ইমাম আহমাদ: পৃথিবীর বুকে এক তারকার গল্প

সাফওয়ান বিন বাসার |
.
সময়টা ১৬৪ হিজরির রবিউল আউয়াল মাস। খিলাফাতের মসনদ তখন উমাইয়াদের অধীনে। ঠিক এমনই কোনো এক সময় জ্ঞানের শহর বাগদাদে সাফিয়্যা বিনতে মাইমুনার কোল জুড়ে আগমন ঘটে এক ফুটফুটে শিশুর। তার নাম রাখা হয় আহমাদ। আহমাদের দাদা হাম্বাল ইবনু হিলাল ছিলেন উমাইয়া খিলাফাতের মার্ভ অঞ্চলের গভর্নর। অভিজাত পরিবার এবং খিলাফাতের শান্ত পরিবেশে বড় হয়ে উঠতে থাকেন আহমাদ। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তার জন্য ভিন্ন কিছু ঠিক করে রেখেছিলেন। আহমাদের বয়স যখন তিন বছর, তখন তার পিতা মুহাম্মাদ ইবনু হাম্বালের মৃত্যু হয়। বাল্যকালেই আহমাদ ইয়াতিম হয়ে যান। মা সাফিয়্যা ছোট্ট আহমাদকে দ্বীনি পরিবেশে লালন করতে থাকেন। তাকে কুরআন হিফযে অধ্যয়ন করান। সে সময়কালে ইসলামি জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু এবং জন্মস্থান বাগদাদেই আহমাদ তার প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে তিনি মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে সরকারি দপ্তরে লেখালেখির কাজের সুযোগ পান। শিক্ষাজীবনের শুরুর দিকে তার শিক্ষক ছিলেন ইমাম কাযী আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ, যিনি ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহর প্রধান ছাত্রদের একজন এবং হানাফি মাযহাবের সম্মানিত ইমাম।

সেসময়কার প্রচলিত ইলম শিক্ষার প্রধান দুটি ধারা ছিল। এক. আহলুর রায়, দুই. আহলুল হাদিস। তিনি আহলুর রায়দের মাদরাসায় কিছুদিন অধ্যয়ন করেন। এতে তিনি যেকোনো মতামত বিশ্লেষণে পারদর্শীতা অর্জনে সক্ষম হন।
১৮৭ হিজরি। আহমাদ ইবনু হাম্বাল তার জীবনের প্রথম হজব্রত পালন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১ হিজরি এবং ১৯৬ হিজরিতেও তিনি হজে গমন করেন। ৩য় হজের পর মক্কাতেই এক বছর অবস্থান করেন। এরপর ১৯৮ হিজরিতে আরো একবার হজ করে ১৯৯ হিজরিতে সেখান থেকে ইয়েমেনে চলে আসেন। সেখানে হাদিস শাস্ত্রের আরেক দিকপাল ইমাম আব্দুর রাযযাক সানা‘আনীর দারসে তার সংকলিত হাদিসগ্রন্থ ‘আল মুসান্নাফ’ থেকে হাদিস শোনেন। উক্ত দারসে ইলমে হাদিসের অন্য দুই পথিকৃৎ ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মুইন এবং ইমাম ইসহাক ইবনু রাহাওয়াইহি উপস্থিত ছিলেন।

খোদ ইমাম আহমাদের ভাষ্যমতে, “আমি পাঁচবার হজ করেছি, যার মধ্যে তিনবার পায়ে হেঁটে। প্রতিবার করেছি বিশ দিরহাম। এর মধ্যে আমি একবার পথ হারিয়ে ফেলি। তখন হাদিসের সেই বিখ্যাত অংশ ياعباد الله دلونا عليدى الطر لق পড়া শুরু করে দিলাম। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি পথ পেয়ে যাই।”
ইমাম আহমাদের উস্তাদগণের মধ্যে ইমাম শাফিয়ি, বাশার বিন মুফাজ্জাল, ইসমাইল বিন আলিয়্যাহ, আব্দুর রাযযাক, ইয়াহইয়া বিন সাইদ, ওয়াকী ইবনুল জিররাহ অন্যতম।
ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে এতটাই নির্ভরযোগ্য ছিলেন যে, তাকে হাদিসের রাবিগণের মধ্যে যে সনদ (ধারাবাহিকতা) সর্বোৎকৃষ্ট হিশেবে বিবেচিত, তিনি তার সর্বশেষ রাবি।
ইমাম আহমেদ ইবনু হাম্বল→ ইমাম শাফিয়ি→ ইমাম মালিক→ নাফে (বিখ্যাত তাবিয়ি এবং ইবনু উমারের ক্রীতদাস)→ সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনু উমার→ রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
হাদিস বর্ণনাকারীদের যতগুলো সনদ রয়েছে, তন্মধ্যে বর্ণনাকারীদের প্রখর স্মৃতিশক্তি এবং মর্যাদার কারণে এই সনদটিকে হাদিস বিশারদগণ ‘আল-সিলসিলাতুল যাহাব’ তথা হাদিস বর্ণনাকারীদের গোল্ডেন চেইন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। [মুহিউদ্দীন মুহাম্মাদ আওয়ামা, তাদরিবুর রাবী: ১/২১৯]

