মুসলিম উম্মাহর ব্যাধি ও পরিশুদ্ধতার উপায়

মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা |

মুসলিম উম্মাহ আজ দিশেহারা। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে লুণ্ঠিত মানবতার নাম মুসলিমসমাজ। আমাদের চিন্তা করা দরকার- যেই মুসলিম উম্মাহ সর্বদা নেতৃত্ব দিতে অভ্যস্ত ছিল, আজ তাদের এই অধঃপতন কেন? কেনইবা মাত্র ৫.২ মিলিয়ন ইহুদি প্রায় দেড়শো কোটি মুসলমানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে বায়তুল মুকাদ্দাসে আধিপত্য বিস্তার করছে? কেনইবা প্রাচ্য-প্রাশ্চাত্যের নেতারা মুসলমানদের সংখ্যাধিক্যের ভ্রুক্ষেপ করছে না? কেনইবা মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করা সত্ত্বেও আমাদের রক্ত জেগে উঠে না? নিশ্চয়ই মুসলিম উম্মাহ গুরুতর পাপে জড়িয়ে আছে। যা এমন অধঃপতনের পথকে সুগম করছে।

মুসলিম উম্মাহ কখনো কাফেরদের শক্তির দ্বারা পরাজিত হয় না; বরং নিজেদের দুর্বলতার কারণেই পরাজিত হয়। যার স্পষ্ট উদাহরণ বদর ও উহুদ যুদ্ধ। বদরের প্রান্তরে মুসলমানদের দৃঢ়তার বলয়ে অনায়াসেই বিজয় লাভ হয়। কিন্তু উহুদ প্রান্তরে সামান্য আনুগত্যহীনতার কারণে মুসলমানদের সাময়িক পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। উম্মাহর প্রতিটি মানুষের অন্তরে আজ ব্যাধির আবাস। দুনিয়ার লোভ ও মৃত্যুকে অপছন্দ করাই হলো সেই গুরুতর ব্যাধি। সাহাবায়ে কেরাম জান্নাতলাভের আশায় মৃত্যুকে ভালোবাসতেন। কিন্তু আমরা দুনিয়ার লোভে মৃত্যুকে অপছন্দ করছি। উম্মাহর দুর্যোগটা মূলত মুসলমানদের অন্তরে দুনিয়ার ভালোবাসা বেড়ে যাওয়া এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করা। মহানবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ব্যাপারে ভয়াবহ ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, খাদ্য গ্রহণকারীদের যেমনিভাবে খাবারপাত্রের চতুর্দিকে ডেকে আনা হয়, তেমনিভাবে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর লোকেরা তোমাদের বিরুদ্ধে একে অপরকে ডেকে আনবে। এক ব্যক্তি বললো, সেদিন আমাদের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে কি এরূপ হবে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা বরং সেদিন প্রচুর সংখ্যক হবে। কিন্তু তোমরা হবে বন্যার স্রোতে ভেসে যাওয়া আবর্জনার মতো। আর আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের অন্তর থেকে তোমাদের আতঙ্ক দূর করে দেবেন এবং তোমাদের অন্তরে ‘আল-ওয়াহন’ ঢেলে দেবেন। সাহাবীরা বললেন, হে রাসুলুল্লাহ! ‘আল-ওয়াহন’ কি? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাহলো দুনিয়ার ভালোবাসা এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করা।’ (আবু দাউদ শরিফ, হাদিস নং-৪২৯৭)

