ইসলাম বোঝার মূলনীতি

ইমাম হাসান আল বান্না রহ. | অনুবাদ : সালমান খাঁ
ইমাম হাসান আল বান্নার অনেকগুলো রিসালাহর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ‘রিসালাতুত তায়ালিম’। এই রিসালায় ইমাম আলোচনা করেছেন ইখওয়ানুল মুসলিমিনের বাইয়াতের রুকন নিয়ে। ইখওয়ানুল মুসলিমিনের বাইয়াতের রুকন মোট দশটি। এর মাঝে প্রথমটি হচ্ছে ‘আল ফাহম’ বা ‘অনুধাবন’। এই ‘আল ফাহম’ রুকনে ইমাম হাসান আল বান্না আলোচনা করেছেন ইসলাম বোঝার মূলনীতি নিয়ে। ইমাম বলেছেন, ইসলামকে বুঝতে হবে এই বিশ মূলনীতির আলোকে।

‘আল ফাহম’ বা ‘অনুধাবন’ বলতে আমি বুঝাতে চাচ্ছি, আপনাকে এই কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে, আমাদের চিন্তা, চেতনা ও আদর্শ নির্মিত হবে নিরেট ইসলামের আলোকে। আমরা যেভাবে ইসলামকে বুঝেছি, আপনাকেও সেইভাবে ইসলাম বুঝতে হবে। ইসলামকে বুঝতে হবে এই বিশ মূলনীতির মানদণ্ডে।

১. “ইসলাম এমন এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানবজীবনের সকল দিক ও বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করে। অতএব ইসলাম হচ্ছে রাষ্ট্র ও দেশ বা শাসনব্যবস্থা ও জাতি, আখলাক ও শক্তি (Power) বা রহমত ও আদালত, সংস্কৃতি ও আইন বা জ্ঞানবিজ্ঞান ও বিচারব্যবস্থা, পুঁজি ও সম্পদ বা উপার্জন ও প্রাচুর্য, জিহাদ ও দাওয়াত বা সেনাবাহিনী ও আদর্শ। ইসলাম যেমন বিশুদ্ধ আকিদা, ঠিক তেমন বিশুদ্ধ আমলও। উভয়টিই সমান গুরুত্বের দাবিদার।”

২. “ইসলামের বিধিবিধান জানার ক্ষেত্রে কুরআনুল কারিম ও পবিত্র সুন্নাহ হচ্ছে প্রত্যেক মুসলমানের প্রত্যাবর্তনস্থল। কুরআনুল কারিমকে আরবি ভাষার নিয়মাবলির আলোকে সকল প্রকার কৃত্রিমতা ও স্বেচ্ছাচারিতা থেকে মুক্ত হয়ে বুঝতে হবে। আর হাদিস বুঝার ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত হাদিস বর্ণনাকারীদের দ্বারস্থ হতে হবে।”

৩. “সত্যনিষ্ঠ ঈমান, বিশুদ্ধ ইবাদত ও চেষ্টা-সাধনার রয়েছে নূর ও সুমিষ্ট স্বাদ। আল্লাহ তায়ালা যাকে চান, তার অন্তরে এ নূর ও সুমিষ্ট স্বাদ ঢেলে দেন। কিন্তু ইলহাম, অন্তরের ঝোঁক-প্রবণতা, কাশফ ও স্বপ্ন শরিয়তের বিধিবিধানের ক্ষেত্রে কোনো দলিল নয়। এগুলোর কেবল তখনই নির্ভর করা যাবে, যখন এগুলো দ্বীনের আহকাম ও নুসুসের (কুরআন ও সুন্নাহর উদ্ধৃতি) বিরোধী হবে না।”

৪. “তাবিয-কবচ, জাদু-টোনা, গলায় শঙ্খ ঝুলানো, হারিয়ে যাওয়া বস্তুর অবস্থান জানার দাবি করা, বালুতে দাগ টেনে কিংবা নক্ষত্রের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ গণনা, গায়েবের জ্ঞান রাখার দাবি করাসহ এ জাতীয় যা কিছু আছে তার সবই গর্হিত কাজ। এগুলো প্রতিহত করা আমাদের কর্তব্য। তবে যে সমস্ত রুকইয়া কুরআনের আয়াত বা হাদিসে বর্ণিত দোয়ার মাধ্যমে করা হয়, তার কথা ভিন্ন।”

