কবি ফররুখ: আমাদের চেতনার নাম

কামরুজ্জামান |

ফররুখ তখন দামি পাঞ্জাবী ও ফিনফিনে ধুতি পরতেন। একদিন বৃষ্টিতে ভিজে, ধুতি-পাঞ্জাবীতে রাস্তার কাদা মাখিয়ে তিনি কলেজের ক্লাসে এসে হাজির হন। পরণের কাপড় ভেজা ও কর্দমাক্ত ছিল বলে তিনি গিয়ে বসেন একেবারে পেছনের বেঞ্চিতে। সেখানেই বসে সবার অলক্ষ্যে তিনি একটি খাতায় কবিতা লিখতে শুরু করেন।

ক্লাস নিচ্ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী। আচমকা তাঁর দৃষ্টি যায় ফররুখ আহমদের দিকে। তিনি চেয়ার ছেড়ে বক্তৃতা-মঞ্চ থেকে নেমে ধীর পায়ে এগিয়ে যান ফররুখ আহমদের কাছে। অধ্যাপককে দেখে ফররুখ আহমদ খাতাটি লুকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রমথনাথ বিশীর সন্ধানী দৃষ্টিতে ধরা পড়ে একজন নবীন কবির কাব্য-প্রয়াস।

ঐ খাতায় লেখা ফররুখ আহমদের কয়েকটি সনেট পড়ে তিনি বিস্ময়-বিমুগ্ধ হন এবং টিচার্স কমনরুমে গিয়ে অন্যান্য অধ্যাপকদের কবিতাগুলো নাকি আবৃত্তি করে শোনান। অভিভূত কণ্ঠে অধ্যাপক বিশী বলেন যে, তিনি একজন তরুণ শেক্সপিয়ারকে আবিষ্কার করেছেন। বুদ্ধদেব বসু অধ্যাপক বিশীর কাছ থেকে ফররুখ আহমদের কবিতার খাতাটি চেয়ে নিয়ে যান এবং সেখান থেকে কয়েকটি কবিতা তাঁর বিখ্যাত ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন।”

এরপর কবি আর থেমে থাকেননি। একের পর এক প্রসব করেছেন কবিতা। সকলের উৎসাহ উদ্দীপনা ফররুখের মাঝে সঞ্চার করেছিল নতুন এক কবিতার জোয়ার। কবির এই সময়ের কথা লিখতে গিয়ে কবিবন্ধু অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বলেন: ”ফররুখের প্রবণতা চলে গেল কবিতার দিকে। তার কলেজ বয়সে কবিতা তাকে এমনভাবে পেয়ে বসল যে, একজন মেধাবী ছাত্র হারিয়ে গেল কবিতার তোড়ে।

কবি তার হাইস্কুল জীবনে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন কবি গোলাম মোস্তফা, প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবুল ফজল এবং ‘কথিকা’, ‘মাস্টার সাহেব’ প্রভৃতি গ্রন্থ-প্রণেতা লেখক আবুল হাশেমের মত খ্যাতিমান ব্যাক্তিদেরকে। কলকাতার রিপন কলেজে ভর্তি হয়ে সেখানে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন “বুদ্ধদেব বসু, প্রমথনাথ বিশী, বিষ্ণু দে’র মত ব্যাক্তিদের।মেধাবী ছাত্র ও প্রতিভাবান কবি হিসাবে তিনি ছিলেন তাদের প্রিয়পাত্র। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী বলে ফররুখ আহমদকে সেসময়ে অনেকেই ‘দ্বিতীয় আশুতোষ’ বলে আখ্যায়িত করতো। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন সত্যজিৎ রায়, ফতেহ লোহানী।”

কলেজেও আছেন, কবিতাও লিখছেন, রাজনীতির গোপন গলিতেও চলাফেরা হচ্ছে, হাতে সেতার, পরণে শৌখিন ধুতি-পাঞ্জাবী উনিশ বিশ বছরের এই ফররুখ আহমদকে সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন কবি বন্ধু জিল্লুর রহমান। কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় ফররুখ আহমদের কবি-খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং কবি হিসাবে তিনি মোটামুটি স্বীকৃতিও লাভ করেন। সে সময়কার পত্র-পত্রিকায় তাঁর কবিতা নিয়মিত ছাপা হতে থাকে।

তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত হয়ে ওঠেন ১৯৪৩ সালে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে অনেকগুলো কবিতা রচনার কারণে। যার সংখ্যা প্রায় ১৯। ১৯৪৩ সালে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘আকাল’ নামে একটি সংকলন প্রকাশ করেন। তাতে কবি ফররুখ আহমদের বিখ্যাত ‘লাশ’ কবিতাটি স্থান পায়। দুর্ভিক্ষ নিয়ে অদ্যবধি বাংলা সাহিত্যে ‘লাশ’ এর মত কবিতা আর কেউ লিখতে পারেননি। দুর্ভিক্ষ নিয়ে ব্যথিত কবির উচ্চারণ ছিল-
যেখানে পথের পাশে মুখ গুঁজে পড়ে আছে জমিনের পর;
সন্ধ্যার জনতা জানি কোনদিন রাখেনা সে মৃতের খবর।

চাকরি জীবনে প্রথমে কলকাতার আইজি প্রিজন অফিস এবং সিভিল সাপ্লাই অফিসে কয়েক বছর চাকরি করার পর ১৯৪৫ সাল থেকে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন এবং দেশভাগের পর ঢাকায় এসে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে স্টাফ শিল্পী হিসেবে যোগ দেন। আমৃত্যু অবধি এই কাজেই ছিলেন।

পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে ফররুখ আহমদ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। নতুন শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রতি তাঁর ছিল অকৃত্রিম দরদ। তিনি নিজেই বার বার বলেছেন,’যারা নতুন এসেছেন তাদের প্রতিষ্ঠা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।’ কবি সিকান্দার আবু জাফরসহ অনেককে তিনি তাড়া দিয়ে লেখাতেন এবং জয়নুল আবেদীন, সফীউদ্দিন ও কামরুল হাসানের কাছ থেকে ছবি আদায় করেছেন।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মোহাম্মদীর সম্পাদকীয় বিভাগে তাঁর চাকুরী বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। মোহাম্মদীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক থাকাকালে তাঁর রচিত একটি কবিতা ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ কিছুটা রদবদল করে অন্যের নামে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে ছাপানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফররুখ আহমদ প্রতিবাদ স্বরূপ মাসিক মোহাম্মদীর চাকুরী থেকে ইস্তফা দেন। এ ঘটনা সমসাময়িক অনেকেরই জানা ছিল। ফররুখের প্রতিবাদী মন এ বিষয়কে কেন্দ্র করে ‘কবিতা চোরের প্রতি’ নিম্নোক্ত সনেটটি রচনা করেন,
বোমা মারিলেও পেটে কাব্য কণা হয় না বাহির
কবিতা চুরিতে তাই মনোযোগী বৃদ্ধ জ্ঞানপাপী,
অসৎ উপায়ে চাও নাম কিছু করিতে জাহির
সতর্ক দেশের লোক ধরে ফেলে অচিরে তথাপি।
চোরের দশম দিন শেষ হলে গৃহস্থের দিন
অবশ্যই আসে ফিরে (ধরা পড়ে যখন তস্কর
দুষ্ট ছেলেদের হাতে পেয়ে তার অবস্থা সংগিন
দু’পাশে হাসির তোড়ে ফেটে পড়ে প্রাচীন শহর)।

এভাবে কবি-জীবনের শুরুতেই তাঁর প্রতিবাদী মনের পরিচয় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে তিনি তাঁর আদর্শ ও নীতিবোধকে সবোচ্চ মূল্য দিতেন। নির্মোহ জীবনে তিনি অনেক লোভ-প্রলোভনকে উপেক্ষা করেছেন। এজন্য তাঁকে জীবনে অনেক ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। তিনি ছিলেন মুসলিম পুনর্জাগরণবাদী কবি। তাঁর কাব্যের মৌলিক প্রবণতা মুসলিম সংস্কৃতির গৌরবকীর্তন ও জাতীয় চেতনার পুনর্জাগরণ। পাকিস্তানবাদ, ইসলামিক আদর্শ ও আরব-ইরানের ঐতিহ্য তাঁর কবিতায় উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে।

