পয়গামে মুহাম্মাদীর উদ্দেশ্য হিসেবে আখলাক

প্রফেসর ডঃ মেহমেদ গরমেজ

আমি আমার জীবনের শুরু থেকে নিয়ে শিক্ষকতা সহ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ত্বপালন কালে আমাদের দেশ এবং মুসলিম উম্মাহর অবস্থাকে সবসময় খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষন করার চেষ্টা করেছি। আমার এই পর্যবেক্ষণে যে বিষয়টি ধরা পড়েছে তা হল মুসলিম উম্মাহ হিসেবে আজ আমরা অনেক সমস্যার সম্মুখীন।

এই সকল বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় হল ইসলামকে বুঝা। ইসলামের বোধগম্যতার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নেই। ইসলাম বোধগম্য কিন্তু আমাদের বুঝার ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। এই ক্ষেত্রে আমি আজকে আখলাক নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
আজ আমরা দুইটি গুরুত্ত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন।

১। সমগ্র উম্মাহ হিসেবে আজ আমরা ‘উসূল’ বা মেথডোলজির সমস্যার সম্মুখীন। উসূল বলতে আমি কেবলমাত্র কুরআন এবং সুন্নাহকে বুঝার উসূলকে বুঝাচ্ছি না। উসূল বলতে আমি সমগ্র দ্বীনকে সঠিক ভাবে বুঝার কথা বলছি। এবং এর মধ্যে আখলাক এর অবস্থান এবং এর গুরত্ত্ব সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।

২) আজ সমগ্র মানবতা এক ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন। এই সকল সংকট একই সাথে এক আখলাকী সমস্যার জন্ম দিয়েছে। মানুষের পারস্পারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, পারিপারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আজ আমরা অনেক বড় সমস্যার সম্মুখীন। আমরা আজ সকলেই একথার স্বাক্ষী যে, আখলাকী দিক থেকে মানবতা আজ সবচেয়ে বেশী অধঃপতনের মধ্যে নিমজ্জিত।

এই বিষয়ের চেয়ে আরও গুরত্ত্বপূর্ণ একটি বিষয় হল, আজ আমরা মূল্যবোধের সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত। আমরা শুধুমাত্র সম্পর্ককেই হারিয়ে ফেলিনি, একই সাথে যে সকল মূল্যবোধ, আচার-আচরণকে আখলাকে পরিণত করে আমরা সে সকল বিষয়কে হারিয়ে ফেলেছি। মুসলিম উম্মাহ হিসেবে আমাদের দায়িত্ত্ব ছিল সমগ্র মানবতাকে আখলাকের শিক্ষা দেওয়া।
আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে আখলাকের ৩ টি উৎস আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
১। শক্তি,
২। কামনা-বাসনা,
৩। স্বার্থ।

এই সকল বিষয়ের মূল ভিত্তি সমূহ আমাদের সকলের কাছেই সুস্পষ্ট। গ্রীক সভ্যতায়, রোমান সভ্যতায় এবং এনলাইটেনমেন্ট দর্শনে (Enlightenment Philosophy) একে অপরকে প্রতিপালিত কারী এই তিনটি ধারণা বা তাদের ভাষায় নৈতিক মূল্যবোধ সবসময় সামনে এসেছে। শক্তি, স্বার্থ এবং কামনা এই তিনটি হল তাদের সভ্যতার মূলভিত্তি। তাদের সকল কিছুই এই তিনটির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

দুঃখ জনক হলেও সত্য এই তিনটি বিষয় অর্থাৎ শক্তি, কামনা এবং স্বার্থ আজ মুসলমানদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ মুসলমানদের দায়িত্ত্ব ছিল তাদেরকে আখলাকের মৌলিক মূল্যবোধসমূহ শিক্ষা দেওয়া। এই তিনটি বিষয় (শক্তি, স্বার্থ এবং কামনা) মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় না। মুসলিম দার্শনিকগণ এই ‘কামনা-বাসনা’ না সাদাতে দারাইন অর্থাৎ উভয় জগতে সুখ-শান্তি নামে নামকরণ করেন। কিন্তু আধুনিক সময়ে এসে কামনা- বাসনা (Pleasure, Enjoyment) পুনরায় সাদেত (সুখ-শান্তি) র স্থান দখল করেছে। ‘শক্তি,ক্ষমতা এবং আখলাক’ এদের মধ্যেকার সম্পর্ক এবং ব্যক্তিস্বার্থকে সামাজিক স্বার্থের উপরে স্থান দেওয়া আজ আমাদের জন্য অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ।

মৌলিক আখলাককে হারিয়ে ফেলার চেয়েও বড় বিষয় হল, যে সকল মূল্যবোধ আচার- আচরণকে আখলাকে পরিণত করে সেসকল মূল্যবোধকে হারিয়ে ফেলা, মিয়ি’য়ার (معيار) কে হারিয়ে ফেলা, মিযানকে হারিয়ে ফেলা। কোন ধরণের আচরন আখলাকী এবং কোনটি আখলাকী নয় সেটা হারিয়ে ফেলা। এই বিষয়টিও উসূলের সাথে সম্পৃক্ত একটি বিষয়। এর একটি অংশ হিসেবে আমরা মূল্যবোধের ক্রমধারা (Hierarchy of Values) কে হারিয়ে ফেলেছি। যে সকল মূল্যবোধ, আচার-আচারণকে আখলাকে পরিণত করে কেবলমাত্র সেই সকল বিষয়কে শনাক্ত করাটাই যথেষ্ট নয়। একই সাথে সবসময় মূল্যবোধের ক্রমধারা (Hierarchy of Values) কে সঠিকভাবে শনাক্ত করাও অতীব গুরত্ত্বপূর্ণ।

যদি তা না করা যায় তাহলে, যে মু’মিন মূল্যবোধের ক্রমধারা (Hierarchy of Values) কে হারিয়ে ফেলেছে তার কাছে হাজারে আসওয়াদকে চুম্বন করা হাজারো মুসলমানকে কষ্ট দেওয়ার চেয়ে শ্রেয়।

যে মু’মিন মূল্যবোধের ক্রমধারা (Hierarchy of Values) কে হারিয়ে ফেলেছে, সে দুই রাকাত তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করার জন্য শত শত মানুষকে কষ্ট দেওয়াটাকেও স্বাভাবিক মনে করবে।

মূল্যবোধের ক্রমধারা (Hierarchy of Values) কে হারানো একটি উম্মাহ, আরাফাতে ইহরাম অবস্থায় থাকার সময় একটি মশা-মাছি ও যেন না মরে এই জন্য সতর্ক অবস্থায় থাকবে কিন্তু ফেরার সময় শয়তানকে পাথর মারতে যাওয়ার সময় শত শত মানুষকে মাড়িয়ে যেতেও দ্বিধা করবে না।

মূল্যবোধের ক্রমধারা (Hierarchy of Values) কে হারানো একজন মু’মিন একটি নফল ইবাদতের জন্য অন্য মানুষকে কষ্ট দিতেও দ্বিধা করবে না।

এই জন্য, মানুষের সাথে সম্পর্ক এবং আখলাক যতটা গুরুত্ত্বপূর্ণ, মূল্যবোধের ক্রমধারা (Hierarchy of Values) কেও শনাক্ত করা ততটাই গুরত্ত্বপূর্ণ।

আচরণকে আখলাকে পরিণতকারী মূল্যবোধ সমূহকে শনাক্ত করা যতটা গুরত্ত্বপূর্ণ (যদিও এটা উসূলের বিষয়), মূল্যবোধের ক্রমধারা (Hierarchy of Values) কেও শনাক্ত করা ততটাই গুরত্ত্বপূর্ণ।

