সন্তানের দ্বীন পালনে বাবা-মা

মাহমুদুল হাসান | 

১.
বাস স্ট্যান্ডে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে ওয়াহিব। ঈদের ছুটি শেষ, তাই চারপাশে কেবল মানু্ষের সমাগম। হঠাৎ এক বৃদ্ধা এসে হাত পেতে বসল। এক পলক বৃদ্ধার দিকে তাকালো ওয়াহিব, তারপরই আবার বাবার দিকে তাকালো। বাবার মুখে কিছুটা বিরক্তির ছাপ।

ঈদে পাওয়া বকশিশ থেকে ২০ টাকার একটা নোট বের করে বৃদ্ধার দিকে এগিয়ে দিল। দেখে ফেললেন বাবা। ছেলের হাত থেকে ২০ টাকা নিয়ে খুচরো ২টাকার একটি নোট মানিব্যাগের কোণা থেকে বের করে বৃদ্ধার থালাতে দিলেন। ছেলে কিছুটা বিভ্রতবোধ করলো।
-বাবা ২ টাকা কেন দিলা তুমি?
-এত টাকা ফকিরদের দিতে হয় না, আব্বু।
-কিন্তু ২ টাকা দিয়ে তো কেবল একটা চকলেটই কিনতে পারবে। উনি কি চকলেট কিনে খাবে?

২.
ইসলাম নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে সাজিদ এই কিছুদিন হলো। জানতে পারলো হাশরে সবকিছুর আগে সালাতের হিসাব নেওয়া হবে। কেউ এই পরীক্ষায় পাশ করে গেলে বাকি পরীক্ষাগুলো তার জন্য সহজ হয়ে যাবে। যেই জানা সেই কাজ। এতোদিন সাজিদ কেবল সালাতের ফরযটুকুই আদায় করে আসছিল। বিষয়টি জানার পর সে চেষ্টা করছিল সুন্নাহ, ওয়াজিবগুলো সঠিকভাবে শিখতে যাতে তার বিচার দিবসের হিসাবটা আর একটু সোজা হয়। একদিন তার হুজুর তাকে জানালেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “একাকী সালাত আদায় অপেক্ষা জাম’আতে সালাত আদায় করলে ২৭ গুণ বেশি সাওয়াব পাওয়া যায়।” -(সহীহ বুখারী: ৬৪৫)
২৭ গুন বেশি সওয়াব! তাহলে তো মসজিদে গিয়েই সালাত পড়তে হবে।
-আম্মু আমি একটু বের হচ্ছি।
-কোথায় যাচ্ছ তুমি?
-মসজিদে যাব, হুজুর বলেছেন মসজিদে সালাত আদায় করলে ২৭ গুণ বেশি সওয়াব পাবো।
-হ্যাঁ, সেটা ঠিকাছে। কিন্তু প্রতিদিন ৫ বার করে তুমি মসজিদে গেলে তো অনেক কষ্ট হয়ে যাবে।
-এইতো পাশেই মসজিদ।
-তবুও কতবার সিড়ি বেয়ে নামতে হবে! থাক যাওয়া লাগবে না।
-কিন্তু আম্মু হুজুর বলছে…
-আবার কিসের কিন্তু? হুজুর কি শুধু জাম’য়াতে সালাত পড়তে বলছে, মায়ের কথা যে শুনতে হয় তা বলেনি? এখন বাসায় পড়, বড় হলেও মসজিদে গিয়ে পড়তে পারবে।