আজ এই দুনিয়ার লোভে মুসলমানগণ নিজেদের জাত-পরিচয় ভুলে গেছে। সামান্য স্বার্থের জন্য মুসলিমরা দীনের ক্ষেত্রে ত্রুটি করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। ক্ষমতা ও অর্থ লোভে কাফেরদের সাথে হাত মিলাচ্ছে। এমনকী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অভিশাপপ্রাপ্ত ইহুদিদের সাথেও সখ্যতা গড়ে তুলছে। মুসলিম আজ তার ইতিহাস ঐতিহ্য ভুলে গেছে। আমরা ভুলে গেছি সাহাবায়ে কেরামগণের শহীদী চেতনা। ভুলে গেছি তারিকের পুত্র জিয়াদ কর্তৃক আন্দালুসিয়া তথা বর্তমান স্পেন জয়ের সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। ভুলে গেছি সুলতান ইমামুদ্দিন জিনকি ও তার পুত্র নুরুদ্দিন মাহমুদ জিনকির ক্রুসেড যুদ্ধের ইতিহাস। ভুলে গেছি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী কর্তৃক সমগ্র খ্রিস্টান জাতিকে পরাজিত করে জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের ইতিহাস। ভুলে গেছি লেবাননের বীর শহীদ ওমর মুখতারের সেই অমীয় বক্তব্য ‘আমরা কলোনী মুক্ত করবো নয়তো শহীদ হবো’। সেদিন ইতালির মুসোলোনী কর্তৃক শত লোভ-লালসার প্রস্তাব ওমর মুখতারকে তার পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। ফাঁসির কাষ্ঠে ওমর মুখতারের বক্তব্য ছিল, আমার শাহাদাত উম্মাহর জন্য শিক্ষা হবে যে, মুসলিম ফাঁসির কাষ্ঠ বরণ করবে তবুও বাতিলের সাথে আপস করবে না। কিন্তু আফসোস, বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ সামান্য ক্ষমতা, আর্থিক সহায়তা ও পণ্য-দ্রব্যের লোভে কাফেরদের নিকট নিজেদের আত্মমর্যাদা বিলিয়ে দিচ্ছে।

মুসলমানদের নিকট আজ আখেরাতের মূল্য নেই। পবিত্র কোরআনুল কারীমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা বলেন, ‘বলুন, দুনিয়ার সুখ সামান্য। আর যে তাকওয়া অবলম্বন করবে তার জন্য আখিরাত উত্তম।’ (সুরা নিসা, আয়াত-৭৭) মুসলমান আজ এই আয়াত অমান্য করায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। আর ধ্বংসের পরেই হয় পরিবর্তন। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তিনি তোমাদের স্থলে অন্য কোনো জাতিকে স্থলাভিষিক্ত করবেনা।’ (সুরা মোহাম্মদ, আয়াত-৩৮) আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া সামান্য মাত্র। এব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর কসম! আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া হচ্ছে, ‘যেমন তোমাদের কেউ সমুদ্রের জলে এই আঙ্গুল (তর্জনী) রাখলো। অতঃপর তোমাদের কেউ যেন দেখে তার আঙ্গুল কতটুকু পানি উঠিয়ে আনতে পেরেছে। আজ দুনিয়া ও আখেরাতের এই পরিধির দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা।

আমাদের পরিকল্পনা পুনর্বিন্যাস করতে হবে। দূর করতে হবে আমাদের সব ব্যাধি। এখানে ব্যাধি থেকে পরিশুদ্ধতার উপায় তুলে ধরা হলো-
১. দুনিয়ার বোঝা থেকে ভারমুক্ত হওয়া : দুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ত অন্তর লুণ্ঠিত ভূমি মুক্ত করতে পারে না। দুনিয়ামুখী মানুষ কেবল নিজের জন্যই বেঁচে থাকে। কেবলই খাদ্য, পানীয়, প্রভাব-প্রতিপত্তি, বিনোদন ও বিলাসিতায় মত্ত থাকে। এই অবস্থায় বিজয় অর্জন করা সম্ভব নয়।

২. সর্বদা মৃত্যুর কথা স্মরণ করা : মৃত্যুর স্মরণ কোনো দুঃখপূর্ণ বা নেতিবাচক বিষয় নয়; বরং রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতের অনুসরণ। মৃত্যুর স্মরণ সর্বদা নিজের কর্মকাণ্ডের হিসাব গ্রহণ, গুনাহ থেকে তাওবা করা, আল্লাহর দিকে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করে।

৩. ইলমি মজলিসে উপস্থিত হওয়া : ইলমে মজলিস বিজয়ের চূড়ান্ত একটি মাধ্যম। সর্বদা ইলমি মজলিসগুলোর উপস্থিতি যে কোনো মুসলমানকে পদস্খলন থেকে রক্ষা করে। ভুল-ত্রুটি থেকে বাঁচিয়ে দেয়। শরিয়তের জ্ঞান দান করে এবং সিরাতে মুস্তাকিমের পথে পরিচালিত করে।

