মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের প্রতি মহানবি ﷺ-এর অপরিসীম উদারতা

রেদওয়ান রাওয়াহা | 

মুনাফিকি-গাদ্দারি আর বেঈমানির রেকর্ড তালাশ করলে যে ব্যক্তিটির নাম সর্বপ্রথম উঠে আসবে, সে হলো আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সূলুল। হেন কোনো ষড়যন্ত্র নেই, যা সে রাসুলে কারিম ﷺ-এর জন্য, মুসলিমদের জন্য করেনি। নিফাকির নজিরবিহীন উদাহরণ আছে তার বিরুদ্ধে। কতোভাবেই না আল্লাহর রাসূলকে সে কষ্ট দিয়েছে। উহুদের যুদ্ধে পেছন থেকে ৩০০জন মুজাহিদ নিয়ে ভেগে গেছে। আল্লাহর রাসুলের সাহাবিদেরকে যেনো মদিনাবাসী দান না করে, সে ব্যাপারে উস্কানি দিয়েছে। এতোটুকুন করেই থেমে থাকে নি সে। একযুদ্ধে সে তাঁর অনুসারী মুনাফিকদের বললো,

মদিনায় ফিরলে সম্মানিতরা (সে এবং তাঁর অনুসারী মুনাফিকরা) নিকৃষ্টদের (নবিজি ও তাঁর সাহাবাদেরকে সে নিকৃষ্ট বলেছে) বের করে দেবে। [আল-কুরআন : ৬৩/০৭-০৮]

দ্বীন প্রচারের কাজে সে আল্লাহর রাসুলকে কতোভাবেই না কটুক্তি করেছে। কতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য ব্যক্তিগতভাবেও করেছে। একদিন রাসুল ﷺ নিজের বাহনে করে যাবার সময় তার সামনে পড়লে, সে বলে সরে যাও। তোমার গাধার গন্ধ আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আরো একবার আল্লাহর রাসুল ﷺ তার সাথে একদল লোককে দেখতে পেয়ে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন। তখন সে আল্লাহর রাসুল ﷺ-কে বললো;
সরে যাও, এখানে আমাদের নিজস্ব মিটিং চলছে। বিরক্ত করবে না। তুমি এসব কথা তাদেরকেই বলবে, যারা নিজ থেকে তোমার কাছে তা শুনতে চাবে। তুমি যা কিছু বলবে, তা কিছুতেই আমি ভালো মনে করবো না। এবং তা যদি সত্য-ও হয়, তবুও। [মা’আল মুস্তফা-১৫৯]

ইসলামের দাওয়াত, দ্বীনের শিক্ষা পৌঁছে দিতে দেখলে তো একজন খাঁটি মুমিনের অন্তরে প্রশান্তির জোয়ার নেমে আসাটাই ছিলো স্বাভাবিক। অথচ সে কী এক উন্মাষিকতা নিয়ে রাসুল্লাহ ﷺ-কে অবজ্ঞা করেছে। আল্লাহর রাসুলের প্রিয়তমা স্ত্রী, উম্মুল মুমিনীন আয়িশা রাস্বিয়াল্লাহু আনহার নির্মল পবিত্র চরিত্র ও সতীত্ব নিয়েও দুর্নাম রটিয়েছে। রাসুল্লাহ ﷺ-এর স্ত্রী এবং তাঁর ইজ্জতের ওপর আঘাত হেনেছে। কিন্তু আল্লাহর রাসুল ﷺ তাকে সব সময়ই ক্ষমা আর উদারতা দিয়ে গিয়েছেন। তার এমন মুনাফিকির জন্য একাধিক সাহাবি তাকে হত্যা করতে চেয়েছে, স্বয়ং তার ছেলেও তাকে খুন করতে নবিজির কাছে আবেদন করেছে। কিন্তু মানবিক মহাপুরুষ মুহাম্মাদ ﷺ তাকে তা করতে নিষেধ করেছেন।

