মুসলিম উম্মাহর দরদী দাঈ সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলী নদবী

মুহাম্মাদ রবিউল হক |
বালাকোটের যুদ্ধের ৮৫ বছর পর এক মহান মুজাহিদের জন্ম হয় যার শানিত কলম এবং ভাষার মাধুর্যতা তাকে আরব অনারবে প্রসিদ্ধি এনে দেয়।

যার মহান কর্ম গোটা বিশ্বকে নিজের দিকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। তার নাম মাওলানা সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলী নদবী। বিদগ্ধ এই কলম সৈনিক ভারতের উত্তরপ্রদেশের ছোট গ্রাম তাকিয়াকিলাঁর সাইয়্যিদ বংশের হাসানী খান্দানে ২৪ নভেম্বর ১৯১৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন।

তখন কেউ জানতো না যে, এই শিশু শুধু নিজের বংশই নয় বরং নিজের দেশ, জাতি ও দ্বীনের নাম এমন আলোকিত করবে যা শুধু আরব-অনারব নয় বরং ইউরোপীয় রিসার্চ সেন্টারগুলোতে তার রচনাবলী, চিন্তা-দর্শন ও দাওয়াতের ওপর গবেষণা চলবে। মাওলানা আবুল হাসান আলী নদবী ছিলেন একজন মহান চিন্তাবিদ, মুবাল্লিগ, দাঈ, বিদগ্ধ লেখক, অনুসন্ধানী ঐতিহাসিক, প্রতিথযশা সাহিত্যিক ও নন্দিত বক্তা।

যার রচনাবলীর প্রতিটি অনুচ্ছেদ সাহিত্যের এক অমূল্য রত্ন। যার বক্তব্যের প্রতিটি বাক্য ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত এবং উম্মতের জন্য ব্যাথা ও উদ্বিগ্নচিত্ততার উজ্জল দৃষ্টান্ত। আলী মিয়া নদবী প্রথম ভারতীয় আলেম ছিলেন যাকে অনারবদের তুলনায় আরবরা বেশী জানতো। মাওলানা ছিলেন হিন্দুস্তানের প্রথম আলেম, যাকে সৌদি আরবের রয়েল ফ্যামিলি ১৯৫১ সালে হজ্জের সময় মক্কার চাবি হস্তান্তর করেন এবং যে কাউকে সঙ্গে নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়।

তিনি ছিলেন এমন আলেম, যাকে ১৯৮০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক সেন্টারের পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়। মাওলানা নদবী প্রথম এমন আলেম ছিলেন যাকে দল, মত নির্বিশেষে সবাই নিজেদের পথ প্রদর্শক হিসেবে মেনে নেন এবং নিজেদের মাহফিলে দাওয়াত দিতে গর্ববোধ করতেন। তিনি এমন এক আলেম ছিলেন যার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশ্বের রাজা-বাদশারা সম্মানিতবোধ করতেন এবং মনযোগ দিয়ে তার উপদেশ শুনতেন।

মাওলানা আলী মিয়া নদবী জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহ ও হুসাইন, সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সাল, খালিদ ও ফাহাদ, মরক্কোর রাজা মালিক হাসান ছানী, শারজাহর বিচারপতি সুলতান বিন মুহাম্মাদ কাসেমী, ইয়েমেনের রাষ্ট্রপ্রধান আলী আব্দুল্লাহ সালেহ, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউল হক প্রমুখের সঙ্গে কয়েকবার সাক্ষাৎ করেন এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য গুরুতপূর্ণ উপদেশ প্রদান করেন।

১৯৩৪ সালে তিনি নদওয়ার প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। এখানে তিনি তাফসীর,হাদীস এবং আরবি সাহিত্যের পাঠদান করতে থাকেন। তার মেধা ও যোগ্যতা দেখে ১৯৫১ সালে তাকে নদওয়ার সহকারী শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়।

সাইয়্যিদ সুলায়মান নদবীর মৃত্যুর পর ১৯৫১ সালে তিনি শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব পান। ১৯৬১ সালে তার সহোদর নদওয়ার রেক্টর ডা. সাইয়্যিদ আব্দুল আলী মৃত্যু বরণ করলে মজলিসে শূরার সর্বোসম্মতিতে তিনি রেক্টর মনোনীত হোন। এরপর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জ্ঞান ও সাহিত্যের এই গোলাপ বাগানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন। এই প্রতিষ্ঠানকে প্রসিদ্ধি ও শ্রেষ্ঠত্বের আসনে পৌঁছে দেন।

মাওলানার রচনাবলির সংখ্যা ৫ শতকেরও অধীক। তার কিছু রচনা বিশ্বের প্রায় সব ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এর মধ্যে- কাসাসুন্নাবিয়্যীন লিল আতফাল, আল কিরাআতুর রাশিদা, মুখতারাত ফি আদাবিল আরাবি এই তিন কিতাব ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ আরব বিশ্বের প্রায় ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত।

