সূরা আল আসর

আয়ুশী পারভেজ মিম |

এমন এক তাৎপর্যময়ী সূরা যেটার ব্যাপারে ইমাম শাফেঈ রহ. বলেন “অন্য কোনো সূরা নাযিল না হয়ে কেবল শুধুমাত্র এই সূরাটি যদি পবিত্র কুর’আনে নাযিল হতো তাহলেও তা হেদায়েতের জন্যে যথেষ্ট হতো”।

তাছাড়া সাহাবীদের নিকট এই সূরা ছিলো অন্তত প্রিয়, হযরত আব্দুল্লাহ বিন হাফ্ছ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবীগণের মধ্যে এমন দু’জন সাহাবী ছিলেন, যারা মিলিত হলে একে অপরকে সূরা আসর না শুনিয়ে বিদায় নিতেন না। (তাবরানী)

সূরাটি যেমন ছোট ঠিক তার বিপরীত হচ্ছে এর ব্যাখার গভীরতা। বিশ্বের অনেক অনেক বিজ্ঞ মুফাসসির এর তাফসীর লিখতে গিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে গেছেন। সেখানে আমার মত নগন্য কম জ্ঞানের মানুষ এই সূরার গভীরতা কতটুক সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবো জানি না।

সূরাটির আয়াত গুলো দেখা যাক,

وَالْعَصْرِ – সময়ের কসম।

পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহ তা’আলা অনেক জায়গায় অনেক কিছুর নাম নিয়ে কসম খেয়েছেন৷ মানুষ শুধু একমাত্র আল্লাহ এর নামে কসম খেতে পারে। কিন্তু আসমান ও জমীন ও সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আলামিন চাইলে যেকোনো কিছুর নামেই কসম খেতে পারেন। আর তিনি যেই বস্তু বা জিনিসের নামে কসম খান সেই বস্তুর নিঃসন্দেহে অনেক মর্যাদা রয়েছে।

মূলত এইখানে “ওয়াল” শব্দটি বা কসম একটি Emphasis (বিশেষ জোর দেওয়া)। আমরা যখন বই পড়ি তখন বই এর প্রতিটা কথাই কিন্তু আমাদের জন্যে প্রয়োজনীয় কিন্তু আমরা সুন্দর কালার পেইন দিয়ে সেইসব লাইনই আন্ডারলাইন করি যেগুলো আমাদের জন্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

আল্লাহ তা’আলা ও ঠিক তেমন কিছু কিছু আয়াতের আগে কসম খেয়ে এর জন্যেই বলে থাকেন যেনো তিনি আমাদের বলছেন “এই লাইন গুলো ভালো ভাবে মনোযোগ দিয়ে শুনো, এইগুলা খুবই দরকারী কথা”সময়ের কসম খেয়ে আল্লাহ আমাদের কোন কথাটি মনোযোগ দিয়ে শুনতে বলেছেন সেটা জানতে হলে দ্বিতীয় আয়াতটি পড়তে হবে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে।

إِنَّ الْإِنسَانَ لَفِي خُسْرٍ – নিশ্চয়ই মানুষ বড়ই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে।

এই আয়াতটি যে কেউ প্রথমে একবার পড়লে তার কাছে আয়াত টি নরমাল লাগবে যে ও আচ্ছা মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ। কিন্তু আমরা যদি আয়াতটির দিকে বিশেষ মনোযোগ দেই তাহলে দেখবো এই ছোট একটি আয়াতে আল্লাহ আমাদের এমন কিছু বলেছেন যা আসলেই বিবেকে নাড়া দেওয়ার মত। প্রথম আয়াতের মত এই আয়াতেও আল্লাহ তা’আলা Emphasis ব্যবহার করেছেন। এই আয়াতের প্রথম শব্দ “ইন্নাল” মানে নিশ্চয়ই। আল্লাহ যা বলেন সেটা অবশ্যই সত্য তারপরো আল্লাহ “নিশ্চয়ই” শব্দটা এই আয়াতে ব্যবহার করার মাধ্যমে যেনো আমাদের বুঝালো অবশ্যই এটি সত্য যেমন টা সকালের আকাশে সূর্য উদয় হয় প্রতিদিন ঠিক তেমন টাই সত্য, এর মাঝে বিন্দুমাত্র কোনো সন্দেহ নেই৷

