রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে আলিমসমাজের ভূমিকা

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ | 

আলিম শব্দ দ্বারা জ্ঞানীদেরকে বুঝালেও এর সাথে দ্বীনিজ্ঞানের সম্পৃক্ততা রয়েছে। যে কারণে হযরত মুহাম্মদ (সা) ‘আলিমগণকে নবীদের উত্তরাধিকার’ হিসেবে ঘোষণাও দিয়েছেন। রাসূলের (সা) অনুপস্থিতিতে কুরআনের সঠিক জ্ঞানের ভিত্তিতে ইসলামী সমাজকে পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁরা যথার্থ ভূমিকা পালন করবেন- এটা তাঁদের প্রধান দায়িত্ব। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) তাই ইলম চর্চা এবং আলিমগণকে মর্যাদার উচ্চাসন দান করেছেন এবং আলিমগণ সে দায়িত্ব যথাযথভাবে আঞ্জাম দেবার প্রয়াসও চালিয়ে আসছেন। আরবের বাইরের অঞ্চলে বিশেষত আমাদের বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে আলিমসমাজের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। রাজনৈতিকভাবে ইসলাম বিজয়ের পূর্বে এসব অঞ্চলে আলিমগণই ইসলামের সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন। স্থানীয়ভাবে আমরা তাদেরকে অলি, সুফি, ধর্মপ্রচারকসহ নানা বিশেষণে সংজ্ঞায়িত করেছি। মুসলমানগণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরও আলিমগণ শাসকগণকে সঠিক পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে ইসলামের সম্প্রসারণ এবং ইসলামের পূর্ণাঙ্গরূপ বাস্তবায়নে যথার্থ ভূমিকা পালনে সচেষ্ট থেকেছেন। তবে কোন কোন শাসকের নির্বুদ্ধিতা কিংবা স্বার্থান্বেষী চিন্তা-চেতনা আলিমগণের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বার্থান্বেষী ধামাধরা কিছু আলিম নামে পরিচিত ব্যক্তির সহায়তায় স্বার্থের বৈতরণী পার করে নিয়েছেন। আধুনিককালেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির লাখনৌতি বিজয়ের মধ্য দিয়েই মূলত বাংলা অঞ্চলে মুসলিম শাসনের যাত্রা হয়। কিন্তু সে সময়েও এখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিলো না। এখানে হিন্দু সংখ্যাগুরুর মাঝে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী বিদ্যমান ছিলো। প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক ময়দানে না হলেও আলিমগণ মুসলিম শাসক ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝখানে ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন। এ বিষয়ে ড. ইশতিয়াক হুসাইন কোরেশী তাঁর ‘উলামা ইন পলিটিকস’ গ্রন্থে বলেন- ‘আলিমগণ অব্যাহতভাবে শিক্ষার শুদ্ধতা রক্ষা করা, মুসলিম জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সংরক্ষণ করা এবং মুসলিম সাম্রাজ্যকে শক্তিশালী করার পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত তিনটি লক্ষ্যে কাজ করেছেন।’ তবে এ কথাও সত্য যে, মুসলিম সা¤্রাজ্য শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করলেও তাঁরা মুসলিম শাসকদের অন্ধ সমর্থক ও সাহায্যকারী ছিলেন না। শরীয়াহর যে কোনো সুস্পষ্ট লংঘনের ক্ষেত্রে তারা মুসলিম শাসকদের হুঁশিয়ার করতেন এবং প্রয়োজনে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেন।

