ভূমধ্যসাগরের তরবারি

মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল কাফী |

[১]
১৪৯২ সাল। দীর্ঘ আটশো বছর ধরে উড্ডীয়মান খিলাফতে ইসলামির কালিমাখচিত পতাকার শেষ চিহ্নটুকু আন্দালুসের আকাশ থেকে মুছে যায়। গ্রানাডার পতন ঘটে। খ্রিস্টানরা গোটা আন্দালুসিয়ায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করে। প্রথম দিকে খ্রিস্টান শাসকগোষ্ঠি নিরব ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও এক দশক না পেরুতেই তাদের আসল চরিত্র প্রকাশ পায়। সম্রাট পঞ্চম চার্লস এবং পূত্র ফিলিপ মুসলমানদের বিরুদ্ধে লোমহর্ষক অত্যাচারে নেমে পড়ে। মুসলমানদের মুখোমুখি হতে হয় কুফ্ফারগোষ্ঠির নারকীয় তাণ্ডবের। ১৫০২ সালে সামগ্রিকভাবে ইসলামকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

দীর্ঘ আট শতাব্দী ব্যাপি ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি, শিল্পকলা, চিত্রকলা ও চেতনা লালিত প্রায় সাত লক্ষাধিক মুসলিম অধ্যুষিত আন্দালুসিয়ার মাটিতে আজ মুসলিমদের বিরুদ্ধে ইসলামকে চিরতরে নিষিদ্ধ করা হলো। পতন হয়েই নাকি ইতিহাস বারবার পরিহাস সেজে আসে। যদিও প্রত্যেকটি পতন থেকে নতুন করে উঠে দাঁড়াতে হয়। ইতিহাসের এ-ই অমোঘ নিয়ম হতে সুবিস্তীর্ণ সীমানার আন্দালুসিয়াও রেহাই পেলো না।

এ-ই পতন মুসলমানদের চরম দুর্ভোগ ও জুলুমের দিকে ঠেলে দেয়। মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার ওপর উপর্যুপরি চাপ সৃষ্টি করা হয়। মসজিদগুলোকে চার্চে পরিণত করা হয়। ইসলাম সংশ্লিষ্ট সকল নিশানা ও নিদর্শন মুছে ফেলা হয়। ইসলামি নিয়মে পশু জবাই নিষিদ্ধ করা হয়। মুসলিম নারীদের ওপর হিজাব পরিধানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। আরবী ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সকলকে ক্যাস্তিলিয়ান ভাষায় কথা বলতে বাধ্য করা হয়।

জুলুম ও ইসলাম-বিদ্বেষের পরিধি এতটাই বৃহৎ ও ভয়ংকর ছিল যে, মুসলিমদের পরস্পর সালাম আদান-প্রদান এবং গোপনে সালাত আদায়েরও সুযোগ ছিল না। নির্বিঘ্নে চলাফেরা করার নূণ্যতম স্বাধীন ফুরসৎটুকুও ছিনিয়ে নেয়া হয়। চার্চে যাওয়া এবং খ্রিস্টীয় পদ্ধতিতে ইবাদাত করার ওপর বাধ্য-বাধ্যকতা আরোপ করা হয়।

মুসলিমরা ইসলাম পরিচয়ে চলতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিলো। অনেকে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। অনেকে সাগর পেরিয়ে উত্তর আফ্রিকায় হিজরত করে। অনেকে বাহ্যিকভাবে খ্রিষ্টধর্ম মেনে নিলেও আন্তরিক ও অভ্যন্তরীণভাবে ইসলাম পালন করে। কিন্তু ইসলাম পালন করা খুব দুঃসাধ্য এবং রীতিমতো অবিশ্বাস্যভাবে অসম্ভব হয়ে পড়ছিলো। রাতের আঁধারে চুপিসারে কুরআন তিলাওয়াতও ছিল বিপদসংকুল।

কিন্তু এভাবে আর কতদিন আকম্পিত নিরব জীবন যাপন করা যায়! ভীতি নিয়ে ধর্ম পালন করা যায়! ইসলামের দীক্ষা আর কুরআনের প্রীতি এ-ই প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যতটুকু অপ্রতিরোধ্য করে রেখেছিলো—তাই অনেক কিছু। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের কি হবে? তাঁরা তো ক্রুশ এবং যিশুর তথাকথিত চেতনা নিয়ে বেড়ে ওঠবে! ক্রিশ্চিয়ানপ্রীতি নিয়ে বড়ো হবে!