ফররুখ আহমদ ছাত্রাবস্থায়ই এম.এন. রায়ের র‌্যাডিক্যাল মানবতাবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু, ১৯৪১ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ সম্মেলনে গৃহীত ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রসত্মাবে’র প্রেক্ষিতে কবি-র মতাদর্শিক পরিবর্তন ঘটে। কবি তাঁর মুরশিদ বিশিষ্ট আলেম অধ্যাপক আব্দুল খালেকের সংস্পর্শ লাভ করেন। কবি তাঁর মুরশিদের দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হন এবং বিভাগোত্তরকালে তিনি ছিলেন পাকিস্তানি আদর্শ ও মুসলিম রেনেসাঁর একজন সমর্থক।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রতি কবির ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। তিনি তখন পাকিস্তানের অপরিণামদর্শী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে কঠোর হাতে লেখনী পরিচালনা করেন। বায়ান্ন’র রক্তাক্ত ঘটনার পর রেডিওতে কর্মরত শিল্পী আলতাফ মাহমুদ, আব্দুল আহাদ, আব্দুল হালিম চৌধুরীদেরকে নিয়ে তিনি ধমঘটে যোগদেন। তিনি তদানিন্তন পাকিস্তানী শাসকদের ব্যাঙ্গ করে ‘রাজ-রাজরা’ নামে একটি নাটক লেখেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটকটি মঞ্চায়িত হয়। প্রখ্যাত নাট্যকার মুনীর চৌধুরী এতে অভিনয় করেন।

১৯৪৭ ‘মোহাম্মদী’ অফিসের চাকরিতে ইস্তফা দানের পর থেকে কবি বেকার হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর পর ১৯৪৮ সনে কবি কলকাতা ছেড়ে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে প্রথমে ওঠেন কবি বেনজীর আহমদের বাসায়। এরপর সপরিবারে বাসা বাঁধেন কমলাপুরে। সর্বশেষ ৭/৫ ইস্কাটন গার্ডেন কলোনির সরকারী বাসভবনে মৃতু্যকাল অবধি অবস্থান করেছিলেন।

ফররুখ আহমদ ঢাকায় এসে প্রথমে ঢাকা বেতারে অনিয়মিত এবং পরে ১৯৫২ সনের এপ্রিল থেকে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট বা নিজস্ব শিল্পী হিসাবে আমৃত্যু কাজ করেন। ঢাকা বেতারে তিনি দীর্ঘকাল ছোটদের আসর ‘কিশোর মজলিশ’ পরিচালনা করেন। বেতারের প্রয়োজনে গান, কথিকা, নাটিকা, শিশুতোষ রচনা, গীতিনাট্য, গীতি-বিচিত্রা ইত্যাদি লিখেছেন। নিজের ও অন্যদের কবিতা আবৃত্তি করেছেন, পুঁথি পাঠ করেছেন, বিশেষ অনুষ্ঠানসমূহ প্রযোজনা ইত্যাদি নানা কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন।

বেতারে তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে ছিলেন কবি শাহাদৎ হোসেন, কবি আজিজুর রহমান, কবি সৈয়দ আলী আহসান, কবি আবুল হোসেন, কবি সিকান্দার আবু জাফর, কবি শামসুর রাহমান, কবি হেমায়েত হোসেন, সুরকার আব্দুল আহাদ, গীতিকার নাজির আহমদ, কথাশিল্পী আশরাফুজ্জামান খান, কথাশিল্পী নাজমুল আলম, মোবারক হোসেন খান প্রমুখ।

১৯৭০ সনের জানুয়ারি মাসে ঢাকা থেকে ‘দৈনিক সংগ্রাম’ পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার প্রাক্কালে উক্ত পত্রিকার সম্পাদক হওযার জন্য উনাকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে কাব্য-কলার সাধনায় নিজেকে একাগ্রভাবে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যেই সম্ভবত তিনি ঐ প্রস্তাব গ্রহণনি। অবশ্য দৈনিক সংগ্রামের প্রতি কবির সহৃদয় সহানুভূতি সর্বদাই লক্ষ্যণীয় ছিল।

উদ্বোধনী সংখ্যার প্রস্তুতিলগ্নে কবির কাছে লেখা চাইলে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ‘সংগ্রাম’ শীর্ষক একটি কবিতা লিখে দেন।উদ্বোধনী সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় রঙিন হরফে তা ছাপা হয়েছিল। এর পরে প্রতিটি বিশেষ সংখ্যায় কখনো সাপ্তাহিক সাহিত্য পাতায় কবির লেখা প্রকাশিত হতো।

১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিশ্বস্ত এক সহযোগীর নাম আখতার ফারুক। তিনি লিখেন ‘একাত্তরের সামরিক পদক্ষেপের পর মাঝে মাঝে আমরা [মানে ফররুখ আহমদ ও তিনি] মিলতাম। তিনি একদিকে পাঞ্জাবীদের মূর্খতাজনিত বাড়াবাড়ি ও অন্যদিকে ভারতের ষড়যন্ত্রমূলক কারসাজি দুটারই তীব্র সমালোচনা করতেন। বলতেন, এ শয়তানীর খেসারত দু’পক্ষকেই সুদে-আসলে দিতে হবে’। (ফারুক ২০০৪: ৭৬)

