ভূমিকম্প : কিয়ামতের আলামত

মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম |

কিয়ামত আরবি শব্দ। অর্থ- মহাপ্রলয়, পুনরুত্থান। ইয়াওমুল কিয়ামা অর্থ কিয়ামত দিবস। কিয়ামত দিবসের আরো নাম রয়েছে যেমন- ইয়াওমুল জাযা- প্রতিদান দিবস, ইয়াওমুল হিসাব- হিসাবের দিবস, ইয়াওমুল কাযা- বিচার দিবস, ইয়াওমুদ দিন- শেষ বিচারের দিন, ইয়াওমুল হাশর- সমাবেশের দিন, ইয়াওমুল জাময়ে- একত্রিত করার দিন, ইয়াওমুল বায়াছ- পুনরুত্থান দিবস প্রভৃতি। হজরত জিবরাইল আ: একদা ছদ্মবেশে মহানবী সা:-এর কাছে হাজির হয়ে আরজ করেন, কিয়ামত কখন অনুষ্ঠিত হবে? মহানবী সা: বলেন, ‘জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি জিজ্ঞাসাকারী থেকে অধিক জ্ঞাত নয়। (এ ব্যাপারে আপনার চেয়ে আমি অধিক জ্ঞাত নই) কিয়ামত কখন অনুষ্ঠিত হবে তা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না।’ (মিশকাত)

ভূমিকম্প কিয়ামতের একটি আলামত : কিয়ামতের আগে অসংখ্য আলামত দেখা দেবে। তন্মধ্যে অন্যতম হলো ভূমিকম্পের আধিক্য। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘তারা কি শুধু এ অপেক্ষায় রয়েছে যে, কিয়ামত তাদের কাছে হঠাৎ এসে পড়ুক। বস্তুত কিয়ামতের লক্ষণগুলো তো এসেই পড়েছে। সুতরাং এসে পড়লে তারা কিভাবে উপদেশ গ্রহণ করবে?’ (সূরা মুহাম্মদ-১৮)

হজরত জিবরাইল আ: মহানবী সা: থেকে কিয়ামতের কিছু আলামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিয়ামতের একটি আলামত হলো- দাসী তার মনিবকে প্রসব করবে অর্থাৎ ছোটলোকের ঘরে বড়লোক জন্মগ্রহণ করবে, আরেকটি আলামত হলো- নগ্ন পা বিশিষ্ট, বস্ত্রহীন মেষচালক বিশাল বিশাল প্রাসাদ তৈরি করবে এবং এ কাজে তারা পরস্পর গর্ব করবে। অর্থাৎ একসময় যারা গরিব ছিল, পরবর্তীতে তারা ধনী হয়ে অহঙ্কারী হবে।’ (মিশকাত-২)

মহানবী সা: বলেন, ‘কিয়ামতের আগে সরকারি মালকে নিজের মাল মনে করা হবে, আমানতের মালকে নিজের মালের মতো ব্যবহার করা হবে, জাকাতকে জরিমানা মনে করা হবে, ইসলামী আকিদাবর্জিত বিদ্যা শিক্ষা করা হবে, পুরুষ নারীর অনুগত হবে, মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করা হবে, বন্ধুকে আপন মনে করা হবে, পিতাকে পর ভাববে, মসজিদে শোরগোল করবে, পাপী লোক গোত্রের নেতা হবে, অসৎ ও নিকৃষ্ট লোকেরা জাতির চালক হবে, ক্ষতির ভয়ে কোনো লোককে সম্মান করা হবে, গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন হবে, মদপানের আধিক্য ঘটবে- এই উম্মতের পরবর্তী লোকেরা পূর্ববর্তী লোকদের বদনাম করবে।’ (তিরমিজি)

