ওমর ফারুক ত্রিপুরা : পাহাড়ে ইসলামের প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ

কমরেড মাহমুদ |

শহীদ ওমর ফারুক ত্রিপুরার তিন মেয়ে এক ছেলে। হাফসা ত্রিপুরা, আমেনা ত্রিপুরা, ও মায়মুনা ত্রিপুরা। হাফসা ত্রিপুরার বিয়ে হয়ে গেছে, তিনি স্বামীর সাথে বর্তমানে ঢাকায় থাকেন। আমেনা ত্রিপুরা ৭মে শ্রেণিতে পড়েন, ছেলে ইব্রাহীম ত্রিপুরা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। ছোট মেয়ে মায়মুনা ত্রিপুরা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। সবচেয়ে খুশির খবর তারা সবাই মাদ্রাসাতে পড়াশোনা করছে। খুশির খবর বললাম এই কারনে যে, এই পরিবারটি শুধু নামেই মুসলিম হতে চায়নি। ওমর ভাই নিজে এবং নিজ পরিবারকে ইসলামের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।

পুর্নেন্দু ত্রিপুরার বাবা বৌদ্ধ ধর্ম থেকে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ২০১৪ সালে পুর্নেন্দু ত্রিপুরা থানচিতে তার একজন উপজাতীয় মুসলিম বন্ধুর দাওয়াতে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর বান্দরবানে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ওমর ফারুক নাম গ্রহণ করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর তিনি ঢাকায় গিয়ে তাবলিগে যোগ দেন। তাবলিগে এক চিল্লা (৪০দিন) সময় দেয়ার পর নিজ গ্রামে ফিরে এসে মেয়ে হাফসা ও আমেনাকে ঢাকায় নিয়ে এসে মাদ্রাসাতে ভর্তি করে দেন। এই দু’জন এখন ঢাকাতে আছে।

ঢাকা থেকে রোয়াংছড়িতে ফিরে আসার পর শান্তিবাহিনী তার বাড়িতে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য প্রাণনাশের হুমকি দেয়। কিন্তু সাহসী ওমর ফারুক তাদেরকে বলে, ধর্ম পরিবর্তন তার গণতান্ত্রিক অধিকার। কাজেই কোনো ভুল বা অন্যায় তিনি করেননি। তবুও সন্ত্রাসীরা তাকে হুমকি দিলে তিনি সন্ত্রাসীদের বলেন, তোমরা কী করবা আমার। প্রাণ নিবা, নাও আমি বুক পেতে দিলাম। গুলি করো। আমি শহীদ হয়ে যাবো। এই বলে তিনি জামার বোতাম খুলে সন্ত্রাসীদের সামনে বুক চেতিয়ে দাঁড়ান। সেদিন ওমর ফারুকের ত্বাকওয়া ও ঈমানী চেতনার কাছে হতবিহ্বল হয়ে সন্ত্রাসীরা তাকে গুলি না করে ফিরে যায়।

এরপর থেকে তিনি তার আশেপাশের অমুসলিমদের মাঝে দাওয়াত দিতে শুরু করেন এবং একটির পর একটি পরিবারকে ইসলামের আলোয় দিক্ষিত করতে থাকেন। বেশ কিছু পরিবার ইসলামের সুশীতল ছায়ায় চলে আসলে ওমর ফারুক একটি মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন এবং এ লক্ষ্যে নিজের এক একর জমি মসজিদকে দান করেন। নিজেই সে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে নিজেই সেখানে অক্তিয় নামাজের ইমামতি শুরু করেন। এক পর্যায়ে ২০১৮ সালে এই মসজিদে তিনি মাইক লাগিয়ে আজান দেয়া শুরু করেন।

এই মাইক লাগানোর পর থেকে তার উপর নতুন করে প্রাণনাশের হুমকি শুরু হয়। তিনি প্রায়ই তার পরিবার, স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিকট বলতেন, ওরা আমাকে হত্যা করবে।

ওমর ফারুকের মেজো মেয়ে আমেনার বর্ণনা মতে, তার বাবা প্রতিদিন রাতে এশার নামাজ পড়ে এসে পরিবারের সাথে রাতের খাবার খান। ১৮ জুন শুক্রবার দিবাগত রাতেও অন্যান্য দিনের মতোই তার বাবা এশার নামাজ শেষ করে বাড়িতে ফিরে একটি চেয়ারে বসে বিশ্রাম গ্রহণ করছিলেন। বাড়ির অন্যান্যরা রাতের খাবার রেডি করছিলো। এসময় একটি কণ্ঠস্বরে ঘরের বাইরে থেকে তার পূর্বের ত্রিপুরা নাম ধরে তাকে ডাক দেয়।

ওমর ফারুক এই ডাকের অর্থ বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করেন এবং ঘরের ভেতরেই অবস্থান করেন। এ সময় পাশের জঙ্গল থেকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা দরোজা ভেঙে ঘরে ঢুকে তার দিকে অস্ত্র তাক করলে ওমর ফারুকের স্ত্রী রাবেয়া বেগম স্বামীকে রক্ষা করতে ছুটে যান। কিন্তু সন্ত্রাসীরা তার বুকে লাথি মারলে তিনি ছিটকে পড়ে যান। এসময় সন্ত্রাসীরা খুব কাছে থেকে ওমর ফারুকের মাথায় দুই রাউন্ড গুলি করলে তিনি মুখ থুবড়ে পড়ে যান এবং সাথে সাথেই শাহাদাত বরণ করেন। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে আসে, কিন্তু তার আগেই সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়।

আমেনার দাবী, অন্যান্য দিন পাড়াগুলোর প্রত্যেক বাড়িতে বাইরে সোলার বিদ্যুতের বাল্ব জ্বললেও ওইদিন পাড়ায় কোনো বাড়ির বাইরের আলো জ্বালানো হয় নি। গুলির শব্দ শুনে প্রতিবেশী খ্রিস্টান পরিবারের কেউ এগিয়ে না এসে সবাই ঘরে অবস্থান করেছে।

অন্যদিকে কাছাকাছি পাড়ায় বসবাসকারী নওমুসলিম পরিবারগুলো ওমর ফারুকের উপর আসা হুমকির বিষয়টি অবগত ছিলো। ফলে ওমর ফারুকের বাড়িতে গুলির শব্দ শুনে তারা ঘটনাটি সহজেই বুঝে ফেলে এবং সন্ত্রাসীরা এবার তাদের হত্যা করতে আসবে ধারণা করে সকলে স্ত্রী, সন্তানসহ জঙ্গলে পালিয়ে যায়।

শহীদ ওমর ফারুক ত্রিপুরা পাহাড়ে ইসলামের যে আলো জ্বালিয়ে গেছেন সেই আলো পুরো পার্বত্যকে আলোকিত করবে ইনশাআল্লাহ।