অমুসলিমের মৃত্যুর পর দোয়ার বিধান ও যৌক্তিকতা

শায়খ আহমাদুল্লাহ |

কোনো অমুসলিমের মৃত্যুতে একজন মুসলিমের আচরণ কেমন হওয়া উচিত? কোনো অমুসলিম মৃত্যুবরণ করলে আমরা তার জন্য শান্তির দোয়া করতে পারি কি না? জান্নাতের দোয়া করতে পারি কি না? ‘ওপারে ভালো থাকুন, ‘শান্তিতে ঘুমান’ অথবা ‘রেস্ট ইন পিস’ এই জাতীয় কোনো কথা বলে তার জন্য শুভকামনা করতে পারি কি না?

এ বিষয়ে ইসলামের শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত সংক্ষেপে উপস্থাপনের চেষ্টা করছি। প্রিয় পাঠক, শুরুতেই বলে রাখতে চাই, একজন মুসলিমকে ইসলাম সবচেয়ে সুন্দর আচরণের অধিকারী, সবচেয়ে উত্তম আচরণের অধিকারী বা উত্তম ব্যবহারের অধিকারী হওয়ার শিক্ষা দিয়ে থাকে। রাসূলে কারিম সা: বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মানুষের নেক আমলের পাল্লায় সবচেয়ে বেশি ভারী হবে তার উত্তম আচরণ।’ যার কারণে একজন মুসলিমকে সুন্দর আচরণ বা সুন্দর ব্যহারের অধিকারী হতে হয়। একজন মুসলিমকে যথাসম্ভব উদার মানসিকতাসম্পন্ন হতে হয়। কিন্তু মুসলমানের সেই উদারতা বা সৌজন্যতা প্রদর্শনেরও সুনির্দিষ্ট নিতিমালা রয়েছে।

একজন সাধারণ অমুসলিমের সাথে তার জীবদ্দশায় আমাদের আচার-আচরণ কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা মুমতাহিনার ৮নং আয়াতসহ বিভিন্ন জায়গায় দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সাধারণ অমুসলিমদের সাথে জীবদ্দশায় ন্যায়নিষ্ঠা ও উত্তম আচরণের দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু মৃত্যুবরণ করার পর একজন অমুসলিমের প্রতি আমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত সেটিই আজকের আলোচ্য বিষয়।

মৃত্যুবরণ করার পর এমন সাধারণ অমুসলিম যিনি তার জীবদ্দশায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে বা শত্রুতায় লিপ্ত ছিলেন না বা মুসলমানদের কষ্ট দেননি তাহলে সে ক্ষেত্রে তার মৃত্যুতে আমাদের মধ্যে খারাপ লাগা কাজ করবে এ দৃষ্টিকোণ থেকে যে, তিনি যদি ঈমান নিয়ে মরতে পারতেন তাহলে তিনি চির জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতেন আর জান্নাতি হওয়ার সৌভাগ্য পেতেন। এই জায়গা থেকে আমার মধ্যে আফসোস থাকবে, আক্ষেপ থাকবে বা খারাপ লাগা কাজ করবে। এটি খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয় এবং এটি প্রশংসনীয় ও নির্দেশিত।

এর বিপরীতে যদি কোনো অমুসলিম জীবদ্দশায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে, ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে, ক্ষতিসাধন করার চেষ্টা করে বা মুসলমানদের বিপথগামী করে বেড়ায় তবে এ রকম অমুসলিমের মৃত্যুর পর আমাদের মধ্যে ভালোলাগা কাজ করবে। এটাই হলো সক্রিয় এবং সম্পূর্ণভাবে একটি প্রকৃতিগত বিষয়।

কারণ আমাকে হত্যা করার জন্য কেউ অগ্রসর হয়েছে তখন যদি সে হঠাৎ মৃত্যুবরণ করে তাহলে সন্দেহাতীতভাবে আমি প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলব এই বলে যে, আল্লাহ আমাকে রক্ষা করেছেন। এ জন্য রাসূল সা:-এর জীবদ্দশায় ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং যুদ্ধে লিপ্ত অমুসলিমের মৃত্যুর পর তিনি আল্লাহ সুবহানাহুর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। উপরিক্ত আলোচনা থেকে আমরা কোনো মুসলিমের মৃত্যুর পর কেমন আচরণ করব সেটি জানার চেষ্টা করলাম।

অমুসলিমের মৃত্যুতে দোয়া : সব অমুসলিমের মৃত্যুর পর তিনি যে ধরনের অমুসলিমই হোন না কেন তার জন্য শান্তির দোয়া করা বা জান্নাতের দোয়া করা এবং ‘ওপারে ভালো থাকুন বা মৃত্যুর পরে সুখে থাকুন’ এ ধরনের দোয়া করা আমাদের বিশ্বাসের সাথে সম্পূর্ণ বিরোধপূর্ণ। আবার ইসলামের শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকেও নিষিদ্ধ একটি বিষয়। বিশ্বাসের সাথে বিরোধপূর্ণ বা অসঙ্গতিপূর্ণ এ জন্য যে, আমি যদি বিশ্বাস করি, আল্লাহর কুরআন সত্য; সে ক্ষেত্রে কুরআনে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করে তাওবা ছাড়া মুশরিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল তার ঠিকানা জাহান্নাম এবং আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না বলে চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করেছেন।

