সীরাতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)

মাওলানা ইদরীস কান্ধলবী (রাহি:) | পাঠমূল্যায়ন: হাসান হাফিজ

সীরাহ কেনো পড়বো?
আল্লাহ যখন তার নবী/রাসূলদের সাথে কথা বলতেন, তখন তাঁদের নাম ধরে ডাকতেন। কিন্তু আল্লাহ কখনোই আমাদের নবীজিকে তাঁর নাম ধরে ডাকেননি। কখোনোই না। IT DOES NOT EXIST! ব্যাপারটা এমেজিং না?
আচ্ছা, আপনি জানেন কি, আরবিতে যখন কাউকে ডাকা হয়, তখন কী বলে সম্বোধন করা হয়? সিম্পল। তাদের নাম ধরে ডাকা হয় সাথে ‘ইয়া’যোগ করে। আল্লাহও তাই করেছেন। তাঁর পয়গম্বরদেরকে তিনি নাম ধরে ডেকেছেন।
✿ আদম (আলাইহিস সালাম) কে বলেছিলেন, ইয়া আদম! আপনি এবং আপনার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করুন। [২:৩৫]
✿ ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) কে বলেছিলেন, ইয়া ইব্রাহীম! তুমি তোমার স্ত্রীকে ঐ জায়গায় রেখে এসো। ইয়া ইব্রাহিম! তুমি তোমার প্রফেসী ফুলফিল করেছো ।
✿ মুসা (আলাইহিস সালাম) কে বলেছিলেন, ইয়া মুসা! আমিই আপনার রব। যখন আল্লাহ, মুসা (আলাইহিস সালাম) এর সাথে পাহাড়ে সাক্ষাতের জন্য গিয়েছিলেন ।
✿ ঈসা (আলাইহিস সালাম) কে বলেছিলেন, ইয়া ঈসা! আমি আপনাকে উঠিয়ে নিবো। আমি আপনাকে আমার কাছে নিয়ে আসবো।
✿ আল্লাহ তা’আলা এমনকি দাউদ আলাইহিস সালামের সাথে যখন কথা বলছিলেন, তাঁর নাম ধরে ডেকেছিলেন। আল্লাহ দাউদ (আলাইহিস সালাম) কে বলেছিলেন, ইয়া দাউদ! আমি পৃথিবীর বুকে আমার খলিফা পাঠাবো ।
✿ ইয়া মরিয়ম…
✿ ইয়া জাকারিয়া…
কিন্তু আপনি এমন একটি জায়গাও কুরআনে পাবেন না, যেখানে আল্লাহ, স্বয়ং নবীজিকে তাঁর নাম ধরে ডেকেছেন! আল্লাহ কোথাও বলেননি ‘ইয়া মুহাম্মদ’, কোথাও না। IT DOES NOT EXIST! কেনো?

তাহলে কী আল্লাহ তা’আলা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ডাকেননি? অবশ্যই ডেকেছেন। এখন আমাদের জানবার পালা কিভাবে ডেকেছেন? আল্লাহ নবীজিকে এতই ভালবাসতেন, এতটাই বেশী ভালবাসতেন যে, তিনি তাঁকে একটা স্পেশাল প্রিভিলেজ দিয়েছিলেন।

আল্লাহ নবীজিকে এতটাই, আবারো বলছি এতটাই সম্মান করতেন যে, তিনি সব সময় আমাদের নবীকে তাঁর টাইটেল বা অন্য কোনো লাভিং নেইম ধরে ডাকতেন। যেমন, ইয়া আইয়ুহান নবী, ইয়া আইয়্যুহান মুজাম্মিল, ইয়া আইয়ুহার রাসূল, ইয়া আইয়্যুহাল মুদ্দাসসির! সকল জায়গায়, সব ক্ষেত্রে, সকল নবীর জন্য আল্লাহ তাদেরকে নাম ধরে ডাকতেন, একমাত্র ব্যতিক্রম আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সুবহানআল্লাহ।

