আধুনিক ও শ্রেষ্ঠ কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রাসূল (সা.)

ফারহানা সুমাইয়া মিতু

বিশ্বের প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মদীনায়। নিষ্ঠাবান একদল মুমিনের ১৩ বছরের রক্ত, ঘাম, শ্রম আর পুঁজি দিয়ে এই রাষ্ট্রের ভিত তৈরি হয়। ধীরে ধীরে সেই ভিতটি এমনই একটি পর্যায়ে উন্নীত হয় যে সহস্রাব্দের সবচেয়ে আধুনিক সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মানসম্পন্ন একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। আর এই রাষ্ট্রের নায়ক ছিলেন সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ মানুষ আমাদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। যখন তিনি আরব ভূখ-ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন তখন সামাজিক, অর্থনৈতিক, জনমানুষের নিরাপত্তা কোন সেক্টরে এতটুকু আশার আলো ছিল না। সমাজ কতটা জাহেলিয়াতপূর্ণ হতে পারে তারই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ছিল তৎকালীন আরব সমাজ। এমন একটি সমাজ থেকে নীতিবান মানুষ খুঁজে বের করা ছিল যেমনি দুরূহ, তেমনি অসম্ভব ছিল সে সমাজের নোংরামী,পাপ-পঙ্কিলতার সংস্কার করে একটা পবিত্র সমাজ গঠন করা। কিন্তু আমরা দেখেছি কিভাবে মুহাম্মদ (সা.) তাঁর সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে একটু একটু করে মদীনার ভিত গড়ে তুলেছেন। এক একটি যুদ্ধে তিনি যতটা বিজয় অর্জন করেছেন তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়েছেন সাচ্চা মুমিনদের বেছে নিতে পারাতে।

আদর্শ ও কল্যাণ রাষ্ট্র গৃঠনে যেভাবে তিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন তার পদক্ষেপগুলো যদি ধারাবাহিকভাবে আমরা জানার চেষ্টা করি তাহলে পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে তারই একটি বিস্তারিত খণ্ডচিত্র আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

প্রথম নির্দেশ : ইকরা!
পড়ো। অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন করো। সেই জ্ঞান যা মহান রাব্বুল আলামীন এর পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে।

দ্বিতীয় নির্দেশ : “হে চাদর আবৃত ব্যক্তি! জড়তা ছেড়ে জেগে ওঠো। এবং মানবজাতিকে সতর্ক ও সাবধান করো। ঘোষণা কর তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌমত্বের!” (সূরা মুদ্দাস্সির : ১-৪)

এই আয়াতটি যখন নাযিল হয় তখন মুহাম্মদ (সা.) এর দাওয়াতী জিন্দেগী কেবল শুরু। পৌত্তলিক মুশরিকদের মাঝে এক ইলাহের দাওয়াত পৌঁছানো তখনো শুরু হয়নি। সঙ্গী হিসেবে তিনি সংগ্রহ করতে পেরেছেন ৪ জন বিশ্বস্ত ও মূল্যবান সঙ্গী। মহিলাদের মধ্য থেকে বিবি খাদীজা (রা.)। সমাজের প্রভাবশালী অংশের প্রতিনিধি হযরত আবু বকর (রা.)। কিশোরদের প্রতিনিধি হযরত আলী (রা.) এবং কৃতদাসের প্রতিনিধি যায়েদ (রা.)।
এ সঙ্গী সাথীসহ তাকে হুকুম দেয়া হলো
– রবের শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌমত্বের ঘোষণা দেয়ার। সতর্ক করার।
– নিজেকে পবিত্র ও মার্জিত করার।
– রবের জন্য সবর করা।

এ নির্দেশ পাওয়ার পর তিনি যে কাজগুলো করতে শুরু করলেন-
– টানা তিন বছর গোপন দাওয়াত চলে।
– আগ্রহী ব্যক্তিদের সংগঠিত করতে থাকেন।
– তাদেরকে কুরআনের প্রতিটি নির্দেশনা জানিয়ে সেই অনুযায়ী আত্মিক ও বাহ্যিক প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
এরপর সূরা মুজ্জাম্মিল এর মাধ্যমে যে নির্দেশ আসে তা মূলতঃ আল্লাহর সাথে সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে রাতের নামাজ ও কুরআন তেলাওয়াতের নির্দেশ।