আরকানে আরবা’আ, নবীয়ে রহমত, সীরাতে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ, রওয়ায়ে ইকবাল, ইসমাঈ ইয়া মিসর!, আল আহাদিসুস সারিহা লিল আমেরিকা, ইযা হাব্বাত রিহুল ঈমান, কারওয়ানে যিন্দেগী, তারিখে দাওয়াত ওয়া আযিমত, আল মুরতাযা তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। কিন্তু যে গ্রন্থ তাকে আরব বিশ্বে প্রসিদ্ধি এনে দিয়েছে, বিখ্যাত করেছে এবং তাকে অনন্য উচ্চতায় স্থান করে দেয়, তা হল ‘মা যা খাসিরল আলম বি ইনহিতাতিল মুসলিমীন’ বা মুসলমানের পতনে বিশ্ব কি হারালো। এই গ্রন্থ তিনি ১৯৪৪ সাল হতে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সময় নিয়ে লেখেন। আলী মিয়া নদবী এই গ্রন্থে এক নতুন চিন্তা (Thought), নতুন দর্শন উপস্থাপন করেন।

সাইয়্যিদ কুতুব শহীদ এই গ্রন্থের ভূমিকায় লেখেন, ‘গ্রন্থটির পাঠক স্পষ্টতই বুঝতে পারবেন বর্তমান নেতৃত্ব পরিবর্তন আবশ্যক। মুসলমানরা নেতৃত্ব হারানোর দ্বারা সমগ্র মানবজাতি এক মহাবিপর্যয়ে নিপতিত হয়েছে। আর এই বিপর্যয়ে শুধু মুসলিম জাতিই নয় বরং সমগ্র বিশ্ব অন্তর্ভূক্ত।’ মাওলানা এই গ্রন্থে মুসলিমদের বিশ্ব নেতৃত্ব গ্রহণের আহবান করেছেন এবং তিনি প্রমাণ করেছেন মুসলিম উম্মাহর সৃষ্টিই বিশ্ব নেতৃত্বের জন্যে।

মাওলানা আবুল হাসান আলী নদবী বিশ্বের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার প্রদান করেন। তারমধ্যে আলীগড়, কায়রো,জামে আল আজহার,দামেস্ক, মদীনা, লন্ডন, গ্লাসগো, কলম্বিয়া, ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড উল্লেখযোগ্য।

নদওয়ার রেক্টর নিয়োগের পর ১৯৬১ হতে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। এসময় তার দাওয়াতি মিশনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। মিসর, সৌদি আরব, ফিলিস্তিন, কুয়েত, আমিরাত, জর্ডান,লেবানন, মরক্কো, সুদান, শাম, তুর্কি, ইরান, আফগানিস্তান, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ছাড়াও প্যারিস, লন্ডন,জেনেভা প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন এবং সেখানে সেমিনার, সিম্পজিয়ামে বক্তৃতা প্রদান করেন। এসময় তিনি আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হোন এবং বিশ্বের আনাচে কানাচে তার খ্যাতি ও প্রসিদ্ধি পৌঁছে যায়।

১৯৮০ সালে তার মুসলিম উম্মাহর জন্যে অসামান্য অবদানের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ‘কিং ফয়সাল অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করা হয়। পুরস্কারের সমুদয় অর্থ তিনি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামে দান করেন। মাওলানা নদওয়ার রেক্টর, মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সভাপতি, রাবেতায়ে আলমে ইসলামির সদস্য, বিশ্ব ইসলামি সাহিত্যের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, দেওবন্দের মজলিসে শূরা সদস্য, মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলর ও সিন্ডিকেট সদস্য, আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়ার রুকন ছাড়াও অসংখ্য ধর্মীয়,সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ছিলেন।

ইসলামি বিশ্বের এই ক্ষণজন্মা গবেষক,ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক,দাঈ, চিন্তাবিদ, সমাজ সংস্কারক,উম্মাহর একনিষ্ঠ সেবক ১৩ ডিসেম্বর ১৯৯৯ সালে বিংশ শতাব্দীর শেষ সময়ে,রমজান মাসের শেষ শুক্রবারে সূরা ইয়াসিন পাঠরত অবস্থায় জুমার নামাজের পূর্ব ইন্তিকাল করেন।
‘আসমান তোমার কবরে শিশিরের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিক, সবুজ গালিচা তোমার এ ঘরকে ঢেকে রাখুক।’

তথ্যসূত্র: ড. ইউসুফ কারজাভী, আশ শায়খ আবুল হাসান আলী আন নদবী কামা আরাফতাহু
লেখক: শিক্ষক, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