আল মাহমুদের কাব্যদর্শন: স্বপ্ন ও বিপ্লবের সংযোজনা

মাহমুদ সিদ্দিকী |

‘মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখে সে আবার স্বর্গোদ্যানে ফিরে যাবে। এই স্বপ্নের নামই হলো কবিতা।’ (কবির কররেখা, পৃ.৯)
আল মাহমুদ, যাঁকে আমরা কবি হিসেবেই বেশি জানি। জানি উপন্যাসিক এবং গল্পকার হিসেবেও। কিন্তু কাব্য-দার্শনিক কিংবা প্রাবন্ধিক হিসেবে খুব কমই জানি। প্রবন্ধকার আল মাহমুদকে অনেকে অনুজ্জল, অমৌলিক এবং নিষ্প্রভ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর নেপথ্য কারণ সম্ভবত আমাদের কূপমুন্ডুকতা। আমরা আমাদের চারপাশে কথিত বুদ্ধিজীবীদের স্ব স্ব বিভ্রান্তিসঞ্জাত প্যাঁচালো বাক্যমালাকে পাণ্ডিত্যের স্মারক জ্ঞান করি। ফলে আল মাহমুদের স্বচ্ছ, সহজ এবং সুস্পষ্ট কথার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত হয় না। এবং আমরা আমাদের এই অক্ষমতাকে কবির উপর আরোপ করার দৃষ্টতা দেখাই।

আল মাহমুদ নিজে অবশ্য তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে নিজেকে এক্ষেত্রে মানে প্রবন্ধে কবিতার মতো পারঙ্গম বলেননি। তাঁর ভাষায়- ‘কবিতা যা পারে কবির গদ্যশক্তি যত প্রবলই হোক গদ্যে তা কদাচ সম্ভব হয়।’ (প্রাগুক্ত, পৃ.৩০)। তারমানে এই নয় যে, প্রবন্ধে তথা নিজের দ্রষ্টা বা দার্শনিক সত্তাকে প্রকাশে তিনি অসফল ছিলেন। বরং তিনি যে সহজতার সাথে তাঁর কাব্যকেন্দ্রিক দার্শনিকতার অবতারণা করেছেন সেটাকে অভিনব ও চমকপ্রদই বলতে হয়। তাঁর ভাষায়- স্বপ্নই কবিতা।

কিন্তু কোন স্বপ্ন? সেই স্বপ্নের আদি উৎসইবা কি? এই প্রশ্নের উত্তরে আল মাহমুদ যা বলেন সেটা আরো গুরুতর। সেটা জায়ন’স প্রটোকল(The Protocols of the Elders of Zion) অনুসারে সজ্জিত বিরাজমান পৃথিবীর জ্ঞানকান্ড কিংবা সাহিত্যিক পরিমন্ডলের প্রতি প্রত্যক্ষ এবং অবিমিশ্র আঘাতের শামিল।

কবি বলছেন, “আদম এবং ঈভ পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হয়ে তাদের শ্রম, ঘাম ও দুর্ভাগ্যের উপার্জনের শস্য আহরণ করে পৃথিবীতে বাস করতে শুরু করলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে ফেলে আসা স্বর্গের স্বপ্ন সুপ্ত হয়ে থাকলো। এই স্বপ্ন তাদের সন্তান সন্ততির মধ্যেও সঞ্চারিত থাকলো। মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখে সে আবার স্বর্গোদ্যানে ফিরে যাবে। এই স্বপ্নের নামই হলো কবিতা।”

আল মাহমুদ ‘বেস্ট ওয়ার্ড ইন বেস্ট অর্ডার’ এর মতো মনোলোভা বস্তুবাদী সংজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে কবিতাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চাইলেন। সে সংজ্ঞা আরো বিস্তৃত, আরো গভীর, আরো বেশি সংবেদনাময়। কিভাবে? কবি বললেন, ‘এই স্বপ্নের নামই হলো কবিতা।’
-স্বপ্ন! স্বপ্ন মানে কি শুধুই স্বপ্ন?

না। এই স্বপ্ন সেই স্বপ্ন, যে স্বপ্ন মানুষকে বাঁচতে শেখায়। ভালোবাসতে শেখায়। প্রেম এবং বিদ্রোহ শেখায়। এই স্বপ্নই মানুষকে বিরহী করে তোলে। হৃদয়কে সঞ্জীবিত রেখে অঙ্কুরিত করে আধ্যাত্মিকতার বীজ। বিপ্লবের জন্য সবার অলক্ষ্যে প্রস্তুত করে মানুষকে। স্বপ্নকে ঘিরেই শেষ পর্যন্ত এগিয়ে গেছে এবং সম্পন্ন হয়েছে প্রতিটি মানবিক বিপ্লব।

অর্থাৎ, আল মাহমুদ যখন বলেন, ‘এই স্বপ্নের নামই হলো কবিতা’- তখন স্বপ্নের সাথে সম্পৃক্ত এই সবই হয়ে উঠে কবিতার পলিমাটি। স্বপ্নের সাথে সম্পৃক্ত বিরাজমান বাস্তবতাও তখন কবিতা অনিবার্য অনুসঙ্গ হয়ে পড়ে। যেমনটা কবি বলেছেন- ‘দৃশ্যমান জগত সম্বন্ধে মানুষের অভিজ্ঞতা তার কল্পনার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে কবিতাকে অলংকৃত করে।’ (পৃ.১০)

আবার এই স্বপ্ন থেকেই তথা সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা পূরণের আশায় কবিরা ‘এমন পঙক্তি উচ্চারণ করেছেন যাতে তাদের ধমনির ধ্বনি আমরা শুনতে পাই।’(পৃ.১৮)

প্রশ্ন উঠতে পারে ‘এমন পঙক্তি’ কি করে কবিরা উচ্চারণ করতে পারঙ্গম? কিংবা তাদের ‘ধমনীর ধ্বনি’ আমরা শুনতে পারাই কি শেষ, নাকি এর আরো কোন তাৎপর্য রয়েছে? প্রথম প্রশ্নের জবাবে কবি বলছেন- ‘কবির হাতে সেই জাদু তার স্রষ্টা তাকে দিয়েছেন যা অন্যের করতলে সম্ভবপর হয় না।’ কে সেই স্রষ্টা? সে ‘এক অদৃশ্য শক্তি’, যিনি- ‘মানুষ জীবনের বাস্তবতার মধ্যে যখন অসহনীয় জীবনযন্ত্রনায় উপনীত হয় তখনই তাকে স্বপ্নের ভেতর হাটিয়ে নিয়ে চলে।’ (পৃ.৩৪)

তারমানে স্বপ্নের ভেতর হাটিয়ে চলেন যিনি তিনিই স্বপ্নের তথা কবিতার আদি উৎস। তিনিই প্রথম অনুভব করলেন আদমের নিঃসঙ্গতা। ‘আদম যে একাকী এই বোধ কি আদমের ছিল? এই বোধ নিশ্চয় তার সৃষ্টিকর্তার মধ্যেই প্রথম উদিত হয়ে থাকবে।’ (পৃ.৯) স্বপ্ন মানে তো আকাঙ্ক্ষা। অপ্রাপ্তির বেদনা। প্রাপ্তির তীব্র সম্ভাবনাপ্রসূত সংগ্রাম।

কিন্তু কিসের আকাঙ্ক্ষা? -অমরতা এবং পরম প্রেম ও প্রশান্তির আকাঙ্ক্ষা। কিসের বেদনা? -বেদনা ‘অমরতা’র আকাঙ্ক্ষায় ইবলিশের প্রলোভনে পড়ে স্বর্গোদ্যান হারিয়ে ফেলার। (পৃ.৯) কিসের জন্য সংগ্রাম? সংগ্রাম স্রষ্টার পরম সান্নিধ্য (পৌঁছুতে চাই প্রভু তোমার সান্নিধ্যে/তোমার সিংহাসনের নীচে একটি ফুরফুরে/ প্রজাপতি হয়ে।’ প্রার্থনার ভাষা/দ্বিতীয় ভাঙন)। এবং অমরতার সাথে সঙ্গিনী ও স্বর্গোদ্যান ফিরে পাওয়া(‘..সেই/ মহাউদ্যানের টান আমার রক্তে, আমার মাংসে ও মজ্জায়/ দাও তাকে ফিরিয়ে আমায়।’ প্রাগুক্ত)।
‘আমি সব মানুষের জন্য মায়ের মতো, বধূর মতো, বোনের মতো স্বপ্নের খাদ্য কষ্টের মসলা মিশিয়ে রন্ধন করি। যারা আমার রান্নার আঘ্রাণ-আস্বাদন করে তারাই বাঁচার মর্মার্থ হৃদয়ে উপলব্ধি করে। সেই অর্থে কেউ কেউ নয়, সব মানুষই কবি। অর্থাৎ, কবিত্ব ছাড়া মনুষত্বের স্তম্ভ গড়া যায় না। ’ (পৃ.৩৫)

সুতরাং, ‘যতদিন মানুষ থাকবে ততদিন তারা স্বপ্ন দেখবে। আর স্বপ্নের বিবরণ লিখার জন্য কয়েকজন জন্মগত স্বপ্নচারী জন্মগ্রহণ করবেন। আমরা যাদের কবি বলে আখ্যায়িত করতে থাকবো।’ (পৃ.৩৯)

এবার দ্বিতীয় প্রশ্নে আসা যাক। কবিদের উচ্চারিত পঙক্তিতে তাদের ‘ধমনীর ধ্বনি’ আমাদের শুনতে পারাটাই কি শেষ কথা? না, শেষ কথা নয়। এবং এটা শুধু কবিদের নিজস্ব আকাঙ্ক্ষার ফলশ্রুতিও নয়। এটা সমগ্র মানবজাতির স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার স্পন্দন। এর ভেতর দিয়ে সেই ‘মহাউদ্যান’এর স্বপ্ন যেমন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত হচ্ছে, একইভাবে প্রবাহিত হচ্ছে এই পৃথিবীকে সেই স্বর্গোদ্যানের উত্তরাধিকারের মতো মানবজাতির সামগ্রিক উত্তরাধিকারে পরিণত করার স্বপ্নও। এখানে এসে স্বপ্ন এবং বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা একাকার হয়ে যায়।

অর্থাৎ, আল মাহমুদ যে স্বপ্নের কথা বলেন, এবং যে স্বপ্নের প্রসঙ্গ তুলে তিনি ‘মানুষ মাত্রই কবি’(পৃ.৭) বলতে দ্বিধা করেন না, সেই স্বপ্নের পলকে এবং পদক্ষেপে বিপ্লবাঙ্ক্ষার একচ্ছত্র বিচরণ। সেই আকাঙ্ক্ষা কখনওকখনও এতোটাই প্রবল এবং অনিবার্য হয়ে উঠে যে কবিকে আর্তনাদ করে উঠতে হয়। যে কবি ‘সঙ্গিনীকে অপরিত্যাজ্য অপরিহার্য রূপে কল্পনা করতে শিখিয়েছে’ (পৃ.২৫) তাকেই আবার উচ্চারণ করতে হয়- ‘তোমার চেয়েও বড় হে শ্যামাঙ্গী শস্যের বিপদ’ (সোনালী কাবিন)।

এই শস্যের বিপদ কখন এবং কেন এতো বড় হয়ে উঠে? এবং সে বিপদের প্রতিকারই-বা কি? এসব প্রশ্নের উত্তরে আল মাহমুদ আমাদের সম্মুখে এক অনন্য ব্যাখ্যা উন্মুক্ত করেন। কবির মতে, অহংকার এবং অবাধ্যতায় নিমজ্জিত হয়ে ইবলিশ যখন অভিশপ্ত হয়ে গেল তখন সে ‘..প্রার্থনা করে বললো, আমাকে অবকাশ দাও প্রভু।..আমি আকাশে বাতাসে সর্বত্র তার জন্য ফাঁদ পেতে রাখবো অবাধ্যতার। তুমি তাকে বাধ্য, তোমার অনুগত সৃষ্টি হিসেবে পাবে না।’ (পৃ.৮)

এই ইবলিশের ‘ফাঁদে’ পড়া মানবজাতির একটা ‘অবাধ্য’ অংশ যখন সমগ্র বণি আদমের ‘শস্য’ তথা স্বাভাবিক উত্তরাধিকার কুক্ষিগত করে রাখে কিংবা করতে চায় তখন সত্যিসত্যিই শ্যামাঙ্গীর চেয়ে শস্যের বিপদ গুরুতর হয়ে উঠে। এবং শ্যামাঙ্গীকেও হয়ে উঠতে হয় সংগ্রামের সঙ্গিনী। গাইতে হয় ‘অস্ত্রবতী প্রেমিকার গান’ (অক্ষত যদি সে ফেরে আমার কাছে/ সিজদায় আমি কাটাবো আধেক রাত/…/বাকী আধি রাত কাটাবো সোহাগ করে)।

এবং স্মরণ করতে হয় ইবলিশের প্রতিপক্ষে স্রষ্টার নিকট দেয়া প্রতিশ্রুতি। ‘আমি লড়াই চালিয়ে যাবো হে প্রভু, তোমার নিয়ম শৃঙ্খলার পক্ষে।’ কবির দর্শনে ‘এভাবেই আদমের সাথে অমঙ্গলের লড়াই শুরু হলো।’ (পৃ.৮)

এ লড়াই-ই আদমের ধর্ম। অমঙ্গলের হাত থেকে পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা উদ্ধার করে আদমের উত্তরাধিকার বণি আদমের মাঝে বন্টন করা। কবির প্রার্থনাও তাই। ‘আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বন্টন।’ (সোনালী কাবিন)।

তাই বিরাজিত প্রেক্ষাপট যতই তমসাবৃত হোক। আদমের ‘বাধ্য’ সন্তানরা পৃথিবীর উপর তাদের অধিকার ছেড়ে দিতে পারে না। তাকে চালিয়ে যেতে হয় প্রতিশ্রুত লড়াই। অশ্রু এবং খুন দিয়ে হলেও জাগিয়ে রাখতে হয় বিপ্লবের সম্ভাবনা। এবং সে পারেও। পারে, কারণ ‘কঠোর বাস্তবতার মধ্যে থেকেও মানুষ ভাবে একদিন সে সুখের স্বর্গে ফিরে যাবে। এই স্বপ্ন অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে নেই।(পৃ.৯)।

[পৃষ্ঠা নম্বরযুক্ত উদ্ধৃতিগুলো আল মাহমুদের ‘কবির কররেখা’ নিবন্ধগ্রন্থ থেকে নেয়া। প্রকাশনা- সূচীপত্র, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ- ২০০৮। প্রথম মুদ্রণ- ২০১৬]

লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।