দাওয়াতের নীরবতা ভেঙ্গে যতই এটা প্রকাশ্য দাওয়াতের দিকে যেতে থাকলো ততই সামাজিক ও মানসিক নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকলো। মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সঙ্গীদের অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করা হলো। পরিবারকে অপদস্ত করা হলো। মানসিকভাবে অপদস্ত করা হলো। কিন্তু গভীর পর্যবেক্ষণের বিষয় মুহাম্মদের সঙ্গী সাথী বাড়তেই থাকলো এবং যারা সাথী হিসেবে রইলেন তাদের ঈমানী মজবুতি বৃদ্ধি পেল। শুরু হলো প্রকাশ্য দাওয়াত। চরম নির্যাতন শুরু হয়ে গেল মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সঙ্গী সাথীদের ওপর। সেই সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে নাযিল হতে থাকলো মুমিনদের প্রশান্তির সবচেয়ে বড় নিয়ামক পবিত্র কোরআনের এক একটি আয়াত। যেখানে কাফের মুশরিকদের জন্য আসলো ভয়ংকর শাস্তি (সূরা হা-মীম আস সাজদাহ- ২৯), মুমিনদের ধৈর্যধারণ ও অটল থাকার আহ্বান (হা-মীম আস সাজদাহ- ৩০-৩৩), এ ধৈর্যের প্রতিদান ও পিছিয়ে গেলে শাস্তির প্রতিশ্রুতি।

আশা জাগানো হয়েছে মুমিনদের, ভরসাস্থল আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতার কথা বার বার মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে। (সূরা নামল- ৫০), সূরা কাহাফ (২৭-৩১)-এ।

মুমিন ও মুনাফিক বাছাই করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হলো পরীক্ষা ক্ষেত্র। বদর এর প্রান্তর। সাচ্চা মুমিন আর ভেজাল মুমিনদের চিনতে পারলেন প্রিয় রাসূল (সা.)। সেই সাথে সাথে আল্লাহর প্রত্যাশা সহযোগিতা আর মদদ বাড়িয়ে দিল মুমিনদের মনোবল। অটল ও অবিচল থাকার শক্তি। নতুনভাবে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্দীপনা।

“অতএব তোমাকে যে আদেশ দেয়া হয়েছে তুমি খোলাখুলি (জনসমক্ষে) তা বলে দাও এবং (এরপরও) যারা (আল্লাহর সাথে) শরীক করে তাদের তুমি উপেক্ষা কর, বিদ্রুপকারী ব্যক্তিদের মোকাবিলায় আমিই যথেষ্ট। যারা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে তারা অচিরেই (তাদের পরিণাম) জানতে পারবে।” (সূরা হিজর : ৯৪-৯৯)

এই স্তরটি ছিল নিঃসন্দেহে সবচেয়ে কঠিন। কেননা একেকটি পরীক্ষায় মুমিনদের সবরের চরম পরাকাষ্ঠা দেখাতে হয়েছে। এক একটি যুদ্ধের ময়দান, এক একটা জুলুমবাজদের নির্যাতন প্রতি মুহূর্তে মুমিনদের অস্থির করে তুলেছিলো। এ যেন এমন এক অগ্নি প্রকোষ্ঠ যেখান থেকে কোনভাবেই খাদসহ বেরিয়ে আসা সম্ভব না। হয় নিখাদ হয়ে উঠে আসতে হবে নইলে খাদ নিয়ে আগুনে পুড়ে পুড়ে নিজেকে নিখাদ করতে হবে। আর তাই মহান প্রভু মুমিনদের জন্য পাঠাতে থাকলেন একের পর এক প্রশান্তিদায়ক বাণী। যা তাদেরকে জানালো মূসা (আ.) এর সময়ের কথা, ইবরাহীম (আ.) এর পরীক্ষাগুলোর কথা। হক কথার অনুসারীদের মাথার উপর দিয়ে আগুনের করাতও যে চালানো হয়েছে, সেসব ভয়ংকর নির্যাতনের কথা। আর অবশেষে আল্লাহর দ্বীনই বিজয়ী হয়