শুধুমাত্র মূল্যবোধের ক্রমধারা (Hierarchy of Values) নয়, এর চেয়েও বড় ভুল এবং বিপদজনক বিষয় হল, মূল্যবোধ সমূহের স্থান পরিবর্তন!
-খারাপ কে ভালো, আর ভালোকে খারাপ বলে আখ্যায়িত করা।
– সুন্দর এবং অসুন্দরের মধ্যে স্থানের পরিবর্তন।
-উপকারি এবং অপকারীর মধ্যে স্থানের পরিবর্তন ।
-হক্ব এবং বাতিলের মধ্যকার স্থান পরিবর্তন।

অবক্ষয়কে দ্বীনের সাথে সম্পৃক্ত করণ। আমাদের গাইরে আখলাকী ভুল কাজ সমূহকে জায়েজ করার জন্য দ্বীনের মধ্যে রেফারেন্স খোঁজার চেষ্টা করা। গাইরে আখলাকী বিষয়কে ধর্মীয়করণ করা। আমাদেরকে আখলাকে হামিদিয়া শিক্ষা দেওয়ার জন্য যে দ্বীন এসেছে সে দ্বীনকে আমরা আমাদের গাইরে আখলাকী আচরণের সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছি।
ফিকহের আখলাককে আমরা হারিয়ে আজ বাহ্যিক মাসআলা মাসায়েল নিয়ে ব্যতি ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। ইবাদতের উদ্দেশ্যকে ভুলে গিয়ে কিছু বাহ্যিক আচার আচরণের মধ্যে আজ আমরা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছি। ইবাদত সমূহকে শুধুমাত্র বাহ্যিক কিছু আচার আচরণের মধ্যে নামিয়ে নিয়ে আসা একজন মুসলমানের জন্য এবং মুসলিম সমাজের জন্য সবচেয়ে বড় মুসিবত সমূহের মধ্যে একটি।
ইসলামকে বুঝার ক্ষেত্রে আমারা যে উসূল নির্ধারণ করেছি সে উসূলে আমরা আখলাকের কোন স্থান দেইনি।

প্রিয় ভাইয়েরা আমার,
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার রাসূলকে কেন এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন এটাকে তিনি পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার রাসূলকে পাঠিয়েছেন; সমগ্র মানবতার জন্য হক্ব ও আদালত প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং তাওহীদের বানীকে সমগ্র দুনিয়াতে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। এটাকে পয়গামে (রিসালাতে) মুহাম্মদীর উদ্দেশ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

রাসূল তার আগমের উদ্দেশ্যকে নিজে বর্ণনা করেছেন। তার সেই বর্ণনা আমরা হাদীস শরীফের মাধ্যমে জানতে পারি। এই সকল হাদীস সমূহের মধ্যে চারটি হাদীসকে যদি আমরা হাইলাইট করি তখন দেখতে পাই যে, এর মধ্যে একটি হল,
بعثت بالحنيفية السمحة

অর্থাৎঃ ফিতরাতের সাথে সবচেয়ে সঙ্গতিপূর্ণ তাওহীদের এই দ্বীনকে সমগ্র পৃথিবীতে প্রচার করার জন্য প্রেরিত হয়েছি।
এই সকল হাদীসের মধ্যে একটি হল,
بعثت رحمة
আমি রহ্মত হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।
পবিত্র কোরআনেও মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার রাসূলকে প্রেরণের উদ্দেশ্য হিসেবে বলেছেন,
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ
অর্থাৎঃ হে মুহাম্মাদ! আমি যে তোমাকে পাঠিয়েছি, এটা আসলে দুনিয়াবাসীদের জন্য আমার রহমত৷
আমাদের আজকের এই আলোচনার ‘শিরোনাম’ ঠিক করার ক্ষেত্রে আমরা যে হাদীসের সাহায্য নিয়েছি সে হাদীসটি হল,
إنما بعثت لأتمم مكارم الأخلاق))
অর্থাৎঃ আমি আর অন্য কোন কারণে নয়, শুধুমাত্র মাকারীমে আখলাককে পরিপূর্ণ করার জন্য প্রেরিত হয়েছি।
রিসালাতে মুহামদ্দীর উদ্দেশ্য সম্পর্কিত সকল আয়াত এবং হাদীসকে আমরা একত্রিত করলে দেখতে পাই যে, রাসূলে আকরাম (সঃ) কে দুনিয়াতে প্রেরণের চারটি গুরুত্ত্বপূর্ণ হিকমত রয়েছে।

১। তাওহীদ,
২। আদালত
৩। আখলাক
৪। রহমত
আমার আজকের এই আলোচনায় শুধুমাত্র আমি আখলাকের উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করব। কিন্তু আমাদের আখলাক, রহমত থেকে আলাদা নয়। আমাদের আখলাক তাওহীদ থেকে আলাদা নয়। আমাদের আখলাক আদালত থেকেও ভিন্ন নয়।
দ্বীন ইসলামকে ঈমান, ইবাদত, আখলাক এবং মুয়ামালাতে বিভক্ত করা কতটুকু সঠিক হয়েছে বা ভুল হয়েছে তা নিয়ে আমাদের নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন।

‘আখলাক’ শব্দটি শব্দগত দিক থেকে, মানুষের ‘সমগ্র আধ্যাত্মিক অস্তিত্ব’ কে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত একটি পরিভাষা। মানুষের ‘বস্তুগত’ বা ‘দৈহিক’ অস্তিত্বকে ‘খালক’ বলে থাকি। আর মানুষের সকল আধ্যাত্মিক অস্তিত্বকে ‘খুলক’ বলে থাকি।
আখলাকের মাসদার খুলক শুধুমাত্র আচার আচরণ অর্থে নয়। ‘আদব’ নামক পরিভাষার চেয়ে এটা ভিন্ন। ইংরেজিতে Morality and Ethics এর মধ্যে যেমন পার্থক্য রয়েছে তেমনিভাবে আদব এবং খুলকের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। ‘আদব’ খুলকের একটি শাখামাত্র। ‘আদব’ কেবলমাত্র ‘আখলাক’ এর আচার-আচরণকে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত একটি শব্দ। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে ‘খুলক’ শব্দের দ্বারা মানুষের আধ্যাত্মিক অস্তিত্ব বুঝানো হয়ে থাকে। মানুষের আধ্যাত্মিক এবং বস্তুগত অস্তিত্বের মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে। মানুষ কেবলমাত্র বস্তুগত অস্তিত্বের দিক থেকে বেঁচে থাকতে পারে না, একই সাথে তাকে আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের দিক থেকেই বেঁচে থাকতে হয়।

إنما بعثت لأتمم مكارم الأخلاق))
এই হাদীসটিকে আগে আমি এই ভাবে বুঝতাম, হযরতে আদম থেকে শুরু করে ইসলাম নামক একটি প্রসাদ রয়েছে, একই সাথে একটি আখলাক রয়েছে। নবীদের সাথে সাথে আখলাক পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। আমিও সেই নবীদের মধ্যে সর্বশেষ নবী হিসেবে এই আখলাককে পরিপূর্ণতা দানের জন্য এসেছি।

কোন কোন আলেমগণ এই হাদীসটিকে এইভাবে ব্যখা করেছেন আমিও এই রকমই ভাবতাম। কিন্তু পরে যখন এটা নিয়ে চিন্তা গবেষণা করলাম তখন দেখতে পেলাম যে, এর অর্থ দাঁড়ায়ঃ মানুষ ফিতরাতগত (সৃষ্টিগত দিক থেকে) ভাবে আখলাকী একটি সৃষ্টি। অর্থাৎ মানুষ সৃষ্টিগত দিক থেকে আখলাকের অধিকারী। মানুষের ফিতরাতের মধ্যকার এই আখলাককে পরিপূর্ণতা দান করার জন্য আমি এসেছি। প্রতিটি মানুষের ফিতরাতের মধ্যেই আখলাক রয়েছে। মানুষ জন্মগতভাবে যেমন খালকের অধিকারী, তেমনি ভাবে মানুষ জন্মগতভাবে খুলকেরও অধিকারী। রাসূল (সঃ) এর এই হাদীসের মূল কথা হল, সকল মানুষের মধ্যে যে আখলাক রয়েছে সে আখলাককে পরিপূর্ণ করার জন্য আমি এসেছি। তবে এটা কেবলমাত্র ইসলামের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা পেতে পারে, রিসালাতে মুহাম্মদীর মাধ্যমে পরিপূর্ণতা পেতে পারে।

রাসূলে আকরাম (সঃ) এর একটি আয়না দোয়া রয়েছে। আয়না দেখার সময় তিনি এই দোয়া পড়তেন । দোয়াটি হল,
اللَّهُمَّ أَحْسَنْتَ خَلْقِي فَأَحْسِنْ خُلُقِي
অর্থাৎ, হে আল্লাহ তুমি আমার বাহ্যিক অবয়বকে যেমভাবে সুন্দর করেছ তেমনি ভাবে তুমি আমার আখলাকেও সুন্দর করে দাও।
তুমি আমার বস্তুগত অস্তিত্ব oboyob (বাহ্যিক) কে যেমন ভাবে সুন্দর করেছ আমাদের আধ্যাত্মিক অস্তিত্বকেও সুন্দর করে দাও। আখলাককে এই ভাবে সামগ্রিকভাবে দেখার প্রয়োজন।

এই আখলাককে যখন আমরা সামগ্রিকভাবে দেখার পর, যখন আমরা উলুমে ইসলামিয়ার শ্রেনীবিন্যাসের দিকে তাকাই, তখন আমরা রিসালাতে মুহাম্মদীর উদ্দেশ্য হিসেবে আখলাককে আমরা দেখতে পাই না। আখলাককে আমরা উসূলের মধ্যে খুঁজে পাই না। ইতিকাদীর বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত করে আমরা আখলাককে পড়ি না।

আল্লাহ এবং মানুষের মধ্যে যে সম্পর্ক এর আখলাকী দৃষ্টিকোনকে আমরা গুরত্ত্ব দেই না। মুয়ামালাতের যে ফিকহ রয়েছে সেখানেও আমরা আখলাককে খুঁজে পাই না। খুঁজে পেলেও দেখতে পাই যে, আখলাককে এক কিনারায় রেখে দেওয়া হয়েছে। ফিকহের মৌলিক বিষয় হিসেবে আমরা আখলাককে পাঠ করি না। উসূলের উদ্দেশ্যে হিসেবে আমরা আখলাককে পাঠ করি না।
ইবাদতের উদ্দেশ্য যে আখলাক এটা উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে আমরা সবসময় দুর্বলতার পরিচয় দিয়ে থাকি।

এই জন্য আমি আখলাককে কেবলমাত্র একটি আখলাকী বিষয় হিসেবে নয়, ইসলামকে বুঝার ক্ষেত্রে আমাদের যে উসূল রয়েছে সেটার মধ্যে এটাকেও সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।

কেন আমি এই কথা বলছি? এই কথা বলার কারণ হল, যখন আমি সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মধ্যকার পারস্পারিক সম্পর্কের দিকে তাকাই তখন দেখতে পাই যে, তাদের পরিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, রাস্তা-ঘাটে এবং হাট-বাজারে ‘আখলাক’ নামক বিষয়টি দ্বীনদার শব্দের মধ্যে যেন হারিয়ে গেছে। দ্বীনদারীর মধ্যে আখলাককে খুঁজে পাওয়া খুব কষ্টকর হয়ে যায়।

আমাদের দ্বীনদারিত্ত্ব কেন আখলাকের জন্ম দিচ্ছে না? দ্বীনদার মানুষরা কেন আজ আখলাকী একটি জীবন যাপন করতে পারছে না?

যুবকরা সব সময় আমাদেরকে যে প্রশ্নটি করে থাকে তা হল, কেন মুসলমানগণ অনুকরণীয় মানুষ হতে পারে না?
গভীর রাতে উঠে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় কারী মানুষটির মধ্যে কেন আমরা তার প্রতিবেশীর সাথে, তার স্ত্রী ও সন্তানসন্তুতির সাথে আচার আচরণে এবং তার ব্যবসা বাণিজ্যে আখলাকে হামিদার (প্রশংসিত চরিত্র) কোন নিদর্শন দেখতে পাই না।

মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে তাকওয়া শব্দটি দুইশত বারের বেশী উল্লেখিত হয়েছে। এই ২০০ স্থানে উল্লেখিত ‘তাকওয়া’ পরিভাষাটির আগে ও পরে যদি আমরা ভালো করে তাকিয়ে দেখি তাহলে দেখতে পাই যে, শতকরা ৯০ ভাগই হল আখলাক সম্পর্কিত।

কিন্তু আমরা ‘তাকওয়ার’ সংজ্ঞা দেওয়ার সময় এইভাবে দিয়ে থাকি, ‘অমুক ভাই আওয়াবিনের নামাজ কখনোই পরিত্যাগ করেন না। তিনি কতই না মুত্তাকী একজন মানুষ’। এই ধরণের কথা আমরা অনেক শুনে থাকি।

দয়া করে কেউ আমাকে ভুল বুঝবেন না। নফল ইবাদত সমূহকে একজন মু’মিন কখনোই ছোট করে দেখতে পারে না। এমন ভুল একজন মুমিন করতে পারে না। নৈশকালীন এবং যে কোন ধরণের সুন্নতকে পালন করার ক্ষেত্রে একজন মু’মিন কখনই সেটাকে ছোট করে দেখতে পারে না। এই সকল ইবাদতের গুরুত্ত্ব অনেক।

কিন্তু কেউ একথা বলে না যে, ‘ অমুক ব্যক্তি তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকা অবস্থায় রাতে ঘুমায় না। সেই কতই না মুত্তাকি একজন ব্যক্তি’। তাকওয়ার এই ধরণের সংজ্ঞা আমরা সাধারণত শুনি না।

‘অমুক ব্যক্তি চল্লিশ বছরের মধ্যে একবারের জন্যও তার স্ত্রীকে কষ্ট দিয়ে কোন কথা বলেনি। সে কতই না মুত্তাকি একজন ব্যক্তি’।
‘অমুক ব্যক্তি তার প্রতিবেশীর সাথে অনেক সুন্দর আচরণ করে, সে কতই না মুত্তাকী একজন মানুষ’। এই ধরণের সংজ্ঞা আমরা শুনি না।

কিন্তু ‘অমুক ব্যক্তি দিনে এত হাজার বার আল্লাহর জিকির করে। সে কতই না মুত্তাকী একজন মানুষ’। ‘অমুক কখনোই তাহাজ্জুদ নামাজ পরিত্যাগ করে না। সে কতই না মুত্তাকী একজন ব্যক্তি’। এই ধরণের কথা আমরা অনেক বেশী বেশী শুনে থাকি।

তাকওয়া এবং কোরআনে উল্লেখিত তাকওয়া পরিভাষার সাথে সম্পৃক্ত সকল শব্দের আখলাকের সাথে সম্পর্ক রয়েছে, ইতিকাদের সাথে সম্পর্ক রয়েছে ইবাদতের সাথে সম্পর্ক রয়েছে। তবে আখলাককে ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এই কথা আমি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে চাই।

উসূল সম্পর্কিত যত বই আছে আমি সকল বই দীর্ঘদিন ধরে পড়ার চেষ্টা করছি। আমাদের উসূলে ‘মাকাসিদ’ নামে একটি পদ্ধতি রয়েছে। এটা শুরু করেন ইমাম জুয়াইনি ও ইমামা গাজালি। পরবর্তীতে এই ধারণা নিয়ে আরও কাজ করেন ইজজ বিন আব্দুস সালাম সহ আরও অনেকেই।

পরবর্তীতে আন্দালুসিয়াতে ইমাম শাতিবি তার তার শিক্ষকদের সাথে এটাকে একটি আলাদা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। তারা ইসলামের সকল হুকুম আহকামকে তিনভাগে বিভক্ত করেন।
১। ضَرُورِيَّاتِ
২। حاجِيَّاتِ
৩। تحسينيات

কিন্তু তারা আখলাককে تحسينيات এর মধ্যে স্থান দিয়েছে। এটাকে নিয়ে আমাদের পুনরায় আলোচনা ও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। ضَرُورِيَّاتِ এর মধ্যে কি আখলাক নেই? حاجِيَّاتِ এর মধ্যে কি আখলাক নেই?

