কাবা শরিফের জুমার খুতবা : যুদ্ধ নয়, ইসলাম এনেছে শান্তি

শাইখ ড. আবদুর রহমান আস-সুদাইস

সকল প্রশংসা আল্লাহর। হে আমাদের রব! আমরা তোমার প্রশংসা করছি। তোমার কাছেই ক্ষমা চাই, তোমার কাছেই সাহায্য চাই। তোমার কাছেই তাওবা করি।

হে আল্লাহ! আমাদের রব! তুমিই শান্তি। তোমার কাছ থেকেই শান্তি।

হে আল্লাহর বান্দারা! আল্লাহকে ভয় করুন। আল্লাহকে ভয় করুন। আল্লাহকে ভয় করার মাধ্যমে উদ্দেশ্য সাধিত হবে। মর্যাদা বাড়বে। পরিণতি শুভ হবে।

‘হে ঈমানদাররা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। একজন ব্যক্তি যেন লক্ষ্য রাখে যে, সে আগামী দিনের জন্য কী অর্জন করে। আল্লাহকে ভয় করো, নিশ্চয়ই তোমরা যা করো, সে সম্পর্কে আল্লাহ অবহিত।’

যেখানেই থাকেন না কেন, আল্লাহকে ভয় করুন। আল্লাহর ভয়কে আঁকড়ে ধরলে ধারণার বাইরে সফলতা অর্জন করা যাবে।
ইসলাম তার সব বিধানে শান্তি ও নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করেছে। ইসলামের বিধানসমূহে মানবতাবোধ ও উন্নত নৈতিকতার প্রকাশ ঘটেছে।

আমার দ্বীন হলো ইসলাম। ভালোবাসার দ্বীন, শান্তির দ্বীন। সম্প্রীতির দ্বীন, সঠিক পথ ও মতের দ্বীন। এটিই বাস্তবতা। এর বিপরীতে যা বলা হয়, তা অপবাদ ও অপপ্রচার। বাস্তব সত্য ও অপপ্রচারের মধ্যে কতই না অসঙ্গতি!

হে মুসলিম সমাজ! শান্তি ও নিরাপত্তা মানুষের স্বভাবজাত প্রয়োজন। শান্তি ও নিরাপত্তা মানবিক প্রয়োজন। শান্তি ও নিরাপত্তা ছাড়া নির্মাণ, উন্নয়ন, উন্নতি, উৎকর্ষ, সমৃদ্ধি, উদ্ভাবন কোনোটিই সম্ভব নয়।

শান্তি ও নিরাপত্তার অনুপস্থিতিতে ঘটে বিপর্যয়, ধ্বংস ও সঙ্কট। ইসলামপূর্ব বিশ্বে ছিল গোত্রীয় ও গোষ্ঠীগত শাসন। প্রাধান্য বিস্তার ও প্রতিশোধের নেশায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলত যুগ যুগ ধরে।

ইসলামের আবির্ভাব ঘটল শান্তির আহ্বান নিয়ে। ইসলাম সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করল শান্তি ও নিরাপত্তার। ইসলাম রুখে দাঁড়াল যুদ্ধ, সঙ্ঘাত ও হত্যার বিরুদ্ধে।
ইসলাম শুধু ইসলাম, ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম-দর্শন নয় সঙ্ঘাত ও সংঘর্ষের আগুন নিভিয়ে মানবতাকে হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে আস্থা-বিশ্বাস, সংহতি ও সহমর্মিতার উন্মুক্ত ক্ষেত্রে নিয়ে এলো।

আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সঠিক পথের ওপর। ইসলাম সেই সঠিক পথকে আলোকিত করেছে। কেননা ইসলাম হলো শান্তি, বিশ্বস্ততা ও সংহতির জীবনব্যবস্থা।

ইসলামি শরিয়াহ এমন বিধানই বিধিবদ্ধ করেছে যাতে রয়েছে বান্দার পার্থিব জীবনের স্বার্থ ও পরকালীন জীবনের কল্যাণ। যেখানেই মানুষের কল্যাণ, সেখানেই আল্লাহর শরিয়াহ।

সালাম একজনের জন্য আরেকজনের কল্যাণ কামনা শব্দটির উৎপত্তি ‘ইসলাম’ থেকে। পরস্পরের জন্য পরস্পরের কল্যাণ কামনায় সালাম শব্দের সাথে মানুষের পরিচয় ঘটেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের পর।