অবশ্যম্ভাবী ফলাফলের কথা। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে লক্ষণীয় যে ফলাফল মুমিন ব্যক্তিরা অর্জন করেছিলেন।
১. হযরত উমর (রা.) এর মত ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণ।
২. মুমিন ব্যক্তিদের ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি।
৩. মুনাফিক বা সুবিধাভোগীদের চিহ্নিত করতে পারা।
৪. জনসমর্থন বৃদ্ধি।

মক্কার প্রথম ১০ বছর যতটা ভয়ংকর ছিল তার চাইতে অনেক বেশি ভয়ংকর ছিল শেষ ৩ বছর। এত অকথ্য নির্যাতন ও জুলুমের মাত্রা এত বেশি ছিল যে, আল্লাহর রহমত ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না এ অবস্থায় টিকে থাকা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য খালিদ বিন সাঈদ (রা.), আবু বকর (রা), আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), হযরত বেলাল (রা.) আম্মার বিন ইয়াসীর (রা.) ও তার পরিবার, খাব্বাব বিন আল আরাত (রা.)। এদের প্রত্যেকের উপর নির্যাতন এতটা বেশি করা হয়েছিলো যে তাদের অনেককে জীবিত শহীদ বলা হতো। এছাড়া তায়েফের ঘটনাটি আরো দুঃখজনক ছিল। প্রিয় নবীজী রাসূল (সা.) কেই চরমভাবে নির্যাতিত হতে হয়। রক্ষক হতে হয় নিজ জন্মভূমি মক্কায়। আর তার পরই তারা হিজরত করে চলে আসেন মদীনায়। কাছ থেকে আকাবায় তিন দফায় বাইয়াত গ্রহণ করেন। মূলতঃ এই বাইয়াতের মাধ্যমে ইকামাতে দ্বীন বা দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজের সূচনা করা হয়।

একটি দালান মাটি থেকে যত উপরে ওঠে মাটির নিচে এর ফাউন্ডেশন ততটাই মজবুত হতে হয়। মদীনার এই রাষ্ট্র কায়েমকে যারা মক্কা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে চান নিঃসন্দেহের তারা এই মূলনীতি থেকেই সরে আসেন। মক্কার এই ১৩টি বছর মূলত: মদীনার ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রস্তুতি ছিল। ব্যক্তিগঠন ও দলগঠনের জন্যই তাদেরকে এই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আর মদীনায় হিজরতের সময় মোহাম্মদ (সা.) এর লক্ষ্যমাত্রা-কে আরো একটু সুনির্দিষ্ট করতে চমৎকারভাবে সূরা বনী ইসলাইলের ৮০ নং আয়াত নাযিল করলেন।

“হে নবী! দোয়া করো এই বলে! হে আমাদের রব! আমাকে প্রবেশ করাও সত্যসহ প্রবেশ করার স্থানে এবং সত্য সহই আমাকে বের কর বের হবার স্থান থেকে। আর তোমার পক্ষ থেকে প্রদত্ত রাষ্ট্রশক্তিকে আমার সহায়ক বানিয়ে দাও।”

মদীনার কিছু ব্যক্তিকে আগেই পাঠিয়ে দেয়ায় সেখানে সবাই (আনসার ও মুজাহিদ) অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছিল প্রিয় নবীর আগমনের জন্য। অনেক বাধা, প্রতিবন্ধকতা, বিপদের সম্ভাবনা কাটিয়ে অবশেষে প্রিয় নবী মদীনায় এলেন।

