আল কুরআনের মহত্ত্ব

মিনহাজুল ইসলাম মাসুম |

যেকোনো ব্যক্তির জন্য অন্য আরেকজন প্রিয় লেখক বা কবির বই-ই প্রিয়। জগতের বড় বড় লেখক, কবি, সাহিত্যিকদের প্রিয় বইটি জনপ্রিয়তার কারণে বেস্ট সেলার হয়। দিনে লাখ লাখ কপি বিক্রি হয়, নতুন নতুন রেকর্ড হয়। বইগুলোর জনপ্রিয়তা এবং লেখার আবেদন কিন্তু সমসাময়িক। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারে না, অনেক সময় হয় কল্পনাশ্রিত। কিন্তু আমি যে বই বা কিতাবের কথা বলব, তা মানুষের ইহকাল ও পরকালের জন্য অর্থাৎ উভয় জগতের জন্য আলোকবর্তিকা। যা সর্বাধিক পঠিত, বিক্রিত, যা অন্তরে মধ্যে গাঁথা আছে কোটি কোটি মানুষের। যে বই সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে পরজীবনের শাস্তির ভয়াল অগ্নি থেকে রক্ষার জন্য মহামহিম আল্লাহ অত্যন্ত দয়াপরবশ হয়ে দিয়েছেন। এই কিতাবটি আমরা প্রতিনিয়ত পড়ছি, অধ্যয়ন করছি, পড়তে হবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত।

মহগ্রন্থ আল কুরআন, আল্লাহ কর্তৃক নাজিলকৃত সর্বশেষ কিতাব। ‘কুরআন’ এর অর্থ হলো যা পড়া উচিত, যা পড়তে হবে, যা পড়ার মতো, যা বারবার পড়তে হয়, যা পড়তে থাকতে হয়, যা পড়ার শেষ নেই। বইটির লেখক হচ্ছেন এই সমগ্র বিশ্বজগতের মালিক স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। আল্লাহর সাম্রাজ্যের কর্মকর্তা, অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফেরেশতা হজরত জিবরাইল আ:-এর মাধ্যমে প্রিয় নবী সা:-এর কাছে ২৩ বছরব্যাপী তা নাজিল হয়। পৃথিবীর বুকে এমন বইও কি আছে, যার সম্পর্কে সুনিশ্চিত করে বলা যায় যে, তাতে কোনো ভুল নেই। পৃথিবীতে কুরআনই একমাত্র কিতাব বা বই যাতে কোনো সন্দেহ নেই বলে এর রচয়িতা প্রথমেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। সূরা বাকারার ২ নং আয়াতেই তা বলা হয়েছে-
‘যালিকাল কিতাবু লা রাইবা ফিহি, হুদাল্লিল মুত্তাকিন’।
অর্থাৎ, এটি সেই কিতাব বা বই যাতে কোনো সন্দেহ নেই, মুত্তাকিদের জন্য আলোর দিশা।

এই কিতাবে যা আলোচনা করা হয়েছে তা, সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের কল্যাণের জন্য। ইরশাদ হয়েছে, ‘এই কিতাবে বা বইয়ে সব মানুষের জন্য ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। আর পথনির্দেশ ও নসিহত রয়েছে মুত্তাকিদের জন্য’ (সূরা আলে ইমরান-২)। এই কিতাব থেকে হেদায়েত লাভ সহজ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি কুরআনকে হেদায়েত লাভের জন্য সহজ করে দিয়েছি, কেউ আছ কি নসিহত গ্রহণকারী?’ (সূরা আল কামার-১৭)।

