ইসলামী আন্দোলনের প্রাণ আনুগত্য, পরামর্শ ও ইহতেসাব

ইসলামী আন্দোলন করা যেমনি ফরজ ইসলামী সংগঠনে নির্ভেজাল আনুগত্য করাও তেমনি ঈমানের অপরিহার্য দাবি। শরীরে জীবনীশক্তি না থাকলে মানুষ যেমন গতিশীলতা হারিয়ে ফেলে তেমনি আনুগত্য, পরামর্শ ও ইহতেসাব না থাকলে সংগঠনের গতিশীলতা স্তিমিত হয়ে যায়। সংগঠনের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। সাংগঠনিক সুস্থতা, সংশোধন, গতিশীলতা ও সুন্দর পরিবেশের জন্য আনুগত্য, পরামর্শ ও ইহতেসাব গুরুত্বপূর্ণ।

আনুগত্য কী
আনুগত্য শব্দটি বাংলা, আরবি শব্দের অর্থ ইতায়াত এর অর্থ মান্য করা, মেনে চলা, আদেশ-নিষেধ পালন করা প্রভৃতি অর্থে ব্যবহত হয়। যেমন- কর্তৃপক্ষের ফরমান অনুযায়ী কাজ করা। আনুগত্য শব্দটি তিনটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়: ১) সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়া, ২) কোরবানি করা। যেমন- মতবাদের কোরবানি, অর্থের কোরবানি, সময়ের কোরবানি, শ্রমের কোরবানি, আরাম-আয়েশের কোরবানি, ৩) উচ্চতর শক্তি বা ব্যক্তির আদেশ মানা।

ইসলামী শরিয়তের ভাষায়, আল্লাহ ও রাসূল (সা)কে নিরঙ্কুশভাবে মেনে নিয়ে ইসলামী সংগঠনের যাবতীয় ভালো কাজে নিজের মতামতকে কোরবানি করে দিয়ে সন্তুষ্টচিত্তে আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ মেনে চলাকে আনুগত্য বলে।

আনুগত্যের গুরুত্ব
সংগঠনের শৃঙ্খলার মূল উপাদান হচ্ছে আনুগত্য। যে সংগঠনে আনুগত্য নেই, সেই সংগঠনে শৃঙ্খলা নেই। প্রাণহীন একটি সুন্দর দেহের যেমন মূল্য নেই, আনুগত্যবিহীন সংগঠনেরও তেমনি মূল্য নেই। কুরআন ও হাদিসের আলোকে আনুগত্যের গুরুত্ব তুলে ধরা হলো:

# আনুগত্য করা ফরজ এটা আল্লাহর নির্দেশ- ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে মেনে চল এবং রাসূলকে মেনে চল। আর তোমাদের মধ্যে যাদের হুকুম দেয়ার অধিকার আছে তাদেরকেও মানো।’ (সূরা নিসা : ৫৯)
# আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার উপায়- ‘হে নেবী! মানুষকে বলুন, যদি সত্যি তোমরা আল্লাহকে মহব্বত কর, তাহলে আমার অনুসরণ কর; তবেই আল্লাহ তোমাদের মহব্বত করবেন এবং তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন। আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।’ (সূরা আলে ইমরান : ৩১)
# হেদায়াতপ্রাপ্তির পূর্বশর্ত (সূরা নূর : ৫৪)
# আল্লাহর দয়া পাওয়ার উপায় (সূরা আলে ইমরান : ১৩২)
# আনুগত্য মুমিনের কাম্য (সূরা শু’আরা : ১৩১)
# আনুগত্যহীনতা আমলকে বরবাদ করে (সূরা মুহাম্মদ : ৩৩)
# সফলতার হাতিয়ার (সূরা নূর : ৫২)
# আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্ত লোকদের সঙ্গী বানায় (সূরা নিসা : ৬৯)
# ঈমানের অপরিহার্য দাবি (সূরা নূর : ৫১)
# আনুগত্য স্বেচ্ছায় করতে হবে (সূরা নিসা : ৮০)
# আনুগত্য সৎকাজে, অসৎ কাজে নয় (সূরা নূর : ৬২ ও মায়েদা : ২)
# ব্যক্তির পরিবর্তে আনুগত্য পরিবর্তন করা যাবে না (সূরা আলে ইমরান : ১৪৪)