আলী ইবনুল মাদিনী রহিমাহুল্লাহ বলেন, “আল্লাহ তা‘আলা দু’ জন মানুষের মাধ্যমে ইসলামকে রক্ষা করেছেন। রিদ্দার সময় আবু বকর রদিয়াল্লাহু আনহুকে দিয়ে এবং মেহনার সময় ইমাম আহমাদকে দিয়ে।” আদৌতে কিন্তু তাই! কারণ ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বালকে উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য শতাব্দীর মুজাদ্দিদ হিশেবে প্রেরণ না করতেন, তাহলে বলতে দ্বিধা নেই, আমরা কখনো সঠিক ইসলামের চর্চা করতে পারতাম না।

ইমাম বাইহাকি রবী’ই থেকে বর্ণনা করেছেন যে— ইমাম শাফিয়ি একখানা চিঠি দিয়ে আমাকে মিশর থেকে ইমাম আহমাদের কাছে পাঠান। আমি তার বাড়িতে গিয়ে যখন পৌঁছেছি, তখন তিনি ফজরের সলাত শেষ করে ফিরছিলেন। আমি চিঠিটা তার হাতে দিতেই তিনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এটা পড়েছো? আমি বললাম, না। তিনি চিঠি পড়তে শুরু করলেন। অল্পক্ষণ পরেই দেখি তিনি কাঁদছেন। আমি ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? তিনি বললেন, ইমাম শাফিয়ি লিখেছেন– “আমি রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্বপ্নে দেখেছি। তিনি বলেছেন, আহমাদকে আমার সালাম বলবে এবং জানিয়ে দিবে খুব শীঘ্রই ‘কুরআন সৃষ্ট’ মাসআলা নিয়ে তাকে পরীক্ষা করা হবে। সাবধান! সে যেন কিছুতেই ওই ঘৃণ্য তত্ত্ব স্বীকার না করে। এর বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা তার চর্চিত জ্ঞানকে কিয়ামাত পর্যন্ত বহাল রাখবেন।” রবী‘ই বলেন, আমি এই সংবাদ তার কাছে পৌঁছে দিয়েছি বলে পুরস্কার হিশেবে তার (আহমাদের) গায়ের জামাটি খুলে আমাকে দিয়ে দিলেন। আমি জামাটি নিয়ে মিশরে ফিরে আসি এবং ইমাম শাফিয়িকে এসব কথা জানাই। তিনি বললেন, জামাটা তুমিই রেখে দাও আর ওটা চুবিয়ে আমাকে একটু পানি দিয়ে যেও, যেন আমি বরকতের একটু ভাগিদার হতে পারি।

ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহর যুগেই ইলমুল কালাম চর্চাকারীরা গ্রিক দর্শনে প্রভাবিত হয়ে কুরআনকে ‘মাখলুক’ তথা সৃষ্টি বলে দাবি করা শুরু করে। মূলত এ সময়ই মুতাযিলা নামক কুফরি আকিদায় বিশ্বাসী একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে।