এরচেয়ে বরং মরে যাওয়াই ভালো। মুসলিম চেতনা বুকে লালন করে খ্রিস্টান সন্তান জন্ম দেবার চেয়ে মাতৃভূমি পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। খুব সংকট, ঝড়-তুফান, আর দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে জীবন অতিক্রান্ত করছিলো তখনও আন্দালুসের মাটিতে রয়ে যাওয়া মুসলিমগণ।

[২]
১৪৭৮ সাল। গ্রীসের লেসবোস দীপপুঞ্জ। উসমানীয় সালতানাতের একজন সাধারণ যোদ্ধা ছিলেন আলবেনিয়ান বংশদ্ভূত ইয়াকুব বিন ইউসুফ। স্ত্রী ক্যাটিরিনা। খুব সাদাসিধে ছিমছাম একটি সুন্দর জীবন ছিলো তাদের। সাদামাটা এ-ই জীবনে পরিবারের নতুন সদস্য হয়ে জন্ম নিলো ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তান। ইয়াকুব ও ক্যাটিরিনা খুব আদর করে নাম রাখলেন খসরুফ।

খসরুফ তাঁর বাবা-মায়ের তৃতীয় পূত্র সন্তান। তাঁর বড়ভাই দুজন হলেন—ইসহাক ও আরুজ। তাঁর আদরের দুজন বোনও আছে। পরবর্তীকালে তাঁর আরেকটি ছোট ভাইয়ের জন্ম হয়। নাম রাখা হয়—ইলিয়াস। সর মিলিয়ে তাঁরা ছয় ভাইবোনের একটি চমৎকার জুটি। বেশ অ্যামাজিংয়ে কাটছিলো তাদের শৈশবের দিনগুলো।

খসরুফ ধীরে ধীরে বড়ো হয়। কৈশোর থেকেই তাঁর চেহারায় চিন্তার এক অস্ফুট ভাব-রেখা পরিলক্ষিত হয়। যত বড়ো হয়, ততই কিছু একটা বিষয় তাকে সর্বদা ভাবিয়ে রাখে।

দ্বীপে থাকার কারণে তাঁদের প্রত্যেক ভাই নৌবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করে। খসরুফও নৌবিদ্যায় অসম্ভব পারদর্শী হয়ে ওঠে। বড়ভাই আরুজের বেশ কয়েকটি নৌকা ছিলো। এসব নৌকাতেই খসরুফ প্রাথমিক পারঙ্গমতা অর্জন করেছিলো।
প্রথমদিকে তাঁরা তিনভাই নাবিক হয়ে কাজ করে। পরবর্তী সময়ে সেন্ট জনের জলদস্যুরা ভূমধ্যসাগরে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে তাঁদের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করতে থাকে। বড়ভাই ইসহাক গ্রীসেই অবস্থান করে ব্যবসার কাজ সামলাচ্ছিলো।

আরুজ ছিলো অত্যন্ত অভিজ্ঞ নাবিক, যোদ্ধা এবং বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী। ত্রিপলি থেকে ফেরার পথে সেন্ট জনের জলদস্যুদের সাথে তাঁদের প্রচণ্ড সংঘর্ষ বাঁধে। প্রাণপণে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ইলিয়াস নিহত হয়। আরুজ বন্দি হয়। বোদরুম দূর্গে এ-ই মহান যোদ্ধাকে কারারুদ্ধ হয়ে থাকতে হয় দীর্ঘ তিন বছর। তিন বছর পর ছোট ভাই খসরুফের কাছে তাঁর বন্দীত্বের সংবাদ পৌঁছলে খসরুফ অবিলম্বে ছুটে যায় বোদরুম অভিমূখে। কৌশলে ভাইকে পলায়ন করতে সহযোগিতা করে। খসরুফ যেমন ছিলো দুঃসাহসিক, তেমনি বিচক্ষণ ও কৌশলী।