কবির অনুমান কোন অংশেই ভুল ছিল না। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কম্যুনিস্ট প্রভাবিত এজেন্ডা নিয়ে তাজউদ্দীনরা যেভাবে কাজ শুরু করেছিলেন, পরবর্তীতে শেখ মুজিব এসে যদি তার লাগাম টেনে না ধরতেন, তাহলে এতদিনে বাংলাদেশ ভারতের একটি প্রদেশ হিসেবেই পরিচিত হয়ে উঠতো। শেখ সাহেব দেশে এসেই ভারতের রাখা সৈন্য বাহিনীকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। যা ছিল মুজিব নগর সরকারের অন্যতম সেরা চুক্তির অন্তর্ভুক্ত বিষয়।

শুরুর দিকের পরিবেশ পরিস্থিতির গোলমাল প্রভাব দূর হলেও এদেশীয় মুসলমান বাঙালি জাতীয়তাবাদী বামুনদের বিজয় ঠিকই অর্জিত হয়। যার ফলে ৭১’এর যুদ্ধে ফররুখ বাংলাদেশকে সাপোর্ট করলেও সেইসকল বামুনদের হাত থেকে বাঁচতে পারেন নি। বরং তারাই ষড়যন্ত্র করে ধর্ম প্রিয় ফররুখ নিয়ে হিংস্র খেলায় মেতে ওঠে। ফলে বেতার চাকরি থেকে উনাকে ইস্তফা দেওয়া হয়। তবুও তিনি বড়কে যান নি। আল্লাহর উপর অবিচল আস্থার সহিত ধৈর্য্য ধরেন।

এ সময় ফররুখকে অনেক কষ্টে দিনানিপাত করতে হয়। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে মারা যায় কবির মেয়ে। পরবর্তীতে আহমদ ছফার শ্লেষাত্মক ভাষায় লেখা একটা কলাম চারিদিকে ব্যপক সমালোচনার ঝড় তুললে কবিকে আবার তার চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়। কিন্তু এত কিছুর পরও অনাহারে, অনাদরে কবিকে করতে হয়েছিল প্রস্থান। দুনিয়ার জীবনে তার ছিল একটি মাত্র অপরাধ, যা বাঙালি সেক্যুলারদের কাছে সহ্য হয় নি, সেটা হলো তার ধর্মের পথে পা বন্দী অটলমান থাকা।

কবির স্ত্রীর সৈয়দা তৈয়বা খাতুনের মতে, কবির ইচ্ছে ছিল, ঢাকায় খুব সুন্দর একটি বাড়ী করার। কিন্তু তাঁর সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পায়নি। ঢাকায় জমি কিনবার মত সামর্থ তাঁর ছিলো না। তবুও হয়তো পারতেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে জমি কিনতে, পারতেন বাড়ী বানাতে।

কিন্তু তার ধর্মপ্রাণ মানস এতে সায় দেয় নি। ইসলামী মূল্যবোধ তিনি পরিহার করতে পারেন নি। ব্যাংকের ঋণ নিলে সুদ দিতে হবে। সুদ তো ইসলামে হারাম। সুতরাং তিনি এ পথে পা বাড়ান নি। এজন্যে তাঁর কোনো আক্ষেপও ছিলো না। কারণ, তিনি ধর্মের ব্যাপারে ছিলেন নিরাপোষ।

প্রায়ই ফররুখ আহমদের প্রসঙ্গ সামনে আসলে কাজী নজরুল ইসলামের নামকেও আনতে দেখা যায়। বস্তুত তারা উভয়েই বাংলার মুসলিমদের সমস্যা নিয়ে ভাবিত ছিলেন। তবে নজরুলের যখন সাহিত্য জীবনের সমাপ্তি, ফররুখের তখন শুরু। নজরুলের আবির্ভাব প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অস্থিরতা, খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের সময়।

বিপরীতে ফররুখ এসেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা, পাকিস্তান আন্দোলন ও দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা নিয়ে। ফলে বাঙালি মুসলমানের বঞ্চনা, অপমান এবং সামাজিক হতশ্রী অবস্থা উভয়েই পর্যবেক্ষণ করলেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও সাড়াদান সমান ছিল না। মরু-ভাস্কর, কাব্যে আমপারা, রুবাইয়াতে উমর খৈয়াম কিংবা অজস্র গজল রচনার পরেও নিজেকে ধর্ম ও জাতের উর্ধ্বে উঠে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন সমন্বয়বাদী হিসেবে। ১৯২৯ সালে এলবার্ট হলে বলতে পেরেছেন, “যে কূলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।”