হাদিসের আলোকে
# আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যম : রাসূলে করিম (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল সে আল্লাহর আনুগত্য করলো, যে ব্যক্তি আমাকে অমান্য করলো সে আল্লাহকেই অমান্য করলো। আর যে ব্যক্তি আমিরের আনুগত্য করলো, সে আমারই আনুগত্য করলো। যে ব্যক্তি আমিরের অবাধ্য হলো সে আমারই অবাধ্য হলো। (বুখারি)
# সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভিত্তি- লা ইসলামা ইল্লা বিল জামায়াত, লা জামায়াতা ইল্লা বিত্তয়াত- সংগঠন ছাড়া ইসলাম নেই, আনুগত্য ছাড়া সংগঠন নেই (হযরত উমর ফারুক রা)
# পছন্দ হোক আর না হোক আনুগত্য করা ফরজ (বুখারি-মুসলিম ও বুখারি)
# সুদিনে-দুর্দিনে খুশি এবং বেজার সকল অবস্থায় আনুগত্য করা ফরজ (মুসলিম)

আনুগত্যের ভিত্তি
আনুগত্যের ভিত্তি হলো ঈমান। যার ঈমান যত বেশি পরিচ্ছন্ন এবং নির্ভেজাল তার আনুগত্য তত বেশি পরিচ্ছন্ন এবং নির্ভেজাল। যার ঈমান যত মজবুত ও সুন্দর তার আনুগত্য তত মজবুত ও সুন্দর। কতিপয় অনুসরণীয় আনুগত্যের উদাহরণ: আনুগত্যের সর্বাগ্রে হযরত আবু বকর (রা)-এর নাম উল্লেখ করা যায়। যিনি রাসূল (সা)-এর পক্ষ থেকে হিজরতের ইঙ্গিত পেয়ে রাসূলের অপেক্ষায় প্রহর গুনেছেন। হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা) হযরত ওমর (রা)-এর নির্দেশ পেয়ে যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় সেনাবাহিনীর শিরস্ত্রাণ খুলে দিয়ে নতুন সেনাপতির মাথায় পরিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেছিলেন। হযরত আবু জান্দাল মক্কার মুশরিকদের দ্বারা নির্যাতিত অবস্থায় শিকল নিয়ে হুদাইবিয়ার সন্ধিস্থলে উপস্থিত হয়ে আল্লাহর নবী ও সাহাবীদের কাছে আশ্রয় চেয়েছিলেন। কিন্তু রাসূল (সা)কে সন্ধির খাতিরে আবু জান্দালকে আবার মক্কায় ফিরে যেতে নির্দেশ দিলেন। আবু জান্দাল ও উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে মনের কষ্ট চাপা দিয়ে সেদিন রাসূল করীম (সা)-এর নির্দেশ মেনে নিয়েছিলেন।