মুক্তি পেয়ে আরুজ আনাতোলিয়ায় উসমানীয় গভর্নরের সাথে সাক্ষাৎ করতে চলে যান। শাহজাদা কুরকুতের সাথে সাক্ষাৎ-বিনিময় করেন। সাক্ষাৎে তিনি তাঁর ও তাঁর ভাইয়ের সাথে ঘটে যাওয়া সেন্ট জনের জলদস্যুদের সংঘর্ষের কথা জানিয়ে দেন। তাছাড়া ভূমধ্যসাগরে তখন উসমানীয় বাণিজ্যিক জাহাজগুলির উপর তাঁরা অনবরত আক্রমণ করে মুসলমানদের ক্ষতি সাধন করছিলো। শাহজাদা কুরকুত ক্ষুব্ধ হন। আরুজকে ১৮ টি গ্যালে দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। সরাসরি শাহজাদার সহায়তা ও নির্দেশনা পেয়ে আরুজ নতুন উদ্যমে জলদস্যুদের বিরুদ্ধে মোকাবিলা শুরু করে।

[৩]
১৫১৪ সাল। আরুজ ও খসরুফ স্ববাহিনী নিয়ে আলজেরিয়ার জিজেল শহরে অবস্থিত স্প্যানিশ ঘাঁটিতে আক্রমণ করেন। তুমুল যুদ্ধ হয়। স্প্যানিশ বাহিনী চরমভাবে পরাস্ত হয়। আরুজ ও খসরুফ এ বিজয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হন। শোকর আদায় করেন।
শহরের নিয়ন্ত্রণ মুসলিম বাহিনীর হাতে চলে আসে। আরুজের বাহিনী সুশৃঙ্খল ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালনার জন্য একটি হেড কোয়ার্টারের বড্ড প্রয়োজন ছিল। যেখান থেকে আন্দালুসীয় উপকূলসহ ভূমধ্যসাগরে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করে সুবিন্যস্তভাবে নৌবহর পরিচালনা সহজতর হবে।

আলজেরিয়ার এ-ই বিজিত স্প্যানিশ ঘাটি সমুদ্র উপকূলে হওয়ার কারণে এ-সবের জন্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। তাই সামরিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে আরুজ এ ঘাটিকে কেন্দ্রীয় কোয়ার্টার ঘোষণা করেন।
চার বছর পর। ১৫১৮ সাল। আরুজ ও খসরুফ তিলিসমান শহরে অবস্থিত স্প্যানিশ ঘাঁটিতে অভিযান চালান। উভয় বাহিনীর মধ্যে তীব্র লড়াই হয়। এ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। বিপক্ষীয় স্রোতের দাবদাহের প্রচণ্ডতায় দিশাহারা হয়ে পড়ে। দিগ্বিদিক ছোটাছুটি আরম্ভ করে দেয়। মুসলিম বাহিনী পরাজিত হয়।

সবচে বড়ো লোমহর্ষক ব্যাপার হলো—আরুজ এ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তার দেহ থেকে মাথা আলাদা করা হয়। আরুজের কর্তিত মস্তক নিয়ে ইউরোপের অলিতে-গলিতে ঘুরানো হয়। প্রতিটি গলিতে ঘুরানোর সময় ঐ গলির চার্চে সজোরে ঘণ্টা বাজানো হতো। নারী-পুরুষ একত্রিত হয়ে আরুজের মৃত্যু-উল্লাসে মেতে উঠতো।

বস্তুত- ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে একের পর এক সফল অভিযান পরিচালনা করে আরুজ হয়ে উঠেছিল তাঁদের মাথা ব্যাথার কারণ। তাঁদের মোকাবিলায় অপ্রতিরোধ্য চ্যালেন্জ হয়ে উঠেছিল সে। আরুজের অভাবনীয় শক্তিমত্তা, কুশলতা ও নিপূণতায় তাঁরা ভেবে নিয়েছিল—আরুজই মুসলিম বাহিনীর বিরামহীন অগ্রগতির প্রধান কারণ। সুতরাং তাঁর তিরোধান মুসলিম বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দেবে। দূর্বল বানিয়ে দেবে। তাঁদের অগ্রযাত্রা পিছিয়ে দেবে অনেক দূর।