যখন সে মৃত্যু শয্যায় শায়িত, তখন-ও তাকে উপদেশ প্রদান করেছেন, নাসীহা প্রদান করেছেন, ঈমানের ব্যাপারে। এরপর যখন মৃত্যু বরণ করলো সে, তখন তিনি নিজের জামাটা দিলেন তার গায়ে। নিজের মুখের লালা দিলেন তার মুখে। তার জানাযা পড়ালেন নিজে। কবরে শায়িত করেছেন নিজের কোলের ওপর রেখে। যখন তিনি জানাযা পড়াতে যান, তখন সাঈয়িদুনা ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নবিজির জামা টেনে ধরেছেন। এই বদমাশ মুনাফিক নেতার জানাযা পড়াতে নিষেধ করেছেন। একে একে তার অতীত কর্মকাণ্ডগুলো নবিজির সামনে তুলে ধরতে লাগলো। আল্লাহর প্রিয় হাবীব, মানবতার নবি সাঈয়িদুনা ওমর ফারুককে লক্ষ্য করে বললো হে ওমর, আল্লাহ তো আমাকে নিষেধ করেনি। আল্লাহ আমাকে সুযোগ দিয়েছেন। অবশেষে আল্লাহর রাসুল তার জানাযা পড়ালেন। কিন্তু সাঈয়িদুনা ওমরের সীদ্ধান্তের সাথে আল্লাহও একমত হয়ে রাসুলে কারিম ﷺ-এর কাছে ওহী অবতীর্ণ করে জানিয়ে দিয়ে বললেন—
হে নবি! আপনি যদি তার জন্য সত্তরবারও ক্ষমা চান, তবুও তাকে ক্ষমা করা হবে না। [আল-কুরআন: ০৯/৮০] এরপরও আল্লাহর নবি বলেছেন যদি সত্তরের বেশি তাওবা করলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হতো, তবে আমি তা-ই করতাম। কিন্তু আল্লাহ সু-স্পষ্টরূপে তাঁর নবিকে নিষেধ করে দিয়ে বলেন— “ আগামীতে যদি এদের কেউ মারা যায়, আপনি তাদের জানাযা পড়াবেন না। তাদের কবরের পাশে দাঁড়াবেন না”। [আল-কুরআন : ০৯/৮৪]

দেখুন, যে ব্যক্তিটি আল্লাহর রাসুলের সার্বক্ষণিক ক্ষতি চাইতো। ইসলামি লেবাসে যে ব্যক্তিটি ইসলামের সাথে সবচেয়ে বেশি দুশমনি করেছে, নবিজির নিষ্কলুষ পূত-পবিত্র স্ত্রীর সতীত্বের ওপর মিথ্যের প্রলেপ লাগিয়ে দিতে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে, নানাভাবে নবিজিকে বিপদে ফেলেছে, অপমানিত করতে চেষ্টা করেছে— এমন একজন মানুষকে, এরকম সুস্পষ্ট টাটকা মুনাফিককে এমন উদারতা, ভালবাসা, কল্যাণকামিতা, সহমর্মিতা, ক্ষমা ও মানবিকতা প্রদর্শন করতে পেরেছে; পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত আর দ্বিতীয়টির নজির নেই।

তায়েফে দাওয়াতি কাজের দিনের দিকেই তাকান, আল্লাহর রাসুল বড়ো আশা নিয়ে তাদের কাছে দ্বীনের সৌরভ ছড়াতে গিয়েছেন। কিন্তু তারা কী নৃশংসভাবেই না জখমই করেছে তাঁর দেহকে, তাঁর মনকেও। পাথরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়ার পরেও তিনি তাদের অভিশাপ করেন নি। তাদের ধ্বংস কামনা করেন নি। জিবরাঈল এসে নবিয়ে রহমত রহমাতাল্লিল আ’লামিনের কাছে তাদেরকে শায়েস্তা করার অনুমতি চাইলে তিনি উত্তর দেন; তারা না বুঝে এমন করেছে। তাদের যদি ধ্বংস করা হয়, তাহলে আমি দ্বীনের দাওয়াত দেবো কার কাছে? মহানবি মুহাম্মাদ ﷺ এরকম জঘন্যতম কাফির-মুশরিকদেরকেও কখনোই বদদু’আ করেন নি। অভিশাপ দেন নি। এটি-ই প্রমাণ করে তিনি কতোটা মানব দরদি ছিলেন। তিনি যে বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ ছিলেন, ছিলেন রহমাতুল্লিল আলামিন এটিও তাঁর অন্যতম একটি উদাহরণ। তাই তো তিনি বলেছিলেন;
‘আমি অভিশাপকারীরূপে প্রেরিত হই নি, আমি কেবল করুণারূপে প্রেরিত হয়েছি।’ [মুসলিম : ৪৭০৭, মিশকাত : ৫৮১২]