এই আয়াতের দ্বিতীয় শব্দ হচ্ছে “ইনসানা” অথাৎ মানুষ। আল্লাহ এইখানে প্রতিটি মানুষের কথা বলেছেন। মুসলিম, অমুসলিম প্রতিটি মানুষের কথা। যদি কিছু মানুষের কথা বলতো তাহলে তিনি বলতেন যে “নিশ্চয়ই এরা বা নিশ্চয়ই এই শ্রেণীর মানুষরা, বা নিশ্চয়ই কাফের/মুশরিক/ফাসেক/মুনাফিক/জালিম। কিন্তু আল্লাহ এইখানে যেনো সমগ্র মানব জাতির কথা তুলে ধরলেন ” ইন্নাল ইনসানা” নিশ্চয়ই মানুষ।

এই আয়াতের তৃতীয় শব্দ হচ্ছে “লা ফি” যার অর্থ হচ্ছে ” অবশ্যই মধ্যে”। “লা ফি” বলে যেনো বুঝাচ্ছেন প্রতিটা মানুষই অবশ্যই এর মধ্যেই রয়েছে। কেউ এর থেকে বেচেঁ নেই। চারপাশ ঘিরে এইটাই রয়েছে, ঠিক যেনো চারপাশে বিশাল সমুদ্র আমরা সেই সমুদ্রের মধ্যে ডুবে রয়েছি। সেই সমুদ্রের নাম হচ্ছে এই আয়াতের চর্তুথ শব্দ “খুসর” (ক্ষতি)। আমরা প্রতিটা মানুষ এই ক্ষতির সমুদ্রের মধ্যে ডুবে রয়েছে। মানুষ মাত্রই ক্ষতির মধ্যে সে রয়েছে৷আয়াত টি এইভাবে না বলে আল্লাহ যদি বলতেন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত তাহলেও আমরা সেটা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে বাধ্য তা সত্ত্বেও আল্লাহ বললেন “ইন্নাল ইনসানা লা ফি খুসর” নিশ্চয়ই অবশ্যই মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে”

এইভাবে এক আয়াতে এতগুলো Emphasis ব্যবহার করে আমাদের যেনো আমাদের আসল অবস্থা টা তুলে ধরেছেন।

إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ – তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, একে অন্যকে সৎকাজের উপদেশ দিয়েছে এবং সবর ধরার উপদেশ দিয়েছে।

মানুষ মাত্রই সে ক্ষতিগ্রস্ত সে ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ এই কথাটি আমাদের জানিয়েছিলেন,
যা আমাদের জন্যে চিন্তার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছিলো যে “আল্লাহ আমরা ক্ষতির মধ্যে রয়েছি, এখন আমাদের কি হবে” কিন্তু আমাদের রব আল্লাহ আমাদের এত্ত বেশি ভালবাসেন তিনি আমাদের কাছে আমাদের অবস্থা তুলে ধরে তার পরের আয়াতে আমাদের যেনো ঠিক সেটার সমাধান দিয়ে যাচ্ছে যে “এই শুনো এইগুলো করো তাহলে তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবা না”

এইখানে তিনি ৪টি গুণের কথা বলেছেন। যার মধ্যে প্রথম দুইটি নিজেদের করতে হবে আর পরের দুইটি হচ্ছে “ওয়া তাওয়া সাও” যার অর্থ হচ্ছে অন্যকে উপদেশ দেওয়া। এই আয়াতে ওয়া তাওয়া সাও “অন্যকে উপদেশ দেওয়া” শব্দটি দুইবার ব্যবহার হয়েছে। এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা আমাদের প্রথমে দুইটি গুণ নিজের মধ্যে ধারণ করতে বলেছেন যেগুলো হচ্ছে ঈমান আনা এবং সৎকাজ করা এবং পরের দুইটি উপদেশ মানুষের মধ্যে প্রচার করতে বলেছেন। সেই দুইটি উপদেশের একটি হচ্ছে সৎকাজের উপদেশ অন্যটি সবরের উপদেশ৷

আমরা মানুষ জাতি খুব অস্থির প্রকৃতির যেটি আল্লাহ খুব ভাল করে জানেন কারণ তিনিই তো আমাদের এরূপ ভাবে সৃষ্টি করেছেন। তাই তিনি আমাদের সবর করার উপদেশ টি ও দিয়ে দিয়েছেন। কারণ আল্লাহ তা’আলা সবরকারীদের ভালবাসেন। একমাত্র সবরকারীরাই সফলতা লাভ কর‍তে সক্ষম হয়। কারণ তারা হাল ছাড়ে না। আল্লাহ এর উপর তাওয়াক্কুল করে সবর করেন তারা।