মাকাসিদ যেমনি ভাবে আহকামের রূহ, তেমনি ভাবে আখলাকও আহকামের আকল।

মরক্কোতে আমাদের একজন মুসলিম দার্শনিক রয়েছে। তিনি অনেক বড় একজন দার্শনিক। তিনি এখনো জীবিত। তার নাম তাহা আব্দুর রহমান। তার বই সমূহ এখন তারকিশ ভাষায় অনুবাদ করা শুরু হয়েছে।

تخليق المقاصيد নামক তার একটি প্রজেক্ট রয়েছে। অনুবাদ করলে এর অর্থ দাঁড়ায়, মাকাসীদের আখলাকীকরণ। ইসলামের মূল উদ্দেশ্যসমূহের মধ্যে আখলাককে স্থাপণ করা।

আখলাককে কেবলমাত্র تحسينيات এর মধ্যে চিন্তা করা মোটেই সঠিক নয়। আখলাককে কেবল মাত্র আমরা এসথেটিকের একটি কিনারায় চিন্তা করতে পারি না। নামাজের উদ্দেশ্য হল আখলাক, রোজার উদ্দেশ্যও আখলাক, হজ্জ তো নিজেই একটি আখলাকী মক্তব। আমাদের জীবনকে পুনর্বিন্যাস করার জন্য উমরা একটি আখলাকী মক্তব। আমাদেরকে আখলাক সম্পন্ন বানানোর জন্যই ইসলামের সকল ইবাদত সমূহকে নির্দেশ করা হয়েছে।

আমরা যদি আখলাককে ফিকহের উদ্দেশ্য হিসেবে পরিণত করতাম তাহলে, ফিকহের গ্রন্থ সমূহে الحيل নামে কোন অধ্যায় থাকত না। প্রতারণার মাধ্যমে আমরা কিভাবে সমাধান পেতে পারি এমন কোন অধ্যায় আমাদের ফিকহের গ্রন্থ সমূহে থাকত না। الحيل হল ( উদাহরণ স্বরূপ ধরুন আপনি আর আমি (এক্স) বসে আছি, আপনার কাছে ফোন আসল। ওপাশ থেকে আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হল যে, এক্স ব্যক্তি আছে কিনা? কিন্তু আমি আপনাকে ইশারা করে বললাম যে, আমার কথা না বলতে। কিন্তু আপনি মিথ্যাও বলতে পারছেন না। পরে আমি উঠে বাহিরে গেলে আপনি বলবেন যে, সে তো এখানে নাই। এই ধরণের আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া সম্ভব)

প্রিয় ভাইয়েরা,
আমি বিশেষ করে বলতে চাই যে, আখলাকের একটি গ্রন্থ হিসেবে মহাগ্রন্থ আল কোরআনকে এবং হাদীস ও সুন্নাহকে আখলাকের বাস্তব নমুনা হিসেবে আমাদের পুনঃবিবেচনা করা প্রয়োজন।

খুলক এবং আখলাক এই শব্দদয় কোরআনে কারীমে খুব কম এসেছে। কিন্তু কোরআনের আখলাক সম্পর্কিত পরিভাষাগত দৃষ্টিভঙ্গীকে যদি সামনে নিয়ে আসেন তাহলে বিশ্বাস করুন পৃথিবীতে আখলাক সম্পর্কিত যত বই আছে তা এবং আখলাক সম্পর্কিত যত দার্শনিক আছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী নিতান্তই সামান্য মনে হবে।

আমি হাদীসের একজন ছাত্র। সারাজীবন হাদীস নিয়ে গবেষণা করার তওফিক মহান আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। এই তওফিককে কাজে লাগিয়ে হাদীস গ্রন্থ হিসেবে পরিচিত সকল গ্রন্থ কমবেশী পড়ার সুযোগ হয়েছে। আমার গবেষণার উপর ভিত্তি করে আমার সামান্য জ্ঞানের আলোকে ‘আখলাক এবং মূল্যবোধের মধ্যকার সম্পর্ক’ কি আমি ৮ টি পয়েন্টে আলোচনা করব।

ক) উপকারি এবং অপকারী সম্পর্কিত মূল্যবোধ সমূহঃ
এটা একদম সুস্পষ্ট। ইসলামী ফিকহ এটার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এটা উপকারী এটা অপকারী। উপকারী এবং অপকারী সম্পর্কিত বিষয়টি বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই ফিকহের বিষয়। এই সকল বিষয় আইনগত বিষয়। আইন হল আখলাকের সর্বনিম্ন পর্যায়। ২৮ঃ ১২ থেকে ২৮ঃ২৪ সেকেন্ড

আমরা আখলাককে কেবলমাত্র আইনের একটি উৎস হিসেবে কল্পনা করে থাকি এবং আইনকে সবসময় উচ্চ মর্যাদা দিয়ে থাকি। আদালতকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আইন অনেক বেশী গুরত্ত্বপূর্ণ হওয়ায়, আইন অবশ্যই গুরুত্ত্বপূর্ণ। আদালত অবশ্যই গুরুত্ত্বপূর্ণ। তবে আমাদের এটা সবসময় মনে রাখা উচিত যে, আইন হল আদালতের সর্বনিম্ন পর্যায়। আইন কেবলমাত্র আমাদের জন্য কোনটি উপকারী আর কোনটি অপকারী এই বিষয়টিকে সুস্পষ্ট করে থাকে। কোন ধরণের অপকারী কাজ করলে কোন ধরণের শাস্তি প্রয়োগ করা হবে বা কোন ধরণের তদবীর নেওয়া হবে এবং মানুষের জান, মাল, ইজ্জত, আকল এবং দ্বীনকে রক্ষা করার জন্য গৃহীত মূলনীতি সমূহ মূলত উপকারী এবং অপকারী বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত মূল্যবোধ সমূহকে উল্লেখ করে থাকে।

খ) সুন্দর এবং অসুন্দরের সাথে সম্পর্কিত মূল্যবোধ সমূহঃ এসথেটিক বা সৌন্দর্যতত্ত্ব সম্পর্কিত জ্ঞান এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করেছে। কোনটি সুন্দর কোনটি অসুন্দর? মূলত হুসুন এবং কুবুহ শুধুমাত্র আখলাকের সাথে সম্পৃক্ত একটি বিষয় নয়, কালাম এবং আকীদার সাথেও সম্পৃক্ত একটি বিষয়। কোনটি সুন্দর এবং কোনটি অসুন্দর এটা নির্ধারণ করার ক্ষমতা আসলে মানুষকে কতটুকু দেওয়া হয়েছে? মানুষের ফিতরাতের বিপরীত কোন ব্যাপারে কি আল্লাহ নির্দেশ দিতে পারেন? মানুষের ফিতরাত যে বিষয়কে অসুন্দর হিসেবে গ্রহণ করে মহান আল্লাহ কি কখনো সে বিষয়টি মানুষকে করতে বলেন? (নাউযুবিল্লাহ) এই ধরণের (হুসুন ও কুবুহর মধ্যকার) বিতর্ক একই সাথে ইলমুল কালামের সাথে সম্পৃক্ত একটি বিষয়। ইলমুল কালাম এই বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে থাকে। এই বিষয়টি একই সাথে উসূলে দ্বীনেরও বিষয়, উসূলে দ্বীনও এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে থাকে। তবে হাদীস সমূহেও এই বিষয়কে একটি মূল্যবোধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।

