আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন

প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী |

কুরআন মুমিনের জন্য শেফা। কুরআন অধ্যয়নকারী সকল ব্যক্তিই উপলব্ধি করে, এই কুরআন যেন তার সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যেই কথা বলছে। হাজারো সমস্যার বেড়াজালে আমরা জড়িত। আল্লাহর সৃষ্ট এক অতি ক্ষুদ্র জীবাণু (যা খালি চোখে দেখা যায় না) সমগ্র পৃথিবীটাকে স্থবির করে দিয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আর্থিক, পারিবারিক, সামাজিক নানাবিধ সমস্যা মানুষের জীবনে সৃষ্টি করেছে বড় ধরনের অশান্তি, বিশেষ করে মৃত্যুভীতি আজ তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

মানুষের জীবনের দু’টি দিক। এক. দুনিয়ার জীবন, দুই. আখিরাতের জীবন। দুনিয়ার জীবনটা কর্মক্ষেত্র এবং খুবই ক্ষণস্থায়ী। পক্ষান্তরে আখিরাতের জীবন ফলভোগের স্থান এবং স্থায়ী। সুখ ও দুঃখের মিশ্রণ নিয়ে দুনিয়ার জীবন। নিরবচ্ছিন্ন সুখ বা দুঃখ বলে কিছু নেই। সেটি রয়েছে আখিরাতে- হয় চিরস্থায়ী সুখ, নয় তো চিরস্থায়ী দুঃখ। এমনকি নবী-রাসূলদের জীবনও এর বাইরে নয়। দুঃখে কাতর হওয়া মানবপ্রকৃতিরই দাবি। দুঃখ-কষ্টে পড়লে মানুষ সান্ত¡না খুঁজে এবং সান্ত¡না সে পেয়েও যায়। একের পর এক পুত্র সন্তানের মৃত্যু ও কাফিরদের সীমাহীন বিরোধিতা এবং ওহি প্রাপ্তিতে বিলম্বে মুহাম্মদ (সা.) হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। সূরা কাউছার, সূরা দোহা ও সূরা আলাম নাশরাহ্ অবতীর্ণ করে আল্লাহপাক নিজেই তাঁর নবীকে সান্ত¡না দিয়েছেন। এটি শুধু তাঁর নবী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাঁর সকল বান্দার জন্যও সত্য। তিনি স্পষ্ট করেছেন, দুঃখের পর অবশ্যই সুখ রয়েছে।

আল্লাহপাকের সবচেয়ে প্রিয়ভাজন হলেন নবী-রাসূলগণ। সেই নবী-রাসূলকে তিনি তাঁর পরীক্ষার আওতার বাইরে রাখেননি। সে পরীক্ষা এসেছে ইসলামের দুশমনদের পক্ষ থেকে, নিজের রোগ-ব্যাধি থেকে, আবার পরিবার থেকেও। আমাদের সম্মুখে এ সবই উদাহরণ হয়ে আছে। ভয়ানক রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন হযরত আইয়ুব (আ), প্রিয়তমা স্ত্রী ছাড়া সবাই তাঁকে ছেড়ে গিয়েছিলেন। ইসলামের দুশমনদের পক্ষ থেকে পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছেন কম-বেশি সকল নবী-রাসূল। আপন পরিবারের পক্ষ থেকে বিরোধিতা ও যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন হযরত নূহ (আ) সন্তানের পক্ষ হতে, হযরত ইবরাহিম (আ) পিতার পক্ষ হতে, হযরত লুত (আ) স্ত্রীর পক্ষ থেকে। সূরা তাগাবুনের ১৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, তোমাদের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির মাঝে কতিপয় শত্রু। পাল্টা শত্রুতা করার কথা না বলে বলেছেন সতর্ক থাকতে এবং ক্ষমা ও সহনশীল আচরণ করতে। কারণ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু। এমন বিপদ-মুসিবতে নবী-রাসূলগণ তাদেরকে ছেড়ে যাননি বা হতাশ হননি বরং সবাই ধৈর্য অবলম্বন করেছেন এবং বিনিময়ে সফল হয়েছেন।

দুনিয়াটা যেহেতু পরীক্ষাক্ষেত্র সেহেতু আল্লাহর বান্দাদেরকে কোনো না কোনোভাবে পরীক্ষার মুখোমুখি হতেই হবে। এটি আল্লাহর স্থায়ী নিয়ম। তাঁর বাণী, “নিশ্চয়ই আমি ভয়, বিপদ, অনশন, জান-মালের ক্ষতি ও আমদানি হ্রাসের দ্বারা তোমাদের পরীক্ষা করবো। এ সমস্ত বিপদ-মুসিবত উপস্থিত হলে যারা ধৈর্য অবলম্বন করে এবং বলে যে- ‘আমরা আল্লাহরই জন্য এবং তাঁরই কাছে ফিরে যাবো’- তাদের জন্য সুসংবাদ।” (সূরা বাকারা : ১৫৫-১৫৬) জীবনে পরীক্ষা আছে তো সফলতা আছে। পরীক্ষাকে যারা ভয় করে এড়িয়ে চলে তারা জীবনে সাফল্য খুঁজে পায় না।

আল্লাহপাক মুমিনদের বন্ধু ও অভিভাবক। তিনি সমস্যার সমাধানও বলে দিয়েছেন। তাঁর বাণী, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো; নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।” (সূরা বাকারা : ১৫৩) বিপদাপদে পতিত হলে আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদেরকে তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়ার কথা বলেছেন। তিনি নিজেই যেহেতু তাঁর কাছে চাইতে বলেছেন, বুঝতে হবে এটি তাঁর প্রতিশ্রুতি, পূরণ না হওয়ার কোনো কারণ নেই। নামায তো আল্লাহর সাথে বান্দার কথোপকথন। তাঁর সাথে চুপি চুপি কথা বলা। বিশেষ করে বান্দাহ যখন সেজদায় যায় তখন আল্লাহর খুব নিকটবর্তী হয়ে হয়ে পড়ে। বান্দার সকল প্রয়োজন তাঁর মহান মনিবের কাছে পেশ করার এ এক অপূর্ব সুযোগ। মুহাম্মদ (সা.) তাঁর সকল প্রয়োজন তাঁর মনিবের কাছে নামাযের মধ্যেই পেশ করতেন।

মানুষ বড় স্বার্থপর। এই স্বার্থপরতা দোষের কিছু নয়। স্বার্থপরতা আছে বলেই মানুষ পরিশ্রম করে, ঝুঁকি নেয়। এই স্বার্থপরতা তখনই দোষের যখন মানুষ অপরের অধিকার হরণ করে। পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-স্বজন ও নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকৃতিজাত এবং এসব ব্যাপারে মানুষের যেমন দায়িত্ব রয়েছে; আবার জবাবদিহিতাও আছে। সন্তান-সন্ততিকে বলা হয়েছে পরীক্ষার সামগ্রী। হারাম-হালাল বিচার না করে মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে মূলত তার সন্তান-সন্ততির সুখ চিন্তা করে।

এবারে করোনা দেখিয়ে দিলো নিজেকে ছাড়া আর কেউ যেন তার আপন নয়। সন্তান মাকে ফেলে পালাচ্ছে, স্ত্রীকে রেখে স্বামী পালাচ্ছে। যে এলাকায় তার জন্ম, বেড়ে ওঠা ও যেখানে তার অসামান্য অবদান, করোনায় মৃত্যুর পর তার লাশ স্বজন ও তার এলাকাবাসী গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। এ তো কিয়ামতেরই দৃশ্য। সেদিন একে অপর থেকে পালাবে। জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার জন্য সে সবকিছু বিনিময় হিসেবে দিতে চাইবে। তাই পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির অধিক সুখ-শান্তির চিন্তায় যে তার পরকাল বিসর্জন দেয় সে একজন আহম্মক বৈ আর কিছু নয়। আল্লাহপাক আমাদেরকে শিখিয়েছেন, আমরা আল্লাহরই জন্য। আমরা তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করি, শুধু এ কারণেই করি যে এটা আমার আল্লাহর হুকুম। যে ব্যক্তি মুখে উচ্চারণ করে ও অন্তরে অনুভব করে সে যেমন আল্লাহর হয়ে যান, আল্লাহও তেমনি তার হয়ে যান। সে তখন সকল ভয়, বিপদ, যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে উঠে অন্তরে অনুভব করে প্রশান্তি।

দুনিয়াকে বাদ দিয়ে মুমিনের জীবন নয়, বরং দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ কামনা করতে আল্লাহ আমাদেরকে শিখিয়েছেন। মুমিন বুদ্ধিমান, সে সব সময় দুনিয়ার ওপরে আখিরাতকে অগ্রাধিকার দেয়। কারণ সে জানে আখিরাতের তুলনায় দুনিয়া অতি নগণ্য, কোনোভাবেই তুলনীয় নয়। তাই আখিরাত ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোনো কাজ করতে মুমিন মোটেই প্রস্তুত নয়। দুনিয়ার জীবনে সাফল্য লাভের ক্ষেত্রে আল্লাহপাক একটি নিয়ম নির্ধারণ করেছেন এবং সেটি হলো- যে শ্রম দিবে, চেষ্টা-সাধনা করবে, কাজে একাগ্র হবে ও ধৈর্য অবলম্বন করবে সে কৃতকার্য হবে। তাই আল্লাহ নামাজিদের সাথে আছেন এ কথা না বলে তিনি বলেছেন, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। এ দুনিয়াকে আল্লাহ তাঁর সকল বান্দার জন্য উন্মুক্ত রেখেছেন। তবে এটি ঠিক, নামায ও ধৈর্য একত্র হলে সাফল্যের সম্ভাবনা অনেকখানি বেড়ে যায়। হালাল রুজির মাধ্যমে একজন মুমিন যা কিছু অর্জন করে তাতে সে বরকত ও প্রশান্তি লাভ করে। পক্ষান্তরে কাফিরের কোনো প্রশান্তি বা তৃপ্তি নেই।

রুজির জন্য মুমিনের প্রচেষ্টা আছে, কিন্তু কোনো পেরেশানি নেই; কারণ সে জানে তার আল্লাহর এক নাম রাজ্জাক। সৃষ্টির প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব তিনি নিজে গ্রহণ করেছেন। আকাশে উড়ন্ত পাখি ও জমিনে বিচরণশীল জন্তু-জানোয়ার সবারই রুজির ব্যবস্থা তিনি করেন এবং এ কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, তোমাদের রিজিকও তিনি দেবেন। প্রয়োজন নিরলস প্রচেষ্টা ও তাঁর কাছে চাওয়া এবং এ ব্যাপারে ধৈর্য অবলম্বন করা। ‘আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন’-এ কথার ওপরে একজন মুমিন আস্থা না রেখে পারে না। এটি ঈমানেরই দাবি। সত্যিই মুমিন বড় ভাগ্যবান। তার সমস্যা পেশ করার একটি জায়গা রয়েছে এবং যেখান থেকে খালি হাতে ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও নির্ভরতা রেখে আল্লাহর কোনো বান্দাহ যখন অগ্রসর হয় তখন সে সফলকাম হয় এবং তার এ সাফল্য দুনিয়া ও আখিরাতে। আল্লাহপাক আমাদের তাঁর পথে চলাটাকে সহজ করে দিন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