আব্বাসি খলিফা হারুন-অর-রশীদের সময় মুতাযিলারা তাদের ভ্রান্ত মতবাদের দাওয়াত দানে সক্রিয় হওয়ায় শক্তভাবে তিনি এদের দমন করেন। কিন্তু খলীফা আল মামুনের মুতাযিলাদের প্রতি ঝোঁক ছিল। এর পেছনে প্রভাবক হিশেবে কাজ করেছিল তার শিক্ষক আবু হুদাইল আল আল্লাফ। সে মুতাযিলাদের একজন নেতাও ছিল! তাই সে খলিফা মামুনের মাথায় বিভ্রান্তিকর আকিদা ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিল। খলিফা মামুন ক্ষমতায় আসার পর মুতাযিলাদের যুক্তিতর্কের মারপ্যাঁচ দেখে বিমোহিত হয়ে যান। এমনকি তাদের খিলাফাতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করেন। মুতাযিলাদের পরামর্শে খলিফা মামুন বাগদাদের সকল আলিমকে দাওয়াত করল। দুর্বল চিত্তের আলিমরা স্বৈরাচারের ভয়ে ‘কুরআন সৃষ্ট’ তত্ত্বের স্বীকৃতি দিয়ে দেয়। কিন্তু ইমাম আহমাদ ও মুহাম্মাদ বিন নূহ সরাসরি অস্বীকৃতি জানান। তাদের দুজনকে উটের পিঠে চড়িয়ে দরবারে আনা হয়েছিল। আসার পথে এক বেদুইন পুরুষ জাবির বিন আমর ইমাম আহমাদকে সালাম জানিয়ে কিছু নাসিহাহ করেছিল— “জনাব, আপনার ব্যক্তিত্ব এই সময় মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান এবং এখন আপনি মুসলমানদের প্রতিনিধি হয়ে দরবারে যাচ্ছেন। কোনো অবস্থাতেই আপনি ‘কুরআন সৃষ্ট’ তত্ত্বের স্বীকৃতি দিবেন না। আপনি যদি আল্লাহর সাথে বন্ধুত্ব রাখেন, তাহলে একটু ধৈর্য রাখবেন। জান্নাত ও আপনার মধ্যে শুধু সময়ের ব্যবধান! শুধু আপনার শহিদ হতে যতটুকু বাকি! আর মৃত্যু! সে তো সবার জন্য অবধারিত। এই পরীক্ষায় যদি আপনি উত্তীর্ণ হয়ে যান, তাহলে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানেই আপনি সফলকাম।”

খলিফা মামুনের দরবারে তাদেরকে এক জায়গায় বসতে দেওয়া হলো। একটু পরেই মামুনের এক খাদেম কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে এসে বলল, “আবু আব্দুল্লাহ! সংকট খুবই মারাত্মক। মামুন খাপ থেকে তলোয়ার বের করে ফেলেছে এবং রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধর হিশেবে শপথ নিয়েছে, আহমাদ যদি ‘কুরআন সৃষ্ট’ তত্ত্বে স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে এই তলোয়ার দিয়ে তার গর্দান উড়িয়ে দিবো।” ইমাম আহমাদ শুনলেন। তারপর হাঁটু গেঁড়ে মাটতে বসে আসমানের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, “ইয়া রব! এই পাপীষ্ঠকে তোমার অনুগ্রহ এমন অন্ধ অহংকারী করে ফেলেছে যে, সে এখন তোমার বন্ধুদের উপর তলোয়ার চালাতেও দ্বিধা করছে না! হে মহান সৃষ্টিকর্তা, যদি কুরআন সৃষ্টি না হয়ে তোমার ‘বাণী’ হয়ে থাকে, তাহলে আমাকে সেই বিশ্বাসের উপর অটল রেখো। এই সত্য কায়েম রাখতে যতো কষ্টই আমাকে সহ্য করতে হোক না কেন, আমি তার জন্য প্রস্তুত।”

পরবর্তীতে ইমাম আহমাদ এ ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আমরা (আমি ও নূহ) অপেক্ষায় আছি। ওদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আতঙ্কে ভরা মুহূর্তগুলো যেন কাটতেই চাচ্ছে না। হঠাৎ চারিদিকে চিৎকার, হট্টগোল, কান্নাকাটি। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে চারিদিকে চাইলাম। কে যেন দৌড়ে যাবার সময় বলে গেল, মামুন মারা গেছে। দু কান শুনছে বটে, কিন্তু কান বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না! ধীরে ধীরে সব জানতে পারলাম, সত্যিই জঘন্য পাপী ও স্বৈরাচারী মামুন মারা গিয়েছে। এরপর প্রহরীরা এসে তাদের কারাগারে নিয়ে যায়।

