ফররুখ আহমদ: নির্বাসিত যুবরাজ

মীর সালমান সামিল |

এক.
ফররুখ ভাই বরাবরই পাকিস্তান ও ইসলামী আদর্শের অনুরাগী ও অনুসারী। কিন্তু তদানীন্তন পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানি শাসকেরা ইসলামের নামে যা করছিলেন, তাতে তাদের ওপরে সবচেয়ে বেশী ক্রুদ্ধ ছিলেন ফররুখ ভাই। তিনি ঐ শাসকদের ব্যঙ্গ করে ‘রাজ-রাজড়া নামে একটা নাটক লিখেছিলেন এবং তা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিনীত হয়েছিল।

ফররুখ ভাই প্রেসিডেন্ট পুরস্কার প্রাইড অব পারফরমেন্স পেলে আমরা তাকে একটি সংবর্ধনা দিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ঢাকা হল মিলনায়তনে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটির দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। ফররুখ ভাইয়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি খুবই সার্থক হয়েছিল এবং ফাররুখ ভাই প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পাওয়ার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন আমাদের সংবর্ধনা পেয়ে। বস্তুত তিনি আইয়ুব খানের কাছ থেকে আদমজী পুরস্কার আনতে করাচী যেতে রাজী ছিলেন না। পাকিস্তানী শাসকদের ইসলামের নামে অনৈসলামিক কার্যকলাপে ফররুখ ভাই এতই ক্ষুব্ধ ছিলেন যে, তাকে কখনো রাইটার্স গিল্ডের কোন কনফারেন্সে পশ্চিম পাকিস্তানে নেওয়া যায় নি।

ফররুখ ভাই রেডিওর কর্মচারী ছিলেন আর ওদিকে পাকিস্তান সরকারের তথ্য বিভাগের কর্মকর্তা কুদরতুল্লাহ শাহাব ছিলেন রাইটার্স গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু ফররুখ ভাই কোনদিন কোন আমলাকে তোয়াক্কা করেন নাই; বরং এসব জাদরেল আমলারাই ঢাকা এলে ফারুক ভাইয়ের ভাঙা বাড়ীতে গিয়ে তাঁকে তাওয়াজ করে আসতেন। ঢাকা রেডিওর কর্মকর্তারা তাকে দস্তুরমতো ভয় পেতেন। ফারুক ভাইয়ের আপোষহীন স্বাধীনচেতা নির্লোভ আদর্শবাদী চরিত্রের সামনে সব সুবিধাবাদীই মাথা নীচু করে চলতেন। ফররুখ ভাই ব্যক্তিগত স্বার্থ ও লোভের উর্ধ্বে ছিলেন।
-অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, অনন্য পুরস্কার, ফররুখ আহমদ: ব্যক্তি ও কবি (প্রবন্ধ সংগ্রহ), পৃ: ১৫০-১৫১

দুই.
আজকের সমগ্র বাংলা সাহিত্যে ফররুখ আহমদের মতো একজনও শক্তিশালী স্রষ্টা নেই। এমন একজন স্রষ্টাকে অনাহারে রেখে তিলে তিলে মরতে বাধ্য করেছি আমরা। ভবিষ্যৎ বংশধর আমাদের ক্ষমা করবে না। অথচ কবি ফররুখ আহমদের মরার সমস্ত ব্যবস্থা আমরা পাকাপোক্ত করে ফেলেছি। আমরা তার চাকুরি কেড়ে নিয়েছি, তার জামাই এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের সৎভাবে পরিশ্রম করে বাঁচার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছি। রাস্তাঘাটে কবির বেরোবার পথ বন্ধ করে দিয়েছি। প্রয়োজনীয় সবগুলো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আমরা ত্রুটি রাখিনি।

কবি ফররুখ আহমদকে আমরা এতে সব লাঞ্ছনার মধ্যে ফেলেছে, তার কারণ তার একমাত্র কবিতায়। ফররুখ আহমদের একমাত্র অপরাধ তিনি একদা পাকিস্তানের সপক্ষে কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতায় বিশেষ জীবনাদর্শের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ পেয়েছে। আর সেই জীবনাদর্শ দুষ্ট লোকের ভাষায় ইসলামী জীবনাদর্শ। এখন কথা হলো, তখন কি পাকিস্তানের সপক্ষে কবিতা লেখা অপরাধ ছিলো? আমরা যতটুকু জানি, পাকিস্তান এবং ইসলাম নিয়ে আজকের বাংলাদেশে লেখেননি, এমন কোনো কবি সাহিত্যিক নেই বললেই চলে।