আল্লাহ নবীজিকে মুহাম্মদ নামে ডাকেননি, এর অর্থ এই নয় যে মুহাম্মদ নামটা খারাপ, এই নামে তাঁকে ডাকা যাবে না । মুহাম্মদ অর্থ হল- প্রশংসিত, বার বার প্রশংসিত। অথবা মোহাম্মদ এমন একটা নাম যা প্রশংসিত হতেই থাকবে এবং হতেই থাকবে।

কাজেই যদি আমরা কাউকে শুধু মুহাম্মদ বলেও ডাকি, তবু কিন্তু তাকে আমরা সম্মান করছি। এজন্যই আমরা দেখতে পাই, অনেক বাবা-মা তার ছেলের নামের সাথে মোহাম্মদ যুক্ত করে অথবা শুধুই মুহাম্মদ রাখে। এমনও অনেক পরিবার পাওয়া যাবে, যারা আল্লাহর রাসূলকে অত্যন্ত ভালবাসেন এবং তাদের ৫ জন ছেলের সবার নামই রেখেছেন মুহাম্মদ। মা-শা-আল্লাহ।

আবু বক্কর (রা.) ছিলেন আমাদের প্রিয় নবীর সবচাইতে কাছের বন্ধু। আপনি যদি সীরাত বা আবু বকর (রা.) এর জীবনী পড়েন, দেখবেন, আবু বকর কখনোই বলেন নাই। ‘আমার বেস্ট ফ্রেন্ড মুহাম্মদ’কে বলতে শুনেছি…। আবু বকর, আল্লাহর রসুলকে তার টাইটেল ধরে ডাকতেন। বলতেন, ক্বালা হামিমি, ক্বলা সাদিকি, ক্বালা খলিল, ক্বালা রসুলুল্লাহ! এম্যাজিং না? কি দরদ দিয়েই না ডাকতেন আমাদের নবীকে! সুবহানাল্লাহ।

নবিজীর স্ত্রীরা তাঁকে খুব ভালোবাসতেন, তারা কখনোই বলেননাই ‘আমার স্বামী মুহাম্মদ’কে বলতে শুনেছি…’। তারা কখনো বলেননি। তাহলে কি নামে ডাকতেন তারা? বলতেন… ক্বলা রসুলুল্লাহ, ক্বলা নবী আল্লাহ, ইয়া রাসুলুল্লাহ, ইয়া নবী আল্লাহ। সুবহানাল্লাহ।

তাঁর চাচারা তাঁকে কখনো নাম ধরে ডাকেনি। তারা এমনকি ক্বলা মুহাম্মদও বলেননি কোনোদিন! তারা কোনোদিন বলেননি আমার ভাতিজা মুহাম্মদকে বলতে শুনেছি…। কী নামে ডাকতেন তাহলে? ক্বলা রসূলুল্লাহ, ক্বলা নবী আল্লাহ! সুবহানাল্লাহ।

তার যে ভাতিজা এবং ভাগ্নি ছিল তারাও কোনোদিন বলেননি আমার আঙ্কেলকে বলতে শুনেছি…। প্রত্যেকবার যখন তারা নবীজীর সমন্ধে কথা বলেছে, তারা বলেছে ক্বলা রাসুলুল্লাহ, ক্বলা হাবিব আল্লাহ! সুবহানাল্লাহ। আমাদের যেমন পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে সম্পর্ক ছিল, তাঁরও কিন্তু ঠিক একই রকম সম্পর্ক ছিল। তাঁর মেয়ে ফাতেমা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) কিন্তু কোনোদিন বলেননি আমি আব্বাকে এটা বলতে শুনেছি। সব সময় বলতেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি…।