৩.
ইয়াসির অনেকক্ষণ ইউটিউবে ঘেঁটে-ঘুঁটে দেখল প্রায় সব হুজুররাই বলছে- “দাঁড়ি রাখতে হবে, কাটলে গুনাহ হতে পারে। আর যেহেতু সকল নবী-রাসুল দাঁড়ি রেখেছে তাহলে মুসলিমদেরও উচিত দাঁড়ি রাখা”। সবেমাত্র কলেজ জীবনে পা রেখেছে ইয়াসির। বয়ঃসন্ধিকালের প্রভাবে মুখের দু’পাশে কিছু কিছু দাঁড়িও গজিয়েছে। দাড়ি রাখা সুন্নত না ওয়াজিব এ নিয়ে অনেক মতবিরোধ থাকলেও, নবিজি (সা:) রেখেছে এই জন্য সেও দাঁড়ি রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
-ইয়াসির সেলুনে গিয়ে চুল কেটে আসো, মুখের ইগুলাও ছোটো করো। (বাবা)
-আব্বু আরো কিছুদিন পরে চুল কাঁটি, এখনো বড় হয় নাই। ঘন ঘন চুল কেটে টাকা নষ্ট করার দরকার নেই। সে জানত আর মা-বাবা তার দাঁড়ি রাখাকে সাপোর্ট করবে না। তবুও সে রাখতে চাইত। তাই ইচ্ছে করেই বাহানা বানাচ্ছে সে। দেড় মাস পর-
-আব্বু টাকা দাও সেলুনে যাব।
-ভালোমতো চুল কাটাবে, বেশি স্টাইল করে কাটার দরকার নেই।
-হুম ঠিক আছে। ভাবতেছি দাঁড়িগুলা রেখে দিব, দেখতে সুন্দরই লাগে। (সাহস করে বলেই ফেলল)
-না, কি দাঁড়ি রাখবা এই ছোট্ট বয়সে! কলেজও তো পাশ করো নাই। বড় হলে রাখিও।
বহু চেষ্টা সত্ত্বেও রাজি করাতে পারেনি সে, কারণ তারা বাবা-মা।

৪.
-সাজিদ তুমি নাকি এখন কোচিংয়ে দেরি করে যাও? বাসা থেকে তো ঠিক টাইমেই বের হও। তবুও লেট হয় কেন?
-একটু লেট হয় মাঝে মাঝে।
-মাঝে মাঝে না, প্রতিদিন? তোমার স্যার ফোন করেছিল তুমি নাকি ক্লাসে সবার শেষে ঢুকো, আর ডেইলি লেট হয়।
-মসজিদ থেকে একেবারে সালাত পড়ে যাই। নাহলে সালাতটুকু মিস হয়ে যায়। স্যারকে তো আমি বলেছিলাম।
-এখন এসব করে নিজের পড়ার ক্ষতি করলে হবে? সামনেই তো এসএসসি পরীক্ষা। পরীক্ষার পরে অনেক সময় পাবে, তখনও তো পড়তে পারবে।
-কিন্তু এতদিনের এত ওয়াক্ত সালাত মিস করতে পারব না।
-আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নিবা, আল্লাহ অনেক ক্ষমাশীল। আর তুমি তো এখনো ছোট।
-আচ্ছা! এত সহজ! তাহলে আমার গুনাহ তুমি নিয়ে নিও আম্মু, পরে তুমি ক্ষমা চেয়ে নিও।
-মুখে মুখে তর্ক করো না, যেটা জানো না সেটা নিয়ে কথা বলো না। পড়ায় মন দাও, শেষ সময়ে এসে ফাঁকিবাজি করো না।
পারিবারিকভাবে আমাদের যেসব আদব শেখানো হয়, তন্মধ্যে একটা হলো বড়দের প্রতি ‘আনুগত্য’ প্রদর্শন করা। নিঃসন্দেহে এটি উত্তম আখলাকের পরিচায়কও বটে। আর পিতামাতার আনুগত্য, তাদের খিদমত তো আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় আমল। হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ্ ইবনু ‘উমার রাদ্বিয়াল্লাহু‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন – “এক ব্যক্তি নবী ﷺ নিকট এসে জিহাদে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করলো। তখন তিনি বললেন, ‘তোমার পিতামাতা জীবিত আছে কি?’ সে বললো, ‘হ্যাঁ।‘ নবী ﷺ বললেন, ‘তবে তাঁদের খিদমতের চেষ্টা কর।” [বুখারি: ৫৯৭২]

মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত, আর বাবার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি। কিন্তু কেমন হয় যখন তারাই তাদের সন্তানদের ইসলাম বিমুখ করে দেন? তাহলে কি সন্তানরা খারাপের দিকে যাবে না? প্যারেন্টিং এর ক্ষেত্রে, সব মা-বাবাকেই বুঝতে হবে,
• কোন শিক্ষায় গড়ে তুলছেন আপনার সন্তানদের?
• কোনটি বেছে নিতে শিখিয়েছেন, দুনিয়া নাকি আখিরাত?