এই কিতাব থেকে আমরা বিশ্ব জগতের পরিচালক আল্লাহর পরিচয়, তাঁর রাসূলের পরিচয়, অন্যান্য নবীদের পরিচয়, ফেরেশতাকুলের পরিচয়, তাকদিরের পরিচয়, ভালো-মন্দের পরিণাম, আখিরাতের পরিচয়, হালাল-হারামের পরিচয়, অভিশপ্ত শয়তানের পরিচয়, মানুষের সফলতা ও ব্যর্থতার কারণ, সমগ্র সৃষ্টিজগত এবং এমনকি অশরীরী জীব জিন জাতির অস্তিত্ব জানতে পারি। আমাদের মৌলিক ইবাদতগুলো- সালাত, জাকাত, সাওম, হজ সম্পর্কিত নির্দেশ সরাসরি লাভ করি। জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে এ বই সবাইকে পাঠ করতেই হবে। এই কিতাবকে প্রাত্যহিক জীবনে সবার পাঠ্য হিসেবে নেয়া খুবই জরুরি। তবেই মানব জীবন সার্থক এবং আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য হাসিল হবে। তাই এই কিতাব বা বইটি আমার অত্যন্ত প্রিয়।

আল কুরআনের অনন্য বৈশিষ্ট্য : ১. এই কিতাব সর্বকালের, সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ ঐশি গ্রন্থ’। যা মানব জাতির মুক্তির সনদ। ২. এই কিতাব পাঠ করার আগে অভিশপ্ত শয়তান থেকে রক্ষার জন্য লেখকের শিখিয়ে দেয়া নির্দিষ্ট দোয়া প্রার্থনা করতে হয়, যা অন্য কোনো বইয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় না। ৩. অন্যান্য কিতাব অপবিত্র অবস্থায় স্পর্শ করা যায়, কিন্তু এই কিতাব অপবিত্র অবস্থায় স্পর্শ করা যায় না। ৪. এই কিতাবটির বেশ কতকগুলো নাম আছে, যেমন- আল ফুরকান, আল হুদা, আন নূর, আল হিকমা, আল মুবিন, আয জিকর প্রভৃতি। অন্য কোনো বইয়ের এত নাম নেই। ৫. এই কিতাবের আরো কতকগুলো বিশেষায়িত নাম আছে, যেমন- আল কুরআনুল হাকিম, আল কুরআনুল কারিম, আল কুরআনুল মজিদ। ৬. এই বইয়ের চেয়ে অধিক পঠিত বই আর নেই। যা বিশ্বজুড়ে সর্বক্ষণ পাঠ হচ্ছে এবং হবে। ৭. এই নশ্বর পৃথিবীটা চিরস্থায়ী নয়, পরকালও আছে তা যে বই আমাদের জানিয়েছে তা হলো কুরআন। ৮. এই কিতাবে কতকগুলো ব্যতিক্রমী বাক্য আছে যা পাঠ করলে, মহান আল্লাহর কাছে সিজদাবনত হতে হয়। এ রকম ১৪-১৫টি বাক্য আছে। যা অন্য কোনো বইয়ে নেই। ৯. ‘এই কিতাবের ভাব-ভাষা সম্পূর্ণ আল্লাহর। যদি আল্লাহর না হতো তাহলে বিভিন্ন মতপার্থক্য এবং পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেখা যেত।’ (সূরা নিসা-৮২)। তাই মানুষের কল্যাণের জন্য, মুক্তির জন্য, অন্যের সাথে সুন্দর আচরণ শিক্ষাদানকারী এবং পরকালীন জীবনের অনুপ্রেরণাদানকারী কিতাবটি সবারই খুব প্রিয়।