সুলতানি ও মোগল আমল
সুলতানি, মোগল কিংবা স্বাধীন বাংলার মুসলিম শাসনামলেও আলিমসমাজের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। দ্বীনিশিক্ষার সম্প্রসারণ ও ইসলাম প্রচার-প্রসারের পাশাপাশি প্রশাসনের ভেতরে বা বাইরে থেকে তারা শাসকদেরকে ইসলামের সঠিক ধারায় এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এ কাজ করতে গিয়ে অনেক প্রসিদ্ধ আলিম শাসকদের দ্বারা নানামুখী নির্যাতনেরও শিকার হয়েছেন। সম্রাট আকবরের দ্বীন ই ইলাহির বিরোধিতা করে সঠিক ইসলামের ধারায় অটুট থাকার কারণে তাঁর দ্বারা অসংখ্য আলিম শহীদ এবং নির্বাসিত হয়েছেন। তিনি তাঁর প্রবর্তিত দ্বীন-ই-ইলাহির সাথে ভিন্নমত পোষণকারী কোনো আলিমকে ভারতবর্ষে বা তাঁর সাম্রাজ্যে থাকতে দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। নগণ্যসংখ্যক স্বার্থবাদী আলিম ছাড়া কোনো ন্যায়নিষ্ঠ আলিমের পক্ষেই দ্বীন-ই-ইলাহির সাথে যুক্ত হবার সুযোগ ছিলো না। তাই তাঁরা নির্যাতন-নির্বাসনের পথে যেতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি।

সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর ১৬০৫ সালে সেলিম জাহাঙ্গীর (১৫৬৯-১৬২৭) সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি সম্রাট আকবরের পথে না হাঁটলেও অনেক কুসংস্কার ও র্শিক আচরণ লালন করতেন। এ সময়ে মুজাদ্দিদ-ই-আলফি সানি নামে খ্যাত শাইখ আহমদ সরহিন্দী (১৫৬০-১৬২৬) বহুমাত্রিক বিভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে উদ্ধার করে রাষ্ট্রীয় নীতিপদ্ধতি ও আচার-আচরণে খাঁটি ইসলামী নীতিমালা অনুশীলন এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিজীবনে ব্যাপকভাবে অনুশীলিত বিচিত্রসব শরীয়াহবিরোধী আচরণ ও প্রথার বিলোপ সাধনের সংগ্রামে নিজের চারপাশে তিনি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অনুগামী ও সমর্থক সংগ্রহে সক্ষম হয়েছিলেন। সম্রাটের সম্মানে মস্তকাবনত করার অস্বীকৃতির কারণে দরবারি কিছু আলিম তাঁকে হত্যা করার জন্য সম্রাটকে পরামর্শ দেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর শাইখ আহমদকে জেলবন্দী করেন। এ সময় এ মহান সংস্কারকের সহায়-সম্পত্তিও লুট করা হয়। এক অথবা দু’বছরের কারাবাসের পর শাইখ আহমদকে মুক্তি দেয়া হয়। রাজপুত্র শাহজাহান অবশ্য এই সংস্কারকের গভীর অনুরাগী ছিলেন। কারামুক্তির পর জাহাঙ্গীরের সাথে এক বৈঠকে শাইখ আহমদ সম্রাটকে ধর্মতত্ত্বের কিছু বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা প্রদান করেন। শাইখ আহমদ সরহিন্দীর সুব্যবস্থিত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রমের ফলে এ সময়ে সম্রাট আকবরের সময়কালের উলামা বিরোধী রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের অবসান ঘটে, রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় আলিমগণের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রপর্যায়ে বিদ্যমান বিভ্রান্তিকর সুফিবাদী অনুশীলন ও প্রকাশ্য শরীয়াবিরোধী কার্যক্রমের ক্রমশ অবসান ঘটতে থাকে। শাইখ আহমদের এমন সংস্কার কার্যক্রম ও তার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের প্রেক্ষাপটেই তাঁকে ‘দ্বিতীয় সহ্রাব্দের সংস্কারক’ বা মুজাদ্দিদ ই আলফি সানি অভিধায় সম্মানিত করা হয়। সম্রাট আকবরের র্শিকপূর্ণ নব্যতন্ত্র দ্বীন ই ইলাহি থেকে অনেকাংশে মুক্ত ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীর। শাইখ আহমদের সংস্কার কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় জাহাঙ্গীর ক্রমশ ধর্মীয় শুদ্ধতা অর্জনে সক্ষম হন এবং সম্রাট শাহজাহান (১৫৯১-১৬৫৮) এ ধারায় আরো অগ্রসর হন। অতঃপর সম্রাট আওরঙ্গজেব (১৬১৮-১৭০৭) বাস্তবে নিখাদ শরিয়তি শাসনব্যবস্থা অনুসরণ করেন। এ জন্য তাঁকে মুহিউদ্দীন আলমগীর অভিধায় সম্মানিত করা হয়। মোগল সাম্রাজ্যের পরবর্তী শাসকগণের সময়ও আলিমগণ যথাযথ ভূমিকা পালনের প্রয়াস পেয়েছেন। সেইসাথে বাংলার স্বাধীন সুলতান ও নবাবী শাসন পরিচালনাতেও আলিমগণের ভূমিকা ছিলো প্রশংসনীয়।

ব্রিটিশ আমল
বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৭ সালে পলাশীর বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধে পরাজিত হলে উপমহাদেশে পরাধীনতার অধ্যায় শুরু হয়। সেই কোম্পানি আমল হতেই ইসলামের মূলধারা থেকে মুসলমানদের বিচ্যুত করার প্রয়াস চলে। পরিকল্পিত এ কর্মকাণ্ডে আলিমসমাজ সচেতনভাবে ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসেন। মীর নিসার আলী তিতুমীরের সংস্কার ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ হবার সুযোগ ঘটায়। ১৮৩১ সালের নভেম্বরে নারকেলবাড়িয়ার বাঁশের কেল্লার এক অসম যুদ্ধে তিতুমীরের বাহিনী পরাজিত হয় এবং তিতুমীরসহ তাঁর বাহিনীর সদস্যগণ জীবন দিয়ে দ্বীনি চেতনার প্রমাণ দেন। অন্যদিকে হাজী শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলন এবং ১৮৩১ সালের মে মাসে বালাকোটের যুদ্ধ ইসলাম রক্ষার এক চরম প্রচেষ্টা হিসেবে পরিগণিত। বিশিষ্ট আলিম সাইয়িদ আহমদ বেরলবী শহীদের (রহ.) (১৭৮৬-১৮৩১) নেতৃত্বে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। শত শত আলিম শাহাদত বরণের মধ্য দিয়ে দ্বীনি চেতনাকে সমুন্নত রেখেছেন। পরবর্তীতে ১৮৫৭ সালে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি-বিরোধী সিপাহি বিদ্রোহ নামে যে মহাবিদ্রোহ সংঘটিত হয়, তার সংগঠক ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলিমগণ। এটিই ছিলো স্বাধীনতাকামী উপমহাদেশবাসীর সম্মিলিত প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। উপমহাদেশব্যাপী আন্দোলনসমূহ পর্যাপ্ত পরিকল্পিত, সুব্যবস্থিত ও সুসমন্বিত না হওয়ায় বাহ্যিকভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কঠোর ও নির্দয় হাতে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করে। দিল্লির মাদরাসা-ই-রহিমিয়াসহ বিপ্লবের সূতিকাগার হাজার হাজার মাদরাসা ধ্বংস করা হয় এবং লক্ষ লক্ষ আলিমকে হয় ফাঁসি দেয়া হয় অথবা আন্দামানসহ বিভিন্ন গহিন দ্বীপে নির্বাসন দেয়া হয়। এভাবে রাজনীতিসহ মতপ্রকাশের সকল কার্যক্রমে আলিমদের অংশগ্রহণ অসম্ভব করে তোলা হয়। তবু নির্মূল করতে পারেনি আলিমগণের স্বাধিকার চেতনা এবং দ্বীন বিজয়ের আন্দোলনকে।