আনুগত্যের সীমা
# শরিয়তের সুস্পষ্ট বিধানের পরিপন্থী নয় এমন সব কাজেই আনুগত্য করতে হবে। আনুগত্য কেবল মারুফ কাজে।
# স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে কোনো সৃষ্টির আনুগত্য করা চলবে না।
# গুনাহের নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নেতার নির্দেশ শ্রবণ ও পালন প্রত্যেকের জন্য অবশ্য কর্তব্য। গুনাহের নির্দেশ দেয়া হলে আনুগত্য পাওয়ার অধিকার তার নেই।
# “গোনাহ ও খোদা নির্ধারিত সীমালংঘনমূলক পরস্পরের সহযোগী হয়ো না।” (সূরা মায়েদা : ২ ) এ প্রসঙ্গে হযরত উমর ফারুক (রা) বলেছেন, বন্ধুগণ তোমাদের কেউ যদি আমার নীতি বা কাজকে বক্র দেখে তাহলে আমার এই বক্রতাকে সোজা করে দেয়া তার কর্তব্য হয়ে দাঁড়াবে।
# আনুগত্য হচ্ছে জান্নাতপ্রাপ্তির অন্যতম উপায়।
# সকল সময়, সকল অবস্থায় আনুগত্য করতে হবে। তোমরা শ্রবণ কর ও আনুগত্য কর যদি তোমাদের ওপর কোন হাবশি গোলামকেও কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয় এবং তার মাথা দেখতে আঙ্গুরের মত (ছোট) হয়। সহজ অবস্থায় ও কঠিন অবস্থায় এবং সন্তুষ্টচিত্তে ও অসন্তুষ্টচিত্তে তথা তোমার অধিকার নস্যাৎ হওয়ার ক্ষেত্রে শ্রবণ করা ও আনুগত্য করা তোমার কর্তব্য। প্রত্যেক মুসলিমের ওপর নেতার নির্দেশ শ্রবণ করা ও আনুগত্য করা অবশ্য কর্তব্য। তাই তা তার পছন্দ হোক বা অপছন্দ হোক, যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহর নাফরমানির নির্দেশ দেয়া হয়। আল্লাহর নাফরমানির নির্দেশ দেয়া হলে তা শ্রবণ করা ও আনুগত্য করা যাবে না। (বুখারি ও মুসলিম)
# “তোমাদের কেউ যদি তার আমিরের মধ্যে কোনো রূপ অপ্রীতিকর বিষয় লক্ষ্য করে, সে যেন ধৈর্য ধারণ করে।” (বুখারি ও মুসলিম)
# হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের ওপর যখন এমন আমির ক্ষমতায় আসীন হবে যারা তাদের অধিকার আমাদের নিকট থেকে পুরোপুরি আদায় করে নিতে চাইবে এবং আমাদের অধিকার দেবে না তখন আমরা কী করবো? রাসূল (সা) প্রশ্নকর্তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করলেন না। সালামাহ আবার জিজ্ঞেস করলেন। রাসূল (সা) বললেন, “তোমরা শ্রবণ করবে ও আনুগত্য করে যাবে। কারণ তাদের বোঝা তাদের ওপর। তোমাদের বোঝা তোমাদের ওপর।” (মুসলিম)

কাদের বা কিসের আনুগত্য করতে হবে
# আল্লাহ, রাসূল ও নেতার।
# সংবিধান, ঐতিহ্য, কর্মনীতি
# প্রতিনিধি, চিঠি, সার্কুলার, ঘোষণা।
# সংগঠনের নির্দেশ, পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত
# সংগঠনের সিস্টেম, নিয়ম-শৃঙ্খলা ও সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত।

কিসে আনুগত্য নষ্ট করে
# আখেরাতের তুলনায় দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দেয়া (সূরা তওবা : ৩৮, ১১১, সূরা নিসা : ৭৪)
# আনুগত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা
# গর্ব-অহঙ্কার মুক্ত থাকা (সূরা বাকারা : ৩৪, সূরা লোকমান : ১৮, নাহল : ২৯)
# হিংসা-বিদ্বেষ (সূরা ফালাক)
# সিনিয়রিটি জুনিয়রিটি মনোভাব- ১৭ বছরের যুবক উসামা (রা)কে যুদ্ধের সেনাপতি নিযুক্ত করেছেন এবং তার অধীনে বড় বড় সাহাবীরা যুদ্ধ করেছেন।
# মেজাজের ভারসাম্যহীনতা
# পদের প্রতি লোভ
# দায়িত্বশীলদের পছন্দ না হলে
# মানোন্নয়নে বিলম্ব হওয়া
# সন্দেহ প্রবণতা
# মতামতের কোরবানি করতে না পারা
# হৃদয়ের বক্রতা
# মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্ন
# বন্ধু-বান্ধবদের দাবি পূরণ করতে গেলে আনুগত্যের পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়।
# পরিবার-পরিজনের চাপ
# নিজেকে অতীব যোগ্য মনে করা (সূরা আরাফ : ১২)
# সুযোগসন্ধানী ও সুবিধাবাদী মনমানসিকতা

আনুগত্য পেতে দায়িত্বশীলদের করণীয়
# কর্মীদের সাথে ইনসাফপূর্ণ আচরণ করা (সূরা নাহল : ৯০)
# জনশক্তিকে কুরআন-সুন্নাহ থেকে সংগঠন বুঝতে প্রেরণা দেয়া (সূরা জুমার : ৯)
# কর্মীদের প্রতি নম্ন কোমল ও রহমদিল হওয়া (সূরা আলে ইমরান : ১৫৯)
# অধস্তন ভাইদের দোষ-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা (সূরা আশ-শূরা : ৪৩)
# সহযোগীদের সাথে পরামর্শ করে কাজ করা (সূরা আশ-শূরা : ৩৮)
# কর্মী ভাইদের জন্য দোয়া করা এবং পরস্পর দোয়ার পরিবেশ তৈরি করা।

দায়িত্বশীলদের মাঝে অপছন্দনীয় কিছু দেখলে হাদিসের আলোকে তার সমাধান
# সবর করা।
# আল্লাহর নিকট দোয়া করতে হবে।
# আনুগত্য করে যেতে হবে, পছন্দ হোক বা না হোক।
# সংগঠন ছাড়া যাবে না, নিষ্ক্রিয় হওয়া যাবে না।
# নেতৃত্বের সাথে লেগে থাকা।

আনুগত্যের পদ্ধতি
# নিজের উদ্যোগে নির্দেশ জেনে নেয়া।
# ভালোভাবে কাজ বুঝে নেয়া/ শ্রবণ করা।
# কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেয়া।
# কাজ বেশি হলে গুরুত্ব অনুযায়ী ক্রম ঠিক করা।
# গুছিয়ে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হওয়া।
# অবস্থা এবং সমস্যা দায়িত্বশীলকে জানানো।

আনুগত্যকারীর গুণাবলি
# এ কাজই আখেরাতের মুক্তির পথ- এ গুরুত্ব উপলব্ধি করা।
# মানসিক প্রস্তুতি- যে কোনো সময় যে কোন কাজ করার জন্য।
# সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ ও আন্তরিকতার সাথে পালন।
# যে কোনো ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত।
# ওজর পেশ করার মানসিকতা পরিহার।
# নেতৃত্বের প্রতি গভীর আস্থা।
# নেতা ও সংগঠনের জন্য দোয়া করা।
# সময়ানুবর্তিতা ও যথার্থ পদ্ধতি প্রয়োগ।
# সঠিক পন্থায় ইহতেসাব।
# ছোট বড় সব কাজকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা।

আনুগত্যের ক্ষেত্রে বর্জনীয়
# খিটখিটে মেজাজ পরিহার করা।
# তর্ক-বিতর্ক পরিহার করতে হবে।
# সংবাদদাতার কাছে রাগ প্রকাশ করা যাবে না।

আনুগত্যহীনতার পরিণাম
# হেদায়াত লাভের তাওফিক থেকে বঞ্চিত হবে (সূরা নূর : ৫৪)
# নেক আমল নষ্ট হয়ে যাবে। (সূরা সূরা মুহাম্মদ : ৩৩)
# জাহিলিয়াতের মৃত্যুসম হবে।
# কিয়ামতের ময়দানে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো দলিল থাকবে না।
# সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, সংগঠনের মজবুতি নষ্ট হবে।

পরামর্শ
পরামর্শ শব্দের অর্থ হলো উপদেশ দেয়া, বুদ্ধি দেয়া, মতামত দেয়া, মতবিনিময় করাÑ একে আরবিতে শূরা, ইংরেজিতে কাউন্সেল-অ্যাডভাইস বলে।

পারিভাষিক অর্থে ইসলামী শরিয়তের কোনো কাজ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে সহযোগীদের সাথে যোগাযোগ ও উদার মন নিয়ে যে মতবিনিময় করা হয় বা যে মতামত পেশ করা হয়, একে পরামর্শ বলে। যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাকে পরামর্শ বলে।