মুমিনদের কাছে কিতাবটি কেন এত প্রিয়?
১. যেহেতু এই কিতাবটি মানুষের জন্য ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির দিকনির্দেশনা দেয়। ২. যেহেতু কিতাবের বইয়ের নির্ভুলতার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। যেহেতু আজ পর্যন্ত কেউ এর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারেননি। ৩. যেহেতু এই এমন এক ব্যক্তির ওপর অবতীর্ণ হয়েছে, যার তুলনা পৃথিবীতে কারো সাথে হতে পারে না। তিনি হচ্ছেন সাইয়্যেদুল মুরসালিন হজরত মুহাম্মদ সা:। যার চরিত্রের সার্টিফিকেট স্বয়ং আল্লাহই দিয়েছেন। যার সত্যবাদিতা এবং আমানতদারিতার ব্যাপারে তাঁর ঘোরতর শত্রুও দিয়েছেন। ৪. যেহেতু এই কিতাবটি সংরক্ষণের দায়িত্ব, তাঁর রচয়িতা স্বয়ং নিয়েছেন। যার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার যায়। ৫. যেহেতু এই কিতাবনিট রচনাশৈলী, শৈল্পিক সৌন্দর্য এবং বর্ণনার বাচনভঙ্গী অন্যান্য বইয়ের চেয়ে পৃথক। ৬. যেহেতু এই বইয়ের পাঠক এবং মুখস্থকারী হাফেজ পৃথিবীর যেকোনো বইয়ের চেয়ে বেশি। অবশ্য অন্যান্য বইয়ের কোনো হাফেজ বা মুখস্থকারী নেই বলে নিশ্চিত বলা যায়। ৭. যেহেতু অন্য কোনো বই পাঠ করলে নেকি হবে এমন কথা কোনো বইয়ে নেই। একমাত্র এই কিতাবের ব্যাখ্যাগ্রন্থ হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি এই কিতাবের (কুরআনের) একটি অক্ষর পাঠ করবে, তার জন্য রয়েছে বিশেষ নেকি। আর নেকি দেয়া হবে ১০ গুণ। আমি (মুহাম্মদ সা:) বলছি না যে, ‘আলিফ-লাম-মিম’একটি অক্ষর। বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর এবং মিম একটি অক্ষর’। ৮. যেহেতু এই কিতাবটি অপরিবর্তনীয়। কোনো সংস্করণ, সংযোজন এবং বিয়োজন চলবে না। কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহ পাকের কাছেই।

এই কিতাবের মূল চরিত্র : আল কুরআনের মূল ভূমিকায় আছেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ সা:। যাকে কেন্দ্র করে মানবজাতির হেদায়েতের জন্য এই বইটি অবতীর্ণ হয়। মূল আলোচ্য বিষয় মানুষ। মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য, মানুষের জীবনাচারকে পরিশুদ্ধ করার জন্য, মানুষকে হিকমত ও গঠনমূলক উপদেশ দেয়ার জন্য। যাকে প্রেরণ করা হয়েছে মানবতার শিক্ষকরূপে, শ্রেষ্ঠতম আদর্শরূপে এবং সিরাজাম মুনির বা আলোর প্রদীপ হিসেবে। এই বইটি বিশেষ বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে এবং প্রয়োজনানুসারে অবতীর্ণ হয়েছে। ৪০ বছর বয়সে নিরবচ্ছিন্ন ধ্যানের সময় রাসূল সা:-এর কাছে অহিকৃত সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি বাক্য তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হয়। এর পরপরই মানুষকে দাওয়াত দিতে থাকেন কুরআনের। তখন থেকেই পৃথিবীর মানুষ এই কিতাব বা বইটি সম্পর্কে জানতে পারেন। এ ছাড়া এ বই মুহাম্মদ সা:সহ মোট ২৫ জন আল্লাহর প্রিয় নবী ও রাসূলের নাম উল্লেখ রয়েছে। যারা যুগে যুগে মানুষকে সঠিক পথের দিশা দিতে আল্লাহ পাক পাঠিয়েছিলেন। এই বইয়ের মূল কপি মহান আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত আছে। যা ‘লাওহে মাহফুজ’ নামে আমরা জানি। কিন্তু অন্যান্য বইয়ের সর্বস্বত্ব লেখকের কাছে থাকে এবং নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে। কিন্তু আল কুরআন কখনো নষ্ট হবে না, তা অবিনশ্বর।