অন্য অনেকের কথা বাদ দিয়েও কবি সুফিয়া কামালের পাকিস্তান এবং জিন্নাহর ওপর নানা সময়ে লেখা কবিতাগুললো জড়ো করে প্রকাশ করলে ‘সঞ্চয়িতা’র মতো একখানা গ্রন্থ দাড়াবে বলেই আমাদের ধারণা। অথচ ভাগ্যের কি পরিহাস! কবি সুফিয়া কামাল বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হয়ে মস্কো-ভারত ইত্যাদি দেশ সফর করে বেড়াচ্ছেন আর ফররুখ আহমদ রুদ্ধদ্বার কক্ষে বসে অপমানে লাঞ্ছনায় মৃত্যুর দিন গুণছেন। -আহমদ ছফা, কবি ফররুখ আহমদের কি অপরাধ?, গণকন্ঠ, ১৬ জুন, ১৯৭৩

তিন.
অথচ নজরুলের উদ্যত কষ্টের অব্যবহিত পরেই ‘সাত সাগরের মাঝি’ কাব্যগ্রন্থে ফররুখের উদ্যত তন্ময় কণ্ঠ শোনা গিয়েছিল। নজরুলের অতীত উল্লেখ যেখানে জনসভার উল্লেখের মত শিরায় দিয়েছে ঘা সেখানে ফররুখের উল্লেখ স্পর্শ হেনেছে চেতনায়, মননে, মনোগঠনে, মানসে। নজরুলের Attitude ছিল শুধুই জাগরণের, ফররুখ ছিল উদ্বোধনের। লক্ষণীয় যে ফররুখের উল্লিখিত গুণগুলোর সবগুলোই অধিকতর পরিণত কবিগুণ। তার অর্থ এই যে, ফররুখ আহমদের কবি-সাফল্যের সম্ভাবনা অন্তত ঐতিহ্য পর্যায়ে নজরুলের চেয়ে বেশী ছিল। -হাসান হাফিজুর রহমান, আধুনিক কবিতা ও ফররুখ আহমদ, ফররুখ আহমদ: ব্যক্তি ও কবি (প্রবন্ধ সংগ্রহ), পৃ: ৩৯৬

চার.
অন্য এক নিবন্ধে আমি ফররুখ আহমদকে এবং সঙ্গে সঙ্গে নজরুল ইসলামকেও- বাংলা কবিতার ইতিহাসে ব্যতিক্রমী পুরুষ বলে চিহ্নিত করেছি। এ দিয়ে আমি শুধু বলতে চেয়েছি যে এই দু’জন এঁদের কালের মুখ্য-প্রবণতার অন্তর্গত নন। এবং প্রত্যেক যুগেই সাহিত্যের একটা মুখ্য-প্রবণতা থাকে। সেই প্রবণতাই সেই যুগের আধুনিকতা। এই মূল প্রবণতা বাইরে যারা দাঁড়ান ইংরেজি সাহিত্য মিল্টন, ল্যান্ডার, ফ্রস্ট; বাংলা কবিতায় নজরুল, ফররুখ- তাদের ব্যতিক্রমী আমাদের কাছে একটা প্রশ্ন চিহ্ন রেখে যায়।
আমরা জানতে চাই এই ব্যতিক্রমিতার কারণ, এবং স্বভাবতই এই কারণের তল্লাশে আমাদের ডুব দিতে হয় তাদের ব্যক্তিজীবনে। আমাদের সহজাত বুদ্ধিই শেখায় যে ব্যতিক্রমী মানুষ না হলে ব্যতিক্রমী সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব নয়। -জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, কবি ফররুখ আহমদের কবিতা, ফররুখ আহমদঃ ব্যক্তি ও কবি (প্রবন্ধ সংগ্রহ), পৃ: ৩৭৬