৪. আকিদারভিত্তিতে সমাজকে ঐক্যবদ্ধকরণ : এই বন্ধন হলো সেই বন্ধন, যা ছিন্ন হবে না। এটা সেই বন্ধন, যাতে মহান আল্লাহ বরকত দিয়েছেন এবং সুদৃঢ় করেছেন। এই বন্ধন মুসলিম উম্মাহকে এক ছায়াতলে আবদ্ধ করে।

৫. গভীরভাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী অধ্যয়ন করা : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনটাই হলো ইসলাম। তাঁর জীবনই কোরআনের বাস্তব নমুনা। তিনি নিজে সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। আমরা রাসুলের জীবনী নিয়ে সঠিকভাবে চিন্তা করলে, আমরা চিনতে পারবো-কে বন্ধু আর কে শত্রু। আমরা বুঝতে পারবো- বিজয়ের মাধ্যম ও পরাজয়ের কারণসমূহ।

৬. উম্মাহর গর্বিত ইতিহাস জানা : নবীগণ থেকে শুরু করে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী, সলফে সালেহীন এবং যুগে যুগে ঘটমান উম্মাহর বিজয় ইতিহাস জানতে হবে। তা আমাদের অন্তরে নতুন করে জেগে উঠার সাহস ও স্বপ্ন জোগাবে।

৭. আল্লাহর শত্রুদের সাথে বন্ধুত্বহীনতা : আল্লাহর শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন ইমানের দুর্বলতা ও আকিদার ভ্রষ্টতার লক্ষ্মণ। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা ইহুদি ও খ্রিস্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে নিশ্চয়ই তাদের একজন। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালেম সমপ্রদায়কে হিদায়াত দেননা। সুতরাং তুমি দেখতে পাবে, যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে, তারা কাফিরদের মাঝে (বন্ধুত্বের জন্য) ছোটাছুটি করছে। (সুরা মায়িদাহ, আয়াত-৫১)

৮. আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা : আল্লাহর সাহায্য কেবল তাদের জন্যেই, যারা তার ফায়সালায় সন্তুষ্ট থাকে এবং তাঁর ব্যাপারে আস্থাশীল। অপরদিকে আল্লাহর ফয়সালায় অসন্তুষ্ট, ক্রুদ্ধ লোকদের সাহায্যের সমীকরণে কোনো স্থান নেই।

৯. সময়কে যথাযথ কাজে লাগানো : গম্ভীর ও গুরুত্বপূর্ণ জীবনে এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট হতে পারে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে একটি মিনিটও অযথায় ব্যয় হয়নি। যথাযথ পরিকল্পনা ও সঠিক পদ্ধতি ছাড়া কেউ উঁচু স্তরে পৌঁছাতে পারেনা। তাই প্রত্যেক মুসলমানকে সময়ের মূল্যায়ন করতে হবে। যথাযথভাবে সময়কে কাজে লাগাতে হবে। ১০. সর্বত্র জিহাদের শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া। প্রচুর তথ্য সন্ত্রাস, মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ও বিভিন্ন ট্যাগ; যেমন-উগ্রপন্থা, চরমপন্থা, ব্রেইন ওয়াশড, জঙ্গি ইত্যাদি লাগানোর ফলে বর্তমানে অনেক সাধারণ মুসলিম ‘জিহাদ’ শব্দ শুনলেই ভয় পায়। এজন্য শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে জিহাদের মূলশিক্ষা ও প্রতিপাদ্য বিষয়টা সর্বত্র তুলে ধরতে হবে। কারণ জিহাদ হলো মর্যাদাপূর্ণ শ্রেষ্ঠ আমল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি জিহাদের সমতুল্য কোনো আমল পাইনি’। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ২৭৮৫)

সবিশেষ উল্লেখ্য যে, নিজেদের পাপ-পঙ্কিলতা মোচন করত সকল ব্যাধি দূর করতে হবে। মুসলিম উম্মাহকে নতুন করে বিশ্বজয়ের পরিকল্পনা সাজাতে হবে। নিজেদের ঐতিহ্য ও গৌরব ফিরিয়ে আনতে আমাদের দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। মহান আল্লাহ মুসলিম উম্মাহর প্রতি সহায় হোন। আমিন।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]