মদীনাবাসীর উদার সম্ভাষণ, সেই সাথে এ ভীষণ অনুকূল পরিবেশ মুহাম্মদ (সা.) কে তার স্বপ্নের পথে, আল্লাহর নির্দেশের পথে দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়ার উদ্দীপনা যোগায়। আর তাই প্রথমেই তিনি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন-
১. মুসলমানদের একটি মিলনস্থল তৈরির জন্য মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠা।
২. মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি এবং অন্যান্য গোত্রসমূহের মধ্যেও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা।
৩. ইয়াহুদীদের সাথে মুসলমানদের বাস্তব সমস্যা উপলব্ধি করে স্থায়ী ঐক্য ও সুসম্পর্কের জন্য মদীনা সনদ নামে ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন করেন।

মসজিদে নববী শুধু নামাজের স্থানই ছিল না বরং তাকে ইসলামী রাষ্ট্র ও সভ্যতার কেন্দ্র ও উৎস হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। এই মসজিদকে একাধারে সরকারের দরবার, পরামর্শ করা, সরকারি অতিথি ভবন, গণপাঠাগার ও জাতীয় সম্মেলন ভবন হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল।

আর ইহুদী, মুশরিক ও মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠার পর মূলত মুহাম্মদ (সা.) একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এবং মদীনা সনদ’ নামক চুক্তিপত্র যা পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান ছিল তাই ধীরে ধীরে একটি রাষ্ট্রের সংবিধানে পরিণত হয়। যার ফলে কার্যত রাষ্ট্রশক্তি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর হাতে চলে আসে। এবং রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্ব ও আইনে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও কুরআন মূল উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে যে দুটি বিষয় তা হলো:
১. একদল পরীক্ষিত জানবাজ নিখাদ কর্মীবাহিনী
২. ব্যাপক জনসমর্থন।

ইসলামী রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ার পর যে সুফলগুলো পেতে শুরু করলো মুমিন ব্যক্তিরা :
১. চুক্তির মধ্যে থাকার ফলে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজের সব শ্রেণির লোকদের কাছে দাওয়াত পৌঁছানো সম্ভব হলো। এবং ইহুদীদের এমন কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করলো যা তাদের সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়েছিলো।

২. ইহুদীদের চরম অনৈতিক চরিত্রের বিপরীতে সৎ ও ঈমানদার মুমিনদের নৈতিকতা সমৃদ্ধ জীবন চরিত্রের পার্থক্যটা প্রকটভাবে ফুটে উঠতে লাগলো। ফলে ইহুদীদের পরিবার থেকেই তাদেরই আত্মীয় স্বজনরা একে একে এই দ্বীনে শামিল হতে লাগলো।
* ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ফলে মুসলিমদের ঐক্যের শক্তি বাড়তে থাকলো।
* মসজিদে নববীতে নিয়মিত মুমিনদের জন্য কুরআনের আয়াত পড়ে শোনানোর মাধ্যমে মুমিনদের ঈমানকে পাকাপোক্ত করার সুযোগ এসে গেল।
* অন্যান্য রাষ্ট্র (হাবশা, রোমান, মিশর) প্রধানদের নিকট পত্র মারফত ইসলামের দাওয়াত পৌঁছালেন।
* অমুসলিমদের স্বার্থ বিঘিœত না হওয়ায় তারাও ইসলামের প্রতি মুগ্ধ হলো, আকৃষ্ট হলো।

সদ্যগঠিত রাষ্ট্রটিকে যে সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে হয়েছে :
১. ইহুদী জাতির মতো একটি জাতিকে নৈতিক শক্তি দিয়ে কাবু করতে হয়েছে। এটা কেবল গঠিত রাষ্ট্র হিসেবে মুসলমানদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তারা যখন দেখছিল চুক্তির বেড়াজালে আবদ্ধ হওয়ায় দলে দলে সবাই ইসলামের সৌন্দর্য অনুধাবন করার সুযোগ পাচ্ছে এবং দাখিল হচ্ছে তখন তারা ঘৃণ্য পথ বেছে নিলো। অপবাদ, অপপ্রচার আর মিথ্যা প্রপাগান্ডা, নৈতিক অপবাদ এগুলো দিয়ে তারা রাসূল (সা.) ও তার বাহিনীকে কোণঠাসা করতে চাইলো। সীরাত বিশ্লেষক নঈম সিদ্দিকী খুব চমৎকার