কিন্তু ইতোমধ্যে মুতাযিলারা যখন বুঝতে পেরেছিল, তাদের রুঁখতে পারবে এমন কেউ আর অবশিষ্ট নেই, সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে। তখন তারা খলিফা মামুনকে নানা চাপ প্রয়োগ করে ২১৮ হিজরিতেই মুতাযিলা মতবাদকে রাষ্ট্রীয় মতবাদ হিশেবে ঘোষণা করিয়ে নিয়েছিল।
মুতাযিলা বিশ্বাসের প্রধান তিনটি আকিদা হলো:
১. ‘কুরআন’কে মাখলুক (সৃষ্ট) মনে করা, একে আল্লাহর কালাম (কথা) বলতে অস্বীকৃতি জানানো;
২. মহান আল্লাহর আরশের উপর সমুন্নত হওয়া অস্বীকার করা, এবং তাকে সৃষ্টির সর্বত্র বিরাজমান বলে দাবি করা;
৩. আখিরাতে আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ অস্বীকার করা।

মুতাযিলাদের মতে— কথা বলা, আরশের উপরে অবস্থান ইত্যাদি কর্মের জন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের প্রয়োজন হয়। আল্লাহর জন্য এরূপ মানবীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য আরোপ করা কুফরি। তাদের মতে, যারা আল্লাহকে দেখতে পাওয়ার দাবি করে, তারা কাফির। কারণ তাকে দেখতে পাওয়ার দাবি করা মানে আল্লাহর আকার সাব্যস্ত করা। আর আল্লাহর আকার দাবি করা কুফরি।
মুতাযিলাদের দাবিকৃত তথাকথিত এই কুফরি থেকে মুসলিমদের বাঁচানোর জন্য খলিফা মামুন (রাজত্ব্: ১৯৮-২১৮ হিজরি) এবং তার পরবর্তী দুজন খলিফা মু‘তাসিম বিল্লাহ (রাজত্ব: ২১৮-২২৭ হিজরি) ও ওয়াসিক (রাজত্ব: ২২৮-২৩২ হিজরি) সকল মুসলিমদের এরূপ আকিদা গ্রহণের নির্দেশ দেন।

হঠাৎ একদিন অন্যান্য বন্দীদের সাথে আহমাদ ইবনু হাম্বাল ও মুহাম্মাদ ইবনু নূহকে নৌকায় তোলা হয়। বেড়ী পরানো হয়েছিল বলে তাদের চলতে, বসতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে মুহাম্মাদ ইবনু নূহ নৌকাতেই ওপারের জগতে পাড়ি জমান। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন!

খলিফা মুতাসিমের খিলাফাতকালে ইমাম আহমাদকে (মুতাযিলাদের মতানুসারে) কুফরি আকিদা গ্রহণের অপরাধে তাকে কারাগারে বন্দী করা হয়। সঙ্গে চলে অসহনীয় অত্যাচার। বিচারপতি মুহাম্মাদ ইবনু আবি দাউদ ও অন্যান্য মুতাযিলা আলিম খলিফার উপস্থিতিতে ইমাম আহমাদের সঙ্গে বিতর্ক করেন। তিনি তাদেরকে বারবার বলেন, “আপনারা যে আকিদাহ দাবি করছেন সেটির পক্ষে কুরআন বা হাদিস থেকে অন্তত একটি বক্তব্য প্রদান করুন। কুরআন, হাদিস বা সাহাবিগণের বক্তব্য থেকে একটি সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করুন, যাতে বলা হয়েছে: কুরআন সৃষ্ট, আখিরাতে আল্লাহকে দেখা যাবে না অথবা মহান আল্লাহর বিশেষণ বিষয়ক বক্তব্যগুলো প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করা যাবে না।”

মুতাযিলারা বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিকে প্রমাণ হিশেবে পেশ করে। ইমাম আহমাদ সেগুলোকে খণ্ডন করে কুরআনে বা হাদিসের সুস্পষ্ট বক্তব্য পেশ করার দাবিতে অটল থাকেন। তখন বিচারপতি ও প্রধান উজির মুহাম্মাদ ইবনু আবি দাউদ খলিফাকে বলেন: “হে আমিরুল মুমিনীন, এ ব্যক্তি একজন মুশরিক। একে হত্যা করুন। এর রক্তের দায় আমি বহন করব।”

