রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কন্যাগণ

মরিয়ম বিনতে মোহাম্মদ আলী |

ইবনে কাসির রহ. বলেন, এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে, শুধু ইবরাহিম (রা.) ছাড়া নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সব সন্তান খাদিজা (রা.) এর গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। ইবরাহিমের (রা.) হয়েছে জন্ম মারিয়া বিনতে শামউন কিবতিয়াহ (রা.) এর গর্ভ থেকে। [১]

ইবনুল কাইয়িমের রহ. মতে— নবীজির প্রথম সন্তান হলেন কাসিম। তারপর পর্যায়ক্রমে যাইনাব, রুকাইয়াহ, উম্মে কুলসুম, ফাতিমা। এরপর জন্ম নিয়েছেন আবদুল্লাহ; অবশ্য তার জন্মকাল নিয়ে মতবিরোধ আছে। এরপর ইবরাহিম (রা.), তিনি মদিনায় জন্ম গ্রহণ করেন। [২] সুতরাং নবীজির চারজন কন্যাসন্তান ছিলেন।
নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চার কন্যা:

❀ যায়নাব রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহা:
যায়নাব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সন্তানদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ কি না সেটা কি না মতপার্থক্য রয়েছে। বংশবিদ্যা বিশারদদের একটি দলের মতে কাসিম প্রথম ও জয়নাব দ্বিতীয় সন্তান। ইবনুল কালবির মতে, যায়নাব প্রথম সন্তান। ইবনে সাদের মতে, যায়নাব মেয়েদের মধ্যে সবার বড়। [৩] ইবন হিশাম মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কন্যা সন্তানদের ক্রমধারা এভাবে সাজিয়েছেন প্রথমে বড় ছেলে আল কাসিম, তারপর আত তাইয়িব ও আত তাহির এরপর বড় মেয়ে রুকাইয়া, তারপর যায়নাব তারপর উম্মে কুলসুম এরপর ফাতিমা। [৪]

তিনি নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বড় মেয়ে। তিনি নবীজির ত্রিশ বছর বয়সকালে জন্মগ্রহণ করেছেন। [৫] পরিণত বয়সে নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে খাদিজার (রা.) একান্ত আগ্রহে তার ভাগ্নে আবুল আস ইবনে রবী’র সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। আবুল আস ছিলেন খাদিজার (রা.) সন্তানের মতো প্রিয় এবং বাণিজ্যে, বিত্তে ও বিশ্বাসে মক্কার একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। নবুয়তের পরে খাদিজা (রা.) ও তাঁর সকল কন্যা ইসলাম আনলেও আবুল আস মুশরিক থেকে যান। তবে কুরাইশরা যাইনাবকে ছেড়ে দিতে বললেও আবুল আস স্ত্রী ত্যাগ করেননি। যাইনাব (রা.) ও পূর্বের মতোই স্বামীর সাথে মক্কায় বসবাস করতে থাকেন। নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার প্রশংসা করতেন।

পিতার নবুয়তের পরে জয়নব তাঁর মায়ের সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন। স্বামী আবুল আস তখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। [৬] আবুল আস তার স্ত্রী জয়নাবকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। কিন্তু তিনি পূর্বপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে স্ত্রীর নতুন ধর্ম কবুল করতে রাজী হলেন না। আবার কুরাইশরা তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যাকে পাঠিয়ে দিতে চাপ দিলো, একাজেও তিনি রাজি হলেন না। [৭][৮]

নবুয়াতের ১৩তম বছরে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরাত করেন, তখন জয়নাব স্বামীর সাথে মক্কায় থেকে যান। [৯] বদরের যুদ্ধে আবুল আস বন্দি হন। যয়নব (রা.) স্বামীর মুক্তিপণ হিসেবে গলার হার খুলে পাঠান; যা খাদিজা (রা.) তাকে বিয়েতে উপহার দিয়েছিলেন। সেই হার না নিয়ে সাহাবিগণ তাকে মুক্তি দিয়ে দেন। [১০] শর্ত দেন যে, ফিরে গিয়ে যাইনাবকে (রা.) মদিনায় পাঠিয়ে দিতে। কেননা, বিধান নাযিল হয়েছে উভয়ে একত্রে থাকতে পারবে না। কুরাইশদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আবুল আস যাইনাবকে (রা.) ফিরিয়ে দেন। [১১]