উদাহরণ দিয়েছেন এ প্রসঙ্গে:
“আসলে তাদের ভূমিকা এরকম যেমন সূর্য্যরে আলোক এরকম, যেমন উঠতি সূর্য্যরে আলোকরশ্মির প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে চামচিকেরা শূন্যে পাখনা পেলে কৃত্রিম অন্ধকার সৃষ্টির ব্যর্থ চেষ্টা চালায়, সশস্ত্র সেনাবাহিনীর গতিরোধ করার জন্য যেমন কিছু মশামাছি ভনভন করে, কিংবা পূর্ণিমার চাঁদ দেখে যেমন কোন গোঁয়ার তার দিকে থুথু নিক্ষেপ করে।”
ঠিক এমনই হীন ইহুদী গোষ্ঠীর বুদ্ধিদৃপ্ত মোকাবিলা করতে হয়েছে রাসূল (সা.) ও তার বাহিনীকে।

২. সদ্য জেগে ওঠা সুবিধাবাদী মুনাফিক বাহিনী যারা ঈমানদার সেজেই দলে ঘাপটি মেরে আছে তাদের সংশোধন বা মোকাবিলা করা।

৩. অব্যাহতভাবে শরণার্থী পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিক সহায়তা দান আবার রাষ্ট্রীয় স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানোর জন্য আর্থিক উৎস নিশ্চিতকরণ।

৪. নবী (সা.) এর আসল পরিচয় জানার পর ইহুদীদের বিরোধিতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তারা জনসম্মুখে তাকে বিতর্কিত করার জন্য নানারকম কুটতর্ক ও বিভিন্ন প্রশ্নে তাকে জর্জরিত করার চেষ্টা করে।

৫. ইসলামী রাষ্ট্রের একটি বড় শক্তি হলো ব্যাপক জনসমর্থন। এই সমর্থকগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করাও বিরাট একটা পরীক্ষা। কেননা জ্ঞানের গভীরতা কম থাকায় এরা খুব সহজেই অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়। ঠিক যেমন এরা বিভ্রান্তিতে পড়েছিলো কেবলা পরিবর্তন করার পর। এবং কেবলা বায়তুল মাকদাস থেকে পরিবর্তন করে কাবার দিকে মূল কারণ ছিল আল্লাহর নির্দেশ সূরা বাকারার : ১৪৪ নং আয়াতে।

৬. রাসূল (সা.) ও হযরত আয়েশা (রা.) কে নিয়ে অপবাদ এবং পরিবেশ নষ্ট করার অপপ্রয়াস।
উপরোক্ত প্রতিটি সমস্যার মোকাবিলা রাসূল (সা.) ও তাঁর প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী আল্লাহর মদদে দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করেছেন। তাই তারা কোন বাধাই পিছপা হননি।

সার্বিকভাবে ইসলামী রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর (মদীনার ১০ বছর ও এর পরেও) কার্যক্রম সম্পাদন হওয়ার পর শুধু মুসলিমরাই নয়। বরং অমুসলিমরাও এর সুবিধাসমূহ ভোগ করতে থাকলো যেমন-

১. সাধারণ নাগরিক সুবিধা : মদীনায় গঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহ সুনিশ্চিত করা। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ কোন অধিকার থেকে একজন প্রতিবন্ধী কিংবা গরীব ব্যক্তিকেও বঞ্চিত হতে হয়নি। রাষ্ট্র প্রধান ও তার প্রতিনিধিরা তাদের এই পদকে পদ না মনে করে আমানত মনে করায় সাধারণ নাগরিকরা তা থেকে প্রতিনিয়তই সুযোগ পেয়েছে। তারা ভয় পেতেন যে একটা প্রাণীও যদি না খেয়ে মারা যায় তবে তাদেরকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এই আল্লাহভীতি তাদের পিঠকে বিছানা থেকে দূরে রাখতো, তাই তারা গভীর রাতেও ঘুরে ঘুরে দেখতেন কেউ অভাবগ্রস্ত আছে কিনা। আজকের বাংলাদেশ বা অন্য যেকোন রাষ্ট্রে যা শুধুই স্বপ্ন। এখানে খাবারের অভাবে পরিবারকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যার ঘটনা খুবই সাধারণ। চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরা, চাকরির অভাবে বেকারত্বের জন্য আত্মহত্যার ঘটনা, বস্ত্রের অভাবে চরম শীতেও নিদ্রাহীন রাস্তার মানুষগুলো সবই খুবই সাধারণ প্রতিদিনকার চিত্র।

২. আল্লাহর বিধান একমাত্র আইনের উৎস হওয়ার সুবিধা : ইসলামী রাষ্ট্রের অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল তার আইনের উৎস ‘আল্লাহর কোরআন’, রাসূলের (সা.) সুন্নাহ। যা সর্বাধিক ভারসাম্যপূর্ণ। যা অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব সমস্যার নিশ্চিত সমাধানকারী। প্রচলিত যে কয়টি মতাদর্শ পৃথিবীতে বর্তমান তার কোনটাই প্রকৃত অধিকার, সামাজিক শান্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনতে সক্ষম হয়নি। শুধুমাত্র ইসলামই তা নিশ্চিত করেছে।

৩. ইসলামী অর্থব্যবস্থা : ভারসাম্যপূর্ণ যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে তৎকালীন ইসলামী রাষ্ট্রে এমন কোন ব্যক্তি পাওয়া যায়নি যে যাকাত লাভের উপযোগী। এমনকি অমুসলিমরাও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি লাভ করেছে। তাদের অভাব দূর হয়েছে, সঠিকভাবে যাকাত সংগ্রহ ও সঠিকভাবে বণ্টন করার মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রই একমাত্র অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে দেখিয়ে দিয়েছে।

৪. পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা : ইসলামী রাষ্ট্রে আদর্শ নাগরিক গড়ে ওঠার মূলমন্ত্র হল ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা। তৎকালীন ইসলামী রাষ্ট্রে সঠিকভাবে শিক্ষা প্রদান হয়েছে বলেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় তখনই সবচেয়ে বেশি উৎকর্ষ সাধন হয়েছে। কোরআন থেকে শিশুদের যত দূরে সরানো হয়েছে, ইবনে সিনা, মূসা, জাবিরের মত বিজ্ঞানী ততো কমেছে। সমাজ সংস্কার তত কমেছে। সামাজিক অপরাধ মূল্যবোধের অবক্ষয় তত বেড়েছে। অন্যায়, ধোকা, প্রতারণা, নারীদের অবমূল্যায়ন এবং চুরি-ডাকাতি, খুন, হত্যা বেড়েছে।

৫. পর্দা ব্যবস্থার প্রচলন : ইসলামী রাষ্ট্র পর্দা ব্যবস্থাকে নিশ্চিত করে। একজন নারী এমন পোশাকে প্রকাশ্যে চলতে বাধা প্রদান করে যে পোশাক অন্য পুরুষের মনে কুচিন্তা, খারাপ কাজের উস্কানি দিতে পারে। বিনোদনের এমন মাধ্যম বন্ধ করে যা মানুষকে খারাপ চিন্তায় ধাবিত করে। মূলতঃ রাষ্ট্র যখন এ ব্যাপারে তৎপর হয় তখনই এমন অবস্থা তৈরি হওয়া সম্ভব যেটা হাদীসে এসেছে- “একটা সময় আসবে যখন একাকী মহিলা নিশ্চিন্তে সানা থেকে রওয়ানা করবে এবং কেউ তাকে উত্ত্যক্ত করবে না। বর্তমান সমাজে ইভটিজিং, ধর্ষণ, ব্যাভিচার প্রভৃতি ধ্বংসাত্মক কাজ যেভাবে বেড়েছে তা একটি জাতিকে আল্লাহর গযবে পরিণত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পর্দা ব্যবস্থা চালু হওয়ার মাধ্যমেই এই নাগরিক নিরাপত্তা, নারী মর্যাদা নিশ্চিত করা যেতে পারে।