পাঁচ.
সুধীন্দ্রনাথ, জসীম উদ্দীন, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে; এঁদের অব্যবহিত পরে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে, বাংলা কাবা এক সম্পূর্ণ নতুন সুর ও জীবনাদর্শের আমদানী করেন অমিততেজ ফররুখ আহমদ। ফররুখ আহমদ ছিলেন এক বেপরোয়া অভিযাত্রিক, কিন্তু তার অভিযাত্রায় তিনি ছিলেন একা, কোনো সহযাত্রী বা অনুগামী ছিল না তার, তাঁর অনুগামী হওয়াও সম্ভব ছিলো না এ কালের আর কোনো শক্তিশালী কবির পক্ষে। কারণ একাধারে শিল্পী ও মিশনারী ছিলেন ফররুখ আহমদ, একটি থেকে অপরটি বর্জন তাঁর পক্ষে ছিল অসম্ভব। তিনি তাঁর জীবনবোধ ও জাতীয় সামাজিক মতাদর্শ পরিবেশন করার পাত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কবিতাকে। এ কারণে তাঁর কবিতাই তার জীবনবোধ, তাঁর জীবনবোধই তার কবিতা। -সৈয়দ আবুল মকসুদ, তাঁর স্বপ্নরাজ্যে তিনি একা, প্রাগুক্ত, ৪৯৬

ছয়.
দুটি মৌল প্রশ্নের জবাবের উপর কবির কাব্যপ্রতিভার মৌলিকতা প্রমাণিত হয়। তিনি কি দিতে পেরেছেন কোন নতুন ভাবনা, তিনি কি দিতে পেরেছেন কোন নতুন আঙ্গিক? এবং বলা বাহুল্য, ভাবনার অভিনবত্বই আঙ্গিকের রূপ পরিবর্তন করে। ফররুখ আহমদের কাব্যপ্রতিভার বিচারে তার অভিনবত্বের পরিচয় হবে ঐ মৌল জিজ্ঞাসার উত্তর। বিংশ শতাব্দীর যে দশকে ফররুখ আহমদের উন্মেষ সে দশক বাংলা কাব্যের ঐতিহ্যগত সকল ধারাকে বদলে দিয়েছিল। -শাহাবুদ্দীন আহমদ, ফররুখ অভিনবত্ব, ফররুখ আহমদ: ব্যক্তি ও কবি (প্রবন্ধ সংগ্রহ), পৃ: ৪৬১

সাত.
বাংলা কবিতায় মধ্যপ্রাচ্যের আবহ রচনায় মোহিতলাল প্রয়াসী হয়েছিলেন। কিন্তু এই ধারায় শ্রেষ্ঠ সাফল্য বোধ করি, অর্জন করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ফররুখ সম্ভবত সেই সাফল্যকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন। নজরুলের কবিতায় মধ্যপ্রাচ্য এসেছে কেবল আবহ নির্মাণ প্রয়োজনে- মুসলিম প্রসঙ্গ অথবা ইসলামের ইতিহাস তার কবিতায় এসেছে দৃশ্য ঘটনা অথবা চরিত্র রূপায়ণের গরজে।

গীতিকার ও সঙ্গীতশিল্পী নজরুল ইরানী আবহাওয়া সৃষ্টি করেছিলেন শব্দ নির্বাচন ও যোজনার অপূর্ব কৌশলে। কিন্তু ফররুখের কৃতিত্ব সেখানেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস ও কিংবদন্তী থেকে সংগৃহীত মৃত উপকরণে নতুন প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ক্রমাগত ব্যবহারের ভেতর দিয়ে শব্দ প্রতীকী ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ হয়েছে।

মোটকথা, ফররুখ আহমদ ঐতিহ্যকে ব্যবহার করেছেন এলিয়েটীয় অর্থে, তিনি নিজেই যেন আরব্য উপন্যাসের নায়ক,সেই কল্প জগতের সম্ভাব্য সমস্ত অনুষঙ্গ যেন তারই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অংশ। ত্রিকালজ্ঞ ঋষির মতো, সন্তের মতো, কেবল বর্তমান নয়, অতীত ও ভবিষ্যতের ভেতরে উজ্জীবিত হয়েছেন তিনি। এই ক্ষেত্রে নজরুলের সংগে তার। পার্থক্য।

ফররুখের সিন্দাবাদ কেবল আরব্য উপন্যাসের চরিত্র নয়- এই সিন্দাবাদ এক আশাবাদী চেতনার প্রতীক, বারবার সমুদ্র-যাত্রায় বিপর্যস্ত হয়েও যার অভিযাত্রী আত্মা ক্লান্তি স্বীকার করে না সেই অপরাজেয় মানবিক সত্তার প্রতীক। একই অর্থে শাহজাদা, হাতেম তায়ী, নৌফেল ফররুখ আহমদের কাব্য পরিমণ্ডলে বারবার ফিরে এসেছে। বস্তুত ফররুখের কবি-ব্যক্তিত্ব বুঝতে হলে এই সব প্রতীকের মর্ম হৃদয়ংগম করতে হবে। -আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ব্যতিক্রমী শিল্পী, ফররুখ আহমদ: ব্যক্তি ও কবি (প্রবন্ধ সংগ্রহ), পৃ: ৪৩৮