কুরআনের আলোচ্য বিষয়সমূহ : ১. এতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোচনা করা হয়েছে। ২. মানুষের যেকোনো সমস্যার যথাযথ সমাধান আছে, যেমন- বিয়ে-তালাকের আইন। ৩. এতে শরিয়তে অনেক হুকুম-আহকাম আছে। ৪. দণ্ড প্রয়োগবিধি আলোচনা করা হয়েছে। ৫. যুদ্ধনীতি, শান্তিচুক্তি, বন্দী নীতি, কূটনৈতিক সম্পর্ক, আচরণবিধি প্রভৃতি বর্ণিত আছে। ৬. এতে হালাল, হারাম (আদেশ-নিষেধ) সম্পর্কে আলোচনা আছে। ৭. এতে সমাজ-সংগঠন, দেশ-পরিচালনা সম্পর্কিত বিধি আছে। ৮. এতে পারিবারিক নীতি, সামাজিক নীতি, নারীনীতি, অর্থনীতি, ভূমিনীতি সম্পর্কিত আলোচনা আছে। ৯. তাওহিদ, রিসালাত এবং আখিরাতের অতি সুন্দর বর্ণনা আছে। ১০. কী করলে জান্নাত পাবে? এবং কী করলে জাহান্নাম অনিবার্য তা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ১১. পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ধ্বংসের কাহিনী বর্ণিত আছে।

এই কিতাবের সমকক্ষ কোনো কিতাব নেই : আজ পর্যন্ত আল কুরআনের চ্যালেঞ্জ কেউ গ্রহণ করেনি। ইরশাদ হয়েছে- ‘(হে নবী) আপনি বলুন, এই সূরার মতো ১০টি স্বরচিত সূরা রচনা করে আনো এবং আল্লাহ ছাড়া যদি তোমাদের কোনো সাহায্যকারী থাকে, তবে তাদের সাথে ডেকে নাও যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো’ (সূরা হুদ-১৩)। শুধু তা-ই নয়, ‘১০টি সূরার পরিবর্তে একটি সূরার চ্যালেঞ্জও কেউ গ্রহণ করেননি’ (সূরা আল বাকারা-২৩)।

এই কিতাব সম্পর্কে উপরোক্ত আলোচনা সংক্ষিপ্ত মাত্র। কিতাবটি জ্ঞানের মহাসমুদ্র। ঈমান বা বিশ্বাস, আমল বা কর্ম এবং ইলম বা জ্ঞানের নিবিড়চর্চার সমন্বয়ে এই কিতাবটি থেকে জ্ঞানার্জন করে কল্যাণ লাভ করতে হবে। এই কুরআন নামক কিতাব বা বইটির অনন্য কিছু কথা কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রিয় নবী সা: দিয়েছেন। যেমন- এটি আল্লাহর রজ্জু, হিকমতপূর্ণ উপদেশ, সরল পথ, নফসকে সরল পথে পরিচালিত করে, জিহ্বা যার দ্বারা সিক্ত থাকে, জ্ঞানীরা প্রেরণা লাভ করে থাকে, বারবার পাঠ করলে স্বাদ আরো বাড়তে থাকে এবং যার রহস্যের কোনো শেষ নেই। পরিশেষে বলা যায়, আমার কাছে তাই এই বই-ই প্রিয়। কারণ এই কিতাব পড়লে অসাধারণ জ্ঞান লাভ করা যায়, বিধানগুলো মেনে চললে সম্মানিত হওয়া যায়, শিক্ষাদান করলে সর্বোত্তম ব্যক্তি বলে রাসূল সা: কর্তৃক ঘোষিত হয়, পরকালে মুক্তির গ্যারান্টি পাওয়া যায়। তাই কিতাব হচ্ছে সমগ্র মানব জাতির জন্য আলোর মিনার। এমন কিতাবের তুলনা অন্য কোনো বইয়ের সাথে হতে পারে না।
লেখক : গবেষক