খলিফার কাছে এ প্রস্তাব রাখা হলে, ইমাম আহমাদকে বেত্রাঘাতের আদেশ করা হয়। অর্ধমৃত ইমাম আহমাদকে খলিফা বলেন, “আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি, আপনি উম্মাতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম ও ফকিহ। আপনি রাষ্ট্রদ্রোহীতার বিরুদ্ধে কথা বলেন। আমার আনুগত্যের জন্য জনগণকে নির্দেশনা দেন। আমি আমার ছেলে হারুনের জন্য যেরূপ মমতা অনুভব করি, আপনার জন্যেও অনুরূপ মমতা অনুভব করি। তবে কুরআন আল্লাহর অনাদি বাণী, আখিরাতে আল্লাহকে দেখা যাবে ইত্যাদি কুফরি মতবাদ পরিত্যাগ না করলে আপনাকে আমি হত্যা করতে বাধ্য হবো। আপনি এমন কিছু বলুন যে, আমি আপনাকে ছেড়ে দিতে পারি। আমি নিজ হাতে আপনার বাঁধন খুলে দেবো।” অর্ধমৃত ইমাম আহমাদ বারবার বলতে থাকেন, “আমাকে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসুলের সুন্নাহ থেকে কিছু দান করুন।” [যাহাবি, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা: ১১/২৪৬-২৪৮]

বেত্রাঘাতের ফলে ইমাম আহমাদ কয়েকবার অজ্ঞান হন। জ্ঞান ফিরে আসতেই খলিফা মু‘তাসিম তাকে বলত— আহমাদ, আমার কথা মেনে নাও। আমি তোমাকে ছেড়ে দেব। একইসাথে জল্লাদও খলিফার কথা মেনে নিতে বলল। কিন্তু ইমাম আহমাদ তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। পুনরায় বেত্রাঘাত শুরু হলো। ইমাম পুনরায় সংজ্ঞাহীন হয়ে গেলেন। জ্ঞান ফিরলে তিনি দেখলেন, তিনি রাজকীয় এক কামরায় শুয়ে আছেন। হাতে-পায়ে বেড়ীও নেই। ইমাম আহমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবার আদেশ দেয়া হয়েছিল। এ ঘটনা ২২১ হিজরির ২৫ রমাদ্বনের। খলিফা মু‘তাসিমের তখন অনুশোচনায় প্রায় উন্মাদ হওয়ার অবস্থা! বারবার লোক পাঠিয়ে ইমাম আহমাদের খোঁজ নিচ্ছিলেন।

একটু চিন্তা করুন, দশ লক্ষ হাদিসের হাফিয, যার হাজার হাজার ছাত্র ছিল, যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইমাম বুখারি; সেই ইমাম আহমাদকে ‘মুশরিক’, ‘মুরতাদ’ ফাতাওয়া দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে হত্যার ফরমান জারি হলো! ইমাম আহমাদ সম্পর্কে তার এক ছাত্র ইমাম আবি দাউদ বলেন,
“আমাদের মধ্যে সবচেয়ে হাদিস জানে, ইমাম আহমাদ। তাই আল্লাহর রাসুল সম্পর্কেও সবচেয়ে বেশি জানে, ইমাম আহমাদ। তাই আমি আবি দাউদ আর কী করব? আমিও ইমাম আহমাদের মতো পোশাক পড়ি, চলি-ফিরি, খাই।” এথেকেও আমরা একটি শিক্ষা নিতে পারি, সত্যের পথে থাকলে বাধা বিপত্তি আসবেই। তাই সত্যান্বেষীদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।
এক্ষেত্রে স্বয়ং ইমাম আহমাদেরই একটি কথা স্মরণ হয়, সেটি হলো: “হকের পথে যদি তুমি একা থাকে, তাহলে তুমি একাই একটি জামা‘আত।”

কারাবন্দী থাকাকালে এক কারারক্ষী ইমাম আহমাদকে কারাগার থেকে বের করে তার পাহারা দেওয়ার স্থানে নিয়ে আসে।
– ইমাম ইবনু হাম্বাল, এখানে বসুন
– ওহে কারারক্ষী, আমাকে এখানে কেন নিয়ে এলে?
– আমি রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি হাদিস সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি।
– সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম…. কোন হাদিস সম্পর্কে তুমি জানতে চাচ্ছ?
– যালিম ও তার সহযোগীদের ব্যাপারে যে হাদিসটি রয়েছে সেটি। হাদিসটি কি সহিহ?
– যালিম ও তার সহযোগীদের সম্বন্ধে হাদিস তো অগণিত। তার মধ্যে একটি সহিহ হাদিস হলো:
(হাদিসটির সনদ বর্ণনা করার পর)
জাবির রদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,