কিয়ামতের আগে দ্বীনি ইলমের ঘাটতি হবে, নগ্নতা-উলঙ্গপনা বৃদ্ধি পাবে, ফিতনা-ফাসাদের বিস্তার ঘটবে, অশ্লীলতার সয়লাব হবে, ভূমিকম্পের আধিক্য ঘটবে, হত্যাকাণ্ড বৃদ্ধি পাবে। এমনকি হত্যাকারী বলতে পারবে না কেন সে খুন করছে। মানুষ অট্টালিকা নির্মাণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে, মানুষ জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে মৃত্যুকে বেশি পছন্দ করবে। ধনসম্পদ এত বেড়ে যাবে যে, ধনীরা সদকা করার মতো কাউকে পাবে না। দু’টি বৃহৎ দল একই দাবিতে ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হবে। কিয়ামতের আগে ৩০ জন নবুওয়তের দাবিদার হবে। মুসলমানরা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের অনুকরণ ও অনুসরণ করবে। মানুষ জালিমকে জালিম বলবে না, খারাপ কাজ থেকে কেউ কাউকে বারণ করবে না। নারীদের আধিক্য হবে, ৫০ জন নারীর দেখাশোনার ভার একজন পুরুষের ওপর অর্পিত হবে। জিনা, ব্যভিচার ও মদের ছড়াছড়ি হবে। ইহুদিদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ হবে এবং যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হবে।

এমনকি জড় পদার্থ পাথরও তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে এসে বলবে, হে মুসলমান! দেখো আমার পেছনে এক ইহুদি লুকিয়ে আছে, তাকে হত্যা করো।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)

কিয়ামতের বড় বড় নিদর্শনগুলো এখনো পরিদৃষ্ট না হলেও ছোট ছোট নিদর্শনগুলো সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে। মানুষের মধ্যে কুরআন-হাদিস চর্চা এবং তা অনুযায়ী আমল করা কমে যাচ্ছে। কুরআন ও হাদিসের জ্ঞান থেকে মানুষদের দূরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। বদ দ্বীনি আচরণ ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছে। মানুষ থেকে নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। হিংসা, লোভ ও অহঙ্কারের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিযোগিতা করে অট্টালিকা নির্মাণ করা হচ্ছে। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনের পরিবর্তে দুষ্টের লালন ও শিষ্টের দমনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শিরক, বিদআত, নিফাক ইত্যাদি চরমভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মিথ্যা, আমানতের খিয়ানত, ওয়াদা খিলাফ অহরহ হচ্ছে। সন্তান পিতামাতার শুধু অবাধ্য নয়; বরং পিতামাতাকে খুন করছে। পিতামাতা সন্তানকে আদর স্নেহ দিয়ে মানুষ করার পরিবর্তে নিজেই হত্যা করছে। ভাইয়ের কাছে বোন, পিতামাতার কাছে সন্তান নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। পিতা তার কন্যাকে, ভাই তার বোনকে ধর্ষণ করছে, পুরুষ পুরুষকে, নারী নারীকে বিয়ে করছে; যা জাহেলি যুগেও করা হতো না।

অন্যায়-অবিচার এত প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, মানুষ অন্যায়কে অন্যায় মনে করছে না। ন্যায়নীতির পরিবর্তে অন্যায়-জুুলুম চরমভাবে করা হচ্ছে। নারীরা পর্দা করার পরিবর্তে পর্দাহীনতাকে অহঙ্কারের বিষয় বানিয়ে নিয়েছে। পোশাকের স্বাধীনতার নামে নগ্নতার জন্য সংগ্রাম করছে। সুদ-ঘুষ, মদ, জিনা-ব্যভিচার অধিক হারে বেড়ে গেছে। জাহেলি যুগের মতো সুদকে ব্যবসার মতো হালাল মনে করা হচ্ছে। ঘুষকে স্বাভাবিকভাবে দেখা হচ্ছে। মদপানকে তুচ্ছ করে দেখা হচ্ছে। পাঁচ বছরের বালিকা পর্যন্ত ধর্ষিতা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুবতীরা যুবকদের হাতে নির্যাতিত হচ্ছে। সমাজে সৎ ও নেককার লোকেরা লাঞ্ছিত হচ্ছে এবং দুষ্ট লোকদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। মহানবী সা: বলেছেন, ‘কিয়ামতের আগে অজ্ঞতা বেড়ে যাবে, ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে, মানুষের হৃদয় কঠিন হয়ে যাবে, মারামারি ও হত্যাযজ্ঞ বেড়ে যাবে।’ (সহিহ বুখারি)

লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী