সোভিয়েত-উত্তর আজারবাইজানে ইসলামের পুনরুত্থান

সোভিয়েত আমলে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা তাদের ধর্মপালনের বিষয় গোপন রাখতেন। ফারজানা গ্যাসিমোভার নামের এক মহিলা সোভিয়েত আমলের স্মৃতিচারণ করে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, তার দাদা-দাদীরা সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের নজরদারি এড়িয়ে গোপনে, সতর্কতার সাথে দ্রুত নামাজ-রোজাসহ ধর্মীয় বিধিবিধান পালন করতেন।

আলজাজিরার কাছে তিনি বলেন, ‘সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (ইউএসএসআর) আমলে আজারবাইজানে নামাজ আদায় ও হিজাব পরার অনুমোদন ছিল না।’ তিনি বলেন, ‘তখন আজারবাইজানসহ সোভিয়েত ইউনিয়নজুড়ে শুধু নাস্তিকতাবাদই প্রচার করা হতো।’ দেশটিতে ইসলামের যাত্রা শুরু হয়েছিল সপ্তম শতাব্দীতে, তবে সোভিয়েত শাসনের সময় ইসলামের কার্যক্রম ছিল সীমিত এবং ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রিত। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আজারবাইজান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর নিষেধাজ্ঞা উঠে যায় এবং দেশটিতে আবার দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের চর্চা বাড়তে থাকে।

গ্যাসিমোভা বলেন, ‘১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর, ধর্মচর্চায় আমাদের সুযোগ-সুবিধা অনেক বেড়ে যায় এবং আমাদের ধর্মচর্চার একটি স্বাধীনতা চলে আসে।’ তিনি বলেন, ‘টিভি চ্যানেল এবং কনসার্ট হলগুলোতে কোনো নির্দ্বিধায় আমি এখন হিজাব পরতে পারি।’

গ্যাসিমোভা মূলত ‘মুঘা’ গায়ক হিসেবে পরিচিত, মুঘা আজারবাইজানি লোকসঙ্গীতের একটি বিভাগ। আর এই বিভাগে গ্যাসিমোভা হলেন জনপ্রিয়তায় শীর্ষে থাকা শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম।

তিনি ২০ বছর বয়স থেকে ইসলামী জীবনধারা অনুসরণ করে আসছেন। এর চার বছর পর থেকেই চুল ডেকে রাখার জন্য তিনি মাথায় হিজাব পরেন। তিনি বলেন, ‘আমি আমার দেশে কোনো নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হইনি।’

জারবাইজানের সংস্কৃতিতে ইসলামের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ দেশটির মোট জনসংখ্যার ৯৩ থেকে ৯৯ শতাংশ মানুষ মুসলিম। এর মধ্যে শিয়ারা সংখ্যাগুরু এবং সুন্নীরা সংখ্যালঘু। ক্যাস্পিয়ান সাগরের পশ্চিম পাড়ের এই দেশটি ১৯১৮ সালে সংক্ষিপ্ত সময়ে জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় যেখানে ধর্মপালনের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। দেশটির সংবিধানে, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, পেশা, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাইকে পূর্ণ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রদান করা হয়েছিল।

যাই হোক, ১৯২০ সালে দেশটিতে রেড আর্মির আক্রমণের পর থেকে টানা সাত দশক সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনাধীন ছিল। সোভিয়েত আমলে মুসলিমদের মতো আজারবাইজানের অন্য ধর্মাবলম্বী যেমন, ইহুদি ও খ্রিষ্টানরাও ধর্মপালনে বিধিনিষিধের শিকার হয়।

ককেসাস মুসলিম অফিসের (সিএমও) ডেপুটি চেয়ারম্যান হাজী সালমান মুসায়েভ বলেছেন, ‘তখন নাগরিকদের ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণের অনুমতি দেয়া হতো না।’ তিনি বলেন, ‘পুরো সোভিয়েত ইউনিয়নজুড়ে মাত্র দু’টি মাদরাসা চালু ছিল, উভয়টিই ছিল উজবেকিস্তান সীমান্তের মধ্যে’।