‘‘একদা নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা’ব বিন উজরাহকে বললেন, ‘আল্লাহ তোমাকে নির্বোধদের শাসনকাল থেকে আশ্রয় দিন।’ কা’ব বললেন, ‘নির্বোধদের শাসনকাল কী?’ তিনি বললেন, ‘আমার পরবর্তীকালে এক শ্রেণীর আমীর হবে; যারা আমার আদর্শে আদর্শবান হবে না এবং আমার পদ্ধতিও অবলম্বন করবে না। সুতরাং যারা তাদের মিথ্যাবাদিতা সত্ত্বেও তাদেরকে সত্যায়ন করবে এবং অত্যাচারে তাদেরকে সহযোগিতা করবে তারা আমার দলভুক্ত নয় এবং আমিও তাদের দলভুক্ত নই। তারা আমার ‘হাওয’ (কাওসারের) পানি পান করার জন্য উপস্থিত হতে পারবে না’।” [মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৪৪৪১]
কারারক্ষী কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বলল,
– আমি কি যালিমের সহযোগী?
– না, তুমি যালিমের সহযোগী নও। যালিমের সহযোগী তো তারা, যারা তাদের চুল আঁচড়ে দেয়, তাদের সামনে খাবার পরিবেশন করে, তাদের জীবনচলার কাজে সহযোগিতা করে। ওহে কারারক্ষী, তুমি যালিমের সহযোগী নও, বরং তুমি নিজেই যালিমদের একজন! [ইবনুল কাইয়িম, মানাকিবুল ইমাম আহমাদ: ১/৪৩১]
.
আল্লাহ দ্বীনের প্রতি ইমাম আহমাদ ও তাঁর সমসাময়িক আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আলিমদের মহান খিদমাত কবুল করুন। মুসলিম উম্মাহর পুনরায় মাথা নাড়াচাড়া দিয়ে ওঠা নব্য মুতাযিলা ফিতনাহ থেকে রক্ষা করুন, যা বিভিন্নভাবে আমাদের গ্রাস করছে!
.
উম্মাতে মুসলিমাহর অনন্য খিদমাতের জন্য লাভ করেছেন “ইমামু আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ” উপাধি। তাঁর কুনিয়াত হলো ‘আবু আব্দুল্লাহ’, অর্থাৎ আব্দুল্লাহর পিতা। পিতার মতো আব্দুল্লাহ রহিমাহুল্লাহও ছিলেন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস। আব্দুল্লাহ তাঁর পিতার কাছ থেকে আকিদা বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে রচনা করেন ‘আস সুন্নাহ’ নামক একটি আকিদার কিতাব, যা সারা বিশ্বের উলামাদের কাছে সমাদৃত।

ইমাম আহমাদ রহিমাহুল্লাহ কোনো এক বিদ‘আতী আলিমকে লক্ষ করে বলেছিলেন, “তার ও আমাদের মাঝে পার্থক্যকারী হবে ‘জানাযা’।” সুবহানাল্লাহ! বাস্তবে কিন্তু হলোও তাই! ৭৭ বছর বয়সে ইমাম আহমাদ আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। ইমাম বাইহাকী ও ইমাম হাকিম তাদের স্ব স্ব কিতাবে বর্ণনা করেন— আব্দুল ওয়াহহাব আল আওয়াকের কাছে যে বর্ণনা পৌঁছেছে তাতে বলা হয়েছে, জাহিলিয়্যাত ও ইসলামের কোনো যুগেই কারো জানাযায় এতো লোকের সমাগম হয়নি। কারো কারো মতে, জানাযায় শরীকের সংখ্যা ছিল চার লাখ; কারো মতে, সাত লাখ। কেউ কেউ বলেন, এর চেয়েও বেশি।

ইমাম ইবনু আবি হাতিম, মুহাম্মাদ ইবনু দারাহ থেকে বর্ণনা করেন যে— আবু যার‘আ মারা যাওয়ার কিছুদিন পর আমি তাকে স্বপ্নে দেখলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, কেমন আছেন আপনি? তিনি জবাব দিলেন, আল্লাহ তা‘আলা আমার ব্যাপারে আদেশ করলেন, ওকে আবু আব্দুল্লাহ, আবু আব্দুল্লাহ এবং আবু আব্দুলাহর সাথে মিলিয়ে দাও! উল্লেখ্য, ইমাম মালিক, শাফিয়ি, আহমাদ তাদের তিনজনই আব্দু আব্দুল্লাহ নামে পরিচিত।