৫. “ইমাম বা তার প্রতিনিধির মতামত চলবে সেখানে, যেখানে নস নেই, নস থাকলেও তা একাধিক অর্থের সম্ভাবনা রাখে এবং মাসলাহা মুরসালার ক্ষেত্রে। ইমাম বা তার প্রতিনিধির মতামতের উপর তখনই আমল করা যাবে, যখন তা কোনো শরয়ি মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক হবে না। আর স্থান, কাল, প্রচলিত রীতিনীতি ও মানুষের অভ্যাসের আলোকে তাদের মতামত ভিন্ন হতে পারে। ইবাদতের ক্ষেত্রে মূলনীতি হচ্ছে কারণ বা উদ্দেশ্য তালাশ না করে নিরেট অনুসরণ। আর অভ্যাসগত কর্মের ক্ষেত্রে মূলনীতি হচ্ছে তাৎপর্য, প্রজ্ঞা ও উদ্দেশ্য তালাশ করা।”

৬. “আল মাসুম বা নির্ভুল সত্তা (মুহাম্মাদ সা.) ছাড়া অন্য সবার কথা গ্রহণ করাও যাবে, বর্জন করাও যাবে। সালাফদের থেকে আসা যা কিছু কুরআন-সুন্নাহর সাথে মিলে যাবে, আমরা তা গ্রহণ করব। (আর যদি না মিলে) তাহলে আল্লাহর কিতাব ও রাসূল সা. এর সুন্নাহই অনুসৃত হওয়ার অধিক দাবিদার। তবে মতপার্থক্যের কারণে আমরা কোনো ব্যক্তিকে বিদ্রƒপ বা দোষারোপ করব না। আমরা তাদেরকে তাদের নিয়তের উপর ছেড়ে দিব। তারা তাদের কর্মের প্রতিদান পাবেন।”

৭. “যে সকল মুসলমান শাখাগত ফিকহি বিধিবিধানের দলিল যাচাই-বাছাই করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি, তারা ইমামদের মাঝে কোনো একজন ইমামের অনুসরণ করবে। তবে এর পাশাপাশি কোন বিধানের ক্ষেত্রে তার ইমামের দলিল কী, তা জানার চেষ্টা করাটা তার জন্য উত্তম হবে। আর তার উচিত হবে দলিলনির্ভর সকল নির্দেশনাই মেনে নেওয়া, যদি দলিলদাতার সততা ও যোগ্যতা প্রমাণিত হয়। তবে সে যদি আলেম হয়, তাহলে তার উচিত হবে জ্ঞানগত অপূর্ণতা দূর করে যাচাই-বাছাই করার স্তরে পৌঁছা।”

৮. “শাখাগত মাসয়ালায় ফিকহি মতবিরোধ কখনোই দ্বীনের মাঝে দলাদলির কারণ হবে না। এ মতবিরোধ যেন কোনো প্রকার ঝগড়া ও হিংসা-বিদ্বেষের সৃষ্টি না করে। প্রত্যেক মুজতাহিদের জন্যই প্রতিদান রয়েছে। আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও পারস্পরিক সহযোগিতামূলক মনোভাব লালন করে শাখাগত মাসয়ালায় প্রকৃত সত্য উদঘাটনের নিমিত্তে বস্তুনিষ্ঠ ইলমি গবেষণায় কোনো সমস্যা নেই। তবে খেয়াল রাখতে হবে, এটা যেন নিন্দিত ঝগড়া ও গোঁড়ামির দিকে নিয়ে না যায়।”

৯. “প্রত্যেক এমন মাসয়ালা যার উপর আমল করা দরকার হয় না, তা নিয়ে গভীর আলোচনা-পর্যালোচনায় লিপ্ত হতে আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন, অসংঘটিত বিষয়ে অধিক পরিমাণ শাখা মাসয়ালা উদঘাটন করা, সাহাবিদের মাঝে কার মর্যাদা কম ও কার মর্যাদা বেশি এ নিয়ে তর্ক করা এবং তাদের মাঝে সংঘটিত বিরোধ নিয়ে আলোচনা করা। সাহাবিদের প্রত্যেকেরই রয়েছে রাসূল সা.-এর সুহবতের কারণে বিশেষ মর্যাদা, নিয়তের কারণে প্রতিদান এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার অধিকার।”

১০. “আল্লাহ তায়ালার মারিফত, তাঁর তাওহিদ এবং সকল প্রকার ত্রুটি থেকে তাঁর পবিত্রতা ইসলামী আকিদার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহ তায়ালার সিফাত সম্পর্কিত আয়াত, সহিহ হাদিস ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট মুতাশাবিহাত আমরা সেভাবেই বিশ্বাস করি, যেভাবে তা বর্ণিত হয়েছে। আমরা এগুলোকে ব্যাখ্যাও করি না, বাতিলও করি না। এ ব্যাপারে আলেমদের মাঝে হওয়া মতবিরোধ থেকে আমরা দূরে থাকব। এক্ষেত্রে রাসূল সা. ও সাহাবিদের এ মনোভাব অনুসরণ করাই আমরা যথেষ্ট মনে করি, “আর যারা জ্ঞানে সুগভীর তারা বলে, আমরা এগুলোতে ঈমান রাখি, এর সবই আমাদের রবের কাছ থেকে এসেছে।”

১১. “আল্লাহর দ্বীনের মাঝে নব আবিষ্কৃত প্রতিটি ভিত্তিহীন বিষয়ই হচ্ছে ভ্রষ্টতা। মানুষ তাদের প্রবৃত্তির চাহিদানুযায়ী দ্বীনের মাঝে বাড়িয়ে বা কমিয়ে এগুলো তৈরি করেছে এবং এগুলোকে ভালো মনে করে নিয়েছে। এসব বিদয়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া আবশ্যক। এগুলোকে প্রতিহত করতে হবে সর্বোত্তম পদ্ধতিতে, যাতে সমাধান করতে গিয়ে আবার এরচেয়েও খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়।”

১২. “আল বিদয়াতুল ইযাফিয়্যাহ বা সংযোজনমূলক বিদয়াত, আল বিদয়াতুত তারকিয়্যাহ বা পরিত্যাগমূলক বিদয়াত এবং নির্দিষ্ট কোন ইবাদতে নিরন্তন লেগে থাকা ফিকহি মতবিরোধের আওতায় পড়বে। এ ব্যাপারে প্রত্যেকেরই নিজ নিজ মতামত আছে। তবে দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে প্রকৃত সত্যটা উদঘাটন প্রচেষ্টায় দোষের কিছু নেই।”

১৩. “নেককারদেরকে ভালোবাসা এবং তাদের উত্তম কর্মের প্রশংসা করা আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের মাধ্যম। আওলিয়া তো তারাই যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তারা ঈমান আনে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে (সূরা ইউনুস : ৬৩)। আর (আওলিয়াদের) কারামত কিছু শরয়ি শর্তের আলোকে প্রমাণিত বিষয়। তবে কারামতের ক্ষেত্রে এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, তাদের উপর আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট কিন্তু তারা জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর পরে নিজেদের কোনো উপকার বা ক্ষতি করতে পারে; অন্যের উপকার বা ক্ষতি করার আরও সুদূর পরাহত বিষয়।”

১৪. “সুন্নাহসম্মত পদ্ধতিতে যে কারও কবর জিয়ারত বৈধ অনুশীলন। কিন্তু কবরবাসীদের (যেই হোক না কেন) কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা, তাদের কাছে সাহায্যের জন্য দোয়া করা, নিকট বা দূর থেকে তাদের কাছে প্রয়োজন পূরণের দাবি করা, তাদের জন্য মানত করা, কবরের উপর দালান নির্মাণ, কবরকে আবৃতকরণ, কবরে আলো জ্বালানো, কবরে শরীর মাসাহ করা এবং আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করাসহ এ ধরনের যত বিদয়াত আছে সবগুলোই কবিরা গুনাহ। এগুলো প্রতিরোধ করা আবশ্যক। এ কাজগুলোকে আমরা সাদ্দুদ যারায়ি হিসেবে ব্যাখ্যা করার পক্ষপাতী নই।”