কুরআন মাজিদে বিভিন্নরূপে ‘সালাম’ শব্দের উল্লেখ করা হয়েছে ৪৪ বার। বিপরীত দিকে যুদ্ধের উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র ছয় বার।
আল্লাহ সালাম, এর অর্থ হলো তিনি ঘাটতি ও ত্রুটি থেকে মুক্ত ও পবিত্র। ইসলামের শুভেচ্ছা বিনিময়ের শব্দ হলো সালাম। একের জন্য অপরের শান্তি কামনা। জান্নাত হলো দারুস সালাম শান্তির আবাস। ‘আল্লাহর নেক বান্দাহদের জন্য আল্লাহর কাছে রয়েছে শান্তির আবাস।’

হে মুসলিম উম্মাহ! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সিরাত ও ইসলামের বিজয় অভিযানের ঘটনাবলি প্রমাণ করে যে, ইসলামের ব্যাপক প্রসারের মূল ভিত্তি ও কার্যকরী শক্তি ছিল উত্তমরূপে ইসলামের দাওয়াত পেশ ও সুন্দর কথা। এমনকি যুদ্ধকালীন সময়েও উত্তম আচরণ।

বুরাইদাহ রাদি ‘আল্লাহু আনহুর সূত্রে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো অভিযানে সেনাবাহিনী পাঠানোর প্রাক্কালে সেনাধ্যক্ষকে ব্যক্তিগতভাবে তাকওয়া অবলম্বনের এবং তার সাথের মুসলিমদের কল্যাণ বিবেচনার পরামর্শ দিতেন। তারপর সবাইকে উদ্দেশ করে বলতেন, ‘তোমরা যুদ্ধ করবে, গণিমতের সম্পদে খিয়ানত করবে না, অবিশ্বস্ত আচরণ করবে না, মৃত ব্যক্তিদের লাশের অপমান করবে না। শিশু ও নারী হত্যা করবে না। গির্জা ধ্বংস করবে না। খেজুর গাছ কাটবে না।’

আল্লাহু আকবার! মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই উপদেশবলির মধ্যে ফুটে উঠেছে করুণা ও দয়া। শুধু মানুষের জন্য নয়, সবার জন্য এমনকি উদ্ভিদের জন্যও।

ইতিহাসের কোনো অধ্যায়ে পৃথিবী ও পৃথিবীবাসী এর চেয়ে পরিপূর্ণ, উত্তম ও উন্নত মানবিকতা ও নৈতিকতা আর কোথাও কি দেখেছে? চরমপন্থী ও সন্ত্রাসীরা কি এ মহান মানবিকতা ও নৈতিকতা বিবেচনায় রাখবে না?

ইসলাম এসেছে ইনসাফপূর্ণ ও ন্যায়নিষ্ঠ শরিয়াহ নিয়ে, যার লক্ষ্য বিপর্যয় ও ধ্বংস নয়, বরং শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ইসলাম সর্বদা এমন বিষয়কেই গুরুত্ব প্রদান করে, যাতে রয়েছে বান্দাদের স্বার্থ আর দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি।

ইমাম আলী রা: তাঁর সেনানায়ককে বলতেনÑ সন্ধির আলোচনাকে কখনো প্রত্যাখ্যান করবে না, কেননা এতে রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি, তোমার সেনাবাহিনীর শান্তি, তোমার সব চিন্তা থেকে পরিত্রাণ এবং তোমার দেশের জন্য নিরাপত্তা।

হে মুমিনগণ! ইসলামের সাথে কঠোরতা ও সন্ত্রাসকে যুক্ত করা মূলত ইসলামকে অন্যায়ভাবে অপবাদ দেয়া। ইসলামের সাথে কঠোরতা, চরমপন্থা ও সন্ত্রাসের কোনো সম্পর্ক নেই।

আসলে ইসলাম ও ইসলামের প্রসারভীতির কারণেই ইসলামের বিরুদ্ধে এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ।

অতীতে এবং বর্তমানেও ইসলামের প্রসার ঘটেছে, ইসলামের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সহমর্মিতা, দয়া, উত্তম কথা ও আচরণের মাধ্যমে।

ইসলামের অন্যতম মূলনীতি হলো, ‘দ্বীনের মধ্যে জোর-জবরদস্তি নেই’। ইসলামি দাওয়াতের পদ্ধতি হলো, ‘ডাকো তোমার রবের পথের দিকে বুদ্ধিমত্তা, উত্তম বক্তব্য ও সুন্দর বিতর্কের মাধ্যমে।’