দুনিয়াবি সকল মানুষের ক্ষেত্রে, যারা আপনার খুব কাছের তারা আপনার দ্বারা লেস ইম্প্রেস। মানে তারা যেহেতু আপনার কাছের, আপনার হাড়ির খবর তারা জানে, তাদেরকে যতই আপনি আদেশ দেন, উপদেশ দেন তারা মোটামুটি কম গুরুত্ব দেয় আপনার কথার। এর অর্থ এই নয় তারা আপনাকে অসম্মান করে। আসলে কাছে মানুষদের টেন্ডেন্সিই এমন। যেমন ধরুন, আপনি প্রেসিডেন্ট কিন্তু আপনি কারো না কারো ছেলে, ভাই, বন্ধু। আপনি প্রেসিডেন্ট বলে আপনার বাবা কিন্তু বলবে না, স্যার আসেন ভাত খান। আপনার নিক নেম ধরেই ডাকবে, ভুল করলে কখনো কখনো আপনাকে বাঁদর বলেও ডাকবে। আর আপনার স্ত্রীর কাছে আপনি প্রেসিডেন্ট হলেও অপদার্থ!

আর যে সব লোক দূরের, যারা আপনাকে কম চেনে কম জানে, যারা আপনার নিকট আত্মীয় নয়, তারা কিন্তু মোর ইম্প্রেস। (The people closest to us are least impress with us, the people more far away from us are most impress with us)। এক্ষেত্রে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একেবারেই ব্যাতিক্রম। যে সব লোক তাঁর কাছাকাছি ছিলেন, তারাই বরং সব চাইতে বেশি ইম্প্রেস ছিলেন তাঁর গুণের কারণে।

একদিন কিছু অমুসলিম নবীর সাথে দেখা করতে এসেছিলেন মুসলিম হওয়ার জন্য বা পরামর্শের জন্য। তারা এসে দরজায় ঠকঠক করে কড়া নাড়লেন এবং উচ্চস্বরে আওয়াজ করে বললেন “হে মোহাম্মদ, বাইরে এসো; তোমার সাথে আমাদের কিছু কথা আছে”। তারা যেহেতু মক্কা থেকে অনেক দূরের ছিলেন, কিভাবে নবীজির সাথে আদবের সহিত কথা বলতে হবে, তা তারা জানতেন না। তারা কিন্তু কোন ধরনের অসম্মান মাথায় রেখে আল্লাহর নবীকে নাম ধরে ডাকেননি। যেভাবে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে ডাকে তারা, ঠিক সেটাই করেছিল। আল্লাহ তা’আলার এই জিনিসটা ভালো লাগেনি, পছন্দ হয়নি। আল্লাহ চাননি তার সবচেয়ে প্রিয় বান্দা এবং রাসুলের সাথে মানুষ এভাবে কথা বলুক। কাজেই কিভাবে আল্লাহর রসূলের সাথে কথা বলতে হবে এজন্য সূরা হুজুরাত (৪৯) এর কিছু আয়াত নাযিল করলেন। আল্লাহ বললেন,

“তোমরা তাঁকে ঐভাবে ডেকোনা, যেভাবে তোমরা একে অপরকে ডাকো এবং তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের উপর নিজেদের কণ্ঠস্বর উঁচু করো না এবং নিজেদের মধ্যে যেভাবে উচ্চস্বরে কথা বলো, তাঁর সাথে সেরূপ উচ্চস্বরে কথা বলো না। এই আশংকা হয় যে, তোমাদের সমস্ত ভালো কাজ বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং তোমরা তা উপলব্ধিও করতে পারবা না।” [সুরা হুজুরাত ৪৯:২]

আল্লাহ তাঁর বান্দাদের হুঁশিয়ার করে বলেছেন, তোমরা যদি আমার রাসূলকে সম্মানের সহিত না ডাকো এবং তোমরা যদি আমার রাসূলের সাথে উচ্চস্বরে কথা বলো অথবা বেয়াদবি করো, আমি দেখব না তুমি কে? কি তোমার পরিচয়? কি তোমার আমল? তুমি কি সাহাবী, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন, ইমাম, আলেম, পীর, শায়খ ইত্যাদি। আমি যেটা করবো, তোমার আমলনামাকে শূন্য করে দেবো! আর তুমি সেটা উপলব্ধিও করতে পারবা না ।