ফররুখ এদিক থেকে বিপরীত। তখন দুই প্রতিবেশি সম্প্রদায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের টানাপোড়েনে। তার দায়ভার উভয় সম্প্রদায়ের। আল্লামা ইকবালের ভাবশিষ্য ফররুখ নিজ জাতির সমস্যাকে চোখে আঙুল তুলে দেখিয়েছেন। তার কথা ছিলো,
হে মাঝি! এবার তুমিও পেয়ো না ভয়,
তুমিও কুড়াও হেরার পথিক-তারকার বিস্ময়,
ঝরুক এ ঝড়ে নারঙ্গী পাতা, তবু পাতা অগণন,
ভিড় করে-যেথা জাগছে আকাশে হেরার রাজতোরণ।
সাত সাগরের মাঝি, সাত সাগরের মাঝি

বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ’ মহাকাব্যের পর অত্যন্ত সফল মহাকাব্য ফররুখ আহমদের ‘হাতেম তা’য়ী। কাব্য নাটক রচনার ক্ষেত্রে মুসিলম কবিদের মধ্যে তিনিই পথিকৃৎ। তার ‘নৌফেল ও হাতেম’ একটি সফল কাব্য নাটক। এটি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘আয়ূস্মতীর’ চেয়ে অনেক উন্নতমানের রচনা। সনেট রচনায় ফররুখ আহমদ সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করেছেন।

সম্ভবত, বাংলা সাহিত্যে মাইকেলের পর সংখ্যায় এত বেশি সনেট হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে আজ পর্যন্ত আর কেউ রচনা করতে পারেননি। ব্যঙ্গ কবিতা রচনার ক্ষেত্রে ফররুখ বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেন। প্রায় পনেরটি ছদ্মনামে এসব ব্যঙ্গ কবিতা রচিত হয়েছে। স্বনামেও তিনি প্রচুর ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছেন। তাঁর ব্যঙ্গ কবিতা গ্রন্থের মধ্যে ১. অনুস্বার (ব্যঙ্গ সনেট), ২. ঐতিহাসিক অনৈতিহাসিক কাব্য ৩. তসবির নামা ৪. ধোলাই কাব্য প্রভৃতি প্রধান।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, ১৯৫৭ সালে সিপাহীদের ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামের শতবর্ষিকী পালন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে আয়োজন করা হয় এক স্মরণসভার। সে সভায় উপস্থিত ছিলেন, অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, প্রফেসর ড. মুহম্মদ আব্দুর রহিম, ড. সৈয়দ আলী আশরাফ, ড. কাজী দীন মুহম্মদ, কবি ফররুখ আহমদ, ড. হাসান জামান, আসকার ইবনে শাইখ, ড. মফিজুল্লাহ কবীর সহ ঢাকার জ্ঞানী-গুনী সকল কবি সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীগণ।

শতবার্ষিকী স্মরণ সভায় সাপ্তাহিক দৈনিক সম্পাদক (পরবর্তীতে দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক) ও তমদ্দুন মজলিসের এক সময়ের সাধারণ সম্পাদক জনাব হাসান ইকবালের প্রস্তাবে ইংরেজ কলংকতিলক ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’ নামটি পরিবর্তন করে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের নায়ক শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নামানুসারে ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’ নামকরণ করা হয়।সিপাহীদের শাহাদাত বরণ স্থানটিতে করা হয় স্মৃতিসৌধ। আর সভায় উপস্থাপিত লেখাগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘শতাব্দী পরিক্রমা’ নামের একটি সংকলন।

যেটি ১৯৭৪ সালে ড. হাসান জামানের সম্পাদনায় নতুন করে নওরোজ পাবলিকেশন থেকে বের হয়। সে সভায় কবি কবি ফররুখ সিপাহীদের স্মরণ করে আবৃতি করেছিলেন,
“স্বাগত জানাই আজ, কেননা, এই কীটদষ্ট মাঠে
মর্দে মুমিনের স্বপ্ন পরিপূর্ণ হয়নি এখনও
কান পেতে শুনি আমি রক্ত-বর্ষ!! শোন তুমি শোন
লক্ষ মজলুমের কন্ঠ প্রতিহত পাষাণ কপাটে
সান্ত্বনা পায়নি যারা, স্বস্তি খুঁজে পায় নাই কোন
আসুক আযাদী সেই মানুষের নির্যাতিত বাটে।”

লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।