গ) ভালো এবং মন্দের সাথে সম্পর্কিত মূল্যবোধ সমূহঃ
ভালো এবং মন্দের সাথে সম্পর্কিত মূল্যবোধ সমূহ, আমাদের সকল আখলাকী আচরণ সমূহের আধ্যাত্মিক দিক সমূহ এবং আধ্যাত্মিকতার সাথে সামঞ্জস্যহীন বিষয় সমূহকে ব্যক্ত করে থাকে। যেমন সহীহ হাদীস সমূহে ২৫ টি হাদীস রয়েছে যা خير الناس দিয়ে শুরু হয়েছে।
যেমন,
خير الناس انفعهم لناس
মানুষের মধ্যে ওই ব্যক্তি সর্বোত্তম যে ব্যক্তি মানুষের সবচেয়ে বেশী উপকার করে।

خير الناس احسنهم خلقا
সর্বোত্তম মানুষ হল সেই যার আখলাক সবচেয়ে উত্তম।

خير الناس خيركم لنسائه و بناته
‘সর্বোত্তম মানুষ হল সেই, যে তার কন্যাসন্তানদের সাথে ও তার স্ত্রীর সাথে সুন্দর আচরণ করে’।
এই হাদিসে বিশেষভাবে কন্যা সন্তানদের কথা উল্লেখ করার কারণ হল, সেই সময়ের আরবের সামাজিক প্রথাকে ভাঙ্গার জন্য।

خير بيوتكم بيت فيه يتيم مكرم
সবচেয়ে উত্তম ঘর হল সেই ঘর যে ঘরে এতিম রয়েছে, আর সেই এতিমদের সাথে সুন্দর আচরণ করা হয়।
خير دينكم ايسره
সবচেয়ে উত্তম দ্বীনদারিত্ব হল, দ্বীন ইসলামের সহজতার যে মূলনীতি সেটাকে বাদ না দিয়ে করা দ্বীনদারগিরি।
خَيْرُكُمْ مَنْ يُرْجَى خَيْرُهُ وَيُؤْمَنُ شَرُّهُ
তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই ব্যক্তি যার কাছ থেকে সব সময় ভালো কিছু আশা করা যায় এবং মানুষ যার কাছ থেকে নিরাপদ (অর্থাৎ সে কোনদিন খারাপ কিছু করবে না মানুষ এই ব্যপারে নিশ্চিত থাকে)।

خَيْرُكُمْ مَنْ لَمْ يَتْرُكْ آخِرَتَهُ لِدُنْيَاهُ ، وَلا دُنْيَاهُ لآخِرَتِهِ
তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি সর্বোত্তম যে তার দুনিয়ার জন্য আখেরাতকে এবং আখিরাতের জন্য দুনিয়াকে পরিত্যাগ করে না।

خير الابواب خير الصداقة
সবচেয়ে উত্তম দরজা হল সে দরজা যে দরজায় সাদকা (দান) করা হয়।

خَيْرُ الدَّوَاءِ الْقُرْآنُ
সবচেয়ে উত্তম ঔষধ হল আল-কোরআন।
তবে এটা মনে রাখতে হবে যে, আমাদের শারীরিক কোন রোগের ঔষধ নয়। আমাদের রূহের, ক্বালবের ঔষধ হল এই কোরআন।

خَيْرُكُمْ مَنْ أَطْعَمَ الطَّعَامَ
তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি সর্বোত্তম যে মানুষকে খাদ্য খাওয়ায়।

خيركم من تعلم القرآن وعلمه
তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি সর্বোত্তম যে নিজে কোরআন শিখে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়।

خير الناس أقرؤهم وأفقههم في دين الله”
মানুষের মধ্যে ওই ব্যক্তি সর্বোত্তম যে আল্লাহর কিতাব বেশী বেশী পড়ে এবং দ্বীনের ব্যাপারে সব চেয়ে বেশী জ্ঞানী।

خير النَّاس ذو القلب المخْمُوم واللِّسان الصَّادق
তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি উত্তম যার অন্তর রহমতে পরিপূর্ণ এবং সত্যভাষী।

মূলত আমি প্রতিটি পয়েন্টের জন্যই হাদীস সংগ্রহ করেছি। এই সকল হাদীস সমূহকে যখন একত্রিত করে এক যায়গায় নিয়ে আসি অসাধারণ একটি বিষয় দাঁড়ায়।

ঘ) ভালো ও মন্দের উৎস সমূহ ( قيام البر و الفجور )
ভালো ও মন্দ মহাগ্রন্থ আলকোরআন এই ব্যাপারে অনেক গুরুত্ত্বারোপ করেছে ।

ঙ) طيب و الخبيث যা হালাল এবং হারামকে নির্ধারণ করে থাকে।

চ) মারুফ এবং মুণকারের মূল্যবোধ।

ছ) সালাহ ও ফাসাদ (সংশোধন ও ধ্বংসাত্মক)
‘সালাহ’ ও ‘ফাসাদ’ এই বিষয়টি উত্তম আখলাক এবং গাইরে আখলাকীর বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের সামনে পেশ করে। একটি হল সমগ্র মানবতাকে সংশোধন কারী বিষয় অপরটি হল সমগ্র মানবতাকে ধ্বংসকারী বিষয়।
﴿ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُم بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ﴾
অর্থাৎঃ মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, যার ফলে তাদেরকে তাদের কিছু কৃতকর্মের স্বাদ আস্বাদন করানো যায়, হয়তো তারা বিরত হবে৷
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ قَالُوا إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ﴾

অর্থাৎঃ যখনই তাদের বলা হয়েছে , যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করো না, তারা একথাই বলেছে , আমরা তো সংশোধনকারী ৷
‘সালাহ’ পরিভাষাটি কোরআনের সবচেয়ে মৌলিক পরিভাষা সমূহের একটি। ঈমান আনয়নকারী ও সালিহ আমলকারী। ঈমানকে সব সময় সালিহ আমলের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে।

একটু আগে যার নাম আমি উল্লেখ করেছি, তিনি ‘আখলাকুস সালাহ’ নামে নতুন ভাবে আখলাককে বিনির্মাণ করার চেষ্টা করছেন। শুধুমাত্র ‘তাখলিকুল মাকাসিদ’ বা মাকাসীদের আখলাকীকরণ এবং আখলাককে ইসলামের মৌলিক উদ্দেশ্য সমূহের মধ্যে স্থাপন করাই যথেষ্ট নয়। এই জন্য তিনি ‘আখলাকুস সালাহ’ নামে তিনি নতুন করে জ্ঞানের একটি শাখা আবিষ্কার করছেন। আমি মনে করি এটা খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কেননা ‘সালিহ আমল’ আখলাকের সকল স্তরে একটু আগে আমি উল্লেখ করেছি, যেমন উপকারী-অপকারী, ভালো-মন্দ, সুন্দর-অসুন্দর, তায়্যিব সকল কিছুকে ব্যক্তিকারী একটি পরিভাষা।

‘সালাহ’ শব্দটিকে মাঝে মধ্যে ‘শান্তি’ অর্থে ব্যবহার করা হয়। এটি ভুল শান্তির আরবী হল, ‘সিলম’। ‘সিলম এবং সালাম’ এর অর্থ ভিন্ন, ‘সুলহ এবং সালাহ’ র অর্থও ভিন্ন।