পরামর্শের গুরুত্ব
# কুরআনের নির্দেশ (সূরা আলে ইমরান : ১৫৮-১৫৯)
# পরামর্শ মুহাম্মদ (সা)-এর সুন্নত।
# সাহাবীদের বৈশিষ্ট্য (আশ-শুরা : ৩৮)
# আন্দোলনের নিরাপত্তা প্রহরী।
# পারস্পরিক পরামর্শ দুনিয়ার জিন্দেগির কল্যাণ ও সৌভাগ্যের উৎস।
# উত্তম সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়।
# সবাই নিজের সিদ্ধান্ত মনে করে-উৎসাহ উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়: ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ আপনি যদি বলেন সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে, আমরা বিনা দ্বিধায় তাতেও প্রস্তুত আছি। আমরা মূসার কওমের মত উক্তি করবো না।’-বদর যুদ্ধের ব্যাপারে আনসারদের কথা।
# কাজের গুরুত্ব ও প্রকৃতি সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা জন্মে।
# চিন্তার বিকাশ ও ঐক্য সৃষ্টি হয়।
# স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ হয় ও আস্থা বাড়ে।
# আল্লাহর রহমত পাওয়া যায়।

কয়েকটি হাদিস
# রাসূল (সা) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের নেতারা হবেন ভালো মানুষ, ধনীরা হবেন দানশীল এবং তোমাদের কার্যক্রম চলবে পরামর্শের ভিত্তিতে তখন মাটির উপরিভাগ নিচের ভাগের চেয়ে উত্তম হবে। আর যখন তোমাদের নেতারা হবেন খারাপ লোক, ধনীরা হবেন কৃপণ এবং নেতৃত্ব কর্তৃত্ব যাবে নারীদের হাতে তখন পৃথিবীর উপরের অংশের চেয়ে নিচের অংশ হবে উত্তম।’ (তিরমিজি)
# রাসূল (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি মুসলমানদের পরামর্শ ছাড়াই আমির হিসেবে বাইয়াত নেয় তার বাইয়াত বৈধ হবে না। আর যারা তার ইসারতের বাইয়াত গ্রহণ করবে তাদের বাইয়াতও বৈধ হবে না। (মুসনাদে আহমদ)
# যে ব্যক্তি পরামর্শ নিয়ে কাজ করে তাকে কখনও লজ্জিত হতে হয় না। আর যে বা যারা ভেবে-চিন্তে এস্তেখারা করে কাজ করে তাকে ঠকতে হয় না। যে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করে, সে নিরাপদ থাকে।

পরামর্শ গ্রহণের উপকারিতা
# সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পরামর্শ দেয়ার সুযোগ দিলে আনুগত্যের সুন্দর স্বতঃস্ফূর্ত পরিবেশ তৈরি হয়।
# জনশক্তির মাঝে দায়িত্বানুভূতি বৃদ্ধি পায়।
# পরামর্শ সকল প্রকার সন্দেহ সংশয় দূর করে সংগঠনের অভ্যন্তরে জান্নাতি পরিবেশ তৈরি করে।
# সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সমস্যা সৃষ্টি হলে অযাচিত সমালোচনা ও অবাঞ্ছিত ক্ষতিকর পরিবেশ তৈরির সুযোগ থাকে না।
# সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে।
# পরামর্শ গ্রহণের ফলে সকলের মাঝে কাজের গুরুত্ব স্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।
# পরামর্শ কেন্দ্রীয় কাজে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে রহমত বরকত যোগ হতে থাকে।

পরামর্শ কারা দেবে
# সর্বসাধারণের পরামর্শ
# দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের পরামর্শ
# আহলে রায় বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ।
“আল্লাহ যখন কোনো আমিরের ভালো চান তাহলে তার সত্যবাদী উজির নির্বাচিত করেন। আমির কিছু ভুলে গেলে তিনি তাকে তা স্মরণ করিয়ে দেন। আমির কোন কাজ করতে চাইলে সে কাজে তাকে সহযোগিতা করেন। আল্লাহ যদি আমিরের অমঙ্গল চান তাহলে তার জন্য মিথ্যাবাদী উজির নিয়োগ করেন। তিনি কোনো কাজ তাকে ভালো ভাবে স্মরণ করিয়ে দেন না, আমির কোনো কাজ করতে ইচ্ছা করলে তিনি সে কাজে তার অসহযোগী হন।” (আবু দাউদ)

পরামর্শদাতার বৈশিষ্ট্য
# স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং নিজ দায়িত্বে পরামর্শ দেয়া।
# বিষয়টি ভালোভাবে বুঝা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করা।
# প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও প্রস্তুতি।
# সরাসরি দায়িত্বশীলকে বলা।
# সঠিক পদ্ধতিতে পরামর্শ দেয়া।
# যথাসময়ে বলা।
# চিন্তাভাবনা করে আন্তরিকতার সাথে মতপ্রকাশ।
# দ্বিধাহীনচিত্তে স্পষ্টভাবে মতপ্রকাশ।
# পরামর্শ গৃহীত না হলে সন্তুষ্টি সহকারে সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া ও নিজের মত ভুলে যাওয়া।
# সিদ্ধান্ত পালনে দৃঢ়তা এবং বাইরে না বলা।
# যোগ্যতা অর্জন।

যিনি পরামর্শ গ্রহণ করবেন
# পরামর্শের গুরুত্ব¡ বুঝানো।
# বিষয়ের গুরুত্ব বুঝানো।
# সকলের পরামর্শকে গুরুত্ব দেয়া।
# পরামর্শ গ্রহণে সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন- গোপনীয়/ প্রকাশ্য/ ব্যক্তিগত/ সামষ্টিক।
# উপযুক্ত ব্যক্তির কাছে পরামর্শ চাওয়া।
# অধিকাংশের মত অনুযায়ী সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
# গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দৃঢ়তা অবলম্বন করা।

পরামর্শ প্রদানের পদ্ধতি
# কল্যাণ কামনার উদ্দেশ্যে পরামর্শ দেয়া।
# দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে পরামর্শ চাওয়া।
# মার্জিত ভাষায় পরামর্শ দেয়া।
# সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে পরামর্শ দেয়া।
# পরামর্শ গৃহীত হলো কি না তা বিবেচনা করে পরামর্শ দেয়া যাবে না।
# পরামর্শ দিয়ে আবার দেখবে না যে তার পরামর্শ গৃহীত হলো কিনা।
# পরামর্শ দেয়ার ব্যাপারে গ্রুপিং না করা।
# ক্ষতিকর পরামর্শ দেয়া যাবে না।
# সামষ্টিক মতের নিকট নিজের মতের কোরবানি দেয়া।
# নিজের মতের বিপরীত সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে তা বাইরে প্রকাশ না করা।

কতিপয় সমস্যা
# বারবার বলা।
# সিদ্ধান্ত দেয়া
# বাইরে আলোচনা।
# সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কোনো ত্রুটি দেখা দিলে নিজের পরামর্শের সাফাই।

ইহতিসাব
ইহতিসাব শব্দটি আরবি যার বাংলা অর্থ হলো, গঠনমূলক সমালোচনা বা সংশোধনের উদ্দেশ্যে সমালোচনা। পরিভাষায়, অপরের কল্যাণ কামনায় ভুল-ত্রুটি দেখিয়ে দেয়ার পদ্ধতিকে ইহতেসাব বলে। আর সামষ্টিক গঠনমূলক সমালোচনাকে আরবিতে মুহাসাবা বলে। সংশোধন ও উন্নয়নের জন্য গঠনমূলক সমালোচনা হচ্ছে ইহতিসাব।

ইহতিসাবের গুরুত্ব
# দুর্বলতার প্রতিকার ও গতিশীলতা করার জন্য।
# গিবতের পথ বন্ধ করার জন্য।
# সন্দেহ প্রবণতা দূর করার জন্য।
# মজবুত সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
# ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক বিপর্যয় বন্ধ হয় ও আল্লাহর রহমত লাভ হয়।
# যথাসময়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়।
# পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়।
# আখেরাতের জবাবদিহি থেকে বাঁচা যায়।
# মানুষের হিসাব অতি নিকটে ঘনিয়ে আসছে অথচ তারা গাফিলতির মধ্যে বিমুখ হয়ে পড়ে রয়েছে। (সূরা আম্বিয়া : ১)
# ইন্না আলাইনা ইয়াবাহুম, সুম্মা ইন্না- সন্দেহ নেই তাদেরকে আমাদের কাছেই ফিরে আসতে হবে। অতঃপর আমাকে তাদের হিসাব নিতে হবে। (সূরা গাশিয়াহ : ২৫)
# নিশ্চয় জেনো আল্লাহ অতি দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। (সূরা আলে ইমরান : ১৯৯)