তিনি মানুষকে নিয়ে কতো বেশি ভাবতেন, কতো বেশি চিন্তা করতেন, মানুষগুলো যখন আল্লাহদ্রোহী হয়ে নিজাহান্নামের আগুন-আজাবের দিকে নিজেকে ঠেলে দিচ্ছে, তিনি তখন তাদেরকে তা থেকে বাঁচানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠতেন। মহান আল্লাহ তাঁর এ অবস্থাকে কালামেপাকে বর্ণনা করেছেন এভাবে—
‘আর সম্ভবত আপনি আপনার জীবনকে তাদের পেছনে শোকে-দুঃখে ধ্বংস করে দেবেন যদি তারা ঈমান না আনে।’ [আল-কুরআন : ১৮ /০৬]

একইভাবে আল্লাহ অন্যত্র বলেন—
‘তাদের জন্য আক্ষেপ ও দুঃখে যেনো তোমার জীবন নিঃশেষ না হয়ে যায়’। [আল-কুরআন : ৩৫/০৮]

আসলে বিশ্বনবির জীবনীর প্রত্যেকটা দিক-বিভাগ নিয়ে অসংখ্য অসংখ্য বই-পুস্তক রচনা হয়েছে, এবং ভবিষ্যতেও হবে। তবুও তাঁর মহাপবিত্র অসীম জীবনের কোনো কূল-কিনারা পাওয়া যাবে না। মহানবি মুহাম্মাদ ﷺ-এর মানবিকতা নিয়ে শুধু কয়েক পৃষ্ঠার প্রবন্ধ-নিবন্ধ নয়, অসংখ্য-অগণিত বই-ও তৈরি হতে পারে। মানুষ ও মানবতার এমন কোনো দিক-বিভাগ নেই, যেই দিক-বিভাগ নিয়ে তিনি কথা বলেন নি। আলোচনা করেন নি। কাজ করেন নি কিংবা দিক নির্দেশনা প্রদান করেন নি। আমরা তাঁর আনিত জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের একজন সৈনিক হিসেবে তাঁর জীবনের দিক-বিভাগ চর্চা করবো, নিজেদের জীবনে সেটার প্রতিফলন করবো; এই হচ্ছে কাম্য। আবার মানুষ হিসেবে, মানুষের সাথে কাজ করার ক্ষেত্রে, মানুষকে ইসলাম ও ইসলামি আন্দোলনের পতাকাতলে সহজেই সমবেত করতে চাইলে তাঁর মতো সুউচ্চ মানবিকতা আর দারাজ দিলের অধিকারী হতে হবে। তাঁর মাহাত্ম্য -উদারতা-ক্ষমা-মানবিকতার বর্ণনা দিয়ে ঐতিহাসিক গিবন বলেন —
” In the long history of the world, there is no instance of magnanimity and forgiveness which can approach those of Muhammad (S.) when all his enemies lay at his feet and he forgave them one and all. “

“মুহাম্মদ ﷺ তাঁর পায়ের কাছে অবনত অবস্থায় সকল শত্রুকে পেয়েও তাদেরকে ক্ষমা করে ঐদার্য ও ক্ষমাশীলতার যে অনুপম আদর্শ প্রদর্শন করেছেন, তার দ্বিতীয় কোন নজির দুনিয়ার সুদীর্ঘ ইতিহাসে নেই।”