কি ভালোটাই না বাসতেন আল্লাহ আমার নবীকে? সুবহানাল্লাহ। অথচ আমরা হরহামেসাই ‘মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’ এর নাম নিয়ে কত হাসাহাসি করি, কটুক্তি করি। এমনকি তার হাদিস নিয়েও হাসাহাসি করি। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ মুসলিম ও অমুসলিম সবাইকে শিক্ষা দিয়েছেন কিভাবে তাঁর রসূলের সাথে আদবের সহিত কথা বলতে হবে।

এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরামের চালচলন, কথাবার্তা, এক কথায় সামগ্রিক অবস্থা পাল্টে যায়। তারা এরপর থেকে খুব আস্তে কথা বলতেন। সাহাবী সাবেত ইবনে কায়সের কণ্ঠস্বর স্বভাবগতভাবেই উচু ছিল। এই আয়াত শুনে তিনি ভয়ে সংযত হলেন এবং কণ্ঠস্বর নীচু করলেন। অনুরূপভাবে রাসূলের কোনো সুন্নাত সম্পর্কে জানার পরে সেটা মানতে গড়িমসি বা সামান্যতম অনীহা প্রকাশ করাও বে-আদবি।

একদিন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু দুই ব্যক্তিকে মসজিদে নববীতে উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কোথাকার লোক? তারা বলল, আমরা তায়েফের লোক। তিনি বললেন, যদি তোমরা মদীনাবাসী হতে, তবে আমি তোমাদের বেত্রাঘাত করতাম। তোমরা রাসূলের মসজিদে উচ্চস্বরে কথা বলছো?

বিভিন্ন ব্লগে, পত্রিকায়, অবিশ্বাসীদের কথাবার্তায়, নাস্তিকদের লেখায়, আল্লাহ রাসূলকে অবমাননা করে অনেক কিছুই দেখতে পাই। আমি শুধু ভাবতাম, এদের জন্য আল্লাহ কি শাস্তি বরাদ্দ করে রেখেছে? নবীজির সাথে যে এরা বাজে আচরণ করছে এর ফলে কি তাদের আমলনামায় কোন কিছু যোগ বিয়োগ হবে না?

আলহামদুলিল্লাহ, সূরা হুজুরাতের [৪৯] এই আয়াত পড়ার পর আমি একদম ক্লিয়ার। কাল রোজ হাশরের মাঠে যখন তারা দেখবে তাদের আমলনামায় শুন‍্য, তখন জিজ্ঞেস করবে, হে আল্লাহ আমার আমলনামা খালি কেন?

আমিতো কতই পূণ্যের কাজ করেছি। এত টাকা সদাকা করেছি, মানুষের জন্য স্কুল-কলেজ সাঁকো নির্মাণ করেছি, আমর আমলনামা তো অনেক ভারী হওয়ার কথা। তখন আল্লাহ তাকে স্মরণ করিয়ে দিবেন, হে বান্দা তুমি আমার প্রিয় রাসুলের সাথে খারাপ আচরণ করেছো, তাকে খারাপ নামে ডেকেছো, তার হাদিস হাদিস নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করেছো, তার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলেছো, আর আমি তো বলেই দিয়েছিলাম, কেউ যদি আমার প্রিয় রাসুলকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে তার আমলনামা শূন্য হয়ে যাবে। তুমি কি পড়নি সুরা আল হুজুরাত?