ইহতিসাবের উদ্দেশ্য
অপরের দোষ-ত্রুটি সংশোধনের জন্য।
অপর ভাইয়ের কল্যাণ কামনা।
সম্পর্ক উন্নয়ন ও গভীর করার জন্য।

ইহতিসাবের পদ্ধতি
# ব্যক্তিগতভাবে একে অপরকে সংশোধনের চেষ্টা।
# সংশোধন না হলে দায়িত্বশীলকে জানানো।
# তাতেও যদি সংশ্লিষ্ট ভাইকে সংশোধন না হয়, তা হলে দায়িত্বশীলের অনুমতি সাপেক্ষে সামষ্টিক ইহতেসাব করা।

ইহতিসাবের নিয়মনীতি
মুহাদ্দিসিনে কেরাম ও ইসলামী চিন্তাবিদগণ ইহতেসাবের যে নিয়মনীতি নির্ধারণ করেছেন তা নি¤েœ প্রদত্ত হলো:
# কারো ছিদ্রান্বেষণ বা দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ানো উচিত নয়।
# পেছনে বসে সমালোচনা করা যাবে না।
# সমালোচনায় কোনো বাড়াবাড়ি হওয়া উচিত নয়।
# সমালোচনা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ এবং কোনোরূপ স্বার্থসিদ্ধি ও দুরভিসন্ধি থেকে মুক্ত হওয়া উচিত।
# বক্তব্যটুকু বলে দেয়ার পর তাকে আর মনের মধ্যে লালন করা উচিত নয়।
# সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, সকলের ভেতর পরনিষ্ঠা, আন্তরিকতা, সহানুভূতি ও ভালোবাসা ক্রিয়াশীল থাকতে হবে।

যিনি ইহতেসাব করবেন তার করণীয়
# মন-মানসিকতা, সময় ও পরিবেশ বুঝে ইহতেসাব করা।
# ইহতেসাবের ভাষা হবে মোলায়েম, ভাষায় কোনো তেজ থাকবে না এবং ক্ষোভের অভিব্যক্তিও ঘটবে না।
# আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে ইহতেসাব করা।
# দরদিমন নিয়ে আন্তরিকতার সাথে ইহতেসাব করা।
# কাউকে হেয় করার উদ্দেশ্যে ইহতেসাব না করা।
# কারণ দর্শানোর পর ঐকান্তিকতার সাথে মেনে নেয়া এবং সবকিছু অন্তর থেকে মুছে ফেলা।

যার ইহতেসাব করবেন তার করণীয়
# ছলচাতুরীর আশ্রয় না নিয়ে ত্রুটির স্বীকৃতি দেয়া।
# সংশোধনের জন্য দোয়া কামনা করা ও প্রচেষ্টা চালানো।
# সুন্দর ভাষায় কারণ বর্ণনা করা।
# ভুল ধারণা অন্তর থেকে মুছে ফেলা।
# আপসরফা এবং অভিযোগ খণ্ডন।

সংগঠনে ইহতেসাব না থাকার পরিণাম
# আন্দোলনের গতিশীলতা কমে যায়।
# পারস্পরিক সম্পর্কের কৃত্রিমতা আসে।
# পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস কমে যায়।
# গিবতের মতো মারাত্মক রোগ ছড়িয়ে পড়ে।

ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনের প্রাণশক্তি হলো নির্ভেজাল আনুগত্য, পারস্পরিক পরমার্শের ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা, সংশোধনের উদ্দেশ্যে গঠনমূলক সমালোচনা, ইসলাম পরামর্শমূলক ব্যবস্থাপনার কথা বলে- কারণ সাহাবীরা পরামর্শের ভিত্তিতে তাদের জীবনের সকল কাজ সমাধা করতেন। কুরআনের সূরা আহজাবের ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রাসূলের জীবনেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।” সুতরাং মুসলিম মাত্রেরই উচিত জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ ও অনুকরণ। তাই সংগঠনের সকল পর্যায়ে আনুগত্য, পরামর্শ ও ইহতেসাবের পদ্ধতি বজায় রাখতে হবে।