৬. কঠোর বিচার ব্যবস্থা : সবার মৌলিক চাহিদা পূরণ করার পরও যদি কোন ব্যক্তি চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, ব্যাভিচারে লিপ্ত হয় তবে নিঃসন্দেহে একটি অপরাধ। কোরআন অনুযায়ী ইসলামী রাষ্ট্র তাকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করে। কঠোরভাবে বিচার বিভাগ তা প্রয়োগ করে। ফলে এক অন্যায় বার বার সংগঠিত হয় না। শাস্তির আবশ্যক বাস্তবতা অপরাধীকে সতর্ক করে তোলে।

৭. অর্থনৈতিক উন্নয়ন : ইসলামী রাষ্ট্রে অনাবাদী জমি তিন বছরের অধিক রাখা যায় না। তাই সকল মালিক জমিকে আবাদী/কর্মক্ষেত্রে পরিণত করতে বাধ্য। এভাবে একটি রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। বেকারত্ব কমে যায় এবং অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়।

৮. সামরিক নীতি : রাসূল (সা.) দেশের সীমানার প্রতিটি ইঞ্চিকে আমানত হিসেবে গণ্য করেছেন। বৈদেশিক ও বহিরাগত শক্তির ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে খুবই বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল প্রয়োগ করেছেন। ফলে সীমানায় কারো হস্তক্ষেপ তো দূরের কথা, বরং তা ক্রমাগত সীমানা বৃদ্ধি করে পার্শ্ববর্তী রাজ্যের রাজাকে ইসলামের অন্তর্গত করেছে। বাংলাদেশের গ্যাস খনি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমুদ্র, বন প্রভৃতি সম্পদকে যদি আমানত হিসেবে ব্যবহার করা হতো নিঃসন্দেহে তা বাংলাদেশের মানুষের অভাব পূরণ করে রপ্তানিযোগ্য বা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারতো।

৯. ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা : ইসলামী রাষ্ট্রে রাসূল (সা.) এর কাছে প্রতিটি ব্যক্তির স্বাধীনতা ছিল। তাকে রাষ্ট্র কল্যাণের পথ সুস্পষ্ট করে দিতো। এরপর কোন পথ কে বেছে নেবে তা তার নিজস্ব ব্যাপার ছিল। গোয়েন্দাগিরি তিনি অনুমোদন করেননি। আবার ব্যক্তি স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলাকেও ছাড় দেননি।

প্রতিটি ধর্মীয় উৎসব পালনের এমনকি নির্ধারিত পন্থায় প্রচারের অনুমতিও ভিন্ন ধর্মের যে কারো আছে। তাই প্রকৃতপক্ষে ইসলামী রাষ্ট্র শুধু মুসলিমদের জন্য নয়। অমুসলিমদের জন্যও সর্বাধিক নিরাপদ ও কল্যাণ রাষ্ট্র।

রাসূল (সা.) এর জীবদ্দশায় ও তার পরবর্তীতে খলিফাদের আমলে ইসলামী রাষ্ট্রের যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে তা বর্তমান সময়ের জন্য সত্যিই এক বহু আকাক্সিক্ষত স্বপ্নের মতো। সর্বাপেক্ষা আধুনিক ও কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে তৎকালীন মদীনা তথা আরব রাষ্ট্র এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত হিসেবে আমাদের সামনে রয়েছে। রাসূল (সা.)-এর অনুসারী হিসেবে আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রত্যেককে এ কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজে সর্বোচ্চ মেধা, শ্রম ও পুঁজি খাটানোর তাওফিক দিন। আমীন ॥