আট.
অকস্মাৎ শরতের সুনীল আকাশের বুক চিরে বজ্রপাত হল। আমরা জানলাম বাংলার কাব্যাঙ্গন থেকে সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রদীপটি নিভে গেল। কবি ফররুখ আহমদ চিরনিদ্রার কোলে ঢলে পড়লেন। সাত সাগরের মাঝি বহু ক্লাতির সমুদ্র পার হয়ে এসে অনন্ত বিশ্রামের নিবিড়ে আচ্ছন্ন হলেন। হয়তো একদিন আবার পর্দা পেরিয়ে ভাতার হবে, নারাঙ্গী বনে সবুজ পাতা কাপে প্রাণরস থির থির করে। সাত সাগরের উত্তাল কলরোলে এসে আঘাত হানবে দুয়ারে, কিন্তু মাঝির ঘুম আর ভাঙ্গবে না।

ফররুখ আহমেদ আজ নেই। অন্ধকার এসে গ্রাস করেছে আলোকের উদ্দাম বিহঙ্গকে। যে বিহঙ্গের কণ্ঠে নিয়ত ধ্বনিত হয়েছে গান কবিতা ছড়া আর সনেট। যে কণ্ঠে শুনেছি শিশুর মত সরল হাসি, সে কণ্ঠ আজ স্তব্ধ হয়ে গেছে। আর কোনদিন কাকলি মুখর হয়ে উঠবে না। একথা সবাই জানেন, কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন ইসলামী রেনেসার প্রবক্তা। সত্যি বলতে কি কাজী নজরুল ইসলামের পর মুসলিম কবি হিসাবে ফররুখ আহমদই শ্রেষ্ঠ প্রতিভার দাবীদার। তিনি ইসলামিক ভাবধারার অনুসারী হলেও তার মতাদর্শ কখনই তাঁর কবিসত্ত্বাকে সকীর্ণতায় আবদ্ধ করতে পারেনি। সেই জন্যই তাঁর কবিতায় মানবতার বাণী হয়েছিল বাচ্চার। দুর্ভিক্ষের বছর তেরশো পঞ্চাশ। -সম্পাদকীয়, দৈনিক আজাদ, ২২ অক্টোবর ১৯৭৪

নয়.
ফররুখ আহমদ এমন একজন কবি, যাঁর কবিতাকে তাঁর জীবনদৃষ্টি থেকে আলাদা করা যায় না। এ জীবনদৃষ্টির সাথে যাদের সাযুজ্য তারা তাকে অনেক বেশী আন্তরিকভাবে ও মর্মগতভাবে গ্রহণ করেন। তাদের সাযুজ্য নেই তারাই তাকে শিল্পী হিসাবে, কবি হিসাবে তাঁর যে গুণ সেটা স্বীকার করেন। আমার শিক্ষক মুনীর চৌধুরীর সাথে যখন ফররুখ আহমদের প্রথম দেখা হয়, মুনীর চৌধুরী নাকি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার এ শুশ্রু কি বিশ্বাসজাত না আদর্শজাত? ফররুখ আহমদ নাকি কোন উত্তর দেননি, শুধু হেসেছিলেন। কিন্তু সেই থেকে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন পথের পথিক হয়ে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন। মুনির চৌধুরী বরাবর ফররুখ আহমদের শিল্প-প্রতিভার প্রশংসা করে গেছেন।

দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ফররুখ আহমদের ‘হরফের ছড়া’ ও ‘পাখির বাসা’ যখন প্রকাশিত হয় তখন মুনীর চৌধুরী তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। এর একটি কারণ হলো, ‘হরফের ছড়া’ যখন প্রকাশিত হয় তখন আমাদের এখানে বাংলা বর্ণমালা সংস্কারের কথা হচ্ছে। এরমধ্যে ফররুখ আহমদ ১২টি স্বরবর্ণ ও ৪০টি ব্যঞ্জণ বর্ণ নিয়ে চমৎকার ঐ ছড়ার বইটি লিখলেন। কারণ ১২টি স্বরবর্ণের মধ্যে চার চার করে বিভক্ত তিনটি স্তরে একটি অখণ্ড ছন্দের দোলা আছে। ফররুখ আহমদ সেজন্য এ বারটি বর্ণই রাখার পক্ষপাতি ছিলেন। তিনি এটা ভাঙতে চাননি বা এর কোন একটি বর্ণ বাদ দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না।