কাজেই নবীজীকে ভালোবাসার মধ্যেই আমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত। আমরা যেন ভুল করে হলেও হাদিস নিয়ে হাসি-ঠাট্টা না করি। যদি কোথাও দেখি কেউ আল্লাহর রাসূলকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করছে, আমরা কথা না বাড়িয়ে নিরবে কেটে পড়বো। আমরা চাইনা আমাদের ভুলের কারণেই হোক বা না জানার কারণে হোক, আল্লাহর রাসূলকে নিয়ে কেউ হাসি-ঠাট্টা করুক।

কারো সাথে যদি কখনো কুরআন হাদিস নিয়ে কথা হয় এবং সেখানে যদি বিন্দুমাত্র মনের মধ্যে ভয় হয় যে আল্লাহর রাসুলকে কেউ অবমাননা করবে, আমরা যেন কথা না বাড়াই। সেই জায়গা থেকে আদবের সহিত প্রস্থান করা আমাদের জন্য উত্তম যদিও জানি অন্য পাশের লোকটি ভুলভাল বকছে।

আল্লাহ-রাসুলকে জানার সবচাইতে ভালো পন্থা তার জীবনী পড়া। তাই আসুন, সীরাহ পড়ি। পৃথিবীর বুকে শ্রেষ্ঠ মানুষটির জীবন সমন্ধে জানি। আল্লাহ যাকে বলেছেন রহমাতাললিল আল আমিন। যাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সমগ্র বিশ্বজগতের রহমত স্বরূপ। তিনি হচ্ছেন সেই মানুষ- যাকে আল্লাহ তাআলা সবচাইতে বেশি ভালোবাসেন। আসমান এবং জমিনে, অতীত এবং ভবিষ্যতে, দুনিয়া আর আখিরাতে সবচাইতে প্রশংসিত এবং মহিমান্বিত মানুষটি হলেন আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ নবী এবং রাসূল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

এক নজরে আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
-যখন তিনি মায়ের মায়ের পেটে, তাঁর বাবা মারা যান।
-নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বয়স যখন ৬, তাঁর মা পরকালের পথে পা বাড়ান।
-হৃদয়ের মনি ছিলেন হযরত খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা। খাদিজা সম্বন্ধে নবীজ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “যখন মানুষ আমাকে অস্বীকার করেছিল, তখন তিনি ঈমান এনেছিলেন। যখন মানুষ আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল, তখন তিনি আমাকে সত্যায়ন করেছিলেন। যখন মানুষের কাছে আমি বঞ্চিত হচ্ছিলাম, তখন তিনি আমাকে সম্পদ সহযোগিতা জুগিয়েছিলেন।

তার গর্ভে আমার সন্তান জন্মলাভ করেছে, অন্য কারো গর্ভে নয়।”
-নবিজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বয়স যখন ৫০, হারিয়েছেন প্রিয়তমা স্ত্রীকে।
-বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সবচাইতে ভারী জিনিস পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ। সাত সন্তানের মধ্যে ছয়জন তাঁর জীবদ্দশাতেই মারা গিয়েছিল।
-নবুয়তের পর যখন ধর্ম প্রচার শুরু করেন, কাছের মানুষগুলো শত্রু হয়ে যায়। যে গুটিকতক মানুষ তার প্রতি ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল তারাও ইন্তেকাল করেন।
-সমাজ তাঁকে বয়কট করেছে।
-দেশ থেকে মানুষজন তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছে, তিনি হিজরত করতে বাধ্য হয়েছেন মদিনায়।
-জীবন কাটিয়েছেন একদম মিসকিনের মতো। মাসের পর মাস চলে যেতো, ঘরে কোন রান্না-বান্না হতো না। শুকনো খেজুর আর পানিতেই দিন কাটতো।
ওপরের যে কোনো একটি ঘটনা আমাদের জীবনে ঘটলেই আমরা আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাস করা শুরু করি।