তারপরও যদি আমি মনে করি, তিনি মৃত্যুর পরে ভালো থাকবেন বা ভালো থাকার সম্ভাবনা আছে বা আমি যদি বলি ‘ওপারে ভালো থাকবেন’, ‘শান্তিতে থাকুন’ তাহলে এটা আমার বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক এবং অসঙ্গতিপূর্ণ। আমি আমার বিশ্বাসের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছি এবং বিশ্বাস বহির্ভূত কথাবার্তা বলছি।

প্রিয় পাঠক, একটি উদাহরণ পেশ করছিÑ ধরুন আমার বাবা যে শত্রু নিশ্চয়ই আমি আমার মায়ের কাছে বাবার শত্রুর সপক্ষে কোনো সুপারিশ করতে যাবো না বা শত্রুর পক্ষে সাফাই গাইতে যাবো না এবং আমি সেখানে তথাকথিত উদারতা প্রদর্শন করতে যাব না। একইভাবে আমার রাষ্ট্রে অস্তিত্বকে যদি কেউ অস্বীকার করে নিঃসন্দেহে আমি তার জন্য রাষ্ট্রের কাছে ভালো কিছু আশা করব না। এ জিনিসগুলো আমরা যেভাবে সহজে বুঝি; কুফরি করে, শিরক করে বা আল্লাহদ্রোহিতা করে মৃত্যুবরণ করার পর তার জন্য আল্লাহর কাছে শান্তি আশা করা এটা আমাদের বিশ্বাসের সাথে যায় না।

এ ছাড়া একজন অমুসলিম যিনি তার জীবদ্দশায় জান্নাতে যেতে চাননি বা তাকে জান্নাতের পথে আসতে বলা হলেও তিনি অস্বীকার করতেন, তিনি হয়তো নাক শিটকাতেন। সেই জান্নাতে তার মৃত্যুর পর তাকে যাওয়ার জন্য দোয়া করা বা তার শান্তি কামনা করা এটা যেন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে কোথাও প্রবেশ করিয়ে দেয়ার নামান্তর। যেটা একজন মুসলিম হিসেবে একজন বিবেকবান মানুষ হিসেবে আমাদের জন্য কোনো অবস্থাতেই সমীচীন হতে পারে না।

পবিত্র কুরআনের সূরা তাওবার ১১৩ নং আয়াতে আল্লাহ পরিষ্কারভাবে বলেছেন, আমরা যেন কোনো অমুসলিমের জন্য বা কোনো মুশরিকের জন্য মৃত্যু পর তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া না করি। সহিহ বুখারি শরিফে রাসূল সা: বলেছেন, তোমরা মৃত ব্যক্তিদেরকে গালমন্দ করো না। সুতরাং যারা সাধারণ অমুসলিম আমরা তাদের মৃত্যুর পর তাদেরকে গালমন্দ করব না। তা ছাড়া মুসলমানদের মধ্য থেকেও কোনো পাপিষ্ঠ ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি মুসলমান হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে সুধারণা রাখার মতো সুযোগ আছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার মৃত্যুর পর গালমন্দ করা বা বাজে মন্তব্য করা বা ট্যাগ দিয়ে কথা বলা এগুলো ইসলামের শিক্ষা নয়। কারণ রাসূল সা: বলেছেন, ‘সে তার কর্মের ফল পেয়ে গেছে। সুতরাং তার মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই।’

এই জায়গা থেকে কোনো অমুসলিমের মৃত্যুর পর তার জন্য আমরা শুভকামনা করতে পারি না। ‘রেস্ট ইন পিস’ বা ‘ওপারে ভালো থাকবেন’ বলে দোয়া করতে পারি না। এ রকম বললে বা লিখলে তা কুরআনুল কারিমের আয়াত লঙ্ঘন হচ্ছে। আমি তার জন্য শুভকামনা করা মনে হলো আল্লাহদ্রোহী একটা মানুষের জন্য আল্লাহর কাছে জান্নাত লাভের জন্য আশা করা। যে ব্যাপারে আল্লাহ আগাম ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন।

অনেকেই মনে করেন, হয়তো এটা আমাদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি। এটা আসলে আমাদের উদারতা নয়, এটা আমাদের উদাসীনতা। আমাদের দ্বীন সম্পর্কে, ইসলাম সম্পর্কে, কুরআন সম্পর্কে, সুন্নাহ সম্পর্কে এবং বাস্তবতা সম্পর্কে আমরা উদাসীন হওয়ার ফলেই কিন্তু আমরা এই তথাকথিত উদারতা দেখাতে যাচ্ছি। আল্লাহ আমাদের সব ক্ষেত্রে শুদ্ধ, সুস্থ এবং যৌক্তিক চিন্তাধারাকে লালন করার তাওফিক দান করুন। কুরআন এবং সুন্নাহর অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। কোনো অমুসলিমের মৃত্যুর পর তার জন্য শুভকামনা করা, তার জন্য দোয়া করা, তার জন্য শান্তিতে থাকার কথা বলাÑ এগুলো আমাদের ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞান তলানিতে চলে যাওয়া এবং ধর্মীয় দিক থেকে আমরা চরম দেউলিয়াপনায় পৌঁছে গেছি তারই প্রমাণ বহন করে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হিফাজত করুন।

অনুলিখন : সাইফুল্লাহ হিমেল