ফররুখ আহমদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরই তিনি অসাধারণ খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি বাংলা কাব্যের মূলধারার কবি হয়েও একটি স্বতন্ত্র সুর যােজনার চেষ্টা করেছেন বা করতে সফল হয়েছেন। আমরা জানি যে, চল্লিশের দশকে আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, আবুল হোসেন ও সৈয়দ আলী আহসান আমাদের এ চারজন প্রধান কবি প্রায় একসঙ্গে যাত্রা শুরু করেছিলেন। এরা চারজনই আমাদের প্রথম আধুনিক কবি। এঁরা সকলেই নিজের নিজের মত করে তাদের স্ব-স্ব কাব্যভুবন সাজিয়েছেন । একজনের সাথে আরেকজনের সাজুয্য তেমন একটা না থাকলেও মনে হয়েছিল রবীন্দ্রোত্তর যুগের আধুনিক কাব্যধারা-এরা সে পথের পথিক।

কিন্তু পরবর্তীকালে এরা দেখিয়েছেন যে, সে ধারা থেকে তারা স্বতন্ত্র ধারার পথিক। তারা মূলত স্বতন্ত্র ধারা নির্মাণ করেছেন । এদের মধ্যে ফররুখ আহমদ ছিলেন সর্বাধিক উজ্জ্বল। তার বিশেষ কৃতিত্ব এই যে, তিনি আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দ ব্যবহারে নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন। এক্ষেত্রে নজরুলের পরে তিনি সর্বাধিক সফলতা অর্জন করেন। -ডক্টর আনিসুজ্জামান, শিল্প সচেতন কবি ফররুখ আহমদ, ফররুখ আহমদের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য, পৃ: ২২০

দশ.
ফররুখ আহমদের কবি-চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তাঁর অনমনীয় ব্যক্তিত্ব এবং প্রখর আত্মমর্যাদাবোধ। আমৃত্যু তিনি বাস করেছেন দুঃসহ দারিদ্র্যের মধ্যে। কিন্তু কখন তিনি ওপরতলার দাক্ষিণ্য, লোভ কিংবা প্রাপ্তিযোগের মোহের কাছে নিজের কবিসত্তাকে খাটো করেননি। ১৯৫৮ সালে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রুপাত্মক কবিতা লিখে ক্ষমতার রোষানলে পড়তে হয়েছিল তাকে। একষট্টি সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল তার পাণ্ডুলিপির প্রকাশনা। ওই সময় ছদ্মনাম নিয়ে কাব্যচর্চা করতে হয় কবিকে। আইয়ুবী আমলের শেষ পর্যায়ে একটি সরকারী খেতাব দেয়া হয়েছিল তাকে। কিন্তু সেই পারিতৌমিক দিতে অস্বীকার করেন তিনি।

ভাষা আন্দোলনের সময়ে তাঁর কবিসত্ত্বায় সঞ্চারিত হয়েছিল বিদ্রোহ। চল্লিশের দশকের শেষ দিকে পরিবর্তন আসে ফররুখ আহমদের চিন্তার বলয়ে। তিনি হন ধর্মনিষ্ঠ এবং একান্ত আদর্শতী। তাঁর ভাবনার সঙ্গে অনেক কবিই স্পষ্ট মতপার্থক্য ঘটে। কিন্তু তাহলে কোন সুবিধা লাভের মাঝে নিজের অবস্থান থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি তিনি। ইচ্ছে করলে ঋতুর পাখির মত ভালো পাল্টিয়ে সুখের নিরাপদ নীড় রচনা করতে পারতেন কবি। কিন্তু এ সুখের বদলে নিত্যসঙ্গী দারিদ্রকেই তিনি নিলেন বরণ করে। এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র। এমন চরিত্রবান কবি এ যুগে বিরল। এই একটি কারণে মতনির্বিশেষে সকল মানুষের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধায় নন্দিত হবেন কবি। -সম্পাদকীয়, দৈনিক বাংলা, ২১ অক্টোবর ১৯৭৪