যখনই কোন খারাপ কিছু ঘটে আমরা বলি, “হোয়াই অলওয়েজ মি! আল্লাহ যদি থাকতোই, তাহলে আমার জীবনে এতো কষ্ট থাকবে কেন?” আজকের দিনে মনে হচ্ছে depression কিংবা আত্মহত্যা একটা ফ্যাশন। পরীক্ষা খারাপ হলে কেউ কেউ আত্মহত্যা করে, ফুটবল কিংবা ক্রিকেটে নিজের পছন্দের দল না জিতলে আত্মহত্যা করে, এমনকি পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলেও কেউ কেউ আত্মহত্যা করে। কত ঠুনকো কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে।। এই তো কিছুদিন আগেই এসএসসিতে ফেল করে এক ছেলে ঘোষণা দিয়েছে, সে নাস্তিক হয়ে গিয়েছে?

অথচ ওপরের প্রত্যেকটি ঘটনার যন্ত্রণা সইতে হয়েছে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে। তারপরেও তিনি তাঁর রবের প্রতি ঈমানহারা হননি। বরং তাঁর জবান থেকে আসমান ও জমীনের রবের প্রতি ক্ষণে ক্ষণে প্রশংসা বাণী উচ্চারিত হতো। আল্লাহ তা’আলা আগের এবং পরের সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছিলেন। তবুও তিনি রাত জেগে সালাত আদায় করতে করতে পা ফুলিয়ে ফেলতেন। বলতেন, “আমি কি আমার রবের একজন শোকর গুজার বান্দা হবো না?”

বই সম্বন্ধে কিছু কথা: উপসংহার
আলহামদুলিল্লাহ আমার বেশ কয়েকটি সীরাহ পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। তন্মধ্যে সবচাইতে যেটা ভালো লেগেছে সেটা সীরাতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।

বইটির বিশেষ দিক হল এই সীরাতটি আধুনিক যুগের কিছু সীরাতের মত পশ্চিমা আদর্শ ঘেঁষা ও সংক্ষিপ্ত নয়। এখানে লেখক অকপটে আল্লাহর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবন, দাওয়াহর ক্ষেত্রে আপোষহীনতা, মুজিযা ইত্যাদির আলোচনা করেছেন অত্যন্ত চমৎকারভাবে। যেখানে আধুনিক অনেক সীরাতের কিতাবেই বিষয়গুলোকে ভালভাবে আলোচনা করা হয়নি।

এই গ্রন্থে বিভিন্ন ঘটনার সাথে তার ফিকহি ব্যাপারও আলোচনা করা হয়েছে, এছাড়াও প্রতিটি ঘটনার সাথেই রয়েছে দলিল ও বর্ণনাকারিদের পরিচয় ও তাদের গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে সালাফদের মূল্যায়ন, যা এই কিতাবটিকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করেছে। আর এই বইটির অনুবাদ অত্যন্ত সহজবোধ্য। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পড়ে গেলেও বিরক্তি আসবে না ইনশা আল্লাহ। বইটি পড়লে মনে হবে, ১৪০০ বছর পরে এসেও বইয়ের পাতায় পরিভ্রমণ করছি নববী যুগে।

[নোট:]
কখনো হয়তো মুহাম্মদ নামটি এসেছে, কিন্তু একা মুহাম্মদ কখনোই আসেনি। যেখানেই মুহাম্মদ এসেছে, সেখানে রসুলুল্লাহও এসেছে। কাজেই শুধু মুহাম্মদ কোথাও নেই। শুধুমাত্র একটি জায়গায় আল্লাহ তাঁকে টাইটেল ধরে না ডেকে, নামের শেষে রসুলুল্লাহ যুক্ত না করে শুধু ‘ইয়া মুহাম্মদ’ নামে ডেকেছেন, সেটা সুরা মুহাম্মদ-এ। যেখানে আল্লাহ হাইলাইট করতে চেয়েছেন শুধুমাত্র মুহাম্মদ নামটিকে। এবং এর বিশেষ কারণ আছে, যেটা সুরা হুজুরাতে বলেছেন।

লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।