উলামার আধুনিক শ্রেণিবিন্যাস ও রাজনৈতিক ধারা
ইংরেজদের নানাবিধ নির্যাতন ও কৌশলের মুখে টিকে থাকতে গিয়ে আলিমশ্রেণি নানাভাবে বিভক্ত হয়ে ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস চালান। সরাসরি ব্রিটিশদের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে খুব বেশি ফল পাওয়া যাবে না মর্মে কোন কোন আলিম সমঝোতার ইঙ্গিতে কাজ করলেও এর বৃহৎ অংশই ব্রিটিশের সাথে সহযোগিতামূলক আচরণকে জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতার দৃষ্টিতে দেখেছেন। কেউ কেউ আবার ইসলামকে রাজনীতি থেকে মুক্ত রেখে শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার-আচরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে হলেও ঈমান আকিদা বাঁচিয়ে চলার নিমিত্তে কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তবে রাজনৈতিক চেতনা থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামের সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব নয় এ ধরনের বিশ্বাস ছিল অধিকাংশ হক্কানী আলিমের। সেই সূত্র ধরেই হাজারো সমস্যা মোকাবেলা করেই গড়ে উঠেছে নানা রাজনৈতিক প্লাটফর্ম।

বাংলাদেশের উলামার সর্ববৃহৎ ধারা দেওবন্দি। ব্রিটিশ-ভারতের দেওবন্দে ১৮৬৬ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী উলামার উত্তরাধিকারীরা একটি মাদরাসা স্থাপন করেন, নাম দেন ‘দারুল উলুম’। দেওবন্দ অঞ্চলে অবস্থানের কারণে মাদরাসাটি ‘দেওবন্দ মাদরাসা’ নামেই বেশি খ্যাতি পায়। ইসলাম শিক্ষার প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠান থেকে ‘ডিগ্রিপ্রাপ্ত’ (‘দাউরায়ে হাদিস’ ইত্যাদি) উলামা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েন। এই দেওবন্দি উলামার নেতৃত্বেই ১৯১৯ সালে ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনায় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ দলের ঘনিষ্ঠ ছিলো, তৎকালীন ‘সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের’ নয়। ১৯৪৫ সালে মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর অনুগামী দেওবন্দি উলামার একটি অংশ মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী ও মাওলানা জাফর আহমদ উসমানীর নেতৃত্বে ‘জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম’ নামে বিকল্প উলামা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। দেওবন্দি উলামার এ দু’অংশই মূলত বর্তমান বাংলাদেশের দরসে নেজামি বা কওমি মাদরাসাসমূহ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করছেন। এ ধারার উলামার বৃহৎ অংশ কওমি মাদরাসাসমূহের গঠন-পঠনে নিবেদিত। এ উলামার একটি অংশ আধ্যাত্মিক সাধনা এবং অন্য একটি অংশ প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশের বর্তমান কওমি মাদরাসাভিত্তিক উল্লেখযোগ্য উলামা রাজনীতি বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছেন। এক্ষেত্রে ‘হাফেজ্জী হুজুর’ নামে খ্যাত মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ্র অবদান স্মরণযোগ্য। বাংলাদেশে বর্তমান ‘দাওরায়ে হাদিস’ ডিগ্রি প্রদানকারী কওমি মাদরাসার সংখ্যা দেশে এক হাজার এবং ছোট-মাঝারি কওমি মাদরাসার সংখ্যা সাত হাজারের কিছু বেশি। এ মাদরাসাগুলো নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রীয় কোনো কর্তৃপক্ষ না থাকায় প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়া কষ্টসাধ্য। ‘বেফাকুল মাদারিস’ নামে বেশ কিছু কওমি মাদরাসা নিয়ন্ত্রণকারী একটি কেন্দ্র সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত হলেও এটি সারা দেশের সকল কওমি মাদরাসা নিয়ন্ত্রণ করে না। এ মাদরাসাগুলো মূলত বেসরকারি সাহায্য-সহযোগিতায় পরিচালিত হয়ে থাকে। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ‘হেফাজতে ইসলাম’ এ শ্রেণির আলিমগণের নেতৃত্বেই পরিচালিত হচ্ছে।

সতেরো’শ আশি সালে কলকাতা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আলিয়া মাদরাসা ধারার সূচনা হয়। বাংলাদেশে এখন তিনটি পূর্ণ সরকারি (ঢাকা, সিলেট ও বগুড়া) আলিয়া মাদরাসা রয়েছে। অবশিষ্ট আলিয়া মাদরাসাসমূহ সরকারি সাহায্যপুষ্ট হয়ে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। ইবতেদায়ি, দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল স্তরের মাদরাসার মোট সংখ্যা প্রায় সাড়ে বারো হাজার। বাংলাদেশে এ ধারাতেও বিপুল সংখ্যক উলামার অবস্থান। আলিম মাদরাসাসমূহের নিয়ন্ত্রণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড নামে একটি কর্তৃপক্ষ রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান ধারার রাজনীতি বিশেষত ইসলাম প্রতিষ্ঠার রাজনীতির সাথে এ ধারার উলামার সম্পৃক্ততা ও ভূমিকা খুব বেশি।

বাংলাদেশে পীর-মুরিদী ধারায়ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উলামাকে পাওয়া যায়। শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর উত্তরসূরি সাইয়েদ আহমদ বেরলবীর জিহাদ আন্দোলন বেশির ভাগ ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য পীর-মুরিদীর পথ বেছে নেন। মাওলানা কারামত আলী এ ধারার উল্লেখযোগ্য পীর। বাংলাদেশে এ ধারার (ফুরফুরা, জৈনপুর প্রভৃতি) বেশ ক’জন পীর ও তাদের খলিফা বা প্রতিনিধি রয়েছেন। শর্ষিনা, চরমোনাই, আটরশি, এনায়েতপুর, ফুলতলি প্রভৃতি স্থানকেন্দ্রিক প্রচুর সংখ্যক আলিম পীর প্রায় সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী পীর-মুরিদী ধারায় ইসলাম প্রচার-প্রসারে নিবেদিত রয়েছেন। ‘রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই ইসলামের বিজয় অনিবার্য’ হিসেবে এদের বৃহৎ অংশ এখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। সেইসাথে ইসলাম প্রচার-প্রসারে বাংলাদেশে চার তরিকার (ক. মুজাদ্দেদিয়া, খ. কাদেরিয়া, গ. চিশ্তিয়া ও ঘ. নখ্শবন্দিয়া) অনুসারী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উলামা রয়েছেন। বেশ কিছু খান্কাহ্-সিলসিলাকেন্দ্রিক কার্যক্রমেও সংশ্লিষ্ট রয়েছেন বেশকিছু আলিম। এ ধারার আলিমগণ এখনও ইসলামী রাজনীতিরই মূল ধারায় নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারেননি।

শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর অনুসারীদের ধারাতেই বাংলাদেশে বিস্তৃত হয়েছে আহলে হাদিস উলামার একটি উল্লেখযোগ্য ধারা। দিনাজপুরের আলিম-রাজনীতিক ‘আবদুল্লাহিল বাকী এবং আবদুল্লাহিল কাফী’ ভ্রাতৃদ্বয় বাংলাদেশ অঞ্চলে আহলে হাদিস ধারার জনগোষ্ঠী ও উলামাকে সংগঠিত করেছেন। প্রফেসর ডক্টর আল্লামা আবদুল বারীর নেতৃত্বে আহলে হাদিস জনগোষ্ঠী ও উলামা সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় ঐক্যবদ্ধ থেকেছেন দীর্ঘদিন। পরে ১৮৮৯ ও ২০০০ সালে এ ধারায় বেশ কিছু বিভাজন সৃষ্টি হয়। এদের কোন কোন অংশ রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরির পথে পা বাড়ালেও এখনো ধর্মীয় রাজনীতির মূলধারায় আসতে পারেনি।