এগারো.
ফররুখ আহমদ, আমার ফররুখ ভাই মরে না। তার মৃত্যু অকাল মৃত্যু নয়, আল্লাহ-নির্ধারিত মর্দে মুমীনের মৃত্যু, মুজাদ্দিদের মৃত্যু, যার নাম ইন্তেকাল। তাঁর কবিতার মাঝেই তিনি বর্তমান। হাজার বছরেও এই কবিতার সুমাণ কমে যাবে না, বরং মেশকের মতে, কস্তুরীর মতো এর ঘ্রাণ আরও দূর থেকে দূরান্তরের দিগন্তকে স্পর্শ করবে। মৃত্যু সাতশো বছর পরে যখন সমগ্র পৃথিবীব্যাপী জালাল উদ্দিন রুমির খোঁজ পড়ে, আমেরিকার পঞ্চাশটার বেশি রুমি ক্লাব তৈরি হয়, ইন্টারনেটে শত শত কাব্য প্রেমিক রুমির মসনবী পাঠ করার জন্য ‘Chat Club -এ এসে প্রতি সকাল সন্ধ্যায় মিলিত হন, তখন বোঝা যায় রুমি কত বড়।

অথচ আমরা বাঙালীরা এখনও ঘুমিয়ে, ঝিমিয়ে। মাঝে মাঝে আমার এ-ও মনে হয়, আমরা ফররুখের যোগ্য নই। এক ‘সিন্দবাদ’ কবিতায় যে শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন তিনি বাংলা ভাষায় আর কোন কবি এত লালিত্যময়, রোমান্টিক শব্দ আর কি ব্যবহার করছেন? যেমন মখমল দিন, নতুন সফর, নোনা দরিয়ার ডাক, সফেদ চাঁদির তাজ, পাহাড়-বুলন্দ ঢেউ, আকীক বিছানো, ঘন সন্দল কাফুরের বনে, সিন্ধু ঈগল, দরিয়া হান্মামে, কিশৃতীর পাটাতন, আবলুস-ঘন আঁধার, সূরাত জামাল জওয়ানি, গলিজ-শহরতলীতে, আয়েশী রাতের ফাঁদ, মাতমী লেবাস, দরিয়ার ডাক, দামাল জোয়ার, মখমল-অবসাদ।

বলুন, একটি মাত্র কবিতায় আর কোনো বাঙালি কবি কি এতোগুলো নতুন শব্দ, উপমা, রূপক তুলে এনে সম্পূর্ণ নতুন অনাস্বাদিত এক জগতের সন্ধান দিয়েছেন? -মুস্তফা জামান আব্বাসী, আমার চোখে ফররুখ ভাই, ফররুখ আহমদের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য, পৃ: ৪৫৮

বারো.
ফররুখ তার জীবনকালে ইসলামকে নিয়ে কাপুরুষদের সুবিধা লেটার কাড়াকাড়ি দেখলেও আজ বিশ্বব্যাপী আত্মদানকারী তরুণ-তরুণীরা নিজের রক্তের বিনিময়ে তা কিনে নিয়েছেন। কিনে নিচ্ছেন ইরানের, মিশরে, সিরিয়ায়, লেবাননে তথা সারা মধ্যপ্রাচ্যে। যেখানে রক্তদান ও আত্মত্যাগ নেই, সেখানে ইসলাম আসে না। ফররুখ আহমদ ঠিকই বলেছেন।

যদিও শ্বাপদ তোলে বিষাক্ত ফণ,
যদিও এখানে অসহ্য হলো হীনতার যন্ত্রণা,
তবু বহু দূরে ডাক দিল আজ হেরার শিখর-চূড়া
ডেরার কপাট খোলো আজ, বন্ধুরা;
পাশবিকতার ললাটে তীক্ষ্ণ তীর উদ্যত করো
এই সংগ্রাম…জেহাদে বৃহত্তরো
প্রগাঢ় রক্ত পাপড়ি খেলার মত
একটি নিমেষ দাও মোরে অন্তত।
এই সংগ্রাম
-আল মাহমুদ, ন্যায়ের পথে নিসঙ্গ কবি, ফররুখ আহমদ: ব্যক্তি ও কবি (প্রবন্ধ সংগ্রহ), পৃ: ৪৪৫