অথচ তাঁরা জানে না যে—মুসলিমরা ব্যাক্তি-নির্ভর কোনো জাতি নয়। তাঁদের কাছে ’লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র ঝান্ডা উত্তোলন করাটাই মূল বিষয়। কে করলো তা বড়ো ব্যাপার নয়।
আরুজের মৃত্যু তাঁদের মধ্যে বেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে এসেছিল। প্রশান্তির ঢেকুর নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তাঁরা জানে না যে—তাঁদের এ-ই ঢেকুর, এ-ই নিঃশ্বাস অচিরেই মিলিয়ে যাবে। শীঘ্রই তাঁদের এমন এক যোদ্ধার মোকাবিলা করতে হবে—যিনি আরুজের চেয়েও দুর্ধর্ষ, অপ্রতিরোধ্য। জ্ঞানী ও বিচক্ষণ।

[৪]
৩ নভেম্বর, ১৫১৯ সাল। আলজেরিয়া থেকে নাইট সেন্ট জনের প্রাইভেটিয়ানদের বিরুদ্ধে আরুজ ও খসরুফের অসামান্য অবদানের কথা উল্লেখ করে সুলতান সেলিমের (প্রথম) কাছে পত্র প্রেরণ করা হয়। পত্রে ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে তাঁদের অবিস্মরণীয় কীর্তির উল্লেখ ও আলজেরিয়াকে উসমানী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আবেদন জানানো হয়।

সুলতান তখন মিশর ও সিরিয়া সফর শেষ করে সবেমাত্র ফিরেছেন। পত্র পেয়ে তিনি অত্যন্ত খুশী হন। খসরুফকে আরুজের স্থলাভিষিক্ত করে আলজেরিয়াকে ইসলামি সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করেন। সেদিন থেকে সুলতানের নামে আলজেরিয়ায় খুতবা পাঠ করা শুরু হয়। খসরুফ তাঁর ভাইয়ের অসমাপ্ত মিশন সম্পন্ন করতে যারপরনাই লেগে পড়েন। সুলতান দুহাজার সৈন্য ও একটি তোপখানা দিয়ে খসরুফকে আলজেরিয়া প্রেরণ করেন।

প্রথম সেলিমের পরে খিলাফতে অধিষ্ঠিত হন পূত্র সুলতান সুলেইমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট। তিনিও বাবার মত খসরুফকে সহায়তা করে যান। সুলতান সুলাইমানের যুগেই উসমানীয় সালতানাত সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি লাভ করে। আনাতোলিয়া থেকে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার প্রায় ৫২ লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তন ব্যাপি ইসলামি সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি পায়। মূলত তার দীর্ঘ সারে চার দশকের শাসনকালকেই উসমানীয় সালতানাতের স্বর্ণযুগ বলা হয়।

১৫২৯ সাল। খসরুফ আলজেরিয়ার দ্বীপে স্প্যানিশ একটি দূর্গে আক্রমণ করেন। একাধারে ২০ দিন একটানা গোলাবর্ষণ করলে দূর্গের পতন হয়। স্প্যানিশরা পালিয়ে যায়। অনেকে বন্দি হয়। এ বিজয় খসরুফকে জনমানব ও সুলতানের অনেক নিকটতম করে দেয়।

আন্দালুসের পতন ছোটকালেই খসরুফের হৃদয়ে প্রচণ্ড আঘাত হানে। ছোটকাল থেকেই এ-ই ব্যাথা ও আঘাত খসরুফকে সবসময় বিষিয়ে রাখত। সর্বদা নির্যাতিত আন্দালুসের মুসলিমদের নিয়ে দুশ্চিন্তিত ছিল সে। বড়ো হয়ে তাই নির্যাতিত, নিপীড়িত আন্দালুসিয়ান মুসলমানদের মুক্তি ও নিরাপত্তার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে খসরুফ।

আন্দালুস তখন রোমানিয়ার শাসক পঞ্চম চার্লসের অধীনে। মুসলমানদের ওপর চলছে ভয়াবহ পাশবিকতার নির্মম অত্যাচার। খসরুফ এ বছর ৩৬ টি জাহাজ হাঁকিয়ে আন্দালুসের উপকূলীয় অঞ্চলে গিয়ে অনেক মুসলমানকে মুক্ত করে নিরাপদে আলজেরিয়ায় নিয়ে আসেন। সাত দফায় প্রায় সত্তর হাজার মুসলমানকে আন্দালুসের বর্বরোচিত পৈশাচিকতা থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন।