এছাড়া একটি কথা না বললেই নয়, এই আয়াতটি পড়ে কি মনে হয়না আমাদের যে “কি মহান আমাদের রব, তিনি শুধু আমাদের একা ক্ষতি হতে মুক্ত হয়ে থাকতে বলেনি তিনি আমাদের এই আয়াতে বলেছেন নিজেরা ঈমান আনো ও ভাল কাজ করার পাশাপাশি অন্যকেও উপদেশ দাও। তাদের বলো ভাল কাজ করতে, তাদের সবর করতে বলো। অন্যকেও তার ক্ষতির কথা জানান দাও। সবাই একসাথে ক্ষতি থেকে মুক্ত হও। আসলে যত গভীর ভাবে চিন্তা করি তত অবাক হই। ছোট ছোট আয়াতে কত কত বিশাল বিশাল তাৎপর্য রয়েছে।

এইখানে প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে গুণ রয়েছে তা হচ্ছে ঈমান। এটি আনতেই হবে এটি আনা ছাড়া বাকি কাজগুলোর কোনো মূল্য নেই৷ঈমান আনা ছাড়া বাকি গুণ গুলো যেনো আমার কাছে ব্যক্তিগত ভাবে ০ “শূণ্য” এর সাথে গাণিতিক গুণের মত মনে হলো। কারণ ০ এর সাথে দুনিয়ার যত সংখ্যাই আমরা গুণ(ইনটু) ব্যবহার করবো তার ফলাফল হবে ০ শূণ্যই। যেমনঃ ০X১২৩৪৫৬৭৮৯=০

ঠিক তেমন ঈমান ছাড়া বাকি সব ভাল কাজ এবং ভাল কাজের ফলাফল বাস্তবিক ভাবে জিরো। আর যদি ঈমান আনি তারপর ভাল কাজ করি তাহলে যেনো শূণ্য এর জায়গায় আল্লাহ আমাদের কোটি সংখ্যা দিয়ে দিবে ইং শা আল্লাহ। এখন ঈমান আনার মধ্যে ভাগ রয়েছে৷ অনেকে রয়েছে যারা মৌখিক ভাবে ঈমান আনে। তারা মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে বাপ-দাদা ঈমান এনেছে তাই তারাও মুখে ঈমান এনেছে।

একটি ময়না পাখি কালেমা শাহাদাত পড়লেই যেমন সে মুসলমান বা ঈমানদার হয় না ঠিক তেমন বাপ-দাদার সূত্রে মুখে ঈমান আনলেই সে ঈমানদার হয় না। ঈমান হচ্ছে অন্তরে ব্যাপার। যেটি অনুভব করতে হয়। যে মনে দৃঢ়ভাবে অনুভব করে বিশ্বাস আনে আল্লাহ ও তার রাসূল صلی الله علیہ وسلم এর কথা এবং বিশ্বাস এনে ভাল কাজ করে এবং ভাল কাজ ও সবরের উপদেশ দেয় সেই প্রকৃত সফল এবং ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে। আমাদের জীবনটা হলো বরফ গলে যাবার আগ সময়টার মত। আমাদের উচিত এই ক্ষণস্থায়ী সময়ের মূল্য দিয়ে জীবনযাপন করা এর মধ্যেই আমাদের তৃতীয় আয়াতের ৪ টি কাজ-

-ঈমান আনা,
-সৎকাজ করা,
-সৎকাজের উপদেশ দেওয়া
-সবরের উপদেশ দেওয়া।

তাহলেই আমরা ক্ষতির সমুদ্র থেকে সাঁতার কেটে তীরে আসতে পারবো। আখিরাতে চূড়ান্ত সফলতা “জান্নাতের অধিবাসী” হতে পারবো। আর সময় থাকতে উক্ত ৪ টি কাজ না করতে পারলে ইন্নাল ইনসানা লা ফি খুসর > নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে পুরোপুরি ডুবে থাকবে।আর ক্ষতির চূড়ান্ত পরিনাম “জাহান্নাম”।

আল্লাহ আমাদের সকলকে ক্ষতির চূড়ান্ত পরিণাম জাহান্নাম থেকে হেফাযত করে সফলতার চূড়ান্ত জায়গা জান্নাতের অধিবাসী হবার তৌফিক দান করুন (আমিন)।

লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।