তেরো.
আমাদের বাংলা ভাষার স্বকীয় আদর্শে সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে, আদর্শ হবে কোরআনের শিক্ষা, আধার হবে মুসলমানি ঐতিহ্যানুগ আর বিষয়বস্তু হবে ব্যক্তি বা সমাজ না বৃহদার্থে জগৎ ও জীবন। এভাবে আমাদের জাতীয় জীবন ও জাতীয় সাহিত্য গড়ে উঠবে। সাম্প্রতিক সাহিত্যে তরুণ কবি ফররুখ আহমদ একান্তভাবে মুসলিম পরিপ্রেক্ষিতে কাব্য সাধনা করে পথের দিশারীর গৌরব অর্জন করেছেন। -ড. আহমদ শরীফ, ছোটদের ফররুখ আহমদ, জুবাইদা গুলশান আরা, পৃ: ১৪

এই লেখা সংগ্রহের শিরোনাম দিয়েছি নির্বাসিত যুবরাজ তার কারণ এগারো, বারো এবং তেরো নম্বর লেখা। একাধারে বলিষ্ঠ এবং কোমল চরিত্রের অধিকারী ফররুখ আহমদ উপমহাদেশের দুইজন মহান কবির উত্তরাধিকার। প্রথমে অবধারিতভাবেই নজরুল। বাংলা সাহিত্যে নজরুলের পরে ফররুখ আহমদই প্রধান বাঙালি মুসলমান কবি। নজরুল ফোট উইলিয়াম কলেজ পূর্ববর্তী আরবি-ফারসি শব্দ সমৃদ্ধ বাংলা ব্যবহারের নব সূচনা করে ইসলামকে স্মরণ করেছেন শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে,
“তিমির রাত্রি – ‘এশা’র আযান শুনি দূর মসজিদে।
প্রিয়-হারা কার কান্নার মতো এ-বুকে আসিয়ে বিঁধে।
আমির-উল-মুমেনিন,
তোমার স্মৃতি যে আযানের ধ্বনি জানেনা মুয়াজ্জিন”।

ফররুখ নজরুলের শুরু করা ধারাতেই লিখেছেন তবে তিনি উমর ফারুককে নজরুলের মত বিনম্র চোখে দেখেন নাই।

তিনি উমর ফারুককে নিয়ে এসেছেন একদম আমাদের ঘরের মধ্যে,
আজকে উমর-পন্থী পথির দিকে দিকে প্রয়োজন।
পিঠে বোঝা নিয়ে পাড়ি দেবে যারা প্রান্তর প্রাণ-পণ,
উষর রাতের অনাবাদী মাঠে ফলাবে ফসল যারা,
দিক-দিগন্তে তারে খুঁজিয়া ফিরিছে সর্বহারা!
যাদের হাতের দোররা অশনি পড়ে জালিমের ঘাড়ে
তাদের লাথি ধমক পৌছে অত্যাচারীর হাড়ে,
সে ভয়ঙ্কর, সেই প্রশান্ত মধ্যদিনের রবি,
এই মজলুম দুনিয়ার খাব নিত্যদিনের ছবি।

আর চেতনায় ফররুখ আল্লামা ইকবালের পরবর্তী ধাপ। ইকবাল স্বপ্ন দেখেছিলেন উপমহাদেশে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের আর ফররুখের আহবান করে গেছেন এই জরাগ্রস্ত মুসলমানদের ঘুরে দাঁড়াতে। তবে তিনি শুধু রেনেসাঁসের স্বপ্নই দেখিয়ে যাননি, ইকবালের মতই ফররুখও ছিলেন একজন পরিপূর্ণ কবি।
ফররুখ গেয়েছেন মানুষের জয়গান,
যেখানে পথের পাশে মুখ গুঁজে পড়ে আছে জমিনের পর;
সন্ধ্যার জনতা জানি কোনদিন রাখেনা সে মৃতের খবর।

ভালবেসেছেন প্রকৃতিকে,
“গাঁয়ের নামটি হাটখোলা,
বিষ্টি বাদল দেয় দোলা,
রাখাল ছেলে মেঘ দেখে,
যায় দাঁড়িয়ে পথ-ভোলা৷
মেঘের আঁধার মন টানে,
যায় সে ছুটে কোন খানে,
আউশ ধানের মাঠ ছেড়ে
আমন ধানের দেশ পানে৷”

লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।