আধুনিককালের রাজনীতি ও আলিম সম্প্রদায়
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে তুরস্কের উসমানিয়া খেলাফত খণ্ডিত করার ব্রিটিশ উদ্যোগের প্রতিবাদে পুনরায় উপমহাদেশের আলিমসমাজ ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত হন এবং মুসলিম খেলাফত রক্ষার দাবিতে ‘খেলাফত আন্দোলন’ (১৯১৯-১৯২২) গড়ে তোলেন। এ আন্দোলন লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলেও এর মাধ্যমে উপমহাদেশের আলিমগণ রাজনীতিতে সক্রিয়, সংগঠিত ও সোচ্চার হয়ে ওঠেন। এ সময় দেওবন্দ মাদরাসার (দারুল উলুম দেওবন্দ) শিক্ষক মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানীর (১৮৭৯-১৯৫৭) নেতৃত্বে ১৯১৯ সালে উলামা-মঞ্চ হিসেবে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ গঠিত হয়। এ সংগঠনটির সাথে সংশ্লিষ্ট আলিমগণ ক্রমশ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫)-এর রাজনৈতিক ধারার প্রতি ঝুঁকে পড়তে থাকেন। এক্ষেত্রে কংগ্রেস নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদের কুশলী ও সক্ষম আকর্ষণী শক্তি প্রধান ভূমিকা পালন করতে থাকে। তবে রাজনৈতিক কর্মপ্রক্রিয়া ও কৌশলের ভিন্নতার প্রেক্ষাপটে এই আলিমদের একটি অংশ মাওলানা আশরাফ আলী থানবী ও মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানীর নেতৃত্বে ১৯৪৫ সালে ‘জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই উলামা সংগঠনটি কংগ্রেসের তুলনায় মুসলিম লীগকে (১৯০৬) ভারতের মুসলিমদের যথার্থ প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠন বলে স্বীকার করে এবং মুসলিম লীগের ‘পাকিস্তান’ দাবির প্রতি সমর্থন জানায়। ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট সাইয়েদ আবুল ‘আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। আধুনিক রাজনৈতিক কর্মকৌশলসহ প্রতিষ্ঠিত এ দলে ধর্মীয় শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষা শিক্ষিত ব্যক্তিদের একটি সমন্বয় ঘটে, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ বা জমিয়তে উলামাকে ইসলাম-এ যা অনুপস্থিত থাকে। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ অবিভক্ত স্বাধীন ভারত এবং জমিয়াতে উলামায়ে ইসলাম মুসলিম আবাসভূমি স্বাধীন পাকিস্তানের জন্য সক্রিয় থাকে। বিপরীতে জামায়াত ইসলামী হিন্দ একটি আদর্শবাদী ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা করে এবং অবিভক্ত ভারত অথবা মুসলিম আবাসভূমি পাকিস্তান বিষয়ে বাড়তি আগ্রহ প্রকাশ থেকে বিরত থাকে।