কারন ‘সিলম’ এর বিপরীত হল ‘হারব’ বা যুদ্ধ আর ‘সালাহ’ এর বিপরীত হল ‘ফাসাদ’। আজকে আমরা ভয়াবহ এক ফাসাদের সম্মুখীণ। এটাকে দূর করা আমাদের দায়িত্ত্ব। আর এটা ‘সালাহ’ র সাথে সম্পৃক্ত। ‘সালাহ’র জন্য ‘ইসলাহ’ প্রয়োজন। ‘ইসলাহ’ করার জন্য ‘মুসলিহ’ হওয়া প্রয়োজন। শুধুমাত্র ‘সালিহ’ হওয়ায় যথেষ্ট নয়। মুসলিহ হওয়া প্রয়োজন।

রাসূলে আকরাম (সঃ) এর ‘সালিহ’ পরিভাষাটিকে অসাধারণ ভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। রাসূলে আকরাম (সঃ) কেবলমাত্র আমলে সালেহর কথাই বলেন নি। একই সাথে তিনি ‘সালিহ ঘর’, ‘সালিহ মাল’, ‘সালিহা স্ত্রী’, ‘সালিহ স্বামী’ সম্পর্কেও তিনি আলোচনা করেছেন। সালিহা স্বপ্ন সম্পর্কেও তিনি বলেছেন।
যেমন, যে ঘরে কোরআন তেলাওয়াত করা হয় এবং কোন ধরণের গুনাহ হয় না, যে ঘর বা বাড়িকে তিনি সালিহ ঘর বা বাড়ি (বাইতুস সালিহ) বলে উল্লেখ করেছেন।

তিনি আরও বলেছেন, نِعْمَ الْمالُ الصّالِحُ لِلرَّجُلِ الصّالِحِ
অর্থঃ সালিহ ব্যক্তির জন্য সালিহ মাল কতই না উত্তম।
হালাল উপায়ে উপার্জন করবে, যাকাত আদায় করবে এবং মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যয় করবে। এই জন্য আমলে সালেহ বা ‘সালিহ’ পরিভাষাটিকে নিয়ে আমাদের নতুন করে চিন্তা ভাবনা করা প্রয়োজন।

আমরা যদি কোরআনকে সামগ্রিকভাবে পড়ি এবং বুঝি তাহলে এই সকল পরিভাষা সমূহ থেকে আমরা অসাধারণ একটি উসূলে আখলাক বিনির্মাণ করতে পারি। কোরআনের এই সকল পরিভাষার সাথে রাসূল (সঃ) এর রেখে যাওয়া হাদীস সমূহকে যদি এক সাথে অধ্যয়ন করি তাহলে আমাদের জীবনের আখলাকী বিষয় সমূহকে নতুন করে নির্ধারণ করতে পারব।

আমি শুরুতেই একটি হাদীস পাঠ করেছি। হাদীসটি হল;
إنما بعثت لأتمم مكارم الأخلاق))
অর্থাৎঃ আমি আর অন্য কোন কারণে নয়, শুধুমাত্র মাকারীমে আখলাককে পরিপূর্ণ করার জন্য প্রেরিত হয়েছি।
ইমাম মালেকের রেওয়ায়েত হল,
بعثت لأتمم صالحا الاخلاق
আখলাককে পরিপূর্ণ করার জন্য প্রেরিত হয়েছি, বলে তিনি বর্ণনা করেছেন।
রাসূলে আকরাম (সঃ) এর এই হাদীসটি মাকারীমে আখলাক, মাহাসিনে আখলাক এবং সালিহিল আখলাক হিসেবেও বর্ণিত হয়েছে।

প্রিয় ভাইয়েরাঃ
আমি মনে করি যে, বিশেষ করে দ্বীন এবং আখলাকের ক্ষেত্রে আমরা যা বলে থাকি তা সম্পূর্ণ রূপে সঠিক নয়। দ্বীনের ব্যপারে আমরা যে সকল কথা বার্তা বলে থাকি সেই ব্যাপারে আমি এখন একটু আলোচনা করতে চাই।

আমি আমার সরকারী দায়িত্ত্ব থেকে অবসর নেওয়ার পর যুবকদের সাথে সব চেয়ে বেশী মেলামেশা করার চেষ্টা করেছি। আজকের আমাদের এই সেমিনারের অধিকাংশ শ্রোতাই যুবক। আমি আমার প্রিয় যুবক ভাইদের বলতে চাই, আমরা তোমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম হিসেবে তোমাদের জন্য ভালো একটি দুনিয়া বিনির্মাণ করতে পারিনি। ইনশাল্লাহ তোমরা তোমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আরো সুন্দর একটি দুনিয়া উপহার দিতে পারবে।

যুবকদের সাথে যখন একসাথে বসি, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করি কিংবা তাদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করি তখন বিভিন্ন বিষয়ে আটকে যাই। আমি যে সকল বিষয়ে বেশী প্রশ্নের সম্মুখীন হই সে সকল প্রশ্নকে আমি ৬ ভাগে ভাগ করতে পারি।

১। দ্বীন ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্কঃ
দ্বীন ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা দ্বীনি, ইনসানী (মানবিক), ইসলামী এইভাবে বিভক্ত করে থাকি। আমি মনে করি এই বিভক্তি সমস্যাময়। আমরা এমন ভাবে এই সকল পরিভাষা ব্যবহার করে থাকি যা দেখে মনে হয় যেটা ইসলামী সেটা ইনসানী নয়, যেটা আবার ইনসানী সেটা দ্বীনি নয়! ভাষার ব্যবহার এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যা রয়েছে।

অথচ, যেটা ইসলামী সেটা ইনসানী, আর যেটা ইনসানী সেটাই ইসলামী। ‘দ্বীন অবশ্যই উৎসের দিক থেকে ইলাহী, কিন্তু প্রয়োগের দিক থেকে ইনসানী’। আমরা যদি দ্বীনের মানবিকতাকে হারিয়ে ফেলি তাহলে দ্বীনের আখলাকী বিষয়কেও হারিয়ে ফেলব।

দ্বীন মানুষকে নিচু করার জন্য, তুচ্ছ করার জন্য আসেনি। দ্বীন এসেছে মানুষকে উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার জন্য। দ্বীন এসেছে মানুষকে মানবিকতার শিক্ষা দেওয়ার জন্য, মানবিকতাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য। ‘ইনসান-নিসইয়ান-ই’সইয়ান’, ইনসান (মানুষ) নিসইয়ান থেকে নয় ‘উনসিয়াত’ থেকে এসেছে। আর উনসিয়াত হল, আখলাকের সবচেয়ে মৌলিক পরিভাষা। ‘উনসিয়াত’ হল ওয়াদুদ, মুহাব্বাদ এবং রহমতের উপর ভিত্তি করে সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম মানুষ। ‘উনসিয়াত’ অর্থ হল সত্যিকারের সম্পর্ক। এই জন্য মানবিকতার মূল অর্থ হল সঠিক সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হওয়া।

কিন্তু মাঝে মধ্যে মানুষ এই ‘উনসিয়াত’ কে ভুলে যায়। মানুষের সবচেয়ে বড় ইসইয়ান (অবাধ্যতা) নিসইয়ান (ভুলে যাওয়া) থেকে এসে থাকে। এই জন্য কোরআন হল, জিকির, রাসূলে আকরাম হলেন মুজাক্কির। রাসূলে আকরাম এসেছেন মানুষকে তার দায়িত্ত্ববোধ ও মানবিকতাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য।

আমি আপনাদেরকে একটি কথা বলতে চাই, একজন আলেম, সে যত বড় আলেমই হোক না কেন যদি বক্তব্য দেওয়ার সময় বা ওয়াজ করার সময় এমন কথা বলে যা ইনসানী (মানবিক) নয়। তাহলে তার ব্যাপারে কেবল মাত্র ২ টি কথা প্রযোজ্য
১। হয়তবা তার ব্যাখ্যা ভুল।
২। আর না নয় তার ফিতরাতে সমস্যা রয়েছে বা ফিতরাত বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে।

