা।” (মুসলিম, হাদীস নং-১৫৬৭)তিনি বলেছেন, দুনিয়াতে আল্লাহ এমন কোন নবী পাঠাননি যিনি বকরী চরাননি।। ’সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুল্লাহ (সা.), আপনিও কি? উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ’আমিও এক ‘কিরাত’ (সামান্যঅর্থ) দু’কিরাত –এর বিনিময়ে মক্কাবাসীর বকরি চরিয়েছি- (ফাতহুলবারী, ৪র্থ খন্ড পৃ. ৩০৯) ।

শ্রমের মর্যাদা বুঝাতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,(ছাঃ) مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ أَنْ يَّأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ وَإِنَّ نَبِىَّ اللهِ دَاؤُوْدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ- কারো জন্য স্বহস্তের উপার্জন অপেক্ষা উত্তম আহার্য আর নেই।আর আল্লাহর নবী দাঊদ (আঃ) স্বহস্তে জীবিকা নির্বাহ করতেন’। বুখারী, মিশকাতহা/২৭৫৯। রাসূল (সা.) বলেছেন, শ্রমিকের পারিশ্রমিক নির্ধারণ না করে তাকে কাজে নিযুক্ত করবে না’- (বুখারি,২/১৩২, বায়হাকি)। *جَعَلَهُمْ اللَّهُ تَحْتَ أَيْدِيكُمْ আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধিনস্ত করে দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে দুনিয়ায় প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাছে মুখাপেক্ষী। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই মুখাপেক্ষীহীন। *একজ নশ্রমিকের সবচেয়ে বড় অধিকার বা দাবীহ’ল, তার শ্রমের যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভ করা। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, أُعْطُوا الْأَجِيْرَ أَجْرَهُ قَبْلَ أَنْ يَّجِفَّ عَرقُهُ- তোমরা শ্রমিককে তার শ রীরের ঘাম শুকানোর পূর্বেই পারিশ্রমিক দিয়ে দাও’।২২. ইবনে মাজাহ, মিশকাতহা/২৯৮৭, *فَلْيُطْعِمْهُ مِمَّا يَأْكُلُ وَلْيُلْبِسْهُ مِمَّا يَلْبَسُ অতএব তোমরা যা খাবে তোমার অধিনস্ত কর্মচারীদেরকেও তাই খাওয়াবে। তোমারা যা পরবে তাদেরকেও তাই পরতে দিবে। অর্থাৎ তারা কর্মচারী বলে নোংরা বাসি নিন্মমানের খাবার দেয়া যাবে না। আবার একেবারেই নিন্মমানের পোষাক দিয়ে তাদেরকে ছোট করে দেখা যাবে না। *وَلَا تُكَلِّفُوهُمْ مَا يَغْلِبُهُمْ তাদের অস্বাভাবিক দায়িত্ব চাপিয়ে দিওনা। তাদের কষ্ট হয় অথবা অধিক ভারী বোঝা তাদের উপর চাপিয়ে দিওনা। রাসুল (সা.) আরো বলেছেন,কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ উত্থাপন করবেন। তন্মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হচ্ছে, যে ব্যক্তি কাউকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করে, তার দ্বারা পূর্ণ কাজ আদায় করা সত্ত্বেও তাকে পারিশ্রমিক প্রদান করে না’- (বুখারি, দ্বিতীয় খন্ড:১৩২)।

তিনি আরো বলেছেন, চাকর, দাস-দাসী ও ‘অধীনস্থদের সঙ্গে অসদাচরণকারী বেহেশতে যেতে পারবে না’- (তিরমিজি:২৯৯৮)। ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি/ মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী’ -কাজী নজরুল ইসলাম। *فَإِنْ كَلَّفْتُمُوهُمْ فَأَعِينُوهُمْ আর যদি তাদেরকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দাও তাহলে তাদেরকে সহযোগিতা কর। অর্থাৎ নির্ধারিত দায়িত্বের উপরে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিলে তার সাথে তোমরা নিজেরা অথবা অন্য লোক দিয়ে সহযোগিতা কর। অথবা তাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব আদায় কারণে তাদেরকে ওভার টাইম বা বোনাস ভাতা বাড়িয়ে দাও।

মৌলিক শিক্ষা : ১.নিকটতম দূরতম সকলে খোঁজ খবর নেওয়া আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। ২.সরকারের পক্ষ থেকে পূর্নবাসিতদের পূর্ণ খোঁজ খবর রাখতে হবে। ৩.কাউকে গালি দেয়া যাবে না, ছোট করা যাবে না, হেয় করা যাবে না। ৪.বাবা-মা ইত্যাদির নাম ধরে গালি দেয়া চিরতরে হারাম। ৫.কাউকে গালি দেয়া অনৈসলামিক ও মূর্খতা যুগের কাজ। ৬.কর্মচারী, চাকর-বাকর, দাস-দাসীদের প্রতি সদয় ও মানবিক হতে হবে। তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে বিশেষ সজাগ থাকতে হবে। ৭.তাদের সামর্থের অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া যাবে না। যদি অতিরিক্ত দায়িত্ব বা কাজ দেওয়া হয় তাহলে তাদেরকে সহযোগিতা করতে হবে।

আহ্বান : আসুন আমাদের শ্রমিক শ্রেনী, চাকর-চাকরানী, দাস-দাসী ও সকল স্তরের কর্মচারীদের প্রতি সদয়, মানবিক, দরদী হই। যাদের পরিশ্রমে বদৌলতে মালিক শ্রেনীর সমস্ত আনন্দ-ফুর্তি ও বিলাসিতার চাকা ঘোরে তাদেরকে বঞ্চিত করা আদৌ ঠিক নয়। আল্লাহ আমাদের তওফীক দিন। আমিন।

ডক্টর মুহাম্মাদ খলিলুর রহমান মাদানী | বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক, লেখক ও মিডিয়া ব্যক্তিত