১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে স্বাধীন পাকিস্তান ও ভারতের আত্মপ্রকাশ ঘটে। পাকিস্তানে মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানীর নেতৃত্বে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সংগঠিত হয়। ‘জমিয়তে উলামায়ে পাকিস্তান’ নামে ‘বেরলবী আলিমগণ’ ১৯৪৮ সালে সংগঠিত হলেও তারা রাজনীতিতে পর্যাপ্ত সক্রিয় হতে পারেননি। জামায়াতে ইসলামী হিন্দ যথারীতি পাকিস্তান ভূখণ্ডে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান নামে সংগঠিত হয়ে তাদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে। পাকিস্তানে আলিম নেতৃত্বের দলসমূহ দেশটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করলেও কার্যত কিছু নীতি প্রণয়ন ছাড়া ইসলামী রাষ্ট্রের আর কিছুই পাকিস্তানে বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে আলিম নেতৃত্বের দলসমূহ (জামায়াত, জমিয়ত, নেজাম প্রভৃতি) তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৬.৯৩% ভোট পেয়ে ভোটের সংখ্যাগত দিক থেকে দ্বিতীয় স্থান লাভ করে।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। নিজেদের মাটিতে নিজের মতো করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার প্রত্যাশা থাকলেও ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার কারণে আলিমসমাজ ভীষণভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। স্বাধীনতার পরপরেই আলিমসমাজের উপর নেমে আসে দুর্বিষহ নির্যাতন। নানা অজুহাতে অসংখ্য আলিমকে হত্যা করা হয়। জেলে বন্দি করা হয় হাজার হাজার আলিমকে। অতঃপর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সকল রাজনৈতিক দলসমূহের মতো আলিমগণও রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পান এবং নতুন প্রক্রিয়ায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি শুরু করেন। মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, মাওলানা এ কে এম ইউসুফসহ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ, নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফতে রব্বানী পার্টি, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং ইমারত পার্টির সমন্বয়ে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ গঠিত হয়। কিন্তু সে ঐক্য খুব বেশিদিন টিকে থাকেনি। অতি অল্পদিনের মধ্যেই ইসলামী রাজনৈতিক দলসমূহ নিজস্ব নামে আবারো মাঠে ময়দানে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৮৭ সালের ৩ মার্চ ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন এবং ১৯৮৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ গঠিত হয়। সেই সাথে ইসলামী ঐক্যজোটসহ আরো কিছু ইসলামী রাজনৈতিক দল কর্মকাণ্ড শুরু করলে রাজনৈতিক ময়দানে আলিমদের অংশগ্রহণে নতুন মাত্রা যোগ হয়।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের আলিমসমাজের একটি বৃহত্তম অংশ সরাসরি ইসলামী রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আল্লাহর জমিনে তাঁর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ভূমিকা রেখে চলেছেন। এক্ষেত্রে স্থানীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে অনেকেই জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়ে জাতীয় সংসদে ইসলামের পক্ষে ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছেন। আর কেউ বা চলমান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েও রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ভূমিকা পালন করেছেন। তবে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি ইসলামের পক্ষে নানা ইস্যুতে আলিমসমাজের ভূমিকাও ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। বিশেষকরে তসলিমা নাসরিনসহ ইসলামবিদ্বেষী লেখকদের লেখালেখি, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোট ডিভিশনের ফতোয়া নিষিদ্ধ রায়, নারী উন্নয়ন নীতিমালা, নতুন শিক্ষানীতি এবং নাস্তিক ব্লগারদের ইসলাম বিরোধী প্রচারণা ও ঔদ্ধত্যপনাসহ নানামুখী ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আলিমসমাজের সোচ্চার আন্দোলন ইসলামী রাজনৈতিক ময়দানে নতুন দিকের উন্মোচন করেছে বৈকি। মসজিদের খুতবা ও তাফসির মাহফিলের ওয়াজ-নসিহত ও বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে ইসলামের মূল চেতনাকে তুলে ধরার মাধ্যমেও দ্বীন ইসলামের সঠিক চেতনাকে উপস্থাপনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। সর্বোপরি সরকারের সাম্প্রতিককালে গৃহীত পদক্ষেসমূহের বিরুদ্ধে আলিমসমাজের সোচ্চার ভূমিকা এ আশাই জাগ্রত করে যে, নবীর ওয়ারিশরা বেঁচে থাকতে বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে ইসলামকে কলঙ্কিত করার ক্ষমতা কারোই নেই। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের অস্তিত্ব যতদিন থাকবে আলিমসমাজও ইসলামের পূর্ণাঙ্গ দর্শনকে উচ্চকিত রাখার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

লেখক : কবি ও গবেষক; প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়