কারণ দ্বীন হল ফিতরাত। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন الدِّينُ الْقَيِّمُ পরিভাষাটিকে ফিতরাতের জন্য ব্যবহার করেছেন। মহান আল্লাহ বলেছেন
﴿فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا ۚ فِطْرَتَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا ۚ لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ﴾
অর্থঃ কাজেই ( হে নবী এবং নবীর অনুসারীবৃন্দ ) একনিষ্ঠ হয়ে নিজের চেহারা এ দীনের দিকে স্থির নিবদ্ধ করে দাও৷ আল্লাহ মানুষকে যে প্রকৃতির ওপর সৃষ্টি করেছেন তাঁর ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও৷ আল্লাহ তৈরি সৃষ্টি কাঠামো পরিবর্তন করা যেতে পারে না৷ এটিই পুরোপুরি সঠিক ও যথার্থ দীন৷ কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না৷
এই জন্য ফিতরাতী, ইনসানী এবং ইসলামী এগুলা একই বিষয়।

এখানে যে বিষয়ে দ্বিমত করব তা হল; ইনসানী নিয়ে নয়, হিউম্যানিজম (Humanism) নিয়ে। হিউম্যানিজম (Humanism) হল স্রষ্টাকে বাদ দিয়ে মানুষকে কেন্দ্রবিন্দু বানানো। হিউম্যানিজম (Humanism) ইনসানী (মানবিক) নয়। পাশ্চাত্যে মানুষকে গির্জার আধিপত্যবাদ থেকে রক্ষা করে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ( জুযয়ী ইরাদে) কে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ইনসানী কার্যক্রম (Human Activity) কে আমরা সমর্থন করি। কিন্তু পরবর্তীতে আল্লাহকে বাদ দিয়ে মানুষকে সবকিছুর কেন্দ্র বিন্দুতে পরিনত কারী হিউম্যানিজম (Humanism), ইনসানী (Humanistic) নয়।

কিন্তু আমরা মাঝে মাঝে হিউম্যানিজম (Humanism), কে বাদ দিতে গিয়ে ইনসানিয়াত (Humanistic) কেও বাদ দিয়ে দেই। এটা আমাদের আখলাকী সমস্যার সম্মুখীন করে। ইনসানীর (মানবিকতার) সাথে যখন আমরা ইসলামীকে পৃথক করে ফেলি তখন লিঙ্গ বৈষম্য (Gender Discrimination) এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। মহিলা ও পুরুষের মধ্যকার বিভক্তি সেখান থেকে বের হয়। যদি আমরা ইসলামী ও ইনসানী (মানবিকতা) র মধ্যে সঠিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি সে সময় মহিলা হওয়ার কারণে তাদেরকে নগণ্য ও তুচ্ছ গণ্যকারী কোন ভুল চিন্তা এবং আইডিওলজি মুসলমানদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।

ইসলাম অনুযায়ী পুরুষরা আল্লাহর খলিফা, তাহলে নারীরা কি? নারীরাও তো আল্লাহর খলিফা। একটি প্রথম শ্রেণীর খলিফা অপরটি দ্বিতীয় শ্রেণীর খলিফা এটা কোন ক্রমেই গ্রহণ যোগ্য নয়। উভয়ই আল্লাহর সৃষ্টি এবং উভয় আল্লাহর কাছে সম মর্যাদাবান খলিফা। ইসলাম অনুযায়ী আল্লাহর ওহী শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য নয়, সমগ্র মানুষের জন্য।

ইসলামের আলোকে এই পৃথিবীকে ইমার (বিনির্মাণ) করার দায়িত্ত্ব সকল মানুষের। কেবলমাত্র পুরুষের নয়। আমরা একটি না জেনে একটি বিভাজন করে থাকি, পুরুষরা পৃথিবী বিনির্মাণ (ইমার) করবে আর নারীরা ঘরবাড়ি ও পরিবার দেখবে। অথচ আল্লাহ সকল মানুষকে একই দায়িত্ত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
هُوَ أَنشَأَكُم مِّنَ الْأَرْضِ وَاسْتَعْمَرَكُمْ فِيهَا
তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি চান তোমরা যেন মাটিকে ইমার কর (পৃথিবীতে সভ্যতা) প্রতিষ্ঠা কর।
আমরা একথা বলতে পারি না, নারীরা কেবলমাত্র ঘরের মধ্যে বসে থাকবে আর তাদের ঘর সংসারের দেখা শুনা করবে। সমগ্র পৃথিবীকে নারী-পুরুষ একসাথে ইমার (বিনির্মাণ) করবে।

নিকট অতীতে ঘটি যাওয়া একটি অভিজ্ঞতাকে আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই। দুই বছর আগে সৌদি আরবে গিয়েছিলাম। এই ঘটনাটি বলব কি বলবা না এটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছিলাম। যেহেতু সারা দুনিয়াবাসীর সামনে এটা ঘটেছে এই জন্য এটা বলতে আমি আর কোন সমস্যা মনে করি না। সৌদি আরবে যাওয়ার পর সৌদি আরবের ধর্মমন্ত্রী তার দেশের গুরত্ত্বপূর্ণ আলেম উলামাদের সাথে আমাকে নিয়ে একটি বৈঠকের আয়োজন করে। তাদের সাথে বৈঠক শুরু করার পূর্বে আমার কানে কানে এসে একজন বলে যে, ‘আপনি আলেমদের সাথে কথা বলার সময় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটা বাহানা দিয়ে এই কথাটা একটু বলতে পারবেন কিনা? যে মহিলারা কেন গাড়ি চালাতে পারবে না। তাহলে আমাদের একটু সুবিধা হবে’।

তারা কেন এই ধরণের ফতওয়া জারী করেছিল এর কারণ সমূহের অনেক কারণকেই আমি এখানে বলতে পারব না।

আমিও সেই প্রোগ্রামে দীর্ঘ আলোচনার এক পর্যায়ে জিজ্ঞাসা করি যে, আমি মাঝে মধ্যে যুবকদের সাথে, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। তারা আমাকে প্রশ্ন করে যে, সৌদি আরবের আলেমরা কিসের উপর ভিত্তি করে এই ফতওয়া দিয়েছে যে, নারীদের গাড়ি চালানো জায়েজ নয়? কোরআনে এমন কোন আয়াত আছে সে আমরা জানি না সেটার উপর ভিত্তি করে তারা এই ফতওয়া দিয়েছে? আমরা শুনি নাই বা জানি না এমন কোন হাদীস আছে নাকি যার উপর ভিত্তি করে তারা এই ফতওয়া দিয়েছে? আমরা জানি এমন কোন ইজমা আছে নাকি? কিসের উপর ভিত্তি করে তারা এটা বলে থাকে?

আমি তাদের উদ্দেশ্য করে বললাম যে, এই বিষয়ে কি আমাকে কিছু বলবেন? উপস্থিত আলেমদের একজন ওই লোকের দিকে তাকিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে যে, ১৯৬৪ সালে বিন বাযয আব্দুল্লাহ ইবনে বাযয (রহঃ) কে প্রশ্ন করা হয় যে,
هل يجوز قيادة النساء السيارة
মহিলাদের গাড়ি চালানো জায়েজ কিনা?
فقال لا يجوز لانها تودي الي المفاسد
তিনি জবাবে বলেন যে, না জায়েজ হবে না। কেননা এটা আমাদেরকে মাফসাদাতের (ধ্বংসের) দিকে নিয়ে যাবে।
আমি তার একথা শুনে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম আচ্ছা! এই মাফসাদাতটা কি?