১৫. “কোনো সৃষ্টিকে উসিলা করে আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করা হচ্ছে দোয়ার পদ্ধতি সংক্রান্ত শাখাগত ফিকহি মতপার্থক্য। এটা আকিদার কোনো মাসয়ালা নয়।”

১৬. “ভুল উরফ বা প্রচলন শরয়ি শব্দের হাকিকতকে পরিবর্তন করে না। বরং শব্দ দ্বারা উদ্দীষ্ট অর্থের সীমারেখাকে গুরুত্ব দেওয়া এবং এই সীমারেখার মাঝেই অবস্থান করা বাঞ্ছনীয়। একইভাবে দ্বীন ও দুনিয়াবি সকল ক্ষেত্রে শাব্দিক ধোঁকা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। কোনো কিছুর নাম বা শিরোনাম মূল বিবেচ্য নয়, মূল বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে ঐ নাম বা শিরোনাম যা মর্মার্থ ধারণ করে তা।”

১৭. “আকিদা হচ্ছে আমলের ভিত্তিস্বরূপ। বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলের চেয়ে কলবের আমল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ উভয় আমলের ক্ষেত্রেই পরিপূর্ণতা আনয়ন শরিয়তের দাবি, যদিও দাবির মাত্রা ভিন্ন।”

১৮. “ইসলাম আকল বা চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। ইসলাম বিশ্বজগৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহিত করে, জ্ঞান ও জ্ঞানীদের মর্যাদা সমুন্নত করে এবং সকল উপকারী ও কল্যাণকর ব্যাপারকে স্বাগত জানায়। জ্ঞান মুমিনের হারানো সম্পদ, যেখানেই তা পাওয়া যাক না কেন, সেই এর অধিক হকদার।”

১৯. “কখনো কখনো শরয়ি দৃষ্টিভঙ্গি আকলি দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত হতে পারে। কিন্তু অকাট্য বিষয়াবলিতে কখনও একটি অপরটির বিপরীত হতে পারে না। অতএব বিশুদ্ধ জ্ঞানগত বাস্তবতা কখনও প্রতিষ্ঠিত শরয়ি নীতির সাথে সংঘাতপূর্ণ হবে না। উভয়টির যন্নি বা সন্দেহযুক্ত বিষয়গুলোকে কাতয়ি বা অকাট্য বিষয়গুলোর আলেকে ব্যাখ্যা করতে হবে। আর উভয়টিই যদি যন্নি হয়, তাহলে শরয়ি দৃষ্টিভঙ্গিই অনুসৃত হওয়ার অধিক হকদার, যতক্ষণ না আকলি দৃষ্টিভঙ্গি সুপ্রতিষ্ঠিত হয় কিংবা বাতিল প্রমাণিত হয়।”

২০. “আমরা এমন কোনো মুসলমানকে তার কোনো মতামত বা পাপাচারের কারণে তাকফির করব না; যে দুই শাহাদাতকে স্বীকার করে নিয়েছে, শাহাদাতের দাবি অনুযায়ী আমল করে এবং ফরজগুলো ঠিকঠাক আদায় করে। তবে সে যদি কোনো কুফরি কথার স্বীকৃতি দেয় বা দ্বীনের অকাট্য কোনো বিষয় অস্বীকার করে বা কুরআন সুস্পষ্ট কোনো আয়াতকে মিথ্যারোপ করে বা আরবি ভাষারীতিতে কোনো সম্ভাবনা রাখে না এমনভাবে কুরআনের ব্যাখ্যা করে বা এমন কাজ করে যা কুফরি ভিন্ন অন্য কোন কিছুর সম্ভাবনা রাখে না; তাহলে ভিন্ন কথা।”

ইখওয়ানুল মুসলিমিনের একজন কর্মী যখন এই মূলনীতিগুলোর আলোকে তার দ্বীন ইসলামকে বুঝতে শিখবে, তখন সে এই স্লোগানের মর্ম অনুধাবন করতে সক্ষম হবে, যে স্লোগান সে সারাক্ষণ আওড়িয়ে থাকে,

“কুরআন আমাদের সংবিধান আর রাসূল সা. আমাদের আদর্শ।”

লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব
অনুবাদক : শিক্ষার্থী, ঢাবি