সন্তান মহান আল্লাহ তা’আলার বিশেষ আমানত। দুনিয়াবি জীবনের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে আমরা ভুলে গেছি আমাদের শিকড়ের কথা। আপনাকে সন্তান দান করা হয়েছে নিয়ামাতরূপে, তার মানে এই নয় যে সন্তানকে আপনি আপনার ইচ্ছামত মানুষ করবেন। রাব্বুল আ’লামিনের কাছে আপনি বাধ্য তাদের বিষয়ে জবাবদিহি করতে। ইসলামি শিক্ষায় বড় করা, নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা আপনার কর্তব্য।

সব শিশুরাই অনুকরণ প্রিয়। তারা তাদের মা-বাবা থেকেই দ্বীনের প্রথম শিক্ষা লাভ করে থাকে। আপনারা তাকে যে শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন, সেই মূল্যবোধ নিয়েই সে বড় হবে। আপনার হাত ধরেই সে পৃথিবীকে চিনতে শিখে, কোনটা ভুল আর সঠিক তার পার্থক্য করার জন্য প্র‍য়োজনীয় পাঠ আপনিই দিতে পারবেন। আপনার দেয়া শিক্ষাই তার মধ্যে প্রতিফলিত হবে। চারাগাছকে যেভাবে যত্ম নিবেন, সেভাবেই তো বেড়ে উঠবে। কোনো সন্তান ছোটবেলা থেকে ঠিক করে রাখে না যে স্ট্যাটাস এর দোহাই দিয়ে তার বাবা-মাকে সে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে।

সব সন্তান তার স্ত্রীর প্ররোচনায় পড়ে মা-বাবা থেকে দূরে সরে যায় না। বরং, আপনার দেয়া শিক্ষাই তার মধ্যে প্রতিফলিত হবে। আজকে যদি আপনি নিজে সন্তানদের সামনে অনাথদের অবহেলা করেন, তেমনি ভবিষ্যৎ এ সন্তানরা যে আপনাদের অবহেলা করবে না, এর নিশ্চয়তা কতটুকু! আপনিও তো বৃদ্ধ হলে অনাথের মতই হয়ে যাবেন, নিজে কিছুই করতে পারবেন না।
দুনিয়াতে সফল ব্যাক্তি আল্লাহর নিকট সফল নাও হতে পারে। দুনিয়াবী শিক্ষা যেমন জরুরী, তেমনই দ্বীনি জ্ঞান অর্জনও ফরজ। সন্তানের কষ্ট হবে ভেবে আপনি তাকে মসজিদে দিতে চান না, টাকার অপচয় ভেবে দান সাদক্বা করতে দিচ্ছেন না।

হয়তো দুনিয়াতে আপনি অনেক ভালো মা-বাবা, নিঃসন্দেহে তাদের জন্য আপনাদের অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়; কিন্তু তারা যেন আবার আপনার দুনিয়া ও আখিরাতে আপনার কষ্টের (জাহান্নাম) কারণ না হয়।
দাদীর বয়সী একজন ভিক্ষুক বলেছিলেন, “দুটো ছেলেকে কেবল ব্যাংকারই বানাতে পেরেছি, মানুষ বানাতে পারি নি। তাই রাতের ঔষুধের জন্য সকালে আর সকালের ঔষুধের জন্য রাতে মানুষের কাছে হাত পাততে হয়”।

সন্তানদের ব্যপারে আল্লাহকে ভয় করুন। দ্বীনি শিক্ষায় বড় করুন। প্যারেন্টিং এর ক্ষেত্রে রাসূলের এই বার্তাটি অনুসরণ করুন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন- “জান্নাতে মহান আল্লাহ্‌ নেক বান্দার স্তর উঁচু করে দেবেন। সে বলবে, “হে প্রতিপালক, কীসের বিনিময়ে আমার এ উন্নতি!” তিনি বলবেন, “তোমার জন্য তোমার সন্তানের ইস্তিগফারের (ক্ষমা প্রার্থনা) বিনিময়ে!” [সুনানে ইবনে মাজাহ]
অন্যত্র রাসূল ﷺ আরো বলেন – মানুষ যখন মারা যায়, তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমলের নেকী জারী থাকে। ক. সাদক্বায়ে জারীয়া খ. ফলপ্রসূ ইল্‌ম (উপকারি বিদ্যা) এবং গ. সুসন্তান, যে তার জন্য দু’আ করে। [মুসলিম: ১৬৩১]

লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।