যদি বাসায় কোন ছোট শিশু পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে যায়, এমতাবস্থায় বাড়ীর সামনে থাকা গাড়ি চালিয়ে সন্তানকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া কি মাফসাদাত! অনেক কঠিন সময়ে প্রতিবেশীর সাহায্যে এগিয়ে আসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া কি মাফসাদাত? কিসের উপর ভিত্তি করে আপনারা এই ফতওয়াটা দিয়েছেন?

এই সকল কথা উত্থাপন করার পর সেখান উপস্থিত আলেমদের একজন, শায়খ উসাইমির ফতওয়া আমাকে পড়ে শুনান।
আমি তাদের জবাব শুনে তাদেরকে বলি যে, আমার আরও একটি প্রশ্ন আছে। আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি আপনারা سد الذرائع এবং درء المفاسد এর উপর ভিত্তি করে এই ফতওয়া দিইয়েছেন।

سد الذرائع এবং درء المفاسد নামক ফিকহের মূলনীতি দুইটি কি আল্লাহ তায়ালার হারাম কৃত বিষয়কে হালাল করতে পারে? এর উপর ভিত্তি করে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা পর্যালোচনা হয়।

আজকের এই সময়ে এসে হারামাইন শরীফের মত একটি স্থানে আল্লাহর হালাল কৃত একটি বিষয়কে এই ভাবে হারাম করার কোন দলীলই গ্রহণ যোগ্য হতে পারে না। আমরা যদি রাসূলের জীবনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই নারী এবং পুরুষের মধ্যে কোন ধরণের ভেদাভেদ না করে রাসূলে আকরাম (সঃ) সমগ্র মদিনাকে একটি উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তর করেছিলেন। সেখানে নারী পুরুষ সকলেই এসে তার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারব। অথচ সে স্থানে দেওয়া এমন একটি ফতওয়ার ব্যাপারে কেউ কোন টু শব্দ পর্যন্ত করেনি।

কিন্তু কয়েক মাস পূর্বে সৌদি প্রিন্স তার অ্যামেরিকার সফর কালে একটি ঘোষণা পত্র জারি করেন। সে ঘোষণা পত্রে বলা হয় যে, নারীরা এখন থেকে গাড়ি চালাতে পারবে। এই ঘোষণা জারী হওয়ার পর ট্রাম এবং তার স্ত্রী সৌদি আরবের নারীদেরকে অভিনন্দন জানায়। বিশ্ববাসীর সামনে এই ব্যাপারটি আমাদের মাথাকে নিচু করে দিয়েছে। এরকম হওয়া অসম্ভব। তাদের হারামকৃত একটি বিষয় কি করে আজ হালাল হয়ে গেল?

জাতিসংঘের মহাসচিব, জাতিসংঘের এক অধিবেশনে ৫ মিনিট ধরে শুধুমাত্র এই বিজয়ের কীর্তিগাথা বয়ান করেন।

প্রিয় ভাইয়েরা,
আমাদের নিজেদের তৈরিকৃত অসঙ্গতি সমূহ এবং আমাদের মূর্খতা সমূহকে দ্বীনে মুবিন ইসলামের নামে নামাঙ্কিত করার কোন অধিকার আমাদের নেই। درء المفاسد নামক মূলনীতিকে নির্ণয় করার জন্য মাফসাদাত কি, এটা আগে জানতে হবে। শুধুমাত্র মাফসাদাত নয়, মাসলাহাতকেও জানতে হবে।

মাসলাহাত এবং মাফসাদাতকে নির্ণয় করার জন্য শুধুমাত্র কোরআন পড়াই যথেষ্ট নয়, মাসলাহাত এবং মাফসাদাতকে নির্ণয় করার জন্য একই সাথে মহাবিশ্বকেও অধ্যয়ন করতে হবে। ইতিহাস পড়তে হবে, সভ্যতা জানতে হবে, বিশ্বমানবতার ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হতে হবে। মানুষের জীবন সম্পর্কে জানতে হবে, দ্বীন এবং জীবনে মধ্যকার সম্পর্ক কি? দ্বীন এবং মানুষের মধ্যে সম্পর্ক কি? এই সকল বিষয় সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানতে হবে।

সৌদি আরবে এই ফতওয়া জারি হওয়ার পর আমি জানার জন্য উৎসাহী ছিলাম যে, আমার সাথে যে সকল আলেমরা তর্ক-বিতর্ক করেছিল এই ব্যাপারে তাদের অভিমত কি?

উম্মাহর সম্পদ সমূহকে উম্মাহর কাজে ব্যবহার না করে অন্য কাজে ব্যবহার করার সময় সেটা মাসহালাতের জন্য নাকি মাফসাদাতের জন্য ব্যবহার হচ্ছে এটা না টু শব্দ পর্যন্ত না করে, যারা নারীদের গাড়ি চালানো হালাল নাকি হারাম এটা নিয়ে পড়ে থাকে তারা কেবলমাত্র আমাদেরকে খাটো করে না। একই সাথে তারা অন্য মানুষদেরকেও বিশেষ করে যারা ইসলাম সম্পর্কে জানে না তাদের মনের মধ্যে ইসলামকে নিয়ে বিভন্ন ধরণের প্রশ্নের সৃষ্টি করে। এগুলা আমাদের নিজেদের তৈরি করা গুরুত্বতর অসঙ্গতি সমূহ।

দুই বছর আগেও আরাফাতে একটি ঘটনা ঘটেছে। ওই সময়ে আরাফাতে অনেক মশামাছি ছিল। এসে কামড় দিত কিন্তু কেউ মারত না। কিছু কিছু হাজী বুদ্ধি করে প্লাগ নিয়ে যায়। ওই প্লাগে একটা ম্যাগনেটিক চুম্বক স্থাপন করত ফলে মশা মাছি ওইদিকে যেত। এটা হালাল নাকি হারাম? এটা নিয়ে ওই বছর আমাদের সবচেয়ে বেশী প্রশ্ন করে এই বিষয় নিয়ে। কিন্তু শয়তানকে পাথর মারতে যাওয়ার সময় চার হাজার মানুষ পদতলে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করে। আমি ওইসময় আর্তচিৎকার করে বলেছি এই হিসাব আমরা উম্মাহকে কিভাবে দিব? যে ইবাদতে মশা-মাছিকে পর্যন্ত মারা হারাম করা হয়েছে সে ইবাদত পালন করতে এসে আমরা চার হাজার মানুষকে পায়ের ততে পিষ্ট করে হত্যা করেছি। পরে আমরা দুনিয়া বাসীকে জানিয়েছি যে, ৭৫০ জন মানুষ সেখানে মারা গিয়েছে!
কোন দেশের কত জন হাজী মারা গিয়েছিল, আমি তা জানি। এই সকল অসঙ্গতি বা বৈপিরত্যকে দূর করার জন্য শুধুমাত্র আমাদের আচার আচরণকে সংশোধন করাটাই যথেষ্ট নয়। আমাদের দ্বীনের উসূলের দিকে লক্ষ্য রেখে, আমাদের আচার আচরণকে আখলাকে পরিণত কারী এবং মূল্যবোধের ক্রমধারাকে নতুন করে নির্ণয় (Identify) করা প্রয়োজন।
২। দ্বীন ও দুনিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক।
৩। দ্বীন ও আকলের মধ্যকার সম্পর্ক।
৪। দ্বীনের সাথে ইলমের (জ্ঞানের) মধ্যকার সম্পর্ক।
৫। দ্বীন ও সংস্কৃতির মধ্যকার সম্পর্ক।
৬। দ্বীন ও আখলাকের মধ্যকার সম্পর্ক।
সময় সংক্ষিপ্ত হওয়ার কারণে আমি এই ব্যাপারে পরে আলোচনা করব ইনশাল্লাহ। আমার ধারণা আমাদের যুবকদের সবচেয়ে বেশী প্রশ্ন এই সকল বিষয় নিয়ে।

অনুবাদ: বুরহান উদ্দিন
আঙ্কারা, তুরস্ক