মুসায়েভ অভিযোগ করে বলেন, উজবেকিস্তানের বুখারা শহরে অবস্থিত মীর আরব মাদরাসা, সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে ছিল। দেশটিতে ধর্মীয় অনুশাসনের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা এবং কড়াকড়ি ছিল তারই অংশ হিসেবে এই মাদরাসায় অনেক চাপ প্রয়োগ করা হতো।

শেষ দশকে এসে সোভিয়েত সরকার ধর্মপালনে কঠোরতা কিছুটা কমিয়ে নিয়ে এসেছিল, তবে আজারবাইজানে দীর্ঘ দিন ধরে ধর্মপালনের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ ছিল তা থেকে বের হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ছিল না। মুসায়েভ বলেন, ‘আমরা তখন হজ বা ওমরা পালনের জন্য এক-দুই হাজার লোকও পাঠাতে পারিনি। তবে এখন যত ইচ্ছে লোক আমরা পাঠাতে পারি।’
ধর্মীয় আচার

সোভিয়েত শাসনামলে দেশটিতে ১৮টি মসজিদ ছিল, কিন্তু সোভিয়েত শাসন পতনের পরই দেশটিতে দুই হাজার মসজিদ গড়ে ওঠে। ১৯৯১ সালে দেশটি স্বাধীনতার পর, সরকার দেশের সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করে এবং মসজিদ সংস্কারের জন্য অর্থ সহায়তা বৃদ্ধি করে।

আজারবাইজান পুনরায় স্বাধীনতা লাভের পর ধর্মীয় চর্চা বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে মার্মারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আকিল শিরিনভ বলেন, ইউএসএসআর পতনের পর লোকেরা শূন্যতা অনুভব করেন এবং ধর্মের মাধ্যমে তা পূরণ করার চেষ্টা করেন। যাই হোক, এই প্রবণতা সার্বজনীন ছিল, তা নয়।

ধর্মচর্চা বৃদ্ধি আজারবাইজানের কিছু মানুষের মনে আশঙ্কার সৃষ্টি করে। তারা মনে করেন ধর্মের দিকে লোকজনের ঝুঁকে পড়ার কারণে সংস্কৃতির ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য ও অগ্রহণযোগ্য ধারণার বিষয়টি পাল্টে যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘কিছু পরিবার তাদের সন্তানদের নিয়ে ভয়ে ছিলেন, তারা উগ্রপন্থীদের দলে ভিড়ে যেতে পারে। এমনকি কিছু পরিবার সন্তানদের নামাজ পড়তে অনুৎসাহিত করত।’ তারা নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করলেও ধর্মচর্চা করত না।

স্বাধীনতার কয়েক দশক পার হলেও অনান্য মুসলিম দেশের তুলনায় আজারবাইজানে এখনো ধর্মীয় উৎসব পালন অনেক কম হয়।
ককেশাসের ম্যারোমিটার গবেষণার তথ্যানুযায়ী, আজারবাইজানের মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ নিয়মিত ধর্মপালন করেন, আর ৪০ শতাংশ মানুষ শুধুমাত্র ছুটির দিনগুলোতে ধর্মপালন করেন।

তবে ফারজানা গ্যাসিমোভা বলেন, তিনি তার ধর্মের দূত ও স্বদেশী তরুণ সমাজের জন্য একজন মডেল হিসেবে কাজ করতে পেরে তিনি গর্ববোধ করেন। তিনি বলেন, ‘কিছু মানুষ সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত হয়ে ইসলামের ক্ষতিসাধন ও দুর্নাম ছড়ানোর চেষ্টা করছেন।

নাম ধ্বংস করার চেষ্টা করছে এবং ইসলামকে করে খারাপভাবে উপস্থাপন করছে।’ গ্যাসিমোভা বলেন, ‘বিদেশে আমাকে কনসার্ট পালন করতে দেখে তাদের মনোভাবে পরিবর্তন ঘটে। এমনকি তাদের অনেকে তাদের সন্তানদের নিয়ে আমার কাছে আসেন এবং বলেন, ‘তাদেরকে শিল্প ও সত্যিকার ইসলাম কেমন তা দেখাতে আপনার কাছে নিয়ে এসেছি।’ সূত্র : আলজাজিরা