ইসলামি মূল্যবোধ মেনে আধুনিকতায় বাধা নেই

ডেইলি সাবাহ সাথে রশিদ ঘানুশির সাক্ষাৎকার |

রশিদ ঘানুশি তিউনিসিয়ার আননাহদা পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও উত্তর আফ্রিকার দেশটির শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের একজন। তুরস্কের ডেইলি সাবাহ পত্রিকাকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বলেছেন, ইসলামি মূল্যবোধ ও আধুনিক বিশ্ব, সেকুলারিজম এবং সাম্প্রতিক বিশ্ব পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে।

ডেইলি সাবাহ : ইসলামি জীবনধারায় চলতে গিয়ে আধুনিক বিশ্বের কিছু বিষয় এড়িয়ে চলতে চান অনেকে। আবার অনেকে চান যুগোপযোগিতাকে গ্রহণ করতে। বিষয়টি নিয়ে মুসলিম রাজনীতিকদের মধ্যে ভিন্নমত আছে। এ ক্ষেত্রে আপনার অবস্থান কোথায়?

রশিদ ঘানুশি : ১৯ শতকের শুরুতে যখন স্পষ্ট হয়েছে যে, প্রতিযোগিতামূলক সভ্যতা ক্রমেই আধুনিকতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে তখন থেকেই মুসলিমদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিশেষ করে উৎপাদন, সমরাস্ত্র ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশ্ব দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। দেখা গেল অন্যরা এগিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু মুসলিমরা তখন পেছনে।

একদল বললেন, আমরা পশ্চিমা জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণ না করলে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হতে পারব না। আর কেউ বললেন, আমাদের ধর্ম অন্যদের কাছ থেকে রীতি গ্রহণকে অনুমোদন করে না। মুসলিম সমাজ সংস্কারকেরা সমাধান দিলেন যে, অন্যদের সব কিছু গ্রহণ করা যাবে না আবার সব কিছু বর্জন করেও চলা ঠিক হবে না। আমাদের পরিচয় ও স্বকীয়তা বজায় রেখে তাল মেলানো যেতে পারে। এই সমাধানটি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছিল। যেমন নারীদের বাইরে কাজ করার বিষয়টি নিয়েও বিতর্ক ছিল। আজ মুসলিম নারীরা বাইরে কাজ করতে তাদের শালীন পোশাক রয়েছে।

ডেইলি সাবাহ : মুসলিম বিশ্বে সেকুলারিজমও এখন একটি বড় বিতর্কের বিষয়। প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান মনে করেন, ২০১১ সালে মিসরে দেশ শাসনে সেকুলারিজমের পদ্ধতি সঠিক ছিল। বিষয়টি নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার মত কী?

ঘানুশি : সেকুলারিজম এমন একটি বিষয় যার অনেকগুলো অর্থ হতে পারে এবং এটির বাস্তবায়নেরও অনেকগুলো মডেল রয়েছে পশ্চিমা বিশ্বে। যেমন ব্রিটেন আর ফ্রান্সের সেকুলারিজম এক নয়। ব্রিটেন ধর্মনিরপেক্ষ হলেও সেখানে রানী একই সাথে সরকার ও গির্জার প্রধান। আবার ফ্রান্সে ধর্ম পালনে রয়েছে বিধিনিষেধ। প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাধীনতা ও সহযোগিতার একটি বোঝাপড়া থাকা উচিত। রাষ্ট্রের উচিত নয় ধর্মের ওপর কর্তৃত্ব করতে চাওয়া, অন্য দিকে ধর্মীয় নেতাদেরও রাষ্ট্রীয় পদ্ধতিতে কিছু চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়।

ডেইলি সাবাহ : সুদান ও শাদ সফরের সময় এরদোগান ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘রক্তের গন্ধ খোঁজা হাঙরের চেয়েও তেলের গন্ধ খোঁজা সাম্রাজ্যবাদীরা বিপজ্জনক’। বিশ্ব ধীরে ধীরে ঔপনিবেশিকতা থেকে দূরে সরে এলেও এখন দেখা যায় অনেকে দেশের ওপর বিভিন্ন উপনিবেশবাদ বজায় থাকছে। আপনার দেশও ফ্রান্সের সাবেক উপনিবেশ, সে ক্ষেত্রে আপনার বক্তব্য কী?

ঘানুশি : আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলো সাম্রাজ্যবাদীদের বিতাড়িত করেছে। এখন একমাত্র ইসরাইলের ঔপনিবেশিক সত্তা রয়েছে। আমাদের সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও তা নামমাত্র। অর্থনীতি, সংস্কৃতিসহ অনেক বিষয়েই বড় রাষ্ট্রগুলোর প্রতি নির্ভরশীলতা রয়েছে। মূলত সাম্রাজ্যবাদের নতুন একটি অধ্যায় চলছে এখন। তবে তুরস্ক, ব্রাজিল, চীন, ভারত ইন্দোনেশিয়া, ইরানের মতো দেশগুলোর উত্থানের ফলে সাম্রাজ্যবাদীদের আধিপত্য কমে আসছে।

ডেইলি সাবাহ : আরব বসন্ত ও আইএস অধ্যায়ের পর বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেটিকে আপনার ভাষায় কিভাবে বর্ণনা করবেন?

ঘানুশি : ২০১১ সালে নতুন একটি যুগে প্রবেশ করেছে তিউনিসিয়া। পুরো আরব বিশ্বেই আলো ছড়াচ্ছে এই প্রদীপ। যদিও মিসর ও ইয়েমেনের জন্য আরব বসন্ত সুখকর হয়নি। তবে আরব বসন্তের কারণেই আমরা গণতন্ত্রের পথে চলছি। পাল্টা বিপ্লব ও স্বাধীনতার পক্ষে জনমত জোরদার হচ্ছে। তুরস্কে আমরা দেখছি কিভাবে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে। তিউনিসিয়ায়ও যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আরব বিশ্বে গণতন্ত্র সম্ভব সেটি আমরা দেখিয়েছি এবং এই গণতন্ত্রে ইসলামপন্থী ও সেকুলাররাও সহযোগী হতে পারে। কাজেই রূপান্তর হবে বাস্তবায়নের পথে। কোনো সামরিক শাসককে নামানো মানেই গণতন্ত্র নয়, ফ্রান্সেও ৭০ বছর লেগেছে গণতন্ত্র আসতে।

ডেইলি সাবাহ : তুরস্কের অভ্যুত্থান চেষ্টার রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?

ঘানুশি : এই অফিসেই সহকর্মীদের সাথে ছিলাম। ঘটনার খবর শোনার পর প্রচণ্ড দুঃখ পেয়েছি। প্রেসিডেন্ট এরদোগানের এক উপদেষ্টার সাথে যোগাযোগ করে বলেছিলাম, রাজপথ দখল ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

ডেইলি সাবাহ : প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জেরুসালেম ঘোষণা ও পরে তুরস্কের তৎপরতা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?

ঘানুশি : প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন, ‘আজ আমরা জেরুসালেম হারালে, ভবিষ্যতে মক্কাও হারাতে হবে’। এর সাথে আমি একমত। মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করতে তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন তা জরুরি ছিল। মুসলিম উম্মাহর সম্পদ, সামর্থ সবাই আছে কিন্তু নেতৃত্ব, একতা ও পরিকল্পনা নেই। আরব লিগ নেতারা যা করতে পারেননি তা এরদোগান করেছেন।