১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সুলেইমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট খসরুফকে কনস্টান্টিনোপলে আমন্ত্রণ জানান। খসরুফ ৪৪ টি জাহাজের বিশাল বহর নিয়ে কনস্টান্টিনোপল অভিমূখে রওনা হন। এতদিনে তার সুনাম, সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কনস্টান্টিনোপল যাওয়ার পথে যেখানেই যাত্রা-বিরতি করছিলেন, উৎসুক জনতা এক পলক দেখার জন্য তাঁর কাছে ভিড় জমাচ্ছিল। খসরুফের উদারচিত্ত পথচলা জন-মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল।

কনস্টান্টিনোপল পৌঁছলে উসমানীয়রা তাকে অভ্যর্থণা জানায়। রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা প্রদান করে। সুলতান সুলেইমান তার বিরত্ব-গাঁথা গল্প শুনে অত্যন্ত বিমোহিত হন। তাঁকে উসমানীয় নৌবাহিনীর ‘চিফ’ হিসেবে নিয়োগ দেন। আন্দালুসীয় মুসলমানদের প্রতি তাঁর হৃদয়ঙ্গমতা ও অসামান্য অবদানের কারণে ‘খাইরুদ্দীন’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ‘খাইরুদ্দীন’ অর্থ ধর্মের কল্যাণ। বস্তুত মুসলমানদের প্রতি তিনি প্রকৃত কল্যাণের বারিধারা ও হিতাকাঙ্ক্ষী হয়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন।

সুলতান তাকে উত্তর আফ্রিকার গভর্নর পদে নিয়োগ দেন। অস্ত্রাগার ও গোল্ডেন হর্নের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে নতুন ধাঁচে নৌবাহিনী গড়ে তোলার নির্দেশ প্রদান করেন। একটি রত্নখচিত তরবারিও উপহার দেন।

খাইরুদ্দীন খসরুফ নতুন উদ্দীপনায় কাজ শুরু করেন। দ্রুত কাজ চালিয়ে যান। এক বছরেই ৮৪ টি জাহাজ নির্মিত হয়। এ-সব জাহাজের বিশাল বহর নিয়ে তিনি ইতালির বিভিন্ন শহরে আক্রমণ করেন। বেশ কিছু শহর উসমানীয় সাম্রাজ্যভূক্ত হয়।

[৫]
খাইরুদ্দীন ছিল লাল দাঁড়িওয়ালা। ইউরোপীয়রা তাঁর নাম দেয়—রেড বিয়ার্ড বা বারবারোসা। ‘বারবারোসা’ অর্থ লাল দাঁড়িওয়ালা। বড়ভাই আরুজেরও লাল দাঁড়ি ছিল। ইউরোপীয়রা তাঁদের দুইভাইকে ‘বারবারোসা ভ্রাতৃদ্বয়’ বলে অভিহিত করত।

খাইরুদ্দীন বারবারোসা ইতিমধ্যেই তাঁদের জন্য আতংকের নামে পরিণত হয়। একের পর এক আক্রমণে তারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেয়—আরুজের মত খাইরুদ্দীনকেও হত্যা করে তাঁর অস্তিত্ব চিরতরে মিটিয়ে দেবে। ভূমধ্যসাগর থেকে উসমানীয়দের কর্তৃত্ব মিশিয়ে দেবে। তাঁরা ক্রুসেডের সিদ্ধান্ত নেয়। পোপ তৃতীয় জন ক্রুসেডের ডাক দেয়। গোটা ইউরোপ জুড়ে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা।

কিন্তু তাঁরা হয়তো জানে না—বিজয় সবসময় আপন হয়ে আসে না। এতে প্রয়োজন সুদৃঢ় মনোবল আর খোদাই নুসরতের। শুধু সংখ্যার আধিক্য আর অস্ত্রের ঝনঝনানি বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারে না।
তাঁরা গঠন করে সে সময়ের সবচে বড় নৌবাহিনী। সুসজ্জিত নৌবহর। সেনা সংখ্যা ৬০ হাজার। যুদ্ধ-জাহাজ ৩০২ টি। বিশাল বাহিনী।