ইসলাম শান্তি ও কোমলতার দ্বীন। ইসলামের রব হলেন, সালাম শান্তিময়। ইসলামের চূড়ান্ত পরিণতি হলো, দারুস-সালাম শান্তির আবাস।

ইসলাম ছাড়া পৃথিবীকে শান্তির আলোতে আলোকিত করা সম্ভব নয়। বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে মুসলিমদের সরে যাওয়াতে পৃথিবী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ঈমানের ভাইগণ! বর্তমান বিশ্বে অনেকের কাছে শান্তি ও নিরাপত্তা হলো মরীচিকার মতো, তৃষ্ণার্তরা যাকে পানি মনে করে। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও অধিকারপ্রাপ্তদের অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া সত্যিকার শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে না।

আল্লাহ সব জাতিকে সমান মর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাদের কেউ প্রভু আর কেউ ভৃত্য নয়। সবলরা দুর্বলদের ওপর অবিচার করলে শান্তি আসবে না। প্রকৃত শান্তি ও নিরাপত্তা ইসলামের ছায়াতলেই নিশ্চিত হবে।

হে আল্লাহর বান্দারা! হে আল্লাহর ঘরের হাজীগণ! হজের বিধানসমূহ ন্যায়পরায়ণতা ও সাম্যের বড় উদাহরণ। এখানে ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড় কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই এক স্থানে, এক পোশাকে একত্র হয়। সবাই মহান করুণাময়ের কাছে বিনয়ী হয়ে দোয়ার জন্য হাত তোলে।

বন্ধুগণ! শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য পরস্পরের প্রতি সহযোগী হোন, ঐক্যবদ্ধ হোন, বিরোধে লিপ্ত হবেন না।
‘তোমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরো, বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’

নিজেদের দেশকে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড, কঠোরতা, হিংস্রতা ও চরমপন্থা থেকে মুক্ত রাখুন।
ইসলামি শরিয়াহর কল্যাণকর আচরণ ও বিধানসমূহের প্রকাশ ঘটান, এর মাধ্যমে ইসলামের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের নিরসন ঘটবে।

ইসলাম বিশ্বকে উন্নত সভ্যতা উপহার দিয়েছে। ইতিহাস এর সবচেয়ে বড় সাক্ষী।
মনে রাখতে হবে, দেশের শান্তি, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশের সব নাগরিকের দায়িত্ব দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা অব্যাহত রাখার জন্য চেষ্টা করা।

আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন সব ইসলামি দেশ ও মুসলিমদের দুশমনদের সব ষড়যন্ত্র থেকে হেফাজত করেন। বিশেষ করে হারামাইন শরিফাইনকে সব অনিষ্ট থেকে রক্ষা করে হক তথা সত্য, স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তার মিনার হিসেবে টিকিয়ে রাখেন।

হে আল্লাহর বান্দারা! আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করুন। সংশোধন ও গঠনমূলক কাজের দিকে অগ্রসর হোন। এর মাধ্যমে সম্মান ও মর্যাদা লাভ করবেন।

শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বর্তমান বিশ্বে যেসব বাধা রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফিলিস্তিন ও মসজিদে আকসায় জায়নবাদী ইহুদিদের আগ্রাসন। সিরিয়ায় মুসলিমদের ওপর নির্যাতন। ইরাক ও ইয়েমেনে মুসিলমদের সঙ্কট। বিশেষ করে আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বর্বর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা, বাড়িঘর ধ্বংসের মাধ্যমে সেখানে ঘটছে চরম মানবিক বিপর্যয়।

আমাদের দায়িত্ব হলো শিক্ষা, তথ্য, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার ঘটানো। বিশেষ করে আমাদের যুবসমাজের চিন্তা-চেতনায় ইসলামের সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতার শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাদের উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা।

হে আল্লাহ! ইহুদিদের থাবা থেকে মাসজিদে আকসাকে মুক্ত করে দাও। ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেনে নির্যাতিত মুসলিমদের সাহায্য করো। আল্লাহ! তুমি তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করো।

হে আল্লাহ! দুশমনদের সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দাও। ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র, বিদ্বেষপোষণকারীদের বিদ্বেষ এবং হিংসাকারীদের হিংসা থেকে আমাদের রক্ষা করো।

অনুবাদ : অধ্যাপক আ ন ম রশীদ আহমাদ