ষষ্ঠ হিজরিতে আবুল আস বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে সিরিয়ার যাওয়ার পথে মুসলমানদের একটি টহল দলের হাতে ধরা পড়েন। পরে নবীজির আগ্রহে তার সম্পদ ফেরত দেওয়া হয়, কারণ সম্পদের অধিকাংশই ছিল মক্কার লোকদের আমানত। তিনি মক্কায় সকল সম্পদ ফিরে দিয়ে প্রকাশ্যে মুসলমান হন।

যায়নাব তার স্বামী আবুল আসের সাথে পুনর্মিলনের পর বেশীদিন বাঁচেনি। এক বছর বা তার চেয়ে কিছু সময় মদিনায় স্বামীর সাথে কাটান। জয়নব মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সময় হাব্বার ইবনে আল আসওয়াদ দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হন, এতে তাঁর গর্ভপাত ঘটে রক্ত ঝরে এবং তিনি দীর্ঘদিন পর্যন্ত রোগে ভুগতে থাকেন। অবশেষে ৮ম হিজরির প্রথম দিকে ইনতিকাল করেন। [১২][১৩]

উম্মে আয়মান, সাওদা, উম্মে সালামা, ও উম্মু আতিয়া [১৪] যায়নাবের গোসলের কাজে অংশগ্রহণ করেন। [১৫][১৬][১৭] আর স্বয়ং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর জানাযার নামায পড়ান এবং নিজে কবরে নেমে নিজ হাতে মেয়েকে কবরের মধ্যে শায়িত করেন। [১৮][১৯]

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নিজের ব্যবহৃত একটি লুঙ্গি প্রতীক হিসাবে জয়নবের কাফনের কাপড়ের মধ্যে দিয়ে দেয়। মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর পূর্বে মৃত্যুবরণকারী উসমান ইবনে মাজউনের পাশে দাফন করার নির্দেশ দেন। [২০] তার দুই বছর পর অষ্টম হিজরিতে যাইনাব (রা.) ইন্তেকাল করেন। আবুল আস (রা.) ইন্তেকাল করেন ১২ হিজরিতে যাইনাবের (রা.) চার বছর পর। তার গর্ভে দুটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে— আলী ও উমামা (রা.)।

মায়ের মৃত্যুর সময় আলী ছিলেন দুগ্ধপোষ্য। তার দুধপিতা মক্কার মুশরিক। তাকে নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফিরিয়ে আনেন। মক্কা বিজয়ের দিন আলী নবীজির উটের পিছনে বসে ছিলো। আলী তার বাবার জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন। [২১]
উমামা মায়ের মৃত্যুর সময় ছিলেন ছোট্ট বালিকা। তাকে কাঁধে রেখে নবীজি নামাজ আদায় করতেন। নবীজির আরেক জামাতা চতুর্থ খলিফা আলী (রা.) তাকে তার খালা ফাতিমার (রা.) ইন্তেকালের পর বিয়ে করেন। আলীর (রা.) শাহাদাতের পর তার বিয়ে হয় মুগিরা ইবনে নওফল হাশেমির সঙ্গে এবং মুগিরার স্ত্রী হিসেবেই তিনি ইন্তেকাল করেন। তার গর্ভে আলী রা. ও মুগীরা রা. কারোরই কোনো সন্তান হয় নি। [২২]

❀ রুকাইয়া রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহা:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত লাভের ৭ বছর পূর্বে মক্কায় খাদিজার গর্ভে মেঝো মেয়ে রুকাইয়া জন্মগ্রহণ করেন। যুবাইর, মুসআব ও জুরজানির ধারণা মতে, রুকাইয়া মুহাম্মাদের ছোট মেয়ে। তবে অধিকাংশ ইতিহাসবিদগণ বলেছেন, জয়নাব বড়, আর রুকাইয়া মেঝো মেয়ে। ইবন হিশামের মতে, রুকাইয়া মেয়েদের মধ্যে বড়। [২৩]

রুকাইয়াহ ইসলামের প্রারম্ভের আগে জন্মগ্রহণ করেন। [২৪] আবু লাহাব মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি তটস্থ হন এবং তার পুত্রদের তাঁর কন্যাদের সাথে বিবাহের অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। রুকাইয়াহকে উতবাহ ইবনে আবু লাহাবের সাথে এবং উম্মে কুলসুমকে উথাবাহ ইবনে আবু লাহাবের সাথে বিয়ে দেন। পরবর্তীতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচার শুরু করলে, আবু লাহাব প্রতিকূল অবস্থান নেন এবং সক্রিয়ভাবে ইসলামের বিরোধিতা করা শুরু করেন। এবং নিজ ছেলেদের মুহাম্মাদের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেয়েদের থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটান।

রুকাইয়াহ বিবাহ বিচ্ছেদের পর, উসমানের সাথে রুকাইয়ার ২য় বিবাহ হয়। তাদের আব্দুল্লাহ ইবনে উসমান নামে একটি পুত্র সন্তান ছিল, এবং খুব ছোট বেলায় এই সন্তানটি মারা যায়। মদিনা পৌঁছার পর রুকাইয়া ২য় হিজরিতে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে যান। তখন মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বদর যু্দ্ধের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি উসমানকে তাঁর রুগ্ন স্ত্রীর সেবা-শুশ্রুষার জন্য মদিনায় রেখে নিজে বদরে চলে যান। হিজরতের ১ বছর ৭ মাস পরে পবিত্র রমজান মাসে রুকাইয়া ইনতিকাল করেন। [২৫]

উসামা ইবনে যায়দ বলেন, আমরা যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেয়েকে কবর দিয়ে মাটি সমান করছিলাম ঠিক তখন আমার পিতা যায়দ ইবন হারিসা বদরের বিজয়ের সুসংবাদ নিয়ে আসলেন। [২৬][২৭][২৮] তবে কতকের বর্ণনা মতে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদরে থেকে ফিরে রুকাইয়ার কবরের নিকট গিয়েছিলো। [২৯][৩০]

অসুস্থ স্ত্রীর পাশে থাকার জন্য হযরত উসমান বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। তবে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বদরের গণীমতের অংশ দান করেন। [৩১][৩২] উল্লেখ্য, উসমান মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্বিতীয় মেয়ে রুকাইয়া মারা যাওয়ার পর তৃতীয় মেয়ে উম্মে কুলসুমকে বিবাহ করেন।

❀ উম্মে কুলসুম রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহা:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের ৬ বছর পূর্বে উম্মে কুলসুমের মক্কাতে জন্ম হয়। [৩৩] উম্মে কুলসুম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তৃতীয় মেয়ে।
পরিবারে রাসুলুল্লাহ | ১৩

তবে এ ব্যাপারে কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে, ইমাম আয যাহাবী তাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চতুর্থ সন্তান বলেছেন। [৩৪] যুবাইর ইবনে বাককার বলেছেন, উম্মে কুলসুম রুকাইয়া আর ফাতিমা থেকেও বড়। কিন্তু অধিকাংশ মত এটাই যে, উম্মে কুলসুম রুকাইয়া ছোট। [৩৫]

আল তাবারি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেয়েদের জন্মের ক্রমধারা উল্লেখ করেছেন যথাক্রমে, যায়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম ও ফাতিমা। [৩৬]

রুকাইয়া ছিলেন উসমানের স্ত্রী, ২য় হিজরিতে রমজান মাসে রুকাইয়া মারা গেলে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পুনরায় উসমানের সাথে আরেক কন্যা উম্মে কুলসুমকে বিয়ে দেন। [৩৭] যদি উম্মে কুলসুম রুকাইয়ার বড় হতো তাহলে, উসমানের সাথে উম্মে কুলসুমের বিয়েই আগে হতো।

উম্মে কুলসুম তার মা উম্মুল মুমিনিন খাদিজা ও তার বড় বোন জয়নবের সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে অন্য বোনদের সাথে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে বাইআত হন। [৩৮] এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় হিজরতের পর উম্মে কুলসুম পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে মদিনায় হিজরাত করেন। [৩৯][৪০]

স্বামী উসমানের সাথে ৬ বছর কাটানোর পর ৯ম হিজরির শা’বান মাসে উম্মে কুলসুম ইনতিকাল করেন। [৪১] উম্মে আতিয়াসহ আনসারী মহিলারা তাঁকে গোসল দেন। মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর জানাযার নামায পড়ান। আবু তালহা, আলি ইবনে আবি তালিব, ফাদল ইবনে আব্বাস ও উসামা ইবনে যায়েদ লাশ কবরে নামান। [৪২]

উম্মে কুলসুমের মৃত্যুর পর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমার যদি ১০টি মেয়ে থাকতো তাহলে একের পর এক তাদের সকলকে উসমানের সাথেই বিয়ে দিতাম।

❀ ফাতিমা রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহা:
ফাতিমা ৬০৫ সালে মক্কায় খাদিজার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মদিন সম্পর্কে নানা মতভেদ আছে, তবে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মতে, তিনি প্রথম কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার পাঁচ বছর পর কাবাঘর সংস্কারের সময় ৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। [৪৩][৪৪][৪৫][৪৬]

শিয়া সূত্রমতে, তিনি প্রথম কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার ২ বা ৫ বছর পর জন্মগ্রহণ করেন। [৪৭] জয়নব, রুকাইয়াহ এবং উম্মে কুলসুমের পর ফাতিমা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চতুর্থ কন্যা। [৪৮]

খাদিজা তাঁর অন্য সন্তানদের জন্য ধাত্রী রাখলেও ফাতিমাকে ধাত্রীর হাতে ছেড়ে না দিয়ে নিজের কাছে রেখে, নিজের তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত করেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়ত লাভের পরপরই ফাতিমা তার মা খাদিজা ও অন্যান্য বোনদের সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন। এবং ইসলামের প্রথম ভাগের নারীদের সাথে বাইয়াত লাভ করেন। আয়িশা, ইমাম আয যুরকানি তার শারহুল মাওয়াহিবত গ্রন্থে এই মতকে গ্রহণ করেছেন এবং বলেছেন, ফাতিমার চারিত্রিক গুণাবলী পরিস্ফুটনের ক্ষেত্রে খাদিজার স্পষ্ট অবদান রয়েছে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের ৮ মাস, মতান্তরে ৭০ দিন পর ইহলোক ত্যাগ করেন। অনেকে মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তিকালের ২ মাস অথবা ৪ মাস পরে ইন্তিকালের কথাও বলেছেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের মাঝে ফাতিমাই সর্বপ্রথম ইন্তিকাল করেন, মুহাম্মাদের ভবিষৎবাণী সত্য হয়। ফাতিমার জন্ম যদি নবুয়তের ৫ বছর পূর্বে ধরা হয়, তাহলে মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ২৯ বছর। সুন্নি গবেষক ও অধিকাংশের এই মত সমর্থন করেছেন। মৃত্যুর পূর্বে ফাতিমা তেমন শয্যাশায়ী বা বড় কোনো রোগাক্রান্ত হননি।

আল-ওয়াকিদী বলেছেন, ১১ হিজরির ৩ রমাদান ফাতিমা ইনতিকাল করেন। স্বামী আলী ও আসমা বিনত উমাইস তাকে গোসলের কাজ সম্পন্ন করেন। কিন্তু বর্ণনায় আবু বকর ও আলীর নাম এসেছে। ফাতিমার দাদা আব্বাস তার জানাযার নামায পড়ান। তবে কেউ কেউ জানাজার নামাজ পড়ানোর ব্যাপারে আবু বকর ও আলীর নাম উল্লেখ করেছেন। আলী, ফাদল ও আব্বাস কবরে নেমে দাফন কাজ সম্পন্ন করেন। তবে উম্মে সালমা বলেন, ফাতিমা যখন বুঝতে পারলেন, তার অন্তিম পর্যায় চলে এসেছে। তখন ফাতিমা উত্তমভাবে গোসল করে নতুন কাপড় পরিধান করেন। পরে আলী ঐ গোসল ও কাপড়কেই উপযোগী মনে করেন। ফাতিমাকে আলাদা করে গোসল ও কাফনের কাপড় পরিধান করানো হয়নি।

তার জানাযায় খুব কম মানুষ অংশগ্রহণের সুযোগ পায়, কারণ, রাতে ইনতিকাল হয় এবং ফাতিমার অসিয়ত অনুযায়ী রাতেই তাকে দাফন করেন এবং মৃত্যুর পর ফাতিমার পর্দা রক্ষার জন্য আসমা বিনতে উমাইসের বুদ্ধিতে লাশের বাহনকে খেজুরের ডালের সাথে পর্দা লাগিয়ে নতুন একটি পদ্ধতি উদ্ভব করা হয়, এই পদ্ধতি মদিনায় সর্বপ্রথম দেখা যায়।

আলীর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর শোক:
আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু স্ত্রী ফাতিমার বিয়োগে দুঃখ কষ্ট পান, দাফন কাফনের শেষে শোক পেয়ে একটি কবিতা আবৃত্তি করেন, যার মধ্যে গভীর কষ্টের আভাস পাওয়া যায়। আমি দেখতে পাচ্ছি আমার মধ্যে দুনিয়ার রোগ-ব্যাধি প্রচুর পরিমাণে বাসা বেঁধেছে। আর একজন দুনিয়াবাসী মৃত্যু পর্যন্ত রোগাগ্রস্থই থাকে। ভালোবাসার লোকদের প্রতিটি মিলনের পরে বিচ্ছেদ আছে।

বিচ্ছেদ ছাড়া মিলনের সময়টুকু তা অতি সামান্যই। মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে ফাতিমার বিচ্ছেদ প্রমাণ করে যে, কোন বন্ধনই চিরকাল থাকে না। আবার আলী প্রতিদিন ফাতিমার কবরের নিকট যেতেন, স্মৃতিচারণ করে কাঁদতেন। দুঃখ কষ্টে জর্জরিত হয়ে একটি কবিতা আবৃত্তি করতেন।
আমার একি দশা হয়েছে যে,
আমি কবরের উপর সালাম করার জন্য আসি;
কিন্তু প্রিয়ার কবর আমার প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না।
হে কবর! তোমার কী হয়েছে যে, তোমার আহবানকারীর ডাকে সাড়া দাও না?
তুমি কি তোমার প্রিয়জনের ভালোবাসায় বিরক্ত হয়ে উঠেছো?

আল ওয়াকিদী বর্ণনা করেন, বলেন, বেশীরভাগ মানুষ ফাতিমার কবর জান্নাতুল বাকি গোরস্তানে বলে থাকলেও, তার কবরস্থান মূলত আকিলের বাড়ীর এক কোণে দাফন করা হয়েছে। তাঁর কবর ও রাস্তার মধ্যে ব্যবধান ছিল প্রায় ৭ হাত।

তথ্যসূত্র:
১. যাদুল মায়াদ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৮১
২. আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৩০৬-৭.
৩. সিরাতে ইবনে ইসহাক.
৪. তাবাকাত ৮/৩২.
৫. তাবারী-৩/১৩৬.
৬. ইবন হিশাম, আস্-সীরাহ-১/৬৫২
৭. আনসাবুল আশরাফ-১/২৬৯
৮. আবু দাউদ, হাদিস ২৬৯২
৯. বুখারি, হাদিস ৩০১৬
১০. আল-আ’লাম-৩/৬৭
১১. তাবাকাত-৮/৩৪
১২. সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা-২/২৫০
১৩. আনসাবুল আশরাফ-১/৪০০
১৪, ১৫. তাবাকাত-৮/৩৪
১৬. উসুদুল গাবা-৫/৪৬৮
পরিবারে রাসুলুল্লাহ | ১৬
১৭. বুখারী: বাবু গুসলিল মায়্যিত; সিয়ারু আ’লাম
১৮. আন-নুবালা-২/২৫২
১৯. আনসাবুল আশরাফ-১/২১২
২০. শরহে যুরকানি খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৯৭
২১. মিন মায়ীনিশ শামায়েল, প্রথম অধ্যায়, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
২২. বুখারি, হাদিস ৩৬৯৮
২৩. সীরাত ইবন হিশাম-১/১৯৭
২৪. আসহাবে রাসূলোর জীবন কথা-২/২৭
২৫. আনসাবুল আশরাফ-১/২৯৪, ৪৭৫
২৬. সিরাতু ইবন হিশান-১/৬৪২-৪৩
২৭. আল-ইসাবা-৪/৩০৫
২৮. সিয়ারু আ’লাম-নুবালা-২/২৬২
২৯. তাবাকাত-৮/৩৭
৩০. আনসাবুল আশরাফ-১/২৮৯
৩১. সিরাতু ইবন হিশাম-১/৬৭৮
৩২. সাহাবিয়াত-১২৯
৩৩. সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা, ২/২৫২
৩৪. সীরাতু ইবন হিশাম, ১/১৯০
৩৫. তারীখ আত-তাবাবী (লেইডেন) ৩/১১২৮
৩৭, ৩৮, ৩৯. তাবাকাত, ৮/৩৫, ৮/৩৭ ও ৮/৩৮
৪০. হায়াতুস সাহাবা-১/৩৬৯
৪১, ৪২. সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা-২/২৫২ ও ২/২৫৩
৪৩, ৪৫, তাবাকাত-৮/৩৮-৩৯ ও ৮/৩৭
৪৪. সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা-২/১১৯
৪৬. তা রাজিমু সাইয়াদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ-৫৯২
৪৭. দা’লাম আন-নিসা-৪/১৩১
৪৮. সাহাবিয়াত-১৫৩

লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।