ইউরোপীয়ানদের ক্রুসেড-প্রস্তুতির খবর খাইরুদ্দীনের কাছে পৌঁছলে তিনিও তাঁর বাহিনী প্রস্তুত করেন। উসমানী বাহিনীর সেনা-সংখ্যা ১২ হাজার। যুদ্ধ-জাহাজ ১২২ টি।
৬০ হাজার সেনার মোকাবিলায় মাত্র ১২ হাজার সেনা। ৩০২ টি যুদ্ধ-জাহাজের মোকাবিলায় মাত্র ১২২ টি যুদ্ধ-জাহাজ। মুসলমানদের বিজয়ের কোনো আভাস ছিল না। সম্ভাবনা ছিল না। শক্তি-সামর্থ্যের বিচারে দূর্বল উসমানী বাহিনীর টেকার কোনো কথা ছিল না।

অবশেষে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর গ্রীসের প্রিভেজা অঞ্চলে উভয় বাহিনী মুখোমুখি হয়।
|| ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ ||
ইউরোপীয়ান বাহিনীর নেতৃত্বে আছেন এন্ডড়িয়া ডোরিয়া। মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্বে আছেন খাইরুদ্দীন বারবারোসা এবং তাঁর সহযোগী হিসেবে আছেন বিখ্যাত মিরআতুল মামালিক গ্রন্থের লেখক সাইয়্যিদ আলী রঈস।
এ-ই যুদ্ধ যে কোন মূল্যেই মুসলমানদের জন্য ছিল অসম। পরাজয় মুসলমানদের প্রচুর ক্ষতি সাধন করবে। ভূমধ্যসাগরের নিয়ন্ত্রণ ক্রুসেডারদের হাতে চলে যাবে। আলজেরিয়া ও উত্তর আফ্রিকাও আক্রান্ত হবে। এজন্য এ যুদ্ধে বিজয় অর্জন করা মুসলমানদের জন্য খুবই গুরুত্ববহ ছিল। প্রচুর তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।

খাইরুদ্দীন বারবারোসা তাঁর বাহিনীকে চারটি বহরে ভাগ করেন। প্রথম তিনটি বহর সম্মুখে রেখে বক্রাকারে এগিয়ে যান। স্বল্প সংখ্যক উসমানী বাহিনী কৌশলে চক্রাকারে ক্রুসেডারদের ঘিরে ফেলতে চায়—এটা দেখে এন্ডড়িয়া ডোরিয়া রীতিমতো অবাক। বিস্মিত।

মুসলিম বাহিনীর বহর থেকে গোলা নিক্ষেপ করা হয়। চতুর্দিক থেকে বেষ্টনী এবং গোলার নিক্ষেপন যুদ্ধের সূচনাতেই ক্রুসেডারদের মনোবলে চির ধরিয়ে দেয়। এন্ডড়িয়া ডোরিয়া যুদ্ধ-জাহাজ পেছনে সরিয়ে নিতে চায়। কিন্তু বাতাস স্থীর থাকায় সফল হয় না।
তুমুল যুদ্ধ ও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। শাহাদাতের পিয়াসায় মুসলিম যোদ্ধারা মরিয়া হয়ে ওঠে। সমুদ্র হয়ে ওঠে বজ্রপাতের ন্যায় মুহুর্মুহু কামান আর গোলার বর্ষণে উন্মাতাল। আহতদের রক্ত ও চিৎকার, জীবিতদের বারুদমাখা স্লোগানে আকাশ-বাতাস সবকিছু উত্তাল হয়ে ওঠে। জমিন কাঁপিয়ে ওঠে। উসমানী বাহিনী এগিয়ে যায়। বিপুল সেনা-সংখ্যা সত্ত্বেও দীর্ঘ সাত ঘন্টার লড়াই শেষে খ্রিস্টানবাহিনী পরাজিত হয়।

যুদ্ধে মুসলমানরা প্রচুর গনীমত লাভ করে। তিন হাজার ইউরোপীয়ান সেনা বন্দি হয়। তাঁদের ৩৬ টি যুদ্ধ-জাহাজ মুসলমানরা দখল করে নেয়। ১৩ টি জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়। মুসলমানদের সকল জাহাজ অক্ষুণ্ণ থাকে। তবে মুসলমানদের ৪০০ সেনা নিহত হয়। ৮০০ জন আহত হয়।

যুদ্ধের ফলাফল সত্যিই ছিল অবিশ্বাস্য। বিজয়ের সংবাদ দ্রুতই পৌঁছে যায় গোটা মুসলিম বিশ্বজুড়ে। মসজিদের মিনার হতে আল্লাহু আকবারের ধ্বনি উচ্চারিত হতে থাকে।
প্রেভেজার এ যুদ্ধ-জয়ের মধ্য দিয়ে সমগ্র ভূমধ্যসাগরে উসমানীয় নৌবাহিনীর একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী তিন শতাব্দী পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরের নিয়ন্ত্রণ ছিল উসমানীয়দের হাতে। ইউরোপসহ বিদেশি জাহাজগুলোকে ভূমধ্যসাগরে চলার জন্য উসমানীয়দের ট্যাক্স দিতে হত।

এ যুদ্ধ-জয়ের মূল শক্তি ও প্রেরণা ছিল খসরুফ খাইরুদ্দীন বারবারোসা। যার অসম নেতৃত্ব ও বিচক্ষণ বিরত্বগাঁথা যুদ্ধ পরিচালনায় ইউরোপীয়দের দাম্ভিকতা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।
তাঁর নেতৃত্বে সমুদ্রপথে ভারত ও মালয় দ্বীপপুঞ্জের মুসলিম রাজ্যগুলোর সাথে উসমানীয়দের সম্পর্ক তৈরি হয়। ভূমধ্যসাগরসহ এ-সকল সমুদ্রপথ জলদস্যুতার কালো থাবা থেকে মুক্তি পায়।

[৬]
খাইরুদ্দীন বারবারোসার গোটা জীবন কেটেছে সমুদ্রে। যুদ্ধ এবং সংগ্রামে। ইসলামের এ-ই মহান যোদ্ধা শৈশব থেকেই যে স্বপ্ন লালন করতেন হয়তো অনেকাংশেই সফল হয়েছেন তিনি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা তাঁর দ্বারা মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমানা সম্প্রসারণের ও নৌপথের মহান খেদমত নিয়েছেন। অথচ হলিউডের মুভিগুলোতে আজ তাঁকে একজন ভয়ংকর জলদস্যু হিসেবে প্রদর্শন করা হয়। তাঁর চেয়েও বড় দুঃখজনক ব্যাপার হলো—আমরা মুসলিমরা অধিকাংশই তাঁকে চিনি না। জানি না।
খাইরুদ্দীন বারবারোসা হয়তো শিক্ষাগত যোগ্যতায় তেমন কিছুই ছিলেন না। পুঁথিগত বিদ্যায় সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু তিনি যে-ই ইতিহাস গড়ে গেছেন, ইসলামের ইতিহাসে যে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন, তা হাজার বইয়ের লক্ষ পৃষ্ঠার তুলনায়ও মূল্যবান কিছু। তিনি তাঁর জীবন চরিতে মুসলিম উম্মাহর জন্য অগণিত শিক্ষা রেখে গেছেন।
খাইরুদ্দীন বারবারোসার পতাকার শীর্ষে সুরা সফের ১৩ নং আয়াত লেখা ছিল —
وَأُخْرَى تُحِبُّونَهَا نَصْرٌ مِنَ اللَّهِ وَفَتْحٌ قَرِيبٌ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ.
‘তিনি আরও একটি অনুগ্রহ দিবেন, যা তোমরা পছন্দ কর; আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য এবং নিকটবর্তী বিজয়। (হে রাসুল) মুমিনদেরকে এর সুসংবাদ জানিয়ে দিন।’
বস্তুত—
❝ আমাদের কোনো শক্তি নেই, সামর্থ্য নেই,
যদি না থাকে নুসরত খোদায়ী,
সকল দাম্ভিকতা তাঁর শক্তির সম্মুখে নিরুপায়,
প্রতিটি বিজয়ে তাঁর রহমতই একমাত্র উপায়। ❞
১৫৪৫ সালে খাইরুদ্দীন বারবারোসা পূত্র হাসান পাশাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে কনস্টান্টিনোপল চলে আসেন। ৪ জুলাই ১৫৪৬ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলেই তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা এ-ই মহান যোদ্ধার কবরকে জান্নাতের শীতল বারিধারায